প্রথম পাতা

ফল বিপর্যয় নিয়ে শিক্ষাবিদগণ

লিখলেই নাম্বার দিতে হবে এ প্রবণতা থেকে বের হওয়ার সুফল

স্টাফ রিপোর্টার

২১ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের ফলাফলে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা গত তিন বছরের প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। পাসের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার কমেছে প্রায় আড়াই শতাংশ। আর জিপিএ-ফাইভ পাওয়ার হারও কমে গেছে প্রায় নয় হাজার। গত তিন বছর ধরে পাসের হারও জিপিএ’র ক্ষেত্রে একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর চলতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে গত দশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটা কি ফল বিপর্যয় নাকি শিক্ষার মান ফেরানোর উদ্যোগ। এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাঝে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেশি পাস  দেখিয়ে দেশে শিক্ষার মান বেড়ে গেছে এ ধারণা থেকে সরকার বের হতে চায়। বেশি পাস ও জিপিএ-৫ পাওয়া মানেই মানসম্মত শিক্ষার মাপকাঠি নয়, এটা সরকার বুঝেছে। আর টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে মানসম্মত  শিক্ষার বিকল্প নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাসের হার বাড়া নিয়ে সব মহলের উদ্বেগ ছিল। এর সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য হয়ে উঠেছিল বড় দুশ্চিন্তার কারণ। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ১৭টি বিষয়ের মধ্যে ১২টির এমসিকিউ অংশের প্রশ্নফাঁস হয়েছিল বলে সরকারের তদন্ত কমিটি প্রমাণ পায়। এই প্রেক্ষাপটে কঠোর সমালোচনার মুখে এবার উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা  ঢেলে সাজায় সরকার। প্রশ্নফাঁসের কোনো অভিযোগ ছাড়াই  শেষ হয় পরীক্ষা।

এটি সরকারের বড় অর্জন মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ৬টি কৌশলে এটি রোধ করতে পেরেছি। সামনে পরীক্ষাগুলোতে আরও কিছু কৌশল প্রয়োগ করা হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার মান বাড়াতে যা যা করার দরকার সবই করা হবে। পরীক্ষা পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সামনে আরও পরিবর্তন আসবে।
শিক্ষা গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান বলেন, খাতায় লিখলেই নম্বর দিতে হবে- যে প্রবণতা এতদিন ছিল তা থেকে সরকার বের হতে চায়। তারই অংশ হিসেবে তিনবছর ধরে খাতা মূল্যায়নে বেশকিছু পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বলেন, বেশি পাস দেখালেই দেশের শিক্ষার মান বেড়ে গেছে এ প্রবণতা ঠিক না তা সরকার বুঝতে পেরেছে। গত তিন বছরে সরকার সে ট্রেন্ড থেকে কিছুটা সরে এসেছে। এটা ভালো দিক। আর এর সুফলই হচ্ছে এবারের রেজাল্ট।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, শিক্ষার গুণগত মান ছাড়া বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব না এটা সরকারের নীতি নির্ধারকরা বুঝতে পেরেছে। এটা খুবই পজিটিভ দিক। তিনি বলেন, শিক্ষার মান উন্নয়নে ‘ইউনিট-বেইজড’ কাজ করছে সরকার। উত্তরপত্র মূল্যায়নে নির্দেশনার পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে এখন আগের চেয়ে ‘ভালোভাবে’ উত্তরপত্র মূল্যায়ন হচ্ছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে।  

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পাসের হার যেভাবে বাড়ছিল তা নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ ছিল। আর পরীক্ষার মার্কিংও খুব সহজভাবে হচ্ছিল। কারণ একটা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে  বেড়ে যাওয়া এক জিনিস, আর নানা ধরনের গলদের কারণে ফলাফল হওয়া আরেক জিনিস। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নতি হওয়ায় এবার উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হারে এই পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মানসম্পন্ন শিক্ষার চ্যালেঞ্জ এখন অন্যতম। শুধু পাসের হার নিয়ে নয়, শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনা, শিক্ষকদের মান- এসব সূচকও দেখতে হবে।  

নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, পাসের হার কমে যাওয়া ‘স্বাভাবিক ও ইতিবাচক’ প্রবণতা। গত কয়েক বছরে যে প্রশ্নফাঁসের কালচার গড়ে উঠেছিল এ বছর তার ব্যতিক্রম ঘটলো। আর তিনবছর ধরে খাতার মূল্যায়নও ভালো হচ্ছে। এই যে রেজাল্ট, আমি মনে করি এটাই বাস্তবসম্মত রেজাল্ট। স্বচ্ছ পরীক্ষা এবং স্বচ্ছ তার ফলাফল। স্টুডেন্টরা এভাবেই বুঝতে পারবে  লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক মানবজমিনকে বলেন, সার্বিকভাবে ফলাফলে আমরা সন্তুষ্ট। আমরাযে একটা গুণগত পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছি- এটা তার একটা সূচনা। চলতি বছর পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় কঠিন, প্রশ্নফাঁসমুক্ত পরীক্ষা ও খাতা মূল্যায়নে শিথিলতা প্রতিহারও এবার ফলাফল খারাপ হওয়ার কারণ। কিন্তু পরীক্ষায় শৃঙ্খলা ফিরেছে। শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে ফিরেছে। না পড়েও বিকল্প পদ্ধতিতে পাস বা ভালো ফলাফল করার দিন শেষ হয়েছে এটা সবাই বুঝেছে। এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল এবং সেটি করতে অনেকটা সক্ষম হয়েছি।

মাদ্‌রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর একেএম ছায়েফ উল্যা মানবজমিনকে বলেন, এবার পরীক্ষায় পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি ছিল না। শতভাগ প্রশ্নফাঁসমুক্ত পরীক্ষায় হয়েছে। পরীক্ষকদের খাতা দেখায় কোনো ধরনের গাফিলতি সহ্য করা হবে না বলে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে কঠোর একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে পরীক্ষা হওয়ায় এর কিছু প্রভাব ফলাফলে এসে পড়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। শিক্ষার মান নিয়ে যে প্রশ্ন আছে তা আস্তে আস্তে চলে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

পরীক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার যেসব উদ্যোগ নেয়ার ফলে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধন, মুদ্রণ, প্যাকেটজাতকরণ, ট্রাংকজাতকরণ ও কেন্দ্রে পাঠানোসহ প্রতিটি স্তরেই কঠোর নজরদারি, সতর্কতা। এছাড়াও পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের আসনগ্রহণ বাধ্যতামূলক, পরীক্ষার দিন ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্রের সব সেট পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে আনা, ট্রেজারি থেকে পুলিশসহ তিনজন কর্মকর্তার মাধ্যমে কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছানো, পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে এসএমএস’র মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে সেট কোড পাঠানো, বিশেষ নিরাপত্তা খামে প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ করা এবং পরীক্ষা চলাকালীন পুলিশসহ র‌্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, মাঠ প্রশাসনের ভিজিল্যান্স টিমের কঠোর নজরদারি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status