প্রথম পাতা

কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রথম দিককার চিঠি

সালমান এফ রহমান

২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

মহান ব্যক্তিদের চরিত্র উন্মোচিত হয় যখন তারা চাপের মধ্যে থাকেন। ১৯৫০ সালে লেখা কিন্তু সাম্প্রতিককালে উদ্‌ঘাটিত চিঠিগুলো তখনকার উদীয়মান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আমাদের চোখ খুলে দেয়। ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি জানতে পারেন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পাকিস্তান ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথির কথা। এই চমকপ্রদ নথি এখন একাধিক খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথিপত্র) শীর্ষক বইয়ে। প্রথম খণ্ড (১৯৪৮-১৯৫০) সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

এটি ইতিহাসের এক গুপ্তধন যেটি এর আগে পুরোপুরি অজ্ঞাত ছিল। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের ওপর পাকিস্তান সরকারের নজরদারির রেকর্ড। তিনি যতই বাঙালির মঙ্গল ও তাদের প্রতি ন্যায়ভিত্তিক আচরণ, তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের বাস্তবায়ন এবং তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা সংরক্ষণের পক্ষে সংগ্রামের জন্য পরিকল্পনা করছিলেন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছিলেন, আমরা ততই তার চিন্তা-চেতনা ও মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই । বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই সংগ্রামের ফলশ্রুতিতেই শেষ অবধি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

পাকিস্তান ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ‘নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর’ হিসেবে উল্লেখ করে।

এই মন্তব্য নিবন্ধে দুইটি চিঠি নিয়ে আলোকপাত করা হবে। দু’টো চিঠিই ইংরেজিতে লেখা। বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা। ২১/১২/৫০ তারিখে জনাব সোহরাওয়ার্দীকে লেখা এক চিঠিতে ফরিদপুর কারাগারে নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর লেখেন, ‘...যারা কোনো নীতির পক্ষে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তারা খুব কমই পরাজিত হয়। মহান জিনিস অর্জিত হয় মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আল্লাহ যেকোনো কারোর চেয়ে শক্তিশালী। আর আমি তার কাছে বিচার চাই।’

যেই ব্যক্তি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পূর্ব পাকিস্তানকে নির্যাতন ও বৈষম্য থেকে উদ্ধার করবেন, তার প্রগাঢ় বক্তব্য ছিল এটি। সোহরাওয়ার্দীকে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, কারাগারে তার বই প্রয়োজন। তিনি লিখেন, ‘আপনার ভোলা উচিত নয় যে, আমি এখানে একা। বই আমার একমাত্র সঙ্গী।’

এর আগে চিঠিতে শেখ মুজিবুর অভিযোগের সুরে লিখেন, তাকে ফরিদপুর কারাগারে রাখা হয়েছে, কিন্তু তার বিচার হবে গোপালগঞ্জে। ফলে তাকে বারবার আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতে হয়। অনেকটা কষ্ট থেকেই বলেন যে, একবার যেতেই ৬০ ঘণ্টা লাগে। পাশাপাশি যেই সড়ক ও যান ব্যবহার করা হয় সেগুলো ‘প্রবাদতুল্য ক্লান্তিদায়ক’।

পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এই চিঠি রেখে দেয়। প্রাপকের কাছে পাঠানোর অনুমতি দেয় না। এটি পাওয়া যায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের নথিতে।
জেপু নামে তার এক আত্মীয়ের কাছে লেখা একটি চিঠিও জব্দ করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সেটি ২৬/৫/৫০ তারিখে পাঠানো হয়। চিঠিতে নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর লিখেন, ‘...তবে আপনার জানা উচিত যে, যেই ব্যক্তি কোনো নীতি, তার দেশ, মানবতার মঙ্গলের পক্ষে বাঁচে, তার জন্য জীবনের মানে অনেক ব্যাপক। যন্ত্রণা তার কাছে ততটাই অগুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমি জানি যারা চিন্তা করে দুনিয়া তাদের কাছে রঙ্গশালা আর যারা অনুভব করে তাদের কাছে বিয়োগান্তক।’ শেষের এই বাক্যটি আমাদের আশেপাশের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিই সংক্ষেপে প্রকাশ করে। এরপর তিনি আরো লিখেন, ‘আমি সুনিশ্চিত যে, মিথ্যা ও সত্যের দীর্ঘ যুদ্ধে, মিথ্যা প্রথম যুদ্ধে জয়ী হয়, কিন্তু শেষ যুদ্ধে জয়ী হয় সত্য।’

তার আত্মীয় যখন ইঙ্গিত দিলেন যে, তিনি যদি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে এই বলে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি আর রাজনীতি করবেন না, তাহলে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হবে, বঙ্গবন্ধু তখন রাগান্বিত প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি লিখেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে তুমি ‘মুচলেকা’ শব্দটি লেখার সাহস করতে পারলে। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে মাথা নত করতে শিখিনি।’

ভাষার ওপর তার দখল, তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সর্বশক্তিমানের ওপর তার বিশ্বাস, ভীষণ ব্যক্তিগত দুর্ভোগ, মিথ্যার ওপর সত্য সবসময় জয়লাভ করে এই আপ্তবাক্যের প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস, নিপীড়িতদের যন্ত্রণা বুঝতে পারা, আত্মত্যাগ ছাড়া লক্ষ্য পূরণ হবে না ও আপোষ করা মানে নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা, এই উপলব্ধি, নিজের আদর্শ ও নীতির প্রতি অবিচল থাকা, দেশ গঠনে নিবেদিত থাকা, মানবতার সেবা করার গভীর ইচ্ছা-সবই ১৯৫০ সালে লেখা ওই চিঠি দু’টিতে ফুটে উঠে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর।

তাই এটি মোটেই আশ্চর্যের কিছু নয় যে, পরবর্তী ২১ বছরে তার লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা, আত্ম্যোৎসর্গ, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বের ফলশ্রুতিতেই লাখো মানুষের জীবন ও সম্মানের বিনিময়ে একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের জন্ম হয়। আর নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির পিতা।

(সালমান এফ রহমান ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার দৈনিক পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের সম্পাদক পর্ষদের চেয়ারম্যান। লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status