বাংলারজমিন
কুঁড়েঘরেই বন্দি চা শ্রমিকদের জীবন
এম ইদ্রিস আলী, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন
চাগাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেয়া চাগাছের মতোই, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়েঘরে বন্দি। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা বাগান মালিকদের বাগানের সঙ্গে বাঁধা তাদের নিয়তি। বউ, বাচ্চা আর গরু-ছাগল নিয়ে থাকতে হয় একঘরে। সকালে লবণ পানি দিয়ে এক মগ চা আর সঙ্গে দু’মুঠো চাল ভাজা, দুপুরে শুকনো রুটি আর রাতে মরিচ আর চা পাতার চাটনি কিংবা সামান্য শাক-সবজি দিয়ে ভাত খেয়েই চলে তাদের সংসার জীবন। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও নেপথ্যে মানুষগুলো নানা বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার হয়ে আসছে দিনের পরদিন। প্রায় ২০০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় কাজ করা মৌলভীবাজারের ৯২টিসহ দেশের ১৬৫টি চা বাগানের শ্রমিকরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ তাদের শ্রমেই এই শিল্পের উন্নয়ন হচ্ছে। হচ্ছে না চা শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন। দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি ১০২ টাকা। আর সেই সঙ্গে সপ্তাহ শেষে তিন কেজি খাওয়ার অনুপযোগী আটা। তাও আবার ওজনে কম। মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি তাদের। কিন্তু বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন চা শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন সেই অবহেলিত রয়ে গেছে। সরকার তাদের আবাস্থল নিজ নিজ মালিকানায় করে দেবে বললেও এখনো এর কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আর এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভূমি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন চা শ্রমিকরা। বালিয়া রবিদাস। বয়স ৪৭। কাজ করেন কমলগঞ্জ উপজেলার ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন শমশেরনগর চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে। তিনি বলেন, ‘বাবু, আমরা লম্বরেও ভিজি, ঘরেও ভিজি। বউ, বাচ্চা, গরু-ছাগল নিয়া একঘরে থাকি। বহু কষ্টে চলতে আছি। ২৩ কেজি চা পাতা তুলে হাজিরা পাই মাত্র ১০২ টাকা।’ পরিবারে সচ্ছলতা আনার জন্য বাড়তি কাজ করতে হয় তাদের। বাড়তি কাজ করলে স্বল্প কিছু টাকা মেলে। ৭১ বছর বয়সী বাছিয়া রবিদাস বলেন, ‘ঘরের ওপরে পানি পড়ে। এই রুজি দিয়ে খাওয়ারই তো হয় না। ঘর বানামু কীভাবে। বিরটিশ (বৃটিশ) আমলে দুধ খাইয়া পেট ভরি গেছে। এখন খাইবার পাই
না। এখনের খালি লবণ, আটার রুটি আর লাল চা। বৃটিশ আমলে সমান রেশন ও তলব দিয়া গেছে মালিক। আর এখন জমিনেরও খাজনা কাটিয়া রাখে। বহুত দুঃখে আছি আমরা বাগানি মানুষ।’
হরিধন রবিদাস বলেন, পরিবারে ৫ জন সদস্য। ছেলের বউর নামে কাজ করি, বাকি সবাই বেকার। এভাবে পরিবারের একজনের নাম থাকলেও অন্যরা থাকে বেকার। শ্রীমঙ্গল কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও চা শ্রমিক নেতা পরাগ বাড়ই বলেন, চা শ্রমিকরা সেই বৃটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই চা শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। বর্তমান শ্রমিকবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি- এই অবহেলিত চা শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের যখন তখন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে। বিভিন্ন বাগানের একাধিক চা শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকালে লবণ দিয়ে এক মগ চা আর সঙ্গে দু’মুঠো চাল ভাজা খেয়ে বাগানে যেতে হয়, তার উৎপাদিত চা ও দুধ চিনি দিয়ে খাওয়ার সামর্থ্যও তার নেই। সারাদিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে, মাইলের পর মাইল হেঁটে কঠোর পরিশ্রম। যারা পাতা তোলেন, ২৩ কেজি পাতা তুললেই কেবল দিনের নিরিখ পূরণ হয়, হাজিরা হিসেবে গণ্য হয়। দিনে অন্তত ২৫০টি গাছ ছাঁটতে হয়। এক একর জমিতে কীটনাশক ছিটালে তবে নিরিখ পূরণ। দুপুরে এক ফাঁকে মরিচ আর চা পাতার চাটনি, সঙ্গে মাঝে মাঝে মুড়ি, চানাচুর। এই হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন জীবন। বালিশিরা ভ্যালির চা শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা বলেন, গত দেড়শ’-দুইশ’ বছর ধরে চা শ্রমিকরা বাগানে কাজ এবং বসবাস করে যাচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তারা তাদের ভূমির অধিকার লাভ করেনি। যার ফলে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। গত তিন মাস আগে সিলেটে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আমরা স্মারকলিপি পাঠিয়েছি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও চা শ্রমিক নেতা সাগর হাজরা জানান, চা শ্রমিকরা ববাবরই অবহেলার শিকার। হাড় ভাঙা খাটুনি দিয়ে তারা চা বাগানগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ভূমির অধিকার থেকে তারা সব সময়ই বঞ্চিত।
