বাংলারজমিন

নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন অব্যাহত ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন মন্ত্রীর

শেখ খলিলুর রহমান, শরীয়তপুর থেকে

১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ৮:৪৯ পূর্বাহ্ন

অব্যাহত পদ্মার ভাঙনে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। নড়িয়া এলাকার সরকারি বে-সরকারি ভবন মূলফৎগঞ্জ বাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বহু লোকের সাজানো গোছানো ঘরবাড়ি  প্রতিনিয়ত ভাঙছে। সোমবার রাতে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনটির অধিকাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হাসপাতাল ক্যাম্পাসের একটি আবাসিক ভবনে জরুরি বিভাগ ও বহিঃবিভাগ চালু রাখা হলেও হাসপাতালে প্রবেশের সড়কটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় ভয়ে কোনো রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে না।
গতকাল বিকাল ৩টায় ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে সুরেশ্বর লঞ্চঘাট এলাকা থেকে মূলফৎগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা স্পিডবোট যোগে ঘুরে দেখেন। তিনি ভাঙনকবলিত নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নদী থেকে ভাঙন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। পরে মন্ত্রী সুরেশ্বর লঞ্চঘাট এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পদ্মার পানি কমলেই নদী তীরে স্থায়ী বাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। তিনি ভাঙনকবলিতদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন। স্পিডবোট যোগে নদীর মাঝদিয়ে ঘুরে ভাঙনের দৃশ্য দেখে চলে যাওয়ার কারণে ভাঙনকবলিতরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম, মহিলা আসনের সংসদ সদস্য নাভানা আক্তার, পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক খালেকুজ্জামান, জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের, পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে, সিভিল সার্জন মো. খলিলুর রহমান, পাউবোর শরীয়তপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াছমিন, নড়িয়া পৌরমেয়র শহিদুল ইসলাম বাবু রাড়ি, নড়িয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ব্যাপারি প্রমুখ।

মন্ত্রী স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নড়িয়া-জাজিরার পদ্মা নদীর ডান তীরের ৯ কিলেমিটার দীর্ঘ স্থায়ী বাঁধ রক্ষা প্রকল্পের জন্য ১০৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ তত্ত্বাবধানের কারণে এত বড় অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পদ্মার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকায় চলে এসেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আরো জানান, ভাঙনকবলিত এলাকাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার সুযোগ নেই। তবে, ইতিমধ্যে ২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র ভাঙনকবলিতদের আশ্রয়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ভাঙনকবলিত সব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল দেয়া হয়েছে। আর পুনর্বাসন সহায়তা হিসেবে টিন ও নগদ টাকা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী জানান, প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে প্রতিরক্ষামূলক বাঁধের পাশাপাশি চর ড্রেজিং করে তীর হতে স্রোত মাঝ নদীতে নেয়া হবে। প্রকল্পের কাজ কেন দেরি হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে একটু সময় লেগেছে। এরপর  ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দর কষাকষি করতে আরেকটু সময় চলে গেছে। এখন প্রকল্পের কাজ যেকোনো সময় শুরু করা হবে। বন্যার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। আল্লাহর রহমত থাকলে এ বছর কোনো বন্যা হবে না। তবে, পানির চাপ একটু বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৮ সালে নড়িয়া উপজেলা সদরের চার কিলোমিটার দূরত্বে মূলফৎগঞ্জ বাজার সংলগ্ন পূর্বপার্শ্বে ৩০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়।

২০১৪ সালে ওই হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। হাসপাতাল ক্যাম্পাসে জরুরি বিভাগ, বহিঃবিভাগ ও আবাসিক ভবনসহ ১২টি পাকা ভবন রয়েছে। রোববার সকাল থেকে উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র ৫০ শয্যার হাসপাতালটি গ্রাস করে সর্বনাশা পদ্মা। সোমবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে নতুন ভবনটির ৭৫ ভাগ বিলীন হয়ে যায়। এই হাসপাতালটিতে গত কয়েক দিন আগেও প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ ও শিশুরা চিকিৎসা নিতে আসতো। আগস্ট মাসের শেষের দিকে নড়িয়া সুরেশ্বর সড়কটি পদ্মায় বিলীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে রোগী কমতে থাকে। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ হাসপাতালে প্রবেশ পথটিও পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। এরপর  হাসপাতালের পেছন দিক দিয়ে একটি সরু পথে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হলেও ভাঙন আতঙ্কে কোনো রোগী ভয়ে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে না। স্থানীয়রা আরো জানায়, পদ্মা হাসপাতালের সীমানা প্রাচীর, এরপর নতুন ভবন গ্রাস করে এখন ভেতরের দিকে ঢুকছে। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে সবকটি ভবন পদ্মা গিলে খাবে।

হাসপাতালের মূল ভবনটির বেশির ভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি ভবন নদীগর্ভে চলে গেলে নড়িয়ার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সরজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের নতুন ভবনটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে অধিকাংশ পদ্মায় পড়ে গেছে। পার্শ্বের ভবনগুলো নদীর তীরে রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও কোনো রোগী দেখা যায়নি। হাসপাতালের সামনে দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বালু ভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ভাঙনকবলিত ক্ষতিগ্রস্তরা বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। বাজারের পাকা দোকানগুলো নিজেদের উদ্যোগে ভেঙে ইট ও রড সড়িয়ে নিচ্ছেন। কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ক্ষতিগ্রস্ত ঈমাম হোসেন দেওয়ান বলেন, আমরা খুবই অসহায়। আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। হাসপাতালটি ভাঙনের মুখে পড়ায় এ উপজেলার লোকজনের চিকিৎসা সেবা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

আমরা সরকারের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বে হাসপাতালের কার্যক্রম চালু রাখার দাবি জানাচ্ছি। নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুনীর আহমেদ বলেন, সোমবার রাতে হাসপাতালের নতুন ভবনটির অধিকাংশ পদ্মায় চলে গেছে। আমরা ভবনটি নিলামে বিক্রির জন্য মাইকিং করলেও কোনো লোক আসেনি ক্রয়ের জন্য। হাসপাতালের আরো ১১টি ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে। সীমিত পরিসরে জরুরি ও বহিঃবিভাগের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। তবে, এখনো হাসপাতালের কার্যক্রম অন্যত্র সড়িয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status