বাংলারজমিন

পাবনায় বাদাম চাষে সচ্ছলতা

রাজিউর রহমান রুমী, পাবনা থেকে

২১ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

পাবনায় লাভজনক হওয়ায় চিনাবাদাম আবাদ করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন চাষিরা। ফলে ব্যাপকহারে চিনাবাদাম চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। পদ্মা ও যমুনা নদীসংলগ্ন জেলা পাবনা। জেলায় রয়েছে বিশাল বিশাল চর। এসব চর বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। জেলার পাবনা সদর, সুজানগর, ঈশ্বরদী, বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ চিনাবাদাম আবাদ করে পরিবারে সচ্ছলতা এনেছেন। জেলার চরাঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, কৃষক-কৃষাণীরা পরিবারের ছোট-বড় সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মনের আনন্দে গাছ থেকে চিনাবাদাম সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাবনার চরাঞ্চলের মাটি বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বাদাম চাষ। গেল বছর রবি মৌসুমে জেলায় ১৫৫৪ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। এ বছর রবি মৌসুমে জেলার পাঁচ উপজেলায় ১৪৫৪ হেক্টর জমিতে বাদাম আবাদের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে ১৮৭১ হেক্টর জমিতে বাদম আবাদ হয়েছে। সব চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে বেড়া উপজেলায়। এ উপজেলায় ১১৫৫ হেক্টর জমিতে বাদাম আবাদ হয়েছে। এছাড়াও পাবনা সদর উপজেলায় ২০০, সুজানগরে ৩৫০, ঈশ্বরদীতে ১৫৬ ও সাঁথিয়া উপজেলায় ১০ হেক্টার জমিতে বাদাম আবাদ হয়েছে। বাদাম চাষিরা জানান, প্রতি বছর বর্ষার পানিতে চরাঞ্চলে বাদাম ক্ষেত তলিয়ে যায়। সেজন্য একটু আগে-ভাগেই বাদম রোপণ করা হয় যাতে করে পানি আসার আগেই বাদাম ক্ষেত থেকে তোলা যায়। সাধারণত আষাঢ় মাসের মধ্যেই বাদাম তোলা শেষ হয়ে থাকে। পাবনা সদর উপজেলার শুকচর, দাসপাড়া, নতুন গোহাইলবাড়ী এলাকার বেশ কয়েকজন বাদাম চাষি বলেন, গত কয়েক বছর যাবত চিনাবাদাম চাষ করছে তারা। বাদাম লাগানোর ৯০ দিনের মধ্যে তা তোলা শুরু হয়। প্রতি বিঘায় ১০ থেকে ১৫ মন বাদাম পাওয়া যায়। লাভের অঙ্ক ভালো হওয়ায় দিন দিন বাদাম আবাদের পরিধিও বাড়ছে।
কৃষকেরা আরো বলেন, বাদাম চাষে ভালো ফলনের সাথে অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়েছে তারা। যে কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর আরও বেশি জমিতে চিনাবাদাম চাষ করেছে তারা। সদর উপজেলার শুকচর গ্রামের বাদাম চাষি আলাল শেখ জানান, বাদাম আবাদে ভালো সাফল্য পেয়েছেন, স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাবনা সদর উপজেলার আশুতোষপুর চরের কৃষক আজগর আলী জানান, তিনি এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে বাদাম আবাদ করেছিলেন। এ বছর বাদামের বাম্পার ফলন পেয়েছেন। পাঁচ বিