শেষের পাতা

সিন্ডিকেটের খপ্পরে প্রাথমিকের বিনামূল্যের বই

অতিরিক্ত গচ্চা ১১১ কোটি টাকা

নূর মোহাম্মদ

১৭ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২১ পূর্বাহ্ন

অবশেষে প্রাথমিকের সাড়ে ১১কোটি বই ছাপার জটিলতা নিরসন হয়েছে। সোমবার পুনঃদরপত্রে কাজ পাওয়া মুদ্রাকরদের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এতে কৃষ্ণা ও স্বপ্না নামে বিদেশি দুটি প্রতিষ্ঠান ১০টি লটে মোট ১ কোটি ৪ লাখ ৫৩ হাজারের বেশি বই ছাপার কাজ পেয়েছে। মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এনসিটিবি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেই পুনঃদরপত্র করেছে। প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দর হাঁকানোর অভিযোগে প্রথম দরপত্র বাতিল করলেও পুনঃদরপত্রে প্রথম প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দরে কাজ দেয়া হয়েছে। ফলে আড়াই মাস সময় অপচয় হওয়ার পাশাপাশি সরকারের অতিরিক্ত 
গচ্চা যাচ্ছে ১১১ কোটি টাকা। এতে সরকারের সিদ্ধান্ত অক্টোবরের মধ্যে বিনামূল্যের বই উপজেলায় পৌঁছানো অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে গেল। যদিও এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, অক্টোবরের মধ্যে ৯০ শতাংশ বই পৌঁছাতে পারবো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনওএ দেয়ার পর মুদ্রণকারীদের সঙ্গে চুক্তি করতে আরো ২৮দিন সময় দিতে হবে। তারপর আরো ৮৪দিন সময় পাবে বই ছাপিয়ে উপজেলায় পৌঁছানোর। এরপর আরো ১ মাস সময় পাবে জরিমানা দিয়ে বই দেয়ার। তিনটি অফিসিয়াল প্রক্রিয়া শেষ করে বই দিলেও তা ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়াবে। অর্থাৎ নির্বাচনী বছরে অক্টোবরের মধ্যে বই ছাপিয়ে উপজেলায় পৌঁছানোর সরকারের যে সিদ্ধান্ত ছিল তা অনেকটা অসম্ভব হয়ে গেল। অন্যদিকে পুনঃদরপত্র করে শুধু প্রাথমিকের বই ছাপায় সরকারের অতিরিক্ত গচ্চা যাচ্ছে ১১১ কোটি টাকা। কৃষ্ণা প্রিন্টার্স এক লটে ৭১ লাখ ৫৭ হাজার ৪১৩ এবং স্বপ্না প্রিন্টার্স অন্য লটে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ১৭২টি বই ছাপার কাজ পেয়েছে। ২০১৬ সালে ভারতীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বই ছাপার কাজ করতে তিন মাস দেরি করে। এতে ডিসেম্বরের বই মার্চ মাস পর্যন্ত দিয়েছিল। এতে অনেক বিদ্যালয়ে বই ছাড়াই বই উৎসব এবং ক্লাসে করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এরপর এসব প্রতিষ্ঠানকে আর কাজ না দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও এবার এনসিটিবি নিজেই সেটা ভঙ্গ করে কাজ দিয়েছে। যদিও কৃষ্ণা ও স্বপ্না সময়মতো মানসম্পন্ন বই দেয়ার কথা বলছেন এনসিটিবি।

মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক বইয়ের প্রতি ফর্মা ২ টাকা ২৫ পয়সা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে প্রথম দরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। গত বছর ডিসেম্বরের প্রাক্কলন সঙ্গে জুন মাসের কাগজ, কালিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকায় ২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ৯৩ পয়সা পর্যন্ত। গড়ে ২ টাকা ৭৫ পয়সা প্রতি ফর্মার দাম ধরে দরপত্র জমা দেয়। এতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরো টেন্ডার নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এনসিটিবি প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশি হওয়ায় পুনঃদরপত্রে করার পক্ষে মত দেয় দরপত্র মূল্যায়ণ কমিটি। এ নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির দফায় দফায় বৈঠক হয়। অক্টোবরের মধ্যে বই দিতে হলে দরপত্র বহাল রেখে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার জন্য মত দেন এনসিটিবির একজন সদস্য। একপর্যায়ে ‘নোট অব ডিসেন্ড’ দিয়ে কমিটি থেকে বের হয়ে যান তিনি। এরপর পুনঃদরপত্র করে আগের দামেই এনওএ দিয়েছে এনসিটিবি। অর্থাৎ মুদ্রণকারীরা প্রথম দরপত্রে যে দর দিয়েছিল প্রায় সেই দরে পুনঃদরপত্রে কাজ দেয়া হয়েছে। তাহলে কেন পুনঃদরপত্র এমন প্রশ্ন রেখে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেই এনসিটিবির এমনটা করেছে। তিনি বলেন, পুনঃদরপত্রে প্রাক্কলনে বলে দেয়া থেকে শুরু করে সব কারসাজি হয়েছে। এটা দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার একটি মহাষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে প্রতি ফর্মা এক টাকা ৯৫ পয়সায় ছাপায় মুদ্রণকারীরা। সে বছর কাগজের টন ছিল ৬৪-৬৬ হাজার টাকা। এবার সেটি ৯৬ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এ ছাড়াও কালি, আর্ট পেপারসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েছে। এরপরও এনসিটিবি গত ডিসেম্বরের প্রাক্কলনের দর ৬৪ হাজার টন ধরে দরপত্র আহ্বান করে। অন্যদিকে এনসিটিবি ৮ হাজার টন কাগজ গড়ে ৯৬ হাজার টাকায় কিনেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, একই কাগজ সরকারি প্রতিষ্ঠান কিনেছে ৯৬ হাজার টাকায়, আর দরপত্রে ৬৪ হাজার টাকা টন ধরা হয়েছে। এটা সম্ভব নয়।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, গত মার্চ মাসের দরপত্রে এনসিটিবির প্রাক্কলন ২ টাকা ২৫ পয়সা ধরা হলেও মুদ্রণরা দর দেয় ২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৮২ পয়সা পর্যন্ত। ১২ই এপ্রিল দরপত্র খোলার পর দেখা যায় প্রাক্কলনের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে ৩৫ ভাগ। এতে বই ছাপা নিয়ে সংকট তৈরি হয়। সংকট কাটাতে এনসিটিবির কাছে তিনটি পথ খোলা ছিল। এক. পিপিপি’র ৯৮ ধারার ২৫ ধারা অনুযায়ী বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া, দুই. পুনঃদরপত্র আহ্বান এবং ফ্রেশ দরপত্র আহ্বান করা। এনসিটিবির কর্মকর্তারা প্রথমটির পক্ষে থাকলেও চেয়ারম্যান বাধা দেয়। তিনি পুনঃদরপত্র করতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে সফল হন। এতেই বিদেশি দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ পাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। ব্যবসায়ীরা জানান, বই ছাপার কাজে চলতি বছর বিশ্বব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা নেয়নি সরকার। তাই আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করার কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও শুধু বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে এনসিটিবির চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতেই সরকারের ১১১ কোটি টাকা অতিরিক্ত গচ্চাসহ সময়মতো বই দেয়ার সুযোগ এখন আর নেই বলে জানান মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা।

এদিকে নির্বাচনী বছর হওয়ায় সরকারের অক্টোবরের মধ্যে শতভাগ বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো নিয়ে চরম শঙ্কা দেখা যাওয়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপরতা শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সরকারের সফল এ প্রজেক্ট নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না বলে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে সরকারের শেষ বছর বইয়ের কাজ যথাসময়ে আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা মানবজমিনকে বলেন, ওপেন দরপত্রের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। তাই মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা যেসব অভিযোগ করেছে তা সত্য নয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠান অতীতে দেরিতে বই দেয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আশা করি অক্টোবরের মধ্যে ৯০ ভাগ বই উপজেলায় পৌঁছে যাবে। তারপরও কেউ যদি বই দিতে দেরি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। তিনি আশা করেন, চলতি বছর নির্ধারিত সময়ের আগেই ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বই দিয়ে দিবে। কারণ এর আগে সমুদ্র পথে বই আসতো। এবার সড়ক পথে আসবে। তাই দেরি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

মুদ্রণ সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত মানবজমিনকে বলেন, দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য এনসিটিবি এবারও ষড়যন্ত্র করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বই তুলে দিলো। প্রথম দরপত্রে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানও কাজ পেল না, অথচ পুনঃদরপত্রে ১০টি লটে কাজ পেয়ে গেল। তাই এনসিটিবির প্রতি যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছে। প্রয়োজন হলে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার কথাও জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status