প্রথম পাতা

দালালের খপ্পরে নিঃস্ব ওরা

রোকনুজ্জামান পিয়াস

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন

দালালের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ৭ লাখ টাকায়। অগ্রিম ৫ লাখ, বাকি ২ লাখ দিতে হবে পৌঁছানোর পর। দালাল বলেছিল, সরাসরি লিবিয়া, তারপর ইতালি। গেলেই মোটা বেতনের কাজ। কাজ পাবার ব্যবস্থাও করে দেবে তাদেরই লোকজন। এই বিশ্বাসে পাশের গ্রামের দালাল আলমগীরের কাছে টাকা দিয়েছিলেন নূর মোহাম্মদ। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। বরং, দালালের ফাঁদে ফেঁসে গিয়েছিলেন তিনি। পদে পদে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে তার ওপর। ছেলের জীবন বাঁচাতে জমিজমা বিক্রি আর ধারদেনা করে নিঃস্ব হয়েছেন পিতা। দীর্ঘ ৭ মাস কেটেছে লিবিয়ার জেলে। দিনে একবেলাও ঠিকমতো খাবার জোটেনি।

অবশেষে জেলের ঘানি টেনে বুধবার দেশে  ফিরেছেন ২২ বছরের তরুণ নূর মোহাম্মদ। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ৮ মাসের তীক্ত অভিজ্ঞতা আর দুঃসহ যন্ত্রণা। হাতে-পায়ে-গায়ে ফোসকা পড়ে গেছে তার। শুধু তিনিই নন, তার সঙ্গে ফিরেছেন আরো ১৫৬ বাংলাদেশি। তাদের অনেকেই দালালের ফাঁদে পড়ে একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আবার লিবিয়াতে কারো কারো বৈধ উপার্জন নানা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে দালালরা। ডিটেনশনে থাকা এসব বাংলাদেশিরা ত্রিপোলিস্থ  বাংলাদেশি দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় দেশে ফিরেছেন। ওই ডিটেনশন সেন্টার থেকে দেশে ফেরারর অপেক্ষায় রয়েছেন আরো ৭৭ জন।

মাদারীপুরের রাজৈর থানার পশ্চিম রাজৈর গ্রামের নূর মোহাম্মদ জানান, তার পাশের গ্রাম সিরপাড়ার আলমগীর নামে এক দালাল তাকে ইতালি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। বলে, লিবিয়া হয়ে তাকে ইতালি পাঠাবে। এজন্য ৭ লাখ টাকা দিতে হবে। বিদেশ যাওয়ার আগে ৫ লাখ নগদ এবং বাকি ২ লাখ টাকা সেখানে পৌঁছানোর পর দেয়ার চুক্তি হয়। ওই দালালের মাধ্যমে একই এলাকার আরো ৮-১০ জন ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দালাল আলমগীর বলেছিল, তাদের সরাসরি লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর সাগর পথে ইতালি। মৌখিক চুক্তি মোতাবেক টাকা-পয়সা পরিশোধ করে তারা গত ৮ মাস আগে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়েন। কিন্তু তাদেরকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় দুবাই। এরপর সেখান থেকে মিশর। মিশরের বিমানবন্দরে তাদেরকে বাংলাদেশি কয়েকজন রিসিভ করে। তারা তাদের বাসে করে নিয়ে যায় অজ্ঞাতস্থানের একটি ক্যাম্পে। তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

