প্রথম পাতা

সিলেটের ভোটে ৫ ইস্যু

রোকনুজ্জামান পিয়াস, সিলেট থেকে

২৩ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন

খাল দখল, জলাবদ্ধতা, পানি সংকট, যানজট আর হকার- এই পাঁচ নাগরিক সমস্যাই প্রধান ইস্যু সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। প্রতিবারই নির্বাচন এলে এই ইস্যুগুলো সামনে আসে। নাগরিকরা দাবি তোলেন ভবিষ্যৎ নগরপিতার কাছে সমাধানের। প্রার্থীরাও তাই কৌশল হিসেবে বেছে নেন এগুলোই। প্রতিশ্রুতি দেন সমাধানের। কিন্তু নির্বাচনের পরই এক অদৃশ্য কারণে তারা ভুলতে বসেন। এ নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও কিছুই করার থাকে না অসহায় নগরবাসীর। আবারো অপেক্ষা করতে হয়। তাকিয়ে থাকতে হয় পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত। তবে গত মেয়াদের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এসব সমস্যার দিকে কিছুটা হলেও নজর দিয়েছেন।

পুরোপুরি না হলেও আংশিক সমস্যার সমাধান করেছেন। এমন দাবি করে এবারের নির্বাচনী প্রচারণায়ও ইস্যুটি কাজে লাগাচ্ছেন। বলছেন, তিনি দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকায় সব সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। আরেকবার নির্বাচিত হলে আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েই ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন তিনি। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদর উদ্দিন কামরান বলছেন, তিনি শুরু থেকেই এই মহানগরীর নাগরিক সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়ের ব্যবস্থাও করেন তিনি। তবে সময় স্বল্পতার কারণে সমস্যার সমাধানে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেননি। এবার নির্বাচিত হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ সমস্যাগুলোই আগে দেখবেন। সিলেটের সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিকরা বলছেন, নগরীর এ সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। অতীতে এসব সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ভোটে জয়ী হয়েছেন প্রার্থীরা। তারা বলেন, নগরপিতা যেই হন কেন, তার কাছেই দাবি- সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার। মেয়র নিজেও এই সুবিধাভোগী। এ নগর তারও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীর সীমানার মধ্যে রয়েছে ২৫টি ছড়া ও খাল। পাহাড় থেকে প্রবাহিত ছড়া ও খালগুলো মিলেছে সুরমা নদীতে। এক সময় এসব ছড়া ও খালের পানিই স্থানীয়রা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতেন। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি ছড়া ও খাল দিয়েই নিষ্কাশিত হতো। নৌকাও চলাচল করত। তবে দখল ও ভরাটের কারণে এখন এগুলোর অস্তিত্বই বিলীন। যার কারণে নগরীতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে ২০০৯ সালে নগরীর ছড়া ও খাল উদ্ধারে ১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।

একই কাজের জন্য ২০১৩ সালে ২০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ওই সময় বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতিও কেনা হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরও নগরবাসী তেমন সুবিধা পায়নি। পরবর্তীতে গত মেয়াদে আরিফুল হক চৌধুরী নগরপিতার দায়িত্ব নেয়ার পর ২৫০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেন। ওই টাকা দিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি ছড়া ও খাল দখলমুক্ত প্রক্রিয়া শুরু  করেন। যা এখনো চলমান। এই অবস্থায় জলাবদ্ধতা অনেকটা কমেছে। এখন আর আগের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টির পানি জমে থাকে না। তবে যতক্ষণ বৃষ্টি স্থায়ী ততক্ষণ জলাবদ্ধাতার সৃষ্টি হয়। বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি নেমে যায়। নগরীকে পুরোপুরি জলাবদ্ধতামুক্ত করতে চলমান প্রকল্প সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

সিলেটে নাগরিক সমস্যার আরেকটি হলো যানজট। যানজটের চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি কর্তৃপক্ষ। কারণগুলো হচ্ছে- অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, অবৈধ রিকশা ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার গাড়ির অবাধে চলাচল, শহরের ভেতরের সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোর নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা এবং ট্রাফিক আইন মেনে না চলা। নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, নয়াসড়ক, শিবগঞ্জ, মীরাবাজার, আম্বরখানা, বাদামবাগিচা, বড়বাজার, তালতলা, কালীঘাট, ছড়ারপার, লালদিঘিরপাড়, লামাবাজার, জলারপার, মির্জাজাঙ্গাল, কিনব্রিজ, সুরমা মার্কেট, সুবিদবাজার, মীরের ময়দান, জেলরোড, বারুতখানা, শাহী ঈদগাহ, সাপ্লাই রোড ও সোবহানীঘাট এলাকায় প্রতিদিনই যানজট ভয়াবহ রূপ নেয়।

এসব এলাকায় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। সূত্র জানায়, নগরে প্রায় অর্ধলাখ বৈধ রিকশা চলাচল করে। এ ছাড়া আরো ৫০ হাজার রিকশা অবৈধভাবে চলাচল করছে। অবৈধ এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে যানজট কিছুটা হলেও কমবে। বিগত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী যানজটের এই সমাধানেও হাত দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে নগরীর প্রধান সড়কগুলো প্রশস্ত করেছেন। তবে নগরীর ভেতরে বেশকিছু সড়ক আগের মতোই রয়ে গেছে। সেগুলোর কোনোটির কাজ চলমান রয়েছে। নগরবাসী বলছে, যনজটের প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে আন্তরিক হলে ভবিষ্যতে এ দুর্ভোগ থাকবে না। অন্যথায় আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

