এক্সক্লুসিভ

দেশে সক্রিয় সহযোগীরা

শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কে কোথায়?

আল-আমিন

২৬ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ৮:৫১ পূর্বাহ্ন

একসময় ঢাকায় এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছিল সন্ত্রাসী বাহিনী। যাদের নাম শুনলে আঁতকে উঠতো মানুষ। দিনে-দুপুরে তারা চাঁদা চেয়ে চিরকুট পাঠাতো। সঙ্গে পাঠাতো কাফনের কাপড়। অনেকেই নীরবে দাবিকৃত সেই চাঁদা দিয়ে দিতো। না দিলে জীবন দিতে হতো। তাদের সন্ত্রাস, দখল, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সাধারণ মানুষ। এক সময় এমন সন্ত্রাসীদের নামের তালিকা তৈরি করে প্রশাসন তাদের নাম দিয়েছিল ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’। প্রথম তালিকায় ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এরা হলো সুব্রত বাইন, কালা জাহাঙ্গীর, মোল্লা মাসুদ ছাড়াও আরো অনেকেই। এই ২৩ জনের মধ্যে ১৩ জনই পলাতক রয়েছে দেশের বাইরে। এদের নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। বেশির ভাগই পার্শ্ববর্তী দেশে পলাতক জীবন যাপন করছে। কেউ রয়েছে কারাগারে।

আবার কেউ জামিনে মুক্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালিয়েছে। তবে, আন্ডার ওয়ার্ল্ডের এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা অনেকটা আড়ালে থেকে তারা তাদের ঢাকার নিজস্ব জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব ভয়ঙ্কর শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ভাঙিয়ে তাদের সহযোগীরা করছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ নানা অপরাধ। কেউ কেউ গোপনে দেশে এসে আবার গোপনে পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাচ্ছে। এই শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং তাদের সহযোগীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তীক্ষ্ম নজর রেখেছে। এ ছাড়াও কারাগারে থেকে তারা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে কী-না তা খোঁজ রাখা হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন ইন্টারপোলের পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণকারী এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী ঢাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন বলে গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) দেবদাস ভট্টাচার্য মানবজমিনকে জানান, ‘অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। অনেকেই পলাতক। কেউ জেলে আছে। যারা পলাতক তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তিনি আরো জানান, দুর্বৃত্তরা দেশে থাকুক আর বাইরে থাকুক তারা যাতে দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলার কোনো অবনতি না করতে পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের কোনো সহযোগী যাতে তাদের নাম ভাঙিয়ে কোনো অপরাধ করতে না পারে এই বিষয়ে সতর্ক পুলিশ। আর কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী পাশের দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যাতে বাংলাদেশে ঢুকে কোনো অপরাধ করতে না পারে সেদিকেও নজরদারি রাখা হচ্ছে। এলিট ফোর্স র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরানূল হাসান জানান, তারা যাতে বাইরে তাদের আন্ডার ওয়ার্ল্ড চালাতে না পারে সেইদিকেও নজরদারি রাখা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবের সদর দপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর নামের তালিকা প্রকাশ করে। এদের ধরিয়ে দিতে ৮ জনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।

আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা হলো- সুবু্রুত বাইন, মোল্লা মাসুদ, কালা জাহাঙ্গির, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেল, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম রাসু, ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আব্দুল জব্বার মুন্না, আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস, আরমান, হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, শামীম আহম্মেদ ওরফে আগা শামীম, জাফর আহম্মেদ মানিক ওরফে মানিক, সাগর ওরফে টোকাই সাগর, মশিউর রহমান কচি, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান, সানজিদুল ইসলাম ইমন, জিসান ওরফে মন্টি কচি ও মশিউর রহমান।

সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে ১ জন বন্দুক যুদ্ধে নিহত ও একজন গণপিটুনিতে মারা গেছে। ৮ জন বাংলাদেশের কারাগারে রয়েছে। বাকি ১৩ জন ভারত, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে পলাতক রয়েছে।
১৯৯৭ সালে মিরপুরের পাইকপাড়া এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে বিকাশ কুমার বিশ্বাস ২০১২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পায়। এরপর যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। বিকাশের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ নেতা জরিফ, আগারগাঁওয়ে জোড়া খুনসহ পাঁচটি হত্যা মামলাসহ ১৬টি মামলা রয়েছে। এর আগে বিকাশ ২০০৯ সালের জুনে কাশিমপুর কারাগার-২ থেকে জামিনে মুক্তি পায়। ওই সময় জেলগেটের সামনেই গাজীপুর জয়দেবপুর থানা পুলিশ তাকে আবার গ্রেপ্তার করে। বিকাশের ভাই শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ কুমার বিশ্বাস দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে পরিবার নিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাস করছে। ২০০১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে।

