দেশ বিদেশ

আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?

মেহেদী হাসান পলাশ

১২ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

গতকালের পর
এসব অঞ্চলে সরকার পরিচালনায় তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইনপ্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে। এসব অঞ্চলের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার ও কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হবে। লক্ষণীয়, প্রকাশ্যে বলা না হলেও এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বতন্ত্র জাতীয়তার মধ্যে লুকানো রয়েছে স্বাধীনতার বীজ। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমির উপর যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা আরো ভয়ানক। যেমন :অনুচ্ছেদ-১০: আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি কিংবা ভূখণ্ডথেকে জবরদস্তিমূলকভাবে উৎখাত করা যাবে না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া কোনভাবে অন্য এলাকায় স্থানান্তর করা যাবে না এবং ন্যায্য ও যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে সমঝোতা সাপেক্ষে স্থানান্তর করা হলেও, যদি কোন সুযোগ থাকে, পুনরায় তাদেরকে সাবেক এলাকায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে। অনুচ্ছেদ-২৬ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন, দখলীয় কিংবা অন্যথায় ব্যবহার্য কিংবা অধিগ্রহণকৃত জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের অধিকার রয়েছে। ২৬: ৩. রাষ্ট্র এসব জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি ও রক্ষার বিধান প্রদান করবে। সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথা, ঐতিহ্য এবং ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাপনা মেনে সেই স্বীকৃতি প্রদান করবে।

অনুচ্ছেদ-২৭: রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যৌথভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আইন, ঐতিহ্য, প্রথা ও ভূমি মালিকানাধীন ব্যবস্থাপনার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করবে। অনুচ্ছেদ-২৮ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদ যা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া বেদখল, ছিনতাই, দখল বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এসব যাতে ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে, একটা ন্যায্য, যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় তার প্রতিকার পাওয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে। ২৮: ২. সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় অন্য কোনো কিছুতে রাজি না হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গুণগত, পরিমাণগত ও আইনি মর্যাদার দিক দিয়ে সমান ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদ অথবা সমান আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বা অন্য কোনো যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনুচ্ছেদ-৩০ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ ছাড়া ভূমি কিংবা ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যাবে না। অনুচ্ছেদ-৩২ : ২. রাষ্ট্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এমন কোনো প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে, বিশেষ করে তাদের খনিজ, জল কিংবা অন্য কোনো সম্পদের উন্নয়ন, ব্যবহার বা আহরণের পূর্বে স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণের জন্য তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে। উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিজস্ব আইনে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় চিহ্নিত উপজাতিরা দাবি করছে ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ভূমির মালিক তারা। একই অধিকার বলে সমতলের উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকার সকল ভূমির মালিকানা সেখানকার উপজাতীয়রা দাবি করবে। সেখানে যেসব ভূমি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানা (আদিবাসী নয়) রয়েছে তা ফেরত দিতে হবে বা তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনকি উপজাতীয়রা রাজি না হলে সমতল থেকে সমপরিমাণ সমগুরুত্বের ভূমি ফেরত দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু ঐ গোষ্ঠী সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছে, সেকারণে সেখান থেকে সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেসব বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ইউএনডিপিসহ কিছু বৈদেশিক সংস্থা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এ দাবি তুলেছে। ঘোষণাপত্রের ৩৬ অনুচ্ছেদটি আরও ভয়ানক। অনুচ্ছেদ-৩৬ : ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর, বিশেষত্ব যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে তারা অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠী তথা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংক্রান্ত কার্যক্রমসহ যোগাযোগ, সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে। আমরা জানি বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল উপজাতি জনগোষ্ঠীর মূল আবাস ভারত ও মিয়ানমার। সেখানে এখনো তাদের মূল জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে তাদের খণ্ডিত অংশ যদি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলে ভারতের সমগ্র সেভেন সিস্টার্স রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা এবং মিয়ানমারের বিপুল এলাকা আদিবাসী ল্যান্ড স্বীকৃতি পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। একই সাথে সীমান্তের উভয়পাড়ের অভিন্ন জনগোষ্ঠী যদি অভিন্ন রাজনৈতিক, সরকার কাঠামো কিংবা স্বাধীনতার দাবি তোলে তা আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ নেবে।

এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী ভারত সরকারের দৃষ্টিগোচর করতে পারে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উল্লিখিত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে যা ৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান স্বাধীন করণে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশ্বের দেশপ্রেমিক জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। অধুনা পশ্চিম পাপুয়া নিউগিনিতেও জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ৪৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, আদিবাসীর দাবি এমন একটা জনগোষ্ঠী থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যারা ৪২ বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। কৌশলগত কারণে তারা স্বায়ত্তশাসনের কথা যতোটা উচ্চকিত করে স্বাধীনতার কথা ততোটা নয়। ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষই রাষ্ট্রবিরোধী এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাও রহস্যময় আবরণে সযত্নে ঢেকে রেখেছে দেশবিরোধী এই দুষ্টুক্ষত। কিন্তু যারা সচেতন, বিশেষ করে যারা সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করেন তাদের প্রতি আহ্বান একবারের জন্য হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের পরিচালিত প্রোফাইল, গ্রুপ ও পেইজগুলো ভিজিট করে দেখুন, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কী ভয়ানক প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেখানে। স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের জন্য নিজস্ব জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, মানচিত্র দিয়ে কীভাবে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতনতার জন্য দেশবাসীর জানা উচিত। পাঠকের জ্ঞাতার্থে সিএইচটি জুম্মল্যান্ড নামে তাদের পরিচালিত একটি পেইজের ঠিকানা এখানে দেয়া হলো: (https:/ww/w.facebook.com/pages/CHT-jummaland/327524104096965?fref=ts
)। শুধু ফেসবুক বা সামাজিক গণমাধ্যম নয়, পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল খুলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের প্রচার চালাচ্ছে। তাদের পরিচালিত অসংখ্য সাইটের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পযঃহবংি.পড়স. এই সাইটে করুণালঙ্কার ভান্তে নামে জেএসএসের এক শীর্ষ নেতার ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার প্রচার হচ্ছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশধারী এই ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় তার কর্মতৎপরতার কথা বিস্তারিতভাবে বলেছেন। অডিও-ভিডিও’র এই সাক্ষাৎকারে ভান্তে আরো জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করার মতো পর্যাপ্ত অস্ত্র তাদের হাতে রয়েছে। এখন তিনি শুধু ৫ লাখ গোলাবারুদ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। এই পরিমাণ গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে পারলে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ভিক্ষু সমপ্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের উদাহরণ তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি তরুণ প্রজন্মকে তার সঙ্গে একাত্ম হতে অহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আন্তর্জাতিক শক্তিকে তিনি পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাবেন বলেও জানিয়েছেন। কাজেই বাংলাদেশের উপজাতিদের আদিবাসী স্বীকৃতি কোনো ছেলের হাতের মোয়া নয়। এর সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, অস্তিত্ব, কর্তৃত্ব, ইতিহাস ও মর্যাদার প্রশ্ন। 
[email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status