শেষের পাতা

শোলাকিয়ায় হামলার চার্জশিট

সিরিয়া, সৌদি ও পাকিস্তান থেকে আসে অর্থ, ভারত থেকে আসে অস্ত্র-গোলাবারুদ

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন

শোলাকিয়া হামলায় খরচের যাবতীয় টাকা হুন্ডির মাধ্যমে সিরিয়া, সৌদি আরব ও পাকিস্তান থেকে আসে। শিবগঞ্জে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি মো. বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট (৩২) এই টাকা   বাংলাদেশে আনে। বাশারুজ্জামান চকলেট সেই টাকা নারায়ণগঞ্জে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেয়। এছাড়া ভারত থেকে আসে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জে তামিম চৌধুরীর কাছে সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ পৌঁছে দেয় মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি নূরুল ইসলাম মারজান।

শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসঊদকে হত্যার টার্গেট করে চালানো এই জঙ্গি হামলার বিষয়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রথম বৈঠক হয়। পরে ২০১৬ সালের ২৪শে জুন রাজধানীর বসুন্ধরায় এ্যাপোলো হাসপাতালের পেছনে আজিমপুরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তানভীর কাদেরীর বাসায় শোলাকিয়া হামলার পরিকল্পনা হয়। শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে। বুধবার আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আরিফুর রহমান।

চার্জশিটে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২৪ জনের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে তাদের মধ্যে অভিযুক্ত ১৯ জন বিভিন্ন স্থানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বাকি পাঁচজনকে চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তারা হচ্ছে, কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিম তারাপাশা এলাকার জাহিদুল হক তানিম (২৪), গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাঘবপুর এলাকার জঙ্গি নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, শিবগঞ্জের হাজারদিঘা গ্রামের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, নিহত জঙ্গি শফিউলের বাড়িওয়ালা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের পান্থাপাড়ার আনোয়ার হোসেন এবং কুষ্টিয়ার কুমারখালী সাদিপুর কাবলিপাড়ার জঙ্গি নেতা মো. আবদুস সবুর খান হাসান ওরফে সোহেল মাহফুজ। অভিযুক্ত এই পাঁচজনই এই মামলায় কারাগারে রয়েছে। ২০১৬ সালের ৭ই জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়া হামলার দুই বছরেরও বেশি সময়ের পর এই চার্জশিট দেয়া হলো।

এ প্রসঙ্গে গতকাল পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ, বিপিএম সংবাদ সম্মেলনে জানান, শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার মামলাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। মামলাটির তদন্তে পুলিশকে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হয়েছে। চেকপোস্টে জঙ্গি হামলার ঘটনার নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ড, পরিকল্পনাকারী, পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী, অর্থ ও অস্ত্রদাতা এবং সহযোগীদের ব্যাপারে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়েছে। এসব কারণে মামলাটির চার্জশিট তৈরি করতে কিছুটা সময় লেগেছে।

চার্জশিটে বলা হয়, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার নিকট টাঙ্গাইলে অভিযানে নিহত মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে সুজনের ভাড়াটিয়া বাসায় শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৪শে জুন রাজধানীর বসুন্ধরায় এ্যাপোলো হাসপাতালের পেছনে তানভীর কাদেরীর বাসায় শোলাকিয়া হামলার পরিকল্পনা হয়। এই পরিকল্পনায় রাজীব গান্ধী, তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকলেট, তানভীর কাদেরী, খাইরুল ইসলাম ওরফে বাধন ওরফে পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিমল ওরফে নাহিদ, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিব্রাস ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের ও মেজর জাহিদ উপস্থিত ছিল। পরবর্তীতে হামলার তিনদিন আগে ৪ঠা জুলাই মিরপুর শেওড়া পাড়ার একটি বাসায় নূরুল ইসলাম মারজান, সারোয়ার জাহান ওরফে আবদুর রহমান ও রাজীব গান্ধী এই তিন জঙ্গি শোলাকিয়া হামলার বিষয়ে আরো একটি পরিকল্পনা মিটিং করে।

ওই মিটিংয়েই শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসঊদকে হত্যা করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নব্য জেএমবি’র মাস্টার মাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী, মেজর জাহিদ, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, আবির রহমান, শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ও জাহিদুল হক তানিম কিশোরগঞ্জ শহরের নীলগঞ্জ রোড এলাকার ভাড়া বাসায় অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে ৭ই জুলাই ঈদের দিন সকালে শোলাকিয়ার ইমামকে হত্যা করার জন্য জঙ্গি আবির রহমান ও শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলামকে অপারেশনে পাঠিয়ে তামিম আহমেদ চৌধুরী, মেজর জাহিদ ও ফরিদুল ইসলাম আকাশ কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করে। কিন্তু তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের তৎপরতা নস্যাৎ করে দেয় তাদের সব পরিকল্পনা। তল্লাশির মুখে পড়ে চাপাতি ও বোমা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলে পড়ে জঙ্গি আবির ও শরীফুল।

এ সময় জীবন তুচ্ছ করে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। সকাল পৌনে ৯টায় জঙ্গিদের এই হামলায় ১৪ পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের রক্তে নির্বিঘ্ন হয় শোলাকিয়ায় উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত। আহতদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম তপুর মৃত্যু হয়। এছাড়া কনস্টেবল আনসারুল হককে ময়মনসিংহ সিএমএইচে নেয়ার পর ওইদিনই দুপুরে সেখানে তার মৃত্যু হয়। শোলাকিয়ার সবুজবাগ মোড় পুলিশ চেকপোস্টে আক্রান্ত হওয়ার পর পরই হামলাকারী জঙ্গিদের ধরতে অভিযানে নামে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধ চলে। এ সময় ঘটনাস্থল সবুজবাগ এলাকার গৃহবধূ ঝরনা রানী ভৌমিক (৪৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিজ বাসাতেই মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া পুলিশের গুলিতে জঙ্গি আবির রহমানের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় এবং জঙ্গি শফিউল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় র‌্যাবের হাতে ও স্থানীয় তরুণ জাহিদুল হক তানিম পুলিশের হাতে আটক হয়।

শোলাকিয়া চেকপোস্টে জঙ্গি হামলার এই ঘটনায় পুলিশের চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করা পাকুন্দিয়া থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সামসুদ্দীন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক হওয়া জঙ্গি শফিউল এবং ঘটনাস্থল এলাকার একটি বাসা থেকে আটক স্থানীয় তরুণ তানিমের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে আসামি করে সদর থানায় ১০ই জুলাই মামলা করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আরিফুর রহমান জানান, সিন্ডিকেটসহ ৮০৩ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। শোলাকিয়া হামলায় জড়িত ২৪ জঙ্গির মধ্যে ১৯ জঙ্গি দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। অভিযোগপত্রে তাদের অব্যাহতি দিয়ে বাকি পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আগামী ২৪শে সেপ্টেম্বর এই মামলার পরবর্তী ধার্য্য তারিখ বলেও জানান গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status