এক্সক্লুসিভ

খাসোগি হত্যাকাণ্ড প্রিন্স সালমানের ভরাডুবির কারণ হতে পারে

নিক রবার্টসন

১৪ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

কেউ এটা কল্পনাও করতে পারেনি। দুই সপ্তাহ আগেই সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি আধুনিক সৌদি আরব বিনির্মাণে ‘ভিশন-২০৩০’ পরিকল্পনা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে বিনিয়োগকারীদের সৌদি আরবে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যেই এ সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করেন সালমান। কিন্তু সমপ্রতি সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ও সাংবাদিক খাসোগির হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করে সব বদলে দিয়েছে।
জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড সৌদি আরবের মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে ঘাবড়ে দিয়েছে যে দেশটির সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক নিয়ে তাদেরকে পুনরায় ভাবতে হচ্ছে। সালমানের আয়োজন করতে চলা জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলনটি খুব সম্ভবত তার আকর্ষণ ও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারাতে চলেছে। ইতিমধ্যে বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী নেতারা এই সম্মেলন বর্জন করতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, মোহাম্মদ বিন সালমান কি বহির্বিশ্বের সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করে ফেলেছেন? বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেছেন, শুধুমাত্র পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতেই দুটি রাষ্ট্র মিত্র হয়ে উঠতে পারে। এখন দেখা যাচ্ছে, বৃটেনের এ দৃষ্টিভঙ্গি বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশের মধ্যেই বিদ্যমান। তবে, ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অসাধারণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়াও, ডনাল্ড ট্রাম্পের জামাই ও বিশেষ উপদেষ্টা জারেড কুশনারের সঙ্গে মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠতা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এখন পর্যন্ত সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, জামাল খাসোগিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ থাকলেও সৌদি আরবের উপরে চাপ প্রয়োগে তেমন আগ্রহী নয় দেশটি। বরঞ্চ এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে ব্যবসা বৃদ্ধির ইঙ্গিতও দিয়েছে। শিগগিরই সৌদি আরবের কাছে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্কই কি সালমানকে এই দুর্নাম থেকে বাঁচাতে পারবে? সত্যিকার অর্থে খাসোগি হত্যাকাণ্ডই একমাত্র ইস্যু নয় যার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ক্রাউন প্রিন্স সালমানকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। যদিও কট্টর সৌদি সমাজে সংস্কারবাদী হিসেবে বহির্বিশ্বে তিনি বেশ কয়েকবার প্রশংসিত হয়েছেন। তবে এর মধ্যেও তার কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে সমপ্রতি কানাডার সঙ্গে বিবাদে জড়ানোর বিষয়টি উঠে আসে। একজন নারী অধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে রুটিনমাফিক সমালোচনা করে কানাডা। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে দেশটি থেকে সকল কূটনীতিককে ফেরত আনে সৌদি আরব। একইসঙ্গে নিজ দেশে থাকা কানাডার কূটনীতিকদেরও দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেন। এর আগে সালমান ক্ষমতা স্থায়ী করতে নিজ পরিবারেরই কয়েকজন সদস্যকে গৃহবন্দি করে রাখেন। সালমানের বিরুদ্ধে তাদেরকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতির দায়ে আটকের অভিযোগ রয়েছে। এসময় কয়েক শ’ আরব ধনকুবেরকে দেশটির রাজধানী রিয়াদের রিটজ-কার্লটন হোটেলে আটকে রাখা হয়।
এতসব বিতর্কের মধ্যে সব থেকে বেশি আলোচিত হচ্ছে খাসোগি হত্যাকাণ্ড। সত্যিকার অর্থেই সৌদি আরব একটি সংকটের মুখোমুখি। এমতাবস্থায় দেশটি কীভাবে এ সংকটের মোকাবিলা করবে সেটি স্পষ্ট নয়। সালমান কি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ন্যায় একতরফা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে যাবেন নাকি খাসোগি হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। এখানেও কথা থেকে যায়, পুতিনের সঙ্গে সালমানের পার্থক্যও রয়েছে। পুতিন বারবার তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যান কারণ এ অভিযোগ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। কোনো গ্রু সদস্যের নভিচক নার্ভ গ্যাস হামলার ভিডিও নেই। কারো কাছে কোনো অডিও নেই যাতে প্রমাণ হয় পুতিনই বিশ্বজুড়ে হ্যাকিং-এর নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্যা হলো সালমান যখন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করছেন তখন তুরস্ক দাবি করছে তাদের কাছে খাসোগি হত্যাকাণ্ডের অডিও ও ভিডিও প্রমাণ রয়েছে। এবং দেশটি তার মিত্রদেরকেও এ প্রমাণ দেখাতে চায়।
এরপরেও হয়তো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী হবে। আবার উল্টোটাও সম্ভব। এমনও হতে পারে যে, পশ্চিমা দেশগুলো সৌদি আরবের কাছে আর অস্ত্র বিক্রি করতে চাচ্ছে না এবং আরব কোম্পানিগুলো তাদের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হচ্ছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোও তখন সৌদি আরবে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে। তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে আধুনিক সৌদি আরব বিনির্মাণে সালমানের সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল বিদেশি বিনিয়োগ। আরব আমিরাতের অর্থনীতির আদলে ভিশন-২০৩০ কে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন সালমান নিজেই। এটিই সালমানের ভরাডুবির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে সালমান সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স। তবে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সৌদির রাজনীতি নৃশংস হয়ে উঠতে পারে। সৌদি রাজপরিবারেই অনেকে রয়েছেন যারা সালমানের এহেন আচরণ পছন্দ করছেন না। সুযোগ পেলেই তারা বাদশাহ সালমানকে বুঝাতে পারেন যে, তার পুত্র এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ঐতিহ্যগতভাবে সৌদি আরব সবসময় একজন বাদশাহ শাসন করেন। তবে এ জন্য তিনি রাজ আদালত ও রাজপরিবারের সদস্যদের নিয়ে তৈরি একটি উপদেষ্টা পরিষদের সাহায্য নিয়ে থাকেন। রাজত্ব পরিচালনা সবসময়ই ছিল একটি সমন্বিত কার্যক্রম। কিন্তু বিন সালমান এই সিস্টেমকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এ জন্য তিনি রাজপরিবারের সদস্যদের কারাদণ্ড দিয়েছেন, তাদের অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতা হরণ করেছেন। সৌদি আরবের দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা কাঠামো ভেঙে ইতিমধ্যে নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলেছেন তিনি। নিজের পরিচয় মুছে ফেলা এক বিষয় কিন্তু সমগ্র সৌদি আরবের পরিচয় মুছে ফেলা হবে তার ভরাডুবি থেকে বাঁচার সর্বশেষ খড়কুটোটাও হারানো। সৌদি আরব পরিচালনায় কেউই অপরিহার্য নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোহাম্মদ বিন সালমান কি তার এই বিপদ উপলব্ধি করতে পারছেন নাকি সে তার দম্ভের এমন গভীর খাদে পড়েছেন যে, সেখান থেকে অতীত পরিণতিগুলো দেখতে পারছেন না?
(সিএনএন থেকে অনুবাদ করেছেন অনিম আরাফাত)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status