প্রবাসীদের কথা

মায়ার জীবনে যা ঘটেছে, তা ছিল মিরাকল!

তাহমিনা ইয়াসমিন শশী, ভেনিস, ইতালি

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন

প্রতীকী ছবি

অফিস থেকে ফোন করে আমকে জানানো হয়েছে হাসপাতালে যেতে হবে। কোনও এক বাঙালি ভদ্র মহিলা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। যিনি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত। ইতালীয় ভাষা অল্প জানেন। তার আপন বলতে ইতালিতে কেউ নেই, যারা তাকে সাহায্য করতে পারে।
অফিসের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাসপাতালের উদ্দেশে। হাসপাতালে প্রবেশ করার পর একজন সেবিকা এসে আমাকে নিয়ে গেলেন রোগীর কেবিনে। মধ্যবয়সী একজন ভদ্র মহিলা। আমার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি বাঙালি? উত্তরে বললাম, হ্যাঁ।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো- আমার উত্তরে তিনি খুশি হলেন। আমি জানতে চাইলাম, আপনার নাম কি? তিনি একটু শুষ্ক হেসে বললেন, মায়া (ছদ্মনাম)।
চিকিৎসক কেবিনে প্রবেশ করলেন। ইতালীয় ভাষায় বললেন, মায়া ‘কমে স্তাই অজ্জি’? বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায়- মায়া, আজ কেমন আছো? মায়া বললেন, স্তো বেনে। অর্থাৎ ভালো আছি।
ডাক্তার আমাকে বললেন, মায়া ক্যানসার রোগে আক্রান্ত এবং শেষ স্টেজে আছে। এখন একমাত্র ভরসা উপরওয়ালার ওপর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে কেমোথেরাপি দিতে হবে।

ডাক্তারের কথাগুলো আমার মুখে শোনার পর মায়া কাঁদতে শুরু করলেন। সে কি অঝোরে কান্না! তার কান্নার শব্দে হাসপাতালের অন্যরা এসে ভিড় করল। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার। আমিও স্তব্ধ।
মায়া বললেন, চার বছরের একটি ছেলে ছাড়া ইতালিতে কেউ নেই। মায়া আবার কাঁদতে শুরু করলেন। কে দেখবে তার ছেলেকে? আর এত ওষুধ কেনার টাকা সে কোথায় পাবে? কার কাছে যাবে?
আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলাম। অফিসে এসে সবকিছু খুলে বললাম আমার কলিগের সঙ্গে। খুঁজে দেখলাম এসব ক্ষেত্রে ইতালীয় আইন কী বলে।
ইতালীয় আইন অনুসারে যদি কারো বাচ্চা নাবালক হয়, যদি বাচ্চার দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকে, সেক্ষেত্রে সরকার ওই বাচ্চা শাবালক না হওয়া অবধি সকল দায়িত্ব পালন করে।

পরদিন আবার গেলাম হাসপাতালে। আমি একা নই, সঙ্গে আমার কলিগও। আমার কলিগের কাজ হলো অসহায় আর নিপীড়িত বাচ্চাদের সাহায্য করা।
মায়াকে বললাম, আপনার পরিচিত কেউ কি আছে? যার কাছে আপনার বাচ্চাকে রাখা যায়? উনি বললেন, না। আমার এখানে কেউ নেই, কিন্তু লন্ডনে এক ভাই আছে। আমরা বললাম তাহলে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তার কাছে আপনার বাচ্চাকে রাখা যাবে কি না? বললাম, ইতালীয় আইন অনুযায়ী যদি কোনো নাবালক ছেলেমেয়ের অভিভাবক শারীরিকভাবে কিংবা মানসিকভাবে সুস্থ স্বাভাবিক না থাকে সেক্ষেত্রে তার তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব আত্মীয়স্বজনরা নেয়। যদি তার আত্মীয়স্বজন কেউ না থাকে তখন তার দায়িত্বভার নেবে এ দেশের সরকার। মায়া হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম, আপনি কান্না করছেন কেন? মায়া বললেন, আমি আর পারছি না এ জীবনের ভার বইতে।

