এক্সক্লুসিভ

কলঙ্কমুক্তিতে দীর্ঘ পরিক্রমা

স্টাফ রিপোর্টার

১৫ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ১০:২১ পূর্বাহ্ন

আজ জাতীয় শোক দিবস পালন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৪৩ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন মহান স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। এই হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের একজন বিদেশে অবস্থানকালে মারা গেছেন এবং ছয়জন এখনো পলাতক।
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপাপ্ত পাঁচজন সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি। পলাতক আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান বলে জানা যায়। দীর্ঘ এই পরিক্রমায় বিচারকাজ শেষ হলেও দণ্ডিত পলাতকদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করে কলঙ্কমোচনের যে আকাঙ্ক্ষা সেটি ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পলাতক শরিফুল হক ডালিম, আব্দুর রশিদ, এম রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা আছে। পলাতক ছয় আসামির মধ্যে চারজনের অবস্থান গত নয় বছরেও সঠিকভাবে শনাক্ত হয়নি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বাকি দুজনের অবস্থান শনাক্ত হলেও তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে চলমান আলোচনায় এখনো কোনো আশাব্যঞ্জক সফলতা আসেনি। পলাতকদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) কর্মকর্তারাও গণমাধ্যমকে এমনটি জানিয়েছে। অন্য চার জন শরিফুল হক ডালিম, আব্দুর রশিদ, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন কোথায় আছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও সম্ভাব্য যেসব দেশে তাদের অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে, ওইসব দেশগুলোর সঙ্গে এনসিবি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন বলে জানিয়েছেন খোদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমি কোনো সময় নির্ধারণ করে দেবো না। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু এটা খুব কঠিন হয়ে গেছে এখন।’ এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার আদালতের আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই সঙ্গে তিনি এও জানান, কানাডায় পালিয়ে থাকা নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কানাডায় একটা আইন আছে, যদি কোনো দেশে মৃত্যুদণ্ড থাকে এবং সেই দেশে মৃত্যুদণ্ড সাজা পেতে পারে এমন কোনো আসামিকে তারা ডিপোর্ট করে না। গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা সদরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোকদিবসের আলোচনা সভায় বলেন, আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় এলে আমেরিকায় পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এ নিয়ে আমেরিকা সরকারের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা কষ্টকর বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, আগামীতে ক্ষমতায় এলে রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। পাশাপাশি কানাডায় থাকা নূর চৌধুরীকেও দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বিচারের পথ খোলে। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ই নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। একই বছরের ২রা অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর তখনকার ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ই নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আসামিদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) শুনানি নিয়ে ২০০০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেন। রায়ে বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অন্য পাঁচ আসামিকে খালাস দেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরে ২০০১ সালের ৩০শে এপ্রিল হাইকোর্টে তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। তিনজন খালাস পায়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর বিচারের গতি স্লথ হয়ে যায়। বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠনের পর বিচারে গতি আসে। ওই বছরের ২৪শে আগস্ট আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই বছরের ৫ই অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন। আপিল শুনানির জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ২০০৯ সালের ৪ঠা অক্টোবর বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের (সাবেক প্রধান বিচারপতি) নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। ৫ই অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২৯ কর্মদিবস শুনানির পর ২০০৯ সালের ১৯শে নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের করা আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ২০১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়ও বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না এবং এটি হতাশাজনক কি না- এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু মানবজমিনকে বলেন, এটি হতাশাজনক নয়। কেননা বিদেশিরা নিশ্চয়তা চায় যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড করা যাবে না। তারা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। এ কারণে কানাডা ও অন্যান্য দেশ তাদের হস্তান্তর করছে না। তিনি বলেন, এ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে। আমরা তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status