প্রথম পাতা

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস

সংসদ রিপোর্টার

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২০ পূর্বাহ্ন

সাংবাদিকসহ অংশীজনদের প্রবল আপত্তি  উপেক্ষা করেই পাস হলো বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল।
এতে বহুল আলোচিত ৩২ ধারা বহাল রাখা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৩২ (২)  ধরায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা-১ এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি উল্লেখ করে তা পাস না করতে সম্পাদক পরিষদসহ গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এই আইনে আপত্তি জানিয়ে আসছে। বিলটি গণমাধ্যম ও বাক স্বাধীনতার বিরোধী হবে এমন মত দিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কয়েকজন সদস্য জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় আলোচনার পর গতকাল রাতে বিলটি কণ্টভোটে পাস হয়।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে তিনি বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর পরই বিলটির ওপর জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনীর প্রস্তাব দেন জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র এমপিরা। ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে ১৩টি দফার ওপর সংশোধনীর প্রস্তাব দেন জাতীয় পার্টির তিন এমপি।

তারা হলেন-গাইবান্ধা-১ আসনের শামীম হায়দার পটোয়ারী, বেগম রওশন আরা মান্নান ও ফখরুল ইমাম। তাদের প্রস্তাবে শব্দাবলী বর্জন, প্যারা, সংখ্যা ও বন্ধনী প্রতিস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। কণ্ঠভোটে তাদের প্রস্তাব নাকচ হয়। বিলে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্রর ১২ এমপি। তারা ৩০শে অক্টোবরের মধ্যে জনমত যাচাইয়ের জন্য বিলটি প্রচারের দাবি জানান। স্পিকার বিষয়টি কণ্ঠভোটে দিলে তা নাকচ হয়।

এরপর বিলটি বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্রর ৮ এমপি। নিজেদের মনোনীত ৩, ৪ ও ৫ সদস্যের বাছাই কমিটিতে বিলটি পাঠিয়ে ৩০শে অক্টোবরের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার দাবি তোলেন। বিলটি পাসের আগে আপত্তি তুলে জাতীয় পার্টি দলীয় এমপি ফখরুল ইমাম বলেন, বিলে স্টেকহোল্ডারদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বাক-স্বাধীনতার জন্য এটা উদ্বেগজনক। এটা একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিল।

গণমাধ্যমের উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করাই স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধার সৃষ্টি করবে। দেশে সুশাসনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এই বিলের কারণে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে। জাতীয় পার্টি দলীয় অপর এমপি নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, বিলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিলে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। নূরে হাসনা লিলি চৌধুরী বলেন, বিলটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় যাচাই-বাছাই হওয়া প্রয়োজন।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমি এই কমিটির একজন সদস্য। বিলটি নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এটা নিয়ে অনেক যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। তাই আমি আমার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। একইসঙ্গে বিলটি পাস করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি। প্রস্তাব দেয়া অন্যান্য এমপিরা তাদের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।   কণ্ঠভোটে তাদের সে প্রস্তাবও নাকচ হয়। এক ঘণ্টা ৬ মিনিট পর রাত ৮টা ২৬ মিনিটে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।

বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই-বাছাই প্রসঙ্গে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, এই বিলটি পাসের জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রক্ষার জন্য ডিজিটাল আইন আমরা সবার আগে তৈরি করছি। পৃথিবীর বহু দেশকে এই আইনটি অনুসরণ করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে এটা ঐতিহাসিক আইন। মন্ত্রী বলেন, ভবিষতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ হবে না।

যুদ্ধ হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। তাই কোনোভাবে আমরা রাষ্ট্রকে বিপন্ন হতে দিতে পারি না। তিনি বলেন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইন নয়। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা যেন না থাকে তাই এই আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিলটি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কি পরিমাণ আলোচনা করেছি, তাদের কথা শুনেছি তা এই বিলের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে। আমরা তাদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি।

তারা যেসব জায়গায় যে ধরনের সংশোধনী দেয়া দরকার সেই অনুসারে সবকিছু আমরা করেছি। সাংবাদিকরা আইনমন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির কাছে যেসব কথা বলেছেন তা হয়তো তারা ভুলে গেছেন। যদি তারা ভুলে না গিয়ে থাকেন তাহলে তাদের সমালোচনার অবস্থা থাকে না। আইনটিকে বিতর্কিত করার কোনো সুযোগ নেই। ২০১৫ সাল থেকে বিলটি সর্বস্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ফখরুল ইমামের ৪৩ ধারার সংশোধনী প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, মহাপরিচালকের অনুমোদন নেয়ার বিষয়টি বাদ দেয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি সবাই এই বিষয়টি না রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।

আইনটি পাস হওয়ায় স্বাধীন সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়বে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আগে থেকেই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ এরই মধ্যে আইনটি প্রত্যাখ্যান করেছে। সাংবাদিক ইউনিয়নও আইনটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। আইনে ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অন্তর্ভুক্ত করে এর পরিধি আরো বাড়ানো হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ ওই অ্যাক্ট ভঙ্গ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার সাজা হবে। আইনে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

গত ২৯শে জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। তখন থেকেই আইনটি নিয়ে আপত্তি ওঠে। সম্পাদক পরিষদ এই আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা নিয়ে আপত্তি জানায়। এছাড়া, ১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা আইনের ২১, ২৮, ৩২ ও ২৫ ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।

সংসদীয় কমিটি সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি। কমিটি প্রতিবেদন দিতে তৃতীয় দফায় ১১ই সেপ্টেম্বর এক মাসের সময় নিয়েছিল। কিন্তু সংসদীয় কমিটির সুপারিশকৃত বিলের ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শন, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ, ইত্যাদি বিষয়ে (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, এবং

খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিলের ২১ ধারায় নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচার চালানো বা উহাতে মদত প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম আইনটির ব্যাপারে গণমাধ্যমকে বলেন, প্রস্তাবিত এ আইনটিতে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি যেসব বিষয় ছিল, সেগুলো রয়ে গেছে। কোনো পরিবর্তন আসেনি। স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ আর রইলো না। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে অন্তর্ভুক্ত করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক এই আইন এখন আর ব্যবহৃত হয় না। আঁস্তাকুড়ে থেকে এই আইনটিকে আবার সামনে আনা হলো। তিনি বলেন, সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ সব ধরনের সংবাদমাধ্যমকে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করতেই হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগগতভাবে সব ধরনের গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা রাখে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status