শরীর ও মন

কেন ট্রেন -বাসে উঠলে আমরা অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ি?

৪ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৪:৩১ পূর্বাহ্ন

ট্রেন ছুটছে হুড়মুড়িয়ে, কামরার ভিতরে তিলধারণের জায়গা নেই। তার মধ্যেই হকারদের বিক্রিবাটা, শিশুর কান্না, পা মাড়ানো নিয়ে গলাবাজি— সবই চলছে পুরোদমে। তবু তারই মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন কোণার সিটের ভদ্রমহিলা।

এ ছবি কোনও সিনেমার রিল বা উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা নয়। বরং রোজকার জীবনে এমন দৃশ্য প্রায় সকলেরই চোখ-সওয়া। যে হইহট্টগোলে দু’চোখের পাতা এক করার জো নেই, সেখানেও ঘুমিয়ে কাদা এক শ্রেণির মানুষ! কিন্তু এক বারও ভেবে দেখেছেন কি, কেন এমন হয়?
ঘুম কি এখানে শুধুই ক্লান্তিজনিত কারণ? নাকি যানবাহনে উঠলেই ঘুমিয়ে নেওয়া আদতে স্নায়ুরই কোনও কারসাজি? এমন মানুষদের মধ্যে কি পড়েন আপনি? পড়ে আপনার কোনও চেনা মুখ? চিকিৎসকেরা কিন্তু মোটেই হালকা করে দেখছেন না এই ‘অসুখ’।

স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সমর চৌধুরী যেমন এই কারণের নেপথ্যে মস্তিষ্কের থ্যালামাস-হাইপোথ্যালামাস অংশের ভূমিকার কথা বলছেন। তিনি জানাচ্ছেন, শরীরে অক্সিজেনের অভাব হলেই হাই ওঠে, পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন ঘুমের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেকের মধ্যেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমিয়ে পড়ার স্বভাব আছে। আধুনিক জীবনযাত্রায় অনিদ্রা বা ‘ইনসমনিয়া’ যেমন দুশ্চিন্তার কারণ, তেমনই অতিরিক্ত ঘুম বা ‘সমলোলেন্স’-ও উদ্বেগের বিষয়।
সমরবাবুর মতে, সারা দিনের ক্লান্তি থাক বা না থাক, অনেকেই যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন সহজে। কারণ, এ সব ক্ষেত্রে গাড়ির দুলুনি বা গতি তার শরীরকে আরাম দেয়। সামান্য আরাম পেলেই তাদের স্নায়ুগুলি তাতে সাড়া দেয় ও ‘হাইপক্সিয়া’ বা ঘুমের উদ্রেক হয়। মস্তিষ্কের কোষে অক্সিজেনের অভাবে ক্লান্তিজনিত যে ঘুম আসে আর আরামজনিত কারণে আমাদের যে ঘুম পায়, তা কিন্তু একে অপরের পরিপূরক। তবে এই অভ্যাস অল্পবিস্তর থাকলে তা নিয়ে অত মাথা ঘামান না কেউই। কিন্তু তা বাড়াবাড়ি রকমের হলে তা অবশ্যই অসুখ। সে ক্ষেত্রে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্লিপিং ডিসঅর্ডার নিয়ে চিকিৎসা করেন এমন কারও পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

তবে ঘুমের এই অস্বাভাবিকতা বুঝতে হলে, ঘুম ও শারীরবৃত্তীয় কাজের মধ্যে সম্পর্কটাকেও বোঝা দরকার। মানুষের শারীরবৃত্তীয় কাজের অন্যতম ঘুম শরীরের নানা দিকের ভারসাম্য তো রক্ষা করেই, সঙ্গে মানুষের সারা দিনের কাজকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
মালদহ মেডিক্যাল কলেজের শারীরবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চিকিৎসক মনিকা সাধু জানালেন, এক জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাপ্তি হওয়া উচিত ৬-৮ ঘণ্টা। এর মধ্যে প্রতি ৭০-৯০ মিনিট মানুষ ঘুমচক্রের দু’টি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায়। ১) নন র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট (এনআরইএম), ২) র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম)। ছ’-আট ঘণ্টার ঘুমে প্রায় চার-পাঁচটি ঘুমচক্র চলে। এর মধ্যে প্রথম দিকের এনআরইএনে হালকা ঘুমের পরেই গাঢ় ঘুম আসে। তার পরেই আসে আরও গভীর ঘুমের আরইএন। ফের আসে এনআরইএন, আর তার পর আসে আরইএন। এই ভাবেই ঘুমন্ত মানুষের শরীরে চক্রটি চলে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে তা বোঝা সম্ভব হয় না। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, এই স্লিপিং সাইকেলেই থেকে যায় গলদ, ঘুমের ঘাটতি। যেহেতু সেটা সহজে বুঝে ওঠা যায় না, তাই মনে হতেই পারে, এই তো ঘুমিয়ে উঠলাম, ফের ঘুম পাচ্ছে কেন! সঙ্গে ট্রেনের দুলুনি, বাস বা অন্য যানবাহনের গতি শরীরে আরাম এনে দেয়। মামুষ পাড়ি দেন ঘুমের দেশে।
আবার নারকোলেপ্সি অসুখে ঘুম শুরু হয় র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএন) দিয়ে। এই সব রোগীর কিন্তু দিনের বেলা হঠাৎ হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের সময় শরীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের জোগান না পেলেও তা ঘুমে ব্যাঘাত  হানে। একে বলে অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। এই ধরনের মানুষরা যেখানে-সেখানে, এমনকি, গাড়ি চালাতে চালাতেও ঘুমিয়ে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার প্রভাবে অনেকে নাকও ডাকেন। তাই নাক ডাকাকেও একেবারেই অবহেলা করা উচিত নয়। বয়স হলেই নাক ডাকে মানুষ— এই মিথও তাই ভুলে যাওয়া উচিত। এ ছাড়া অ্যানিমিয়ার রোগীদেরও শরীর ক্লান্ত তাকে। ফলে তাঁরাও ঘুমিয়ে পড়তে পারেন সামান্য অবসরল পেলেই।

তা হলে কি ট্রেনে-বাসে ঘুমের শারীরিক আরামজনিত  কারণের সঙ্গে অন্য কোনও মানসিক কারণও কাজ করে?
মনস্তত্ত্ববিদ জয়রঞ্জন রামের মতে, তা একেবারেই নয়। তিনি মনে করেন, ঘুম মানুষের শারীরিক ক্লান্তির উপরই নির্ভর করে। কতটুকু প্রয়োজন আর কতটুকু জুটছে এই অঙ্কই এখানে প্রধান। তবে অনেকেই ঘুম নিয়ে খুঁতখুঁতে হন, যেখানে-সেখানে ঘুমোতে পারেন না। সে সব পছন্দকে মানসিক অসুখের পর্যায়ে ফেলা যায় না। কিন্তু এই পছন্দ-অপছন্দের বাড়াবাড়ি ঘটলে তাকেও এড়ানো উচিত নয়।

তাই ট্রেনে-বাসে যদি ঘুমোন তবে খেয়াল রাখুন শরীরে ঘুমের চাহিদা আদৌ মেটেনি বলেই কি এমন হচ্ছে? তা হলে কিন্তু দ্রুত পরামর্শ নিন চিকিৎসকদের।


সূত্রঃ-আনন্দবাজার পত্রিকা
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status