বাংলারজমিন

যমুনায় ১৫ হাজার একর জমি বিলীন

গোলাম মোস্তফা রুবেল, বেলকুচি (সিরাজগঞ্জ) থেকে

১৩ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ৯:০১ পূর্বাহ্ন

যমুনা কি-না করতে পারে? ভাঙতেও পারে আবার গড়তেও পারে। কিন্তু মানুষের সহায় সম্বল যখন কেড়ে নেয়- সেই ব্যক্তি জীবনে আর কি করতে পারে? গত দেড়শতকে যমুনা নদীর ভাঙনে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী, বেলকুচি, কাজিপুর, শাহজাদপুর উপজেলার বেশ কিছু এলাকার প্রায় ১৫ হাজার একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আর এ দীর্ঘ সময় নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছে এই চার উপজেলার প্রায় কয়েক লক্ষাধিক মানুষ। এত কিছুর পরেও নদীভাঙন ঠেকাতে এসব এলাকায় স্থায়ীভাবে নদীর তীর সংরক্ষণে (সিসি ব্লক দ্বারা) কাজ হয়েছে খুবই কম।  যমুনার তীর সংরক্ষণ কাজে সিসি ব্লক ফেলা হয়েছে চৌহালী ও সিরাজগঞ্জ জেলা সদর ঠেকাতে। বর্ষার পূর্ব মুহূর্তেই নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষেরা নদী ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ীভাবে নদীর তীর সংরক্ষণের দাবি করেছেন। এলাকাবাসী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন বেলকুচি থানার পূর্বপাড় জুড়ে ভাঙন দেখা দিলে ১৯৭০ সালের দিকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সিরাজগঞ্জ মহকুমার মাধ্যমে ওয়াপদাবাঁধ প্রকল্প যমুনা ভাঙন রোধ শুরু করে। এর পূর্বে বেলকুচি থানার বেলকুচি, বড়ধুল, ছোট বড়ধুল, বড় বড়ধুল, লক্ষ্মীপুর, বংকুরি নামক স্থান ভেঙে নিঃস্ব হয়ে যায় প্রায় লক্ষাধিক লোক। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবস্থা নিচ্ছে দাবি করলেও স্থানীয়রা বলছে, সঠিকভাবে কাজ না করায় এমন পরিস্থিতি  তৈরি হয়েছে। নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত এক জনপদ, সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা। ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলাটি এখন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। গত দুই বছরের ভাঙনে বিলীন হয়েছে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়, হাসপাতাল, সরকারি বেসরকারি অফিস ভবন, মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। আর যেটুকু বাকি আছে তাও হুমকির মুখে। চৌহালী উপজেলা রক্ষায় ২০১৫ সালে একশ নয় কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে এ বছর বর্ষা আসার আগেই বাঁধের বিভিন্ন স্থানে দেখা দেয় ভাঙন।

নদীর বিশালতার কাছে বাঁধটি দুর্বল বলছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। আর বাঁধ নির্মাণে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস স্থানীয় প্রশাসনের। সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে ২০০৭ সাল থেকে শুরু হয় ভাঙন। ২১০ বর্গমাইল আয়তনের ৮০ ভাগ এলাকাই বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। ২০১৭ সালের দিকে দাতা সংস্থা ও দেশীয় অর্থায়নে ‘ফ্লাড এন্ড রিভার ব্যাংক ইরৌশন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এফ.আর.ই.আর.এম.আই.টি) নামক প্রকল্পের অধীনে সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও পাবনা জেলায় প্রায় ৮শ’ ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ধরনের বেশ ক’টি তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালীতে প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৭ কি. মি. দৈর্ঘ্যের ওই নদীর তীর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল সিরাজগঞ্জের চৌহালী ও টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার বিশাল জনপথ যমুনার ভাঙন থেকে রক্ষা করা। চৌহালী উপজেলা সিরাজগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ এলাকা। পাউবো যমুনা নদীর ভাঙন রোধে চৌহালী শহর রক্ষা প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৭ কোটি টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থায়নে ২০১৫ সালের ২৪শে নভেম্বর শুরু হয় চৌহালী শহর রক্ষা বাঁধের কাজ। ২০১৮ সালে বাঁধের কাজ শেষ হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে টাঙ্গাইল জেলা সদর, নাগরপুর উপজেলা ও সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলাসহ ভাটির এলাকা যমুনার ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।

২০১৬ সালে পাউবোর জরিপ প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ২০ বছরে বিলীন হয়েছে চৌহালী উপজেলা হেডকোয়ার্টার, থানা ভবন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পশু হাসপাতাল, ইউএনও অফিস, পল্লী উন্নয়ন ভবন, ডাকঘর অফিস, পরিবার কল্যাণ অফিস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস, তিনটি সরকারি কোয়ার্টার, ঘোরজান ইউনিয়ন পরিষদ, এনজিও মানব মুক্তি অফিস, খাসকাউলিয়া কবরস্থান এবং উপজেলা পরিষদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

এ ছাড়া হিজুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর ছলিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সম্ভুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধুপুলীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পয়লা পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাথরাইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বৃদাশুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৃদাশুরিয়া পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

 দত্তকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাথরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য শিমুলিয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, থাক মধ্য শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাফানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাফানিয়া-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, করুয়াজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরবোয়ালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাষদেলদারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চৌহালী মহিলা ফাজিল মাদরাসা, এসবিএম কলেজ, চৌবাড়িয়া কারিগরি কলেজ, মুঞ্জুর কাদের কারিগরি কলেজ, দত্তকান্দি কেএম উচ্চ বিদ্যালয়, হাটাইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আর আর কে দাখিল মাদরাসা, পয়লা দাখিল মাদরাসা, পয়লা উচ্চ বিদ্যালয়, খাষপুখরিয়া বিএম উচ্চ বিদ্যালয়, চৌহালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, খাষকাউলিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ প্রায় ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চারটি হাট-বাজারসহ প্রায় ৩০ হাজার ঘরবাড়ি ও ১৫ হাজার একর আবাদি জমি যমুনা নদীতে বিলীন হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status