শেষের পাতা

রাইড শেয়ারিং

অনিয়মের বেড়াজালে চালক, বিপাকে যাত্রী

মারুফ কিবরিয়া

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

কাওরানবাজার মোড়ে এসেই রাইডার বললেন, বেশি দূর যেতে পারবো না। আমার তাড়া আছে। যাত্রী বললেন, এ কথা আপনি বলতে পারেন না। কারণ আমি কোথায় নামবো তার লোকেশন আপনাকে আগেই জানানো হয়েছে। সেটা দেখেই আপনি রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছেন। রাইডার বললেন, আমার হাতে সময় নেই। আমার অন্য কাজ আছে।  যাত্রী ফের বললেন, তাহলে আপনি আমাকে আনলেন কেন? আপনাকে তো জোর করে আনা হয়নি।

গতকাল পাঠাও রাইডে চড়ে আসা এক যাত্রীর সঙ্গে এমনই বাক্য বিনিময় হচ্ছিল রাইডারের। জামাল উদ্দিন চৌধুরী নামের ওই রাইডার রায়েরবাগ থেকে যাত্রী নিয়ে আসেন কাওরানবাজার মসজিদ রোডে। সোনারগাঁ হোটেলের উল্টো পাশে পেট্রোবাংলার সামনে দিয়ে বাঁয়ে যেতে বলতেই তিনি রেগে যান। ভেতরে যেতে পারবেন না বলে জানান।

এ সময় যাত্রীর সঙ্গে রাইডারের এমন তর্ক হয়। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে নেমে যান যাত্রী। অথচ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়াই রাইডারের কাজ। আরেক ঘটনা- রাজধানীর গুলশান-২ এ বৃহস্পতিবার ৮টায় অফিসে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন ব্যাংক কর্মকর্তা সাঈদ হোসেন। হাতে থাকা মুঠোফোন বের করে পাঠাও অ্যাপে রাইডার খুঁজছেন। যাবেন মিরপুর-১০। কিন্তু কোনো রাইডার পাচ্ছেন না। তবে কিছুক্ষণ পর পর একজন করে মোটরসাইকেল চালক সামনে এসে বলছেন, ভাই কোথায় যাবেন? খুব বিব্রত হচ্ছেন সাঈদ হোসেন। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে কোনো রাইডার পাচ্ছেন না। আবার কিছু রাইডার অ্যাপ অফলাইন করে তাকে চুক্তির ভিত্তিতে যেতে ডাকাডাকি করছেন। রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে ইদানীং এমন অনিয়মের অভিযোগ শুধু এই ব্যাংক কর্মকর্তার নয়, ঢাকা শহরে যারা সার্ভিসটি নিত্য ব্যবহার করে অভ্যস্ত তাদের অনেকেরই। শুরুর দিকে ভালো সেবা পাওয়ার ফলে পাঠাও, উবার, সহজসহ প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রিয়তা পেলেও এখন তাদের নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। রাস্তায় চলতে ফিরতে কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে গেলে পাঠাও-উবার চালকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ করছেন যাত্রীরা।


নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে না চাওয়া, রিকোয়েস্ট বাতিল করে দেয়া, যাত্রীর ডিসকাউন্ট আছে শুনে রাইডারের  যেতে না চাওয়া, চালকের খারাপ আচরণসহ অনেক অভিযোগ করছেন সাধারণ যাত্রীরা। আর এর মধ্যেই নতুন করে যোগ হয়েছে  চালকদের অ্যাপ বন্ধ করে দিয়ে ‘চুক্তিতে’ যাত্রী খোঁজা। বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, অফিসপাড়ায় সকাল-সন্ধ্যায় মোটরসাইকেল চালকরা দাঁড়িয়ে থাকেন চুক্তিতে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য। গত বুধবার বিকালে কাওরান বাজার পেট্রো বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে রাইড খুঁজছেন রফিক নামের এক যুবক। যাবেন বাড্ডায়। কিন্তু কোনো রাইড পাচ্ছেন না। অথচ সেখানেই কিছু মোটরসাইকেল চালক দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকাডাকি করছেন। রফিক বলেন, আধা ঘণ্টার ওপর রাইড খুঁজছি।

সামনে এতগুলো বাইক থাকতে অনেক দূরে রিকোয়েস্ট চলে যাচ্ছে। তারা আসতে পারছেন না। আর এই জায়গাটিতে যত মোটরসাইকেল আছে সবাই চুক্তিতে যেতে চান। দু-একজন আমাকে জিজ্ঞাসাও করেছেন ‘কোথায় যাবেন’?।


আমি তাতে সাড়া দিইনি। কারণ যাত্রাপথে কোনো অঘটন হলে সে দায় কে নেবে? এটা মোটেও নিরাপদ না। যেকোনো সমস্যায় পড়তে হবে। অ্যাপ বন্ধ করে দিয়ে চালকের কাছ থেকে চুক্তিতে বাসায় পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের মেহেরুন নামের এক শিক্ষার্থীও। তিনি জানান,  ক্লাস শেষে শাহবাগ মোড় থেকে বাসায় ফেরার জন্য অ্যাপে রাইডার খুঁজছিলেন সোমবার দুপুরে। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টার পর কোনো মোটরসাইকেল পাচ্ছিলেন না। মানবজমিনকে ওই শিক্ষার্থী বলেন, অ্যাপে কোনো রাইডার পাচ্ছি না।