নগরীর আরেক প্রধান সমস্যা ফুটপাথের হকার। সিলেটের সুরমা পয়েন্ট থেকে জিন্দাবাজার পর্যন্ত হকারদের আধিপত্য। তাদের দখলে থাকার কারণে এসব এলাকার ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে চলা মুশকিল হয়ে পড়ে। যানজটেরও আরেকটা কারণ এই হকাররা। দক্ষিণ সুরমার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ সবক’টি উপ-সড়ক পুরোটাই হকারদের দখলে। একই অবস্থা সিলেটের উত্তর সুরমায়। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে সিলেট নগরীর সুরমা মার্কেটের সামনে থেকে একদিকে ধোপাদিঘীরপাড়, অপরদিকে সুরমা মার্কেট থেকে চৌহাট্টা এয়ারপোর্ট রোড পর্যন্ত কয়েক হাজার হকারের দখলে।

জেলা পরিষদ, আদালতপাড়া, জেলা প্রশাসকের অফিস ও বাসভবন, এসপি অফিস, প্রধান ডাকঘরের সামনে পর্যন্ত হকাররা তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। ফুটপাথকে হকারমুক্ত রাখতে বিভিন্ন সময়ে নগরপিতার দায়িত্ব পালন করা মেয়ররা নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু কেউ সফল হননি। এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে। গত মেয়াদের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদে বেশকিছু উদ্যোগ নেন। গত সিটি নির্বাচনে পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। নগরী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও যানজটমুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নোটিশ দেন তিনি।

নোটিশের দু’দিনের মাথায় তিনি নিজে উচ্ছেদ অভিযানে নামেন। তবে তার এই উদ্যোগ মেনে নিতে পারেননি ফুটপাথ নিয়ে বাণিজ্যকারীরা। চাপের মুখে পড়েন আরিফ। একপক্ষ আরিফের এই কাজকে সাধুবাদ জানালেও অপরপক্ষ বিরোধিতা করে। এবার নির্বাচনে সেই পক্ষের ভোট বঞ্চিত হবেন বলে অনেকের ধারণা। বর্তমান সিলেট সিটির ফুটপাথ অনেকটাই হকারদের দখলে।
সিলেটে পানির সংকট রয়েছে। গত শুক্রবারও নগরীর লোহারপাড়া এলাকায় পানি সংকটের প্রতিবাদে বিক্ষেভ করেছে ভুক্তভোগীরা। নগরীর তোপখানা এলাকায়ও কয়েকদিন আগেই একই দাবিতে বিক্ষোভ করে এলাকাবাসী। এর আগে একাধিক মেয়র এ ব্যাপারে নানা উদ্যোগ নিয়েও সংকট সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন।

নগরের অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতার ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, সিলেট মহানগরীর জলাবদ্ধতা আগের তুলনায় উন্নতি হয়েছে। গত নির্বাচনে প্রার্থীরা যেমন পানি মাড়িয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, এবার বৃষ্টির মৌসুমে তেমনটা দেখা যায়নি। তিনি বলেন, এবার জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি মানে এটা না যে, একেবারেই নিরসন হয়ে গেছে। বরং সাময়িক সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার মূল কারণ যে খালগুলো সেগুলো এখনো পুরোপুরি দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে জলাবদ্ধতা একবারেই নির্মূল করা সম্ভব হবে। আংশিক এই সফলতার জন্য আবদুল করিম মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আন্তরিকতার পাশাপাশি সরকারে সার্বিক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন। বিশেষ করে বলেন অর্থমন্ত্রীর ভূমিকার কথা। তিনি বলেন, দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠে সমস্যা সমাধানের এমন নজির প্রশংসনীয়।

চলমান নাগরিক সমস্যা এবং তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সিলেট সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সিলেটে নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি দেন। তারা নির্বাচিতও হন। কিন্তু মেয়াদ শেষে দেখা যায়, তেমন কিছুই হয়নি। তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রচারণার সময় তারা যদি তার মেয়াদের উন্নয়নমূলক কাজের চিত্র তুলে ধরেন তাহলে ভোটারদের বুঝতে সুবিধা হয়। ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে দরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আন্তরিকতা। আন্তরিকতা থাকলেই কেবল একটি আধুনিক নগরী গড়ে তোলা সম্ভব।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে নগরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ফুটপাথে হকার, যানজট, পানির সংকট। ফারুক বলেন, যানজট মুক্ত করতে সিটি করপোরেশনের একার উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এখানে বিআরটিএ-এর ভূমিকা আছে। সবার সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করতে হবে। সিলেট সুজন সভাপতি বলেন, অনেকে অবাস্তব কিছু প্রতিশ্রুতি দেয়। যেটা তার আওতার বাইরে। যেমন অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী গ্যাস সমস্যার সমাধানের কথা বলেন। এ সমস্যা সমাধানে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর সেখানে কোনো ভূমিকা নেই। সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধি বলেন, প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে সমস্যাগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিশ্রুতিতে যদি তারা একটা সময় উল্লেখ করে দিতেন তাহলে পরবর্তীতে জবাবদিহিতা থাকতো। তিনি বলেন, আমরা নগরবাসী একটি বাসযোগ্য নগরী চাই। সিলেটকে ডিজিটাল সিটি করপোরেশন হিসেবে দেখতে চাই। যেন নগরবাসী ঘরে বসে তাদের সেবা নিতে পারেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status