বিনোদন

আমাদের ভাসিয়ে গেলেন এক অসীম শূন্যতায়

মোশাররফ রুমী

১৯ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৩৬ পূর্বাহ্ন

গিটার তার বেশ ক’টিই। প্রতিটিই খুব প্রিয়। আর এ প্রিয় গিটারগুলোর যে কোনো একটি কাঁধে ঝুলিয়ে তিনি যখন মঞ্চে এসে দাঁড়াতেন তখন দর্শক সারিতে তুমুল আনন্দ, মুহুর্মুহু করতালি এবং তার নাম ধরে চিৎকার করে করে সীমাহীন উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ। তিনি যখন তার গিটারে সুর তুলতেন তখন দর্শক সারির সে উত্তেজনা রূপ নিতো চরম উন্মাদনায়। আর গিটারের তালে তালে তার কণ্ঠে যখন ফুটে উঠতো গান তখনতো কথাই ছিল না। দর্শকদের আনন্দ যেন আর ধরতো না। তিনি, তার গিটার, গান আর দর্শক মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। ভক্তকুলের ওপর এমন মায়াময় প্রভাব বিস্তার করেই বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন দাঁপিয়ে বেড়াতেন আইয়ুব বাচ্চু। বিশেষ করে দেশীয় ব্যান্ডসংগীতের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড এলআরবির দলনেতা, ভোকাল এবং লিড গিটারিস্ট। গিটার বাজানোর ক্ষেত্রে অনন্য স্টাইল এবং নান্দনিক দক্ষতাগুণে ‘গিটার লিজেন্ড’ খ্যাতিটি তার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে অনেকদিন হয়। এছাড়া তাকে বলা হয়ে থাকে ‘কমপ্লিট মিউজিক পারসোনালিটি’। কারণ তিনি একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, সব সংগীত
যন্ত্র বাজানো ও গান রেকর্ডিং, মিক্সিং, মাস্টারিংয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন। বলা যায় একটি গান তৈরির পুরোটাই নিজ হাতে সারতেন অনায়াসে। আর এ কারণে তার সৃষ্ট যে কোনো গানই পেয়েছে অসাধারণ রূপ। যা দেশের সংগীত ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি লাভ করেছে তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা। অ্যালবামের জন্য গান করার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলেও ছিল তার নিয়মিত এবং দাপুটে বিচরণ। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জিঙ্গেল তৈরির পাশাপাশি কয়েকটিতে কন্ঠও দিয়েছেন তিনি। যেগুলোর প্রায় সবই পেয়েছে ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা। আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রামে। সেখানেই শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের কিছুটা কাটে তার। একসময় সংগীতে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় স্থায়ী হন। ১৯৯১ সালে গড়ে তোলেন ব্যান্ড ‘এলআরবি’। এর আগে তিনি দশ বছর ‘সোলস’ ব্যান্ডের সঙ্গে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সংগীত জগতে তার যাত্রা শুরু হয় ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে। অত্যন্ত গুণী এই শিল্পী তার শ্রোতা-ভক্তদের কাছে এবি (অই) নামেও পরিচিত। তার ডাক নাম রবিন। মূলত রক ঘরানার কন্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক গান, ক্লাসিকাল সংগীত এবং লোকগীতি দিয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করায় দারুণ পারদর্শী ছিলেন তিনি। আইয়ুব বাচ্চুর কন্ঠ দেয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প বলি’। এটি সোলস ব্যান্ডে থাকাকালীন গেয়েছিলেন তিনি। তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবামের নাম ‘রক্তগোলাপ’। যেটি প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে। তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ প্রকাশ পায় ১৯৮৮ সালে। বেশ শ্রেতাপ্রিয়তা পায় অ্যালবামটি। ১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অভিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের সবক’টি গানই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ‘কষ্ট’র পর তার আরো  বেশ কিছু একক অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। এছাড়া ব্যান্ড এলআরবিকে নিয়েও প্রকাশ হয়েছে দুর্দান্ত কিছু অ্যাললাম। যে অ্যালবামগুলোর গান আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি দেশের সংগীত ভাণ্ডারকে করেছে দারুণভাবে সমৃদ্ধ। আইয়ুব বাচ্চু বেশ কিছু বাংলা ছবিতে    প্লে-ব্যাক করেছেন। এসবের মধ্যে তার কন্ঠ দেয়া প্রথম প্লে-ব্যাক ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা ছবির অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এছাড়া মান্না অভিনীত ‘আম্মাজান’ ছবিতে তার গাওয়া ‘আম্মাজান’ গানটি আকাশচুম্বী শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। গিটার বাজানোতে তিনি সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত। বিশ্ববরেণ্য গিটারবাদক জিমি হেন্ড্রিক্স, কার্লোস সানতানা এবং জো স্যাট্রিয়ানীর বাজানোয় তিনি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। আইয়ুব বাচ্চুর নিজের একটি স্টুডিও আছে। ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত এই মিউজিক স্টুডিওটির নাম এবি কিচেন। ব্যান্ড এলআরবিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের প্রায় সব জেলার পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আর সবখানেই নিজেদের জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করে সেখানকার শ্রোতা-দর্শকদের মুগ্ধ করার পাশাপাশি দেশের জন্য বয়ে এনেছেন অনেক সম্মান। গান করার পাশাপাশি জনহিতকর নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন এ গিটার লিজেন্ড। ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড মিশুক, অত্যন্ত বিনয়ী, সদা হাস্যোজ্জ্বল এবং পরোপকারী এ মানুষটির খুব কাছের একজন ছিলাম আমি। ক্যারিয়ারের শুরু থকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের ব্যান্ডসংগীতকে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে পৌঁছে দেয়ার জন্য যে শ্রম দিতে তাকে দেখেছি তার বর্ণনা কোটি শব্দে লিখেও শেষ করা যাবে না। আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ভালোবেসে ডাকতেন ‘বড়মিয়া’ বলে। আর আমি তাকে খুব শ্রদ্ধা নিয়ে ডাকতাম ‘বড়ভাই’। তার কাছের আরো কয়েকজনও তাকে এই নামে ডাকতেন। আমাদের সেই ভাই হঠাৎই এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। আমাদের ভাসিয়ে গেলেন এক অসীম শূন্যতায়। যার সর্বস্ব জুড়ে শুধুই বইছে কঠিন বেদনার স্রোত। আইয়ুব বাচ্চু আজ নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার অসংখ্য সৃষ্টিকর্ম। যেগুলো অনন্তকাল তাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভক্ত-শ্রোতাদের হৃদয়ে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status