মায়া ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, আমার ভাই আমার ছেলেকে তার কাছে রাখতে চায় না। আত্মীয়স্বজন বলতে ইতালিতে কেউ নেই। আমরা জানতে চাইলাম মায়া কেন বাচ্চাকে তার বাবার কাছে রাখছে না? মায়া আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। এবার আমরা সত্যি একটু বিচলিত হলাম। মায়া বললেন, আমাকে আর আমার বাচ্চাকে রেখে স্বামী চলে গেছেন দুই বছর আগে। আমরা জানতে চাইলাম চলে যাওয়ার কারণ কি ছিল? মায়া বললেন, আমি তো দেখতে সুন্দর নই তাই!
আমি বললাম, আপনি সুন্দর নন ব্যাপারটা মোটেই মেনে নেয়ার মতো নয়। মায়া বাঙালি মেয়ে হিসেবে তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট লম্বা এবং শিক্ষিত। গায়ের রঙটা একটু কালো। আমি অবাক হলাম এটা কোনো কারণ হতে পারে কাউকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো!
মায়া আমাদের বললেন, শুনলাম আমার স্বামী দেশে গিয়ে সুন্দরী কোনো এক অল্প বয়সের মেয়েকে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর সে আর ইতালিতে ফিরে আসেনি। এমনকি কোনো দিন বাচ্চার খোঁজও নেয়নি।

আমি বললাম, তাহলে ঠিক আছে আমরা একটা চুক্তিতে আসতে পারি যেহেতু আপনার ইতালিতে আপনজন বলতে কেউ নেই সেহেতু আপনার বাচ্চাকে ইতালিয়ান কোনো এক পরিবারে রাখা যেতে পারে। আপনি যখন চাইবেন আপনার বাচ্চাকে দেখতে পারবেন এবং ফোনে কথা বলতে পারবেন। মায়া বললেন, তাহলে কি আর করা! ভাগ্যের বাইরে আর কিছু করার ক্ষমতা আমাদের কারোর নেই। আপনাদের যা ভালো মনে হয় তাই করেন। মায়া কাঁপা কাঁপা হাতে চুক্তিপত্রে সই করে দিলেন।
মায়ার কেমোথেরাপি চলতে থাকে হাসপাতালে। দেখতে দেখতে ১ বছর পার হয়ে গেল। মায়া আগের চেয়ে অনেক সুস্থ হতে লাগলেন। মায়া এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন এটা ছিল কল্পনার মতো অবাস্তব একটা বিষয়। কিন্তু যা ঘটেছিল তা ছিল মিরাকল!     
মায়া এখন বাঙালি পাড়া থেকে অনেক দূরে বাস করেন। মায়া কাজ করতে চেয়েছিলেন একটা বাংলা স্কুলে। কিন্তু মায়াকে নেয়া হয়নি। কারণ, মায়া স্বামী পরিত্যক্তা।

মায়া বাঙালি সমাজের কোনো রকম সাহায্য না পেয়ে ভরসা করে ইতালীয় সমাজের উপর। কিন্তু হায় সেখানেও তাকে খুব একটা সাহায্য করা যায়নি আইনি সমস্যার কারণে।
মায়া ফিরে যায় বাংলাদেশে। দেশে ফিরেও সুখ মিলল না মায়ার কপালে। বড় ভাই অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ক্যানসার নামক রোগে! মায়ার বাবা মা বয়স্ক তাই তারা ঠিকমতো সংসার চালাতে পারতেন না। লন্ডনে যে ভাই থাকে সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
মায়ার বাবা মা মায়ার বাংলাদেশে ফিরে আসাটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। মনে হচ্ছিল যেন তাদের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছিল। আসলে ডিভোর্সি মেয়েরা শুধু সমাজের জন্য নয় বাবা মায়েদের জন্যও বোঝা।

হাল ছাড়েনি মায়া। কাজ খুঁজতে এক বন্ধুর শরণাপন্ন হয়। মায়াকে আশ্বস্ত করে সে বলে- তোমার চাকরি হবে, কাল একবার আসো আমার অফিসে। বন্ধুর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর মায়া জানতে চাইলো কোথায় চাকরি? কি ধরনের চাকরি? বেতন কত? বন্ধু উত্তরে বলল মেয়ে মানুষের আবার চাকরির অভাব হয় নাকি? আমার অফিসে যেসব ডিলাররা আসে তাদেরকে তুমি সঙ্গ দেবে। মেয়ে মানুষরা হচ্ছে ফুল, ভ্রমর এসে মধু খাবে। তুমি পাবে চাকরি আর আমি পাব টাকা। মায়া কি বলবেন নিজের বন্ধুকে বুঝতে পারছিলেন না! মেয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার অপরাধে ক্ষোভে দুঃখে তিক্ততা মাখা একটা কষিয়ে চড় দিয়ে অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়লেন।
অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন আবার ইতালি ফিরে যাওয়ার। নতুন করে যুদ্ধের সূচনা ঘোষণা করলেন। মায়ার মাথায় হাজারটা দুশ্চিন্তা। মায়ার বাচ্চাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। বাবার চিকিৎসা করাতে হবে। মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে।  
মায়ার পরিচিত সব মহলে থাকার জন্য একটা রুম ভাড়া চেয়েছিলেন।

