রকমারি

যে কারাগারে রক্ষী নেই

২৫ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৫:১৩ পূর্বাহ্ন

প্রথম যেদিন কারাগারে নিজের সেলে ঢুকলেন, সেদিন আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পারেন নি তাতিয়ানা কোরেইয়া দ্যা লিমা।

"আয়নায় নিজেকে দেখে এত অদ্ভুত লাগছিল! দেখে চিনতেই পারছিলাম না।" বলছিলেন ২৬-বছর বয়সী লিমা। বারো বছরের সাজা মাথায় নিয়ে দুই সন্তানের এই মা জেল খাটছেন।

ব্রাজিলে কারাবন্দীর মোট সংখ্যা বিশ্বের চতুর্থ। কারাগারের ভেতরের শোচনীয় অবস্থা নিয়ে প্রায়ই তুমুল আলোচনা চলে। পাশাপাশি রয়েছে ধারণ ক্ষমতার বেশি বন্দী এবং কারাগারের ভেতরে গুণ্ডা দলের দৌরাত্ম্য, মাঝে মধ্যেই যা থেকে দাঙ্গা হাঙ্গামা তৈরি হয়।

লিমাকে মূল কারাগার থেকে সরিয়ে ইটুয়ানার যে কারাগারে নেয়া হয়েছে সেটি পরিচালনা করে 'অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা প্রোটেকশন অ্যান্ড অ্যসিসটেন্স টু কনভিক্টস (এপ্যাক) নামে একটি সংস্থা।

গার্ডবিহীন জেলখানা

ব্রাজিলে অন্য কারাগারের চেয়ে এই কারাগারটি একেবারেই ভিন্ন। এখানে নেই কোন কারারক্ষী। নেই কোন অস্ত্র।

মূল কারাগারে যেখানে বন্দীদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট পোশাক, সেখানে এই কারাগারটিতে লিমা তার নিজের কাপড়ই পরতে পারেন। তার সেলে রয়েছে আয়না, মেকআপ করার সরঞ্জাম।
ব্রাজিলের কারা সঙ্কটের পটভূমিতে এপ্যাক পরিচালিত কারাগারগুলি অনেক বেশি নিরাপদ, সস্তা, এবং মানবিক বলে স্বীকৃতি পাচ্ছে।

গত ২০শে মার্চ ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের রনডোনিয়া এলাকায় এপ্যাক পরিচালিত একটি কারাগারের উদ্বোধন করা হয়। সারা দেশে এধরনের ৪৯টি কারাগার রয়েছে।

এখানে যে ধরনের বন্দীদের আনা হয় তাদের বেশিরভাগই আসে মূল কারা ব্যবস্থা থেকে। এরা যে তাদের অপরাধের জন্য অনুশোচনা করছেন সেটা তাদেরকে প্রমাণ করতে হয়। নিয়মিত শ্রম দেয়া এবং শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যাপারে এই কারাগারের যেসব নিয়মকানুন রয়েছে তা কঠোরভাবে পালন করা হয়।

কারাগারে রয়েছে 'কনজ্যুগাল সুইট', যেখানে রয়েছে ডাবল বেড খাট। দেখা করতে আসা স্বামীদের সাথে বন্দীরা এখানে 'ঘনিষ্ঠ সময়' কাটাতে পারেন।

কারাগারের একপাশে গিয়ে দেখা গেল নারীরা সাবানের বোতলে লেবেল লাগাচ্ছেন। বন্দীদের তৈরি এই তরল সাবান বাইরে বিক্রি করা হবে।
প্রথম এপ্যাক কারাগার স্থান করা হয় ১৯৭২ সালে। একদল ক্যাথলিক খ্রিস্টান এটি তৈরি করেছিলেন। এখন এভিএসআই ফাউন্ডেশন নামে ইতালির একটি এনজিও এবং ব্রাজিলের সাবেক কারাবাসীদের একটি প্রতিষ্ঠান এর অর্থায়ন করে থাকে।
এভিএসআই ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি জ্যাকোপো সাবাতিয়েলো বলছেন, তাদের কারাগারের মূল নীতি হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম এবং অন্যের প্রতি ভালবাসা।

"আমরা সব বন্দীকে তাদের নাম ধরে ডাকি। নাম্বার দিয়ে কোন বন্দীর পরিচয় দেই না।"

শুশ্রূষা

এই কারাগারের বন্দীদের ডাকা হয় 'রিকুপারেন্দোস' নামে অর্থাৎ যাদের আরোগ্যলাভের প্রক্রিয়া চলছে। এক্যাপ বন্দীদের পুনর্বাসনের দিকে জোর দিয়ে থাকে।

