প্রথম পাতা

খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে

স্টাফ রিপোর্টার

২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:০৫ পূর্বাহ্ন

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই এই মামলার বিচারকাজ চলবে এবং তার আইনজীবীরা  আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে পারবেন বলে আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে এ মামলায় অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য আগামী ২৪, ২৫ ও ২৬শে সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের আবেদন গ্রহণ করে গতকাল শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের ভেতরে প্রশাসনিক ভবনের একটি কক্ষে স্থাপিত বিশেষ আদালতে চলছে। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ডের রায় হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে পরিত্যক্ত এই কারাগারে।

গত ৫ই সেপ্টেম্বর এই মামলায় হাজিরা দিয়ে খালেদা জিয়া জানান, তিনি অসুস্থ। বারবার আদালতে আসতে পারবেন না। এরপর ধার্য তারিখগুলোতে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতকে জানানো হয় যে, তিনি আদালতে আসতে অনিচ্ছুক। গতকালও কারা কর্র্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আদালতের বিচারক জানান, খালেদা জিয়া আদালতে আসতে ‘অপারগ’। আদেশে বিচারক বলেন, ‘আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, খালেদা জিয়া আদালতে আসতে অনিচ্ছুক। অথচ জামিনে থাকা মামলার অন্য দুই আসামি প্রতিটি ধার্য তারিখে হাজির হচ্ছেন। তাই, সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারায় প্রসিকিউশনের দরখাস্তটি গ্রহণ করা যায়।’

এর আগে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর শুনানি নিয়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে চলবে কি-না সেই প্রশ্নে আদেশের জন্য ২০শে সেপ্টেম্বর দিন ধার্য রাখেন আদালত। এদিকে আদালতের এই আদেশের প্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা। তার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ। আগে তার চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি সুস্থ হলেই আদালতে আসবেন।

আদালতের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। এখন তার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক হবে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানান বিএনপির চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, খালেদা জিয়া যেহেতু আদালতে আসতে চান না তাই, আদালত ফৌজদারি আইন অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।     

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ই আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলাটি দায়ের করে দুদক। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক পুলিশের সাবেক পরিচালক জিয়াউল ইসলাম ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সাবেক একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। মামলাটি যুক্তিতর্কের পর্যায়ে রয়েছে। গতকালও যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল।

বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে এই বলে অবহিত করেন যে, খালেদা জিয়া অনুপস্থিত। তার অনুপস্থিতিতে শুনানি শুরুর আবেদন জানান তিনি। অন্যদিকে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া খালেদা জিয়া জামিন বর্ধিতকরণ ও বিএনপির চেয়ারপারসনের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমরা বুধবার সাক্ষাৎ করেছি। তিনি তার অসুস্থতা ও কেন আদালতে আসতে অনিচ্ছুক সে বিষয়টি আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি আদালতে আসবেন না সেটি তিনি বলেন নি। নিয়ম অনুযায়ী খালেদা জিয়া এখন আপনার (আদালতের বিচারক) কাস্টডিতে আছেন। আপনি তার চিকিৎসার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। সুস্থ হলে উনিও আসবেন, আমরাও আসবো। এ সময় খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে কি-না সে প্রশ্নে শুনানি করতে চান তার আইনজীবীরা।  

বিচারক বলেন, আজকে তো এ বিষয়ে আদেশের জন্য আছে। আজকে সাবমিশন শুনবো কেন? আজ এ বিষয়ে শুনবো না। বিচারক আরো বলেন, আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ‘কোরাম নন জুডিস’র বিষয়ে এর আগের তারিখে বলেছিলেন। এ বিষয়ে তার ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম।  

আইনজীবী আমিনুল ইসলাম আদেশ না দেয়ার আর্জি জানিয়ে বলেন, ১২ তারিখে (১২ই সেপ্টেম্বর) ‘কোরাম নন জুডিস’র বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু এরকম একটা আদালতে আমাদের আসতে হচ্ছে যেখানে বই নেই, বসার জায়গা নেই। এখন এভাবে যদি আদালত থেকে আদেশ দেয়া হয় তাহলে এটি হবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। বিচারকের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি খালেদা জিয়ার পক্ষে আসিনি। এসেছি আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্নার বিরুদ্ধে প্রসিডিং চলবে কি-না সেই প্রশ্নে। আপনি (বিচারক) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারার ব্যাখ্যা শুনুন। শুনে যাই আদেশ দেবেন তা মাথা পেতে নেবো। এ সময়  বিচারক তাকে শুনানির অনুমতি দেন। শুনানিতে আমিনুল ইসলাম এ সংক্রান্ত বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের নজির তুলে ধরে বলেন, আপনি একটি ন্যায়সঙ্গত আদেশ দিন। যাতে বাইরের মানুষ বুঝতে পারে যে, এখানে একজন সিনিয়র বিচারক বিচারকাজ পরিচালনা করছেন।

