শেষের পাতা

যে গল্প যায় না বলা (৩)

ডাস্টবিনের ময়লাও খেয়েছি

মরিয়ম চম্পা

২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন

এটা শুধু একদল নারীর স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প নয়। বরং তাদের নিয়তি আর জীবন তছনছ হওয়ার গল্প। অসহ্য আর দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে ফিরছে ওরা। বিমানবন্দরে নেমেই ভেঙে পড়ছে কান্নায়। কেউবা লজ্জায় মুখ ঢাকছে। কেউবা করছে আত্মহত্যার চেষ্টা। বিদেশ ফেরত নারীদের জীবনের অবর্ণনীয় পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন আমাদের স্টাফ রিপোর্টার মরিয়ম চম্পা ।

আরিফা বেগম। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাউণ্ডুলে বাবা বরাবরই সংসারের প্রতি ছিলেন উদাসীন। তাই মা মেয়েটাকে পাত্রস্থ করে একটু নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। বছর দশেক আগে বিয়ে হয় আরিফার। তাদের সংসারে ফুটফুটে এক কন্যা। পরিবারের বিপর্যয় কাটাতে আরিফা বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এক বিপর্যয় কাটাতে গিয়ে তার জীবনে নেমে আসে আরো বড় দুর্যোগ। লেবাননে বাসাবাড়িতে চাকরি দেয়ার কথা বলে তাকে সিরিয়ায় পাচার করে দেয়া হয়।

আরিফা মানবজমিনকে বলেন, ভালো নেই। খুব অসুস্থ আমি। বর্তমানে স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় ভাড়া বাসায় আছি। সিরিয়ায় টানা ৭ মাস নির্যাতনের শিকার হয়ে একটি কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। লিভারেও ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। ২০১৫ সালে দেশে ফিরে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এমন কোনো অত্যাচার নেই যে, তারা করেনি। একটি অফিসে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল। ওদের কথা না শুনলে প্রচণ্ড মারতো। আলাদা রুমে নিয়ে মারধর করতো।

বৈদ্যুতিক শক দিতো। সিগারেটের ছেঁকা দিতো। এক হাতে প্যান্টের বেল্ট অন্যহাতে চাবুক দিয়ে পেটাতো। পায়ের ও মাথার তালুতে মারতো। না খাইয়ে রাখতো। বাথরুমে আটকে রাখতো। ১ পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখতো। ক্ষুধার জ্বালায় বাথরুমের পানি খেয়েছি। ডাস্টবিনের ময়লাও খেয়েছি। অফিসে প্রায় ১৬ থেকে ১৭ জন ছেলে মানুষ ছিল। প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্তে ওরা আমাকে শারীরিক নির্যাতন করেছে। তারা একজন করে আসতো।

ওদের শরীর ইয়া মোটা। ইয়া উঁচু। ওরা ধরলেই মনে হতো জীবনটা শেষ। ওদের নির্যাতনের চিহ্ন এখনো শরীরে রয়ে গেছে। আমি গরিব ঘরের মেয়ে। লেখাপড়া খুব একটা করতে পারিনি। দেখতে খুব সুন্দর হইছিলাম তো এজন্য ভাগ্যে আমার এই দশা। আমার স্বামী আজও এটা জানে না। সে জানে আমাকে শুধু মারধর করা হয়েছিল। আমি এখন কোনো কাজ করতে পারি না। বাচ্চাটা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। ঠিকমতো ওষুধ কিনতে পারি না। মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার ওষুধ খেতে হয়। একবেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। মানুষের কাছে হাত পাততে লজ্জা হয়।

মা বেঁচে থাকাকালীন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সাহায্য চেয়ে দিতেন। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ যদি ১ টাকা করেও সাহায্য করে তাহলে হয়তো আমাকে না খেয়ে মরতে হবে না। তার পরেও বাংলাদেশি বোনদের উদ্দেশে বলবো আপনারা নিজের দেশে ভিক্ষা করে খেলেও ভিনদেশ তথা বিদেশে যাইয়েন না।

ভোলার দৌলতখানের মেয়ে রেনু বেগম (ছদ্মনাম)। দীর্ঘ কয়েক মাস নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। রেনু মানবজমিনকে বলেন, ভালো নেই। শরীরটা খুব অসুস্থ। ভাত পানি খেতে পারি না। মাথা ঘুরে পড়ে যাই। ডাক্তার বলেছে, খুব বেশি মারধর করায় আপনার শরীর অনেক ক্লান্ত। আপনাকে বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। রেনু বলেন, আমার সঙ্গে ওরা যা করেছে ওসব তো বলার মতো নয়। বাড়িঘরে দেওর- ভাসুর আছে।

সব তো আর খুলে বলা যায় না। শর্টকাটে বুইঝা লন। একটা পুরুষ মানুষের সঙ্গে একজন মহিলা কি কখনো পেরে ওঠে। সেটাই এখন বুইঝা লন। কি আর কমু। হেরা আমার ওপর অনেক অত্যাচার করেছে। মালিকের পোলার কথা না শুনলে অনেক মারধর করতো। আর কোনো নারী যেন ওই দেশে না যায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status