এমন সময় পেছন থেকে এক মোটরসাইকেল চালক এসে বললেন, আপা কোথায় যাবেন? বুঝতে আর বাকি থাকলো না তিনি পাঠাও উবারের মতো কোনো রাইড শেয়ারিং কোম্পানির চালক। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম অ্যাপে না গিয়ে চুক্তিতে কেন যেতে চাইছেন? মুচকি হেসে ওই মোটরসাইকেল চালক জবাবে বললেন, আমার মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ।

তাই ভাবলাম আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় গিয়ে মোবাইল ফোনের চার্জ দেবো। মেহেরুণ আরো বলেন, তার অযৌক্তিক কথাটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। মোবাইলে চার্জ না থাকলে চুক্তিতে কেন যাবেন? এ ধরনের কোনো সিস্টেম আছে নাকি? আর এটা তো কোনো গণপরিবহন নয়। তাহলে কেন তারা স্বেচ্ছায় যাত্রীসেবা দিতে আসছেন? কিছু মানুষকে দেখছি তাদের ডাকে সাড়াও দিচ্ছেন। কিন্তু এটা তো নিরাপদ নয়। অ্যাপস ছাড়া ভাড়ায় মোটরসাইকেলে যাত্রীসেবা দেয়ার কোনো নিয়ম তো নেই। আমাদের প্রশাসনও তো এসব বিষয়গুলো নজরদারিতে আনছে না।

এদিকে যাত্রী কোথায় যাবেন তা শুনে রিকোয়েস্ট বাতিল করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে চালকদের বিরুদ্ধে। আবার অনেক চালকের রিকোয়েস্ট বাতিল করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। ইসমাইল নামের এক শিক্ষার্থী জানান, কোথাও যেতে চাইলেই রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর তা বাতিল করে দেয়। আমার সঙ্গে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

আবার অনেকে কোথায় যাবো সেটা শুনে যাবেন না বলে রিকোয়েস্ট বাতিল করে দেন। এসব করলে সিএনজি চালিত অটোরিকশা আর রাইড শেয়ারিংয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায় থাকলো? আমরা তো রাইড শেয়ারিংয়ের ব্যাপারটা ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি। যখন সিএনজি চালকরা উবার পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল তখন এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছি। এখন দেখছি সিএনজিই আমাদের জন্য ভালো।

যাত্রীর কাছে আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য প্রায়ই কোম্পানিগুলো ‘ডিসকাউন্ট’ দিয়ে থাকে। তবে সেটা ব্যবহার করতে গিয়েও যাত্রীদের শিকার হতে হয় নানা হয়রানিতে। কোনো যাত্রীর ডিসকাউন্ট আছে শুনলে রাইডার তাকে নিতে আগ্রহী হন না। অনেকে সরাসরি বলেই দেন ডিসকাউন্ট আছে, তো যাবো না। এমন অভিযোগও করেছেন বেশ কজন যাত্রী। শিহাব নামের এক যাত্রী বলেন, আমি নিয়মিত রাইড শেয়ারিং কোম্পানির অ্যাপসের সুবিধা ভোগ করছি। মাঝেমধ্যে ডিসকাউন্ট দেয় কোম্পানিগুলো।

সেগুলো ব্যবহারও করি। কিন্তু চালকরা ডিসকাউন্টের কথা শুনলে আর যেতে চান না। কী আজব! ডিসকাউন্টের টাকা তো কোম্পানি দিয়ে দেয়। তাহলে যেতে সমস্যা কোথায়? চালকদের নিয়ে অভিযোগ সরাসরি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও করছেন অনেকে। পাঠাও ইউজারস অব বাংলাদেশ নামের গ্রুপটিতে অনেক ইউজার তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা পোস্ট করছেন নিয়মিত। এর মধ্যে আহমেদ জুনায়েদ নামের একজন লিখেছেন ‘পাঠাও পে’তে সমস্যা কি রাইডারদের কেউই পেমেন্ট নিতে চায় না পাঠাও পে’তে। লাস্ট ১০টা রাইডের মধ্যে মাত্র একজন রাজি ছিল।  আবদুস সালাম নামের একজন যাত্রী হিসেবে হয়রানির শিকার হয়ে লিখেছেন, ‘ভাই সাহেব রিকুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলেন! তারপর বললেন, আমিতো দূরে চলে আসছি। আপনি একটা কাজ করেন। রিকুয়েস্ট ক্যানসেল করে আরেকটা পাঠাও ডাকেন।

কিন্তু আমি শেষ নবাবের কথা না শুনে বললাম, রিকুয়েস্ট যেহেতু অ্যাকসেপ্ট করছেন লোকেশন না দেখে, সেহেতু আপনিই ক্যানসেল করেন। ও মা শেষ নবাব কহিলেন, আপনিই করেন। নইলে আপনি থাকেন আপনার কানেকশন নিয়ে... এখন বাকিটা আপনারা ভাববেন।’

যাত্রীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে গেলে পাঠাওয়ের বিপণন কর্মকর্তা নাবিলা মাহবুব মানবজমিনকে বলেন, যারা চুক্তিতে রাইড দিচ্ছেন তাদের ব্যাপারে আমরা অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরাও শুনেছি কিছু কিছু রাইডার অ্যাপ বন্ধ রেখে চুক্তিতে যাত্রী সেবা দিচ্ছেন। রিকোয়েস্ট বাতিল করে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে বাতিল করার নিয়ম নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status