সেখানে আলমগীর দালালের মাধ্যমে যাওয়া ১০ জনসহ মোট ৫০ জন বাংলাদেশি ছিল। তারাও দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে সেখানে গেছেন। ওই ক্যাম্পে যাওয়ার পর তাদের কাছ থেকে মোবাইল টাকা-পয়সা সব ছিনিয়ে নেয়া হয়। দালালরা তাদের পরিবারের কাছে ফোন দিয়ে প্রত্যেককে দুই লাখ করে টাকা দিতে বলে। সেই টাকাও দিতে বলে আলমগীরের নামে একটি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে বেধড়ক মারধর করা হয় তাদের। উপায় না পেয়ে দালালদের দেয়া ব্যাংক একাউন্টে দুই লাখ টাকা পাঠায় পরিবার। এরপর তাদেরকে বিক্রি করে দেয়া হয় বিদেশি আরেক দালালের কাছে। ওই দালাল তাদের গাড়িতে করে লিবিয়ার একটি মরুভূমিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে একটি গুদাম ঘরে আটকে রাখে। বাড়িতে ফোন করে আরো দুই লাখ টাকা দিতে বলে। সেখানে দালালরা তাদের মোটা পাইপ দিয়ে বেধড়ক পেটায়। নূর মোহাম্মদ বলেন, ৮ দিন সেখানে তাদের আটকে রাখা হয়। প্রতিদিনই টাকার জন্য মারধর করতো। এই সময়ে তাদের কোনো খাবার দেয়া হয়নি। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে পরিবার থেকে আরো ২ লাখ টাকা দিলে তাদের মরুভূমিতে ফেলে আসে দালালরা। তারা একসঙ্গে ৫০ জন ছিলেন। কারোরই নড়াচড়ার শক্তি ছিল না। খাবার ও পানির জন্য হাহাকার অবস্থা। এর ৭ দিন পর লিবিয়ার পুলিশ উদ্ধার করে তাদের জেলে নিয়ে যায়। সেখানেই ৭ মাস কেটেছে তাদের।

প্রতারিত নূর মোহাম্মদ বলেন, এই জেলে তাদের একবেলা পেটভরে খাবার দেয়া হয়নি। পানি ও ঘুমানোর খুব কষ্ট। অনেকের নানা রোগ হয়ে গেছে। তার নিজেরও হাতে-পায়ে-শরীরের নানা জায়গায় ফোসকা পড়ে গেছে। তিনি বলেন, এই ৭ মাস তাদের কি কষ্টে কেটেছে তা প্রকাশ করার মতো না। তাছাড়া তাদের এখানে মারধরও করা হতো। নূর মোহাম্মদ আরো বলেন, এর মাসখানেক পর দূতাবাসের লোকজন তাদের দেখতে আসে। তারা প্রায়ই আসতো। খোঁজ-খবর নিতো। পরে আইওএম ও দূতাবাসের সহযোগিতায় তাদেরকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।  

দেশে আসার পর দালাল আলমগীরের সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার ফোন বন্ধ। বাড়িতেও কেউ থাকে না। মা-বাবা-বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। তিনি বলেন, তার ঠিকানা কেউ জানে না। তাদের আত্মীয়-স্বজনও খোঁজ দেয় না। তিনি বলেন, তাকে মুক্ত করতে তার বাবার জায়গা-জমি সব বিক্রি করতে হয়েছে।

এদিকে একই ফ্লাইটে দেশে ফেরা সুনামগঞ্জের একরামুল হক জানান, তিনি পাঁচ বছর আগে বৈধভাবে লিবিয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি মসজিদে কাজ করতেন। ভালোই টাকা-পয়সা রোজগার করেছেন। কিন্তু দেশটির যুদ্ধাবস্থার ফলে টাকা পাঠাতে পারেননি। বলেন, তার কাছে ৩০ হাজার দিনার ও ২ হাজার ইউরো জমে গিয়েছিল। এই অবস্থায় জসিম নামে এক বাংলাদেশি দেশে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করবে বলে জানায়। পরে ওই টাকা তার কাছে দিতে গেলে সব ছিনিয়ে নেয়। কাগজপত্রও কেড়ে নেয়। আটকে রেখে মারধর করে। একদিন পর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ঘটনা তিন মাস আগের। গত তিন মাস তিনি ওই কারাগারেই ছিলেন। বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যা আয়-রোজগার করেছিলেন সবই দালাল নিয়ে নিয়েছে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি তারা লিবিয়ান সরকারের কাছ থেকে দেশটিতে কারাবন্দি বাংলাদেশিদের একটি তালিকা পেয়েছেন, যাদের কাছে কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। পর্যায়ক্রমে তাদের ফিরিয়ে আনা হবে বলেও সূত্রটি জানায়। এই কাজে আইওএম তাদের সহযোগিতা করছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status