বন্দীদের সারাদিন ধরে কাজ এবং পড়াশুনা করতে হয়। কখনও কখনও স্থানীয় লোকজনের সাথে কাজ করতে হয়।
কোন বন্দী পালানোর চেষ্টা করলে মূল কারা ব্যবস্থার হাতে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

মি. সাবাতিয়েলো বলছেন, এপ্যাকের কারাগারে মারামারির দু'একটা ঘটনা ঘটলেও খুন রাহাজানির মতো কোন বড় অপরাধের নজির নেই।

তিনি বলছেন, কারাগারে কোন রক্ষী না থাকায় উত্তেজনা কম থাকে। এখানে কিছু নারী রয়েছেন যারা যাবজ্জীবন সাজা খাটছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ভায়াবহ অপরাধ ঘটিয়েছেন।

"আমি এখনও আমার পুরনো বন্দী সংখ্যা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি," বলছেন আগিমারা পাত্রিসিয়া সিলভিয়া কাম্পোস। মাদক চোরাচালানের দায়ে মূল কারাগারে তাকে চার মাস কাটাতে হয়েছিল।

"আমাদের গাদাগাদি করে থাকতে হতো। ছোট একটা ঘরে ২০ জন বন্দী। ঘুমাতে হতো নোংরা তোষকের ওপর," বলছিলেন তিনি, "আর যে খাবার দেয়া হতো তা মুখে তোলার মত ছিল না।"
তার সাথে দেখা করতে আসা আত্মীয়দের নগ্ন করে তল্লাশি করা হতো বলে তিনি জানালেন।

কাম্পোস যে পরিবেশের কথা বলছেন তা ব্রাজিলের কারা ব্যবস্থার একটা বড় সঙ্কটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রাজিলে প্রায়ই নারীদের কারাগারে যেতে হয় তার পুরুষ সঙ্গীর অপরাধের জন্য। এরপর দাগী আসামীদের মধ্যে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। অনেকেই কারাগারের মধ্যেই অপরাধের তালিম নেন।

"আমি যখন জেলে যাই, তখন এই ধরনের অপরাধ সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিল না," বলছেন কাম্পোস, "আমার পাশে যে মহিলা ঘুমাতো সে তার প্রতিবেশীর মাথা কেটে ফেলেছিল। এবং সেই কাটা মাথা একটি সুটকেসে ভরে রেখেছিল।"

দুই সন্তানের জননী এখন আট বছরের জেল খাটছেন।

ব্রাজিলের একজন বিচারক আন্তোনিও দ্যা করাভালহো বলছেন, মূল কারা ব্যবস্থায় কাজ এবং শিক্ষার মাধ্যমে দণ্ড কমানোর প্রথা থাকলেও এটা প্রয়োগ করা হয় সামান্যই। তিনি এপ্যাক কারা ব্যবস্থার একজন সমর্থক।
"মূল কারা ব্যবস্থার বর্তমান হাল খুব দু:খজনক। ব্রাজিলের বিচার ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বন্দীর মানবাধিকার রক্ষা করতে চাইলে এপ্যাক ব্যবস্থাই সবচেয়ে কার্যকারী," তিনি বলেন।

গরাদের আড়ালে যে প্রেম

তাতিয়ানা কোরেইয়া দ্যা লিমা যখন এপ্যাক কারাগারে ঢোকেন তখন তার সুযোগ সুবিধে ছিল কম। জেলের মধ্যে স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে তাকে সেই সুবিধে অর্জন করতে হবে। এটা সব নতুন কারাবন্দীর জন্য প্রযোজ্য।

কোন একজন বন্দী যখন ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়, তখন এক পর্যায়ে তাকে স্বল্প সময়ের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

প্রায়ই বাইরের জগতের সাথে বন্দীদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। এভাবেই লিমা খুঁজে পেয়েছেন তার ভালবাসার পুরুষকে। সহ-বন্দী ভিভিয়েন কাম্পোসকে সাথে নিয়ে সেলের মধ্যে বসে তিনি বলছিলেন কিভাবে তার সাথে পরিচয় ঘটলো সেই পুরুষটির, যিনি নিজেও শহরের অন্য প্রান্তে আরেকটি এপ্যাক কারাগারের বন্দী।

এপ্যাকের এই কারাগারের দেয়ালে লেখা রয়েছে: ভালবাসা ত্যাগ করে কেউ পালায় না।

সুত্রঃ-বিবিসি
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status