এই তালিকায় বিকাশের ছোট ভাই প্রকাশ কুমার বিশ্বাসের নাম ৮ নম্বরে রয়েছে। আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান বর্তমানে দুবাইয়ে আত্মগোপনে আছে। জিসান সেখানে হোটেল ব্যবসা করছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীরুল ইসলাম জয় বহুদিন থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছে। কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু, পরে জয় জামিনে ছাড়া পায়। সানজিদুল ইসলাম ইমন রয়েছে কানাডায়। সেখানে সে মোবাইলের ব্যবসা করে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, মিরপুর এলাকার আরেক সন্ত্রাসী শাহাদাত হোসেনও এখন ভারতে অবস্থান করছে। ২০১৬ সালের ২৭শে অক্টোবর তানভীর মুক্তি পায় বাংলাদেশের কারাগার থেকে। এরপর থেকে তানভীরুল ইসলাম জয়ও থাকেন কলকাতার বনগাঁও এলাকায়। সেখানে তার একটি হোটেল আছে বলে জানা গেছে। শাহদাতের সাঙ্গ-পাঙ্গরা এখনো মিরপুর এলাকায় সক্রিয়।
সূত্র জানায়, আরেক সন্ত্রাসী হারিস আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে আছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও হারিস ছিল দুই বন্ধু। বৃহত্তর মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতো। জিসান বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করায় হারিস সেখানে চলে গেছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগা শামীম ভারতের মেঘালয়ে অবস্থান করছে। শামীম সেখানকার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। সব্রুত বাইন ভারতে পলাতক রয়েছে। ২০০৮ সালের ১১ই অক্টোবর কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় সুব্রত বাইন। পরে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে নেপালে পালায়। পুরস্কার ঘোষিত আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আমিন রসুল সাগর টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ও ইমাম হোসেন কলকাতায় অবস্থান করছে দীর্ঘদিন ধরে। আব্দুল জব্বার মুন্না জার্মানিতে অবস্থান করছে।

সূত্র জানায়, ভারতে পলাতক রয়েছে মোল্লা মাসুদ। মাসুদ কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে কলকতায় পলাতক জীবন যাপন করছে। কয়েক মাস আগে তোফায়েল আহমেদ ওরফে যোশেফ জামিনে মুক্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে। পুরস্কার ঘোষিত আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আমিন রসুল সাগর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। শামীম আহমেদ কানাডায় আছে কয়েক বছর ধরে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ও ইমাম হোসেন কলকাতায় অবস্থান করছে দীর্ঘদিন ধরে। আব্দুল জব্বার মুন্না জার্মানিতে অবস্থান করছে। টোকাই সাগর বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছে।

সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ২৬শে জুন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান মারা যায়। ২০০৩ সালের মার্চে হাতিরঝিল এলাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার পর পালাতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয় সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন। শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকার পর কালা জাহাঙ্গিরের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে খবর রয়েছে কালা জাহাঙ্গির ভারতে পলাতক ও মারা গেছে। জব্বার মুন্নাও ভারতে পালিয়ে আছে। কামরুল হাসান হান্নান জার্মানিতে অবস্থান করছে। তাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জাফর আহম্মেদ মানিক ওরফে মানিক ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, বন্দি কিলার আব্বাসের বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যাসহ ১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী টিটনকে ঢাকা মহানগর পুলিশ ২০০৪ সালে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট বাবর এলাহী হত্যা মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। ২০০৪ সালের টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকা থেকে ফ্রিডম সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।

২০০৪ সালে ফ্রিডম রাসুকে ধানমণ্ডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৫ সালের ৩রা জুন ধানমণ্ডি এলাকা থেকে আরমানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তালিকা প্রকাশের আগেই পিচ্চি হেলালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়াও সুইডেন আসলামও জেলে রয়েছে। ২০০৩ সালে ৩রা জুন মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় আত্মসমর্পণ করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status