বাংলারজমিন

৫ মাসেও কান্না থামেনি নিহত নুশরাতের পিতা-মাতার

আবু তাহের, রামগঞ্জ (লক্ষ্মীপুর) থেকে

২১ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:৩৯ পূর্বাহ্ন

দীর্ঘ পাঁচ মাসেও কান্না থামেনি নিহত নুশরাতের মা রেহানা বেগম ও বাবা মো. এরশাদ হোসেনের। মেয়েকে হারিয়ে রাত-দিন শুধু আহাজারি করছেন তারা। নুশরাতের পরিবারের লোকজনের অবস্থা জানতে ঘটনাস্থলে গেলে দেখা যায়, তার মা রেহানা বেগম মেয়ের জামা কাপড়, বই, খেলনা হাতে নিয়ে আহাজারি করছেন। তবে, নুশরাত হত্যা মামলার এজহারভুক্ত ২নং আসামি মো. বোরহান সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে চিহ্নিত মাদকসেবী আফতাব হোসেন রিপনসহ কয়েকজন নুশরাতের পরিবার ও নুশরাতের মামাতো ভাই সাইফুল ইসলামকে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে আসছে। এরপর থেকে নুশরাতের পরিবারের লোকজন আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। ইতিমধ্যে আফতাব তার ফেসবুক পেজেও এ ব্যাপারে কয়েকবার স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন নুশরাতের পরিবারের লোকজন। তবে, এ ব্যাপারে আফতাব হোসেন রিপনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। নুশরাতের মা রেহানা বেগম ও বাবা এরশাদ হোসেন জানান, শাহ আলম রুবেলের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা ছিল না, অথচ আমার একমাত্র মেয়েকে এতটা নির্মমভাবে ধর্ষণ শেষে হত্যা করলো? আমার মেয়ে নুশরাত হত্যাকারী রুবেল যদি বলতো আমার মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে তাকে দিতে, তাও দিতাম। হায়রে জানোয়ার। আমি বিচারকের কাছে করজোড়ে আবেদন করছি, আমার মেয়ে হত্যাকারীর যেন ফাঁসি দেয়া হয়। এভাবেই সাংবাদিকদের কাছে হাহাকার করে তারা আরো জানান, এ মামলার অন্যতম ২য় আসামি বোরহান উদ্দিন সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হওয়ায় সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছি। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৩শে মার্চ শুক্রবার দুপুরে উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের নোয়াগাঁও নজুমুদ্দিন বাড়ির (কালু মেস্তুরির বাড়ির) প্রবাসী এরশাদ হোসেনের মেয়ে ও স্থানীয় পশ্চিম নোয়াগাঁও ফয়েজুল রাসূল সুন্নিয়া মাদরাসার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নুশরাত জাহান (৭) বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়।
পরদিন নুশরাতের নিকটাত্মীয় আবদুল মান্নান বাদী হয়ে রামগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। যার নম্বর ৯৩৭। জিডির সূত্র ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ কাউসারুজ্জামান বিভিন্ন স্থানে তদন্ত চালায়।
২৬শে মার্চ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ কাউসারুজ্জামান স্থানীয় এলাকাবাসীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পার্শ্ববর্তী কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের ব্রম্মপাড়া গ্রামের ওয়াপদা খালে ভাসমান বস্তাবন্দি অবস্থায় একটি শিশুর লাশ পাওয়ার পর শিশু নুশরাতের মামা মো. জিয়া তার ভাগ্নির লাশ শনাক্ত করেন। এ সময় শিশু নুশরাতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য লক্ষ্মীপুর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হলে চিকিৎসক নুশরাত জাহানকে ধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দেয়। জোর তদন্তে নামে পুলিশ। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সারা দেশের মানুষ নুশরাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। এমনকি, নোয়াগাঁও বাজারে নুশরাত হত্যাকারীর গ্রেপ্তার দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে অন্যতম ভূমিকা পালন করতেও দেখা যায় মূল হত্যাকারী শাহ আলম রুবেলকে।
পুলিশ লাশসহ উদ্ধারকৃত ব্যাগের ছবি দিয়ে লিফলেট প্রকাশ করে তদন্ত চালায়। তদন্তের একপর্যায়ে লাশ বহনকারী সিএনজি অটোরিকশা চালক তারেক হোসেন পুলিশকে শাহ আলম রুবেলের বন্ধু বোরহান উদ্দিনের মাধ্যমে সিএনজি ভাড়া করে নুশরাতের লাশ বহনের কথা জানিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করলে মূল আসামি শাহ আলম রুবেল ও বোরহান উদ্দিন গা-ঢাকা দেয়।
পুলিশ গোপনে ঘটনার মূল হোতা শাহ আলম রুবেলের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে খুলনার ফুলতলা পুলিশের সহযোগিতায় ১লা এপ্রিল শাহ আলম রুবেল (২৫) ও বোরহান উদ্দিনকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন রানার সহযোগিতায় ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করলে মূল ঘটনা বেরিয়ে পড়ে। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় শাহ আলম রুবেল তার জবানবন্দি দেয়।
জবানবন্দিতে শাহ আলম রুবেল জানান, ঘটনার দিন শুক্রবার সকালে বাড়ির সম্পর্কিত ভাতিজি নুশরাত জাহান শাহ আলম রুবেলদের ঘরে টিভি দেখার সময় নুশরাতকে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করলে নুশরাত চিৎকার দেয়। এ সময় শাহ আলম রুবেল নুশরাতের গলা চেপে ধরে ধর্ষণ করলে নুশরাতের জিভ ও চোখ বের হয়ে যায়। রুবেল এ সময় বুঝতে পারে নুশরাত ধর্ষণের সময় মারা গেছে। তড়িঘড়ি করে রুবেল একটি পাটি দিয়ে নুশরাতের লাশ মুড়িয়ে ট্রাভেলব্যাগে ভরে ঘরের স্টিলের আলমিরার উপর লাশ রেখে দেয়। ওই দিন রাত ৮টায় বন্ধু বোরহান উদ্দিনের সহযোগিতায় সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে ব্যাগভর্তি নুশরাতের লাশ পার্শ্ববর্তী কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের ব্রম্মপাড়া গ্রামের ওয়াপদা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন ব্রিজের নিচে ফেলে দেয়। তিন দিন পর ২৬শে মার্চ সকালে স্থানীয় লোকজন ট্রাভেলব্যাগটি ব্রিজের নিচে পানিতে ভাসমান অবস্থায় দেখে রামগঞ্জ থানা পুলিশে খবর দিলে পুলিশ নুশরাতের অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় শিশু নুশরাতের মা রেহানা বেগম শাহ আলম রুবেল ও বোরহান উদ্দিনকে আসামি করে রামগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন।
দীর্ঘ তদন্ত ও সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ কাউসারুজ্জামান  লক্ষ্মীপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ কাউসারুজ্জামান জানান, চলতি মাসের ৯ই আগস্ট বৃহস্পতিবার নারী ও শিশু নির্যাতন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারকের নিকট চার্জশিট জমা দেয়ার পর বিজ্ঞ বিচারক মামলাটি গ্রহণ করে আমলে নিয়েছেন। আশা করছি বাদী পক্ষ সুবিচার পাবেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status