শুনানিতে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, আমাদেরকে না জানিয়েই প্রসিকিউশন পক্ষ মামলার যুক্তিতর্কের শুনানির আবেদন করেছেন। এটি অনধিকার চর্চা ও অনুচিত। আইনের বরখেলাপ।

দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আমরা হঠাৎ করে দরখাস্ত দিই নাই। ১২ তারিখে (১২ই সেপ্টেম্বর) দরখাস্ত দিয়েছি। আপনারা আইনের ব্যাখ্যা দেন। আইনজীবী আমিনুল ইসলাম যে মামলার উদাহরণ দিয়েছেন সেই মামলার আসামি পলাতক ছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আছেন। এখন তিনি আসবেন কি আসবেন না- এ প্রশ্ন যদি থাকে তাহলে ফৌজদারি আইনের ৫৪০ (এ) ধারা অনুযায়ী তার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে কি-না সেই প্রশ্নে আদালত আদেশ দিতে পারবেন।

শুনানিতে খালেদার অন্য আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, যেহেতু তিনি কাস্টডিতে আছেন তাই তাকে আইনজীবীদের কেউ এখন রিপ্রেজেন্ট করছেন না। উনি এখন আপনার (বিচারক) আন্ডারে আছেন। আপনি আপনার আদালতে কাউকে উনার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার আদেশ দেননি। সেই কারণে ৫৪০ (এ) ধারায় আদেশ দেয়া সমীচীন হবে না। খালেদা জিয়ার কাস্টডিয়ান আপনি। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ আপনার কথা শুনছে না। বিচারকের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বলেছেন, আদালতের প্রতি তার কোনো অনাস্থা নেই। তিনি অসুস্থতার কারণে আসতে পারছেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে আইনানুগভাবে হাজির না করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিচারকাজ চলতে পারে না।

দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আমাদের আইনের যে চর্চা তা এই মামলার মধ্য দিয়ে একটি ব্যতিক্রম ধারা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আসবেন না। এখন তার চিকিৎসা শেষে কি তাকে আদালতে আনতে হবে? তার জন্য কি ফৌজদারি আইন পরিবর্তন করতে হবে? তিনি বলেন, একদিকে  ওনারা (খালেদা জিয়ার আইনজীবী) জামিনের দরখাস্ত দিলেন, চিকিৎসার আবেদন করলেন আর অন্যদিকে বলছেন তারা রিপ্রেজেন্ট করছেন না। এখন খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে আদালতে আসবেন- এ রকম দৃষ্টান্ত যদি সৃষ্টি হয় তাহলে বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা বলে কিছু থাকবে না।

দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে আদালত আদেশে বলেন, মামলাটি সাত বছর ধরে চলমান। পৌনে দুই বছর ধরে যুক্তিতর্কের পর্যায়ে রয়েছে। এর আগে খালেদা জিয়া আদালতে আসতে অনিচ্ছুক বলে জানিয়েছেন। আজও জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, তিনি আদালতে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এ থেকে ধরে নেয়া যায় যে, এভাবে চললে বিচার বিলম্বিত হতে পারে। মামলার অন্য দুই আসামি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এ সময় বিচারক এ সংক্রান্ত ত্রিপুরা, এলাহাবাদ, মধ্যপ্রদেশ, মহীশূর হাইকোর্টের বিভিন্ন মামলার নজির তুলে ধরেন।

বিচারক খালেদা জিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন মঞ্জুর এবং খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজের আদেশ দিয়ে বলেন, মামলার সার্বিক অবস্থা, নথি, বিদ্যমান আইন ও পরিস্থিতি, আদালতে আসতে খালেদা জিয়ার অনীহা এবং জামিনে থাকা অন্য দুই আসামি যাতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন এসব বিবেচনায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারায়  প্রসিকিউশনের দরখাস্তটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে গ্রহণ করা যায়। আদেশ দিয়ে বেলা দুইটা পর্যন্ত আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করেন বিচারক। এরপর বেলা ২টার দিকে আবারো কার্যক্রম শুরু হলে এক আদেশে আগামী ২৪, ২৫ ও ২৬শে সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্কের শুনানির দিন ধার্য করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status