কিন্তু মায়া পাননি। কারণ, মায়া স্বামী পরিত্যক্তা। নিরুপায় মায়া ছুটে যান নারী নির্যাতন কেন্দ্রে। সেখানেও ব্যর্থ হন মায়া। কারণ, মায়ার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, মায়াকে তার স্বামী মারধর করেনি। নারী নির্যাতন কেন্দ্র থেকে কেবলমাত্র নির্যাতিত নারীদেরকেই সাহায্য করা হয়।
মায়ার পারমিশন কার্ড নবায়ন করার জন্য তাকে ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠানো হবে। মায়ার ডকুমেন্ট নিয়ে ফাইল ওপেন করার পর বের হয় ভয়ংকর তথ্য। ২০০০ সালেও এক বার মায়া নারী নির্যাতন কেন্দ্রে এসেছিলেন। তখন তার স্বামী তাকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন নারী নির্যাতন কেন্দ্র মায়াকে সাহায্য করেছিল। বসবাসের জন্য জায়গা দিয়েছিল। থাকা খাওয়া এবং ইতালীয় ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি করে দিয়েছিল।

ভোর হতেই মায়া ইমিগ্রেসন অফিসের দুয়ারে বসে থাকে। অফিস খোলা মাত্রই মায়া ঢুকে পড়ল ছেলেকে নিয়ে। ইমিগ্রেসন অফিসাররা মায়ার অফিসে আসার কারণ জানতে চাইলো। মায়া আধো ইতালীয় আধো ইংলিশ ভাষায় বলল- আমার আর আমার ছেলের ইতালি থাকার পারমিট কার্ড নবায়ন করতে হবে। অফিসার বলল কোনো সমস্যা নেই। অফিসার বলল তুমি কাজ কর? তোমার বাসা আছে? মায়া মাথা নিচু করে বসে থাকে। ইমিগ্রেসন অফিসার আবার বলল এসব ডকুমেন্ট না থাকলে কাগজ নবায়ন করা যাবে না।
মায়া কান্না করতে করতে বলল না আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। আমার স্বামী আমাদের ছেড়ে বাংলাদেশে চলে গেছে। আমাদের একটু সাহায্য করুন।

অফিসার বললো ইতালিতে কিছু নিয়ম কানুন আছে। আইনি ব্যবস্থা আছে। এর বিপরীতে আমরা কেউ যেতে পারবো না। আমরা তোমার সমস্যা বুঝতে পারছি। কি বলবো আমরা চাইলেও তোমার ডকুমেন্ট নবায়ন করতে পারবো না। স্রোতের বিপরীতে আমরা কেউ চলতে পারবো না। সবারই জীবনে দুঃখ কষ্ট থাকে কিন্তু আমাদের পক্ষে সম্ভব না সবার ডকুমেন্ট করে দেয়া। তুমি বৃদ্ধ নও, কাজ খুঁজো, বাসা খুঁজো, সব ঠিক থাকলে এসো ডকুমেন্ট নবায়ন করে দেব। আমরা দুঃখিত এখন তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না।
মায়ার মনে হলো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কিছু বুঝে উঠার আগেই মায়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। ইমিগ্রেসন অফিসার মনে করল হয়ত মায়া নাটক করছে সাহায্য পাবার জন্য।

মায়ার পড়ে যাওয়া দেখে তার ছেলে মায়ার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অঝোরে কান্না করে বলল মা উঠ আমরা বাংলাদেশে যাব! আমরা নানা বাড়ি যাব! একজন মহিলা অফিসার এসে মায়ার বুক থেকে তার ছেলেকে তুলে উঠানোর চেষ্টা করল। প্রলয়কে তুলতে গিয়ে ইমিগ্রেসন অফিসার বুঝতে পারল মায়া জ্ঞান হারিয়েছে। অফিসার বুঝে উঠার সঙ্গে সঙ্গে এম্বুলেন্স ফোন করে মায়াকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জরুরি বিভাগে ভর্তি করানো হলো মায়াকে। চেকআপ করার পর জানা গেল মায়ার ক্যানসার হয়েছে এবং তা শেষ ধাপে অবস্থান করছে। প্রথম ধাপে জানলে হয়ত কিছু করা যেত। কিন্তু না তা হয়নি অভাগী মায়ার সঙ্গে! মায়ার অবস্থা অনেকটা এরকম- অভাগা যেদিকে তাকায় সাগর সুখিয়ে যায়...!
মায়াকে আজ থাকার জন্য সরকার বাসা দিয়েছে, চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে। সব আছে মায়ার। কিন্তু হায় মায়ার জীবনের গ্যারান্টি আছে অল্প দিন মাত্র। যেকোনো দিনই পরপারে পাড়ি দিতে পারে মায়াকে। তবুও মায়া আশা করে। স্বপ্ন বুনে আশাই হয়ত মানুষকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়।
[email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status