আমাদের চা শ্রমিকদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকদের মজুরি ৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০২ টাকা করা হয়েছে। এ মাস থেকে তা কার্যকর হয়েছে। মালিকপক্ষ ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাস দিয়েছেন। চা শ্রমিকদের সব অধিকার আদায়ে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সোচ্চার আছে। আশা করছি, সব অধিকার পর্যায়ক্রমে ছিনিয়ে আনতে পারবো।
চা শ্রমিকদের প্রতি সদয় আচরণ ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সবার দায়িত্ব। যাদের শ্রমে অর্জিত হচ্ছে হাজার কোটি বৈদেশিক মুদ্রা, তাদের অবহেলিত না রেখে অধিকার বাস্তবায়ন করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা চা শ্রমিকদের।
না। এখনের খালি লবণ, আটার রুটি আর লাল চা। বৃটিশ আমলে সমান রেশন ও তলব দিয়া গেছে মালিক। আর এখন জমিনেরও খাজনা কাটিয়া রাখে। বহুত দুঃখে আছি আমরা বাগানি মানুষ।’
হরিধন রবিদাস বলেন, পরিবারে ৫ জন সদস্য। ছেলের বউর নামে কাজ করি, বাকি সবাই বেকার। এভাবে পরিবারের একজনের নাম থাকলেও অন্যরা থাকে বেকার। শ্রীমঙ্গল কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও চা শ্রমিক নেতা পরাগ বাড়ই বলেন, চা শ্রমিকরা সেই বৃটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই চা শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। বর্তমান শ্রমিকবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি- এই অবহেলিত চা শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের যখন তখন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে। বিভিন্ন বাগানের একাধিক চা শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকালে লবণ দিয়ে এক মগ চা আর সঙ্গে দু’মুঠো চাল ভাজা খেয়ে বাগানে যেতে হয়, তার উৎপাদিত চা ও দুধ চিনি দিয়ে খাওয়ার সামর্থ্যও তার নেই। সারাদিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে, মাইলের পর মাইল হেঁটে কঠোর পরিশ্রম। যারা পাতা তোলেন, ২৩ কেজি পাতা তুললেই কেবল দিনের নিরিখ পূরণ হয়, হাজিরা হিসেবে গণ্য হয়। দিনে অন্তত ২৫০টি গাছ ছাঁটতে হয়। এক একর জমিতে কীটনাশক ছিটালে তবে নিরিখ পূরণ। দুপুরে এক ফাঁকে মরিচ আর চা পাতার চাটনি, সঙ্গে মাঝে মাঝে মুড়ি, চানাচুর। এই হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন জীবন। বালিশিরা ভ্যালির চা শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা বলেন, গত দেড়শ’-দুইশ’ বছর ধরে চা শ্রমিকরা বাগানে কাজ এবং বসবাস করে যাচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তারা তাদের ভূমির অধিকার লাভ করেনি। যার ফলে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। গত তিন মাস আগে সিলেটে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আমরা স্মারকলিপি পাঠিয়েছি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও চা শ্রমিক নেতা সাগর হাজরা জানান, চা শ্রমিকরা ববাবরই অবহেলার শিকার। হাড় ভাঙা খাটুনি দিয়ে তারা চা বাগানগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ভূমির অধিকার থেকে তারা সব সময়ই বঞ্চিত।
আমাদের চা শ্রমিকদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকদের মজুরি ৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০২ টাকা করা হয়েছে। এ মাস থেকে তা কার্যকর হয়েছে। মালিকপক্ষ ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাস দিয়েছেন। চা শ্রমিকদের সব অধিকার আদায়ে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সোচ্চার আছে। আশা করছি, সব অধিকার পর্যায়ক্রমে ছিনিয়ে আনতে পারবো।
চা শ্রমিকদের প্রতি সদয় আচরণ ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সবার দায়িত্ব। যাদের শ্রমে অর্জিত হচ্ছে হাজার কোটি বৈদেশিক মুদ্রা, তাদের অবহেলিত না রেখে অধিকার বাস্তবায়ন করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা চা শ্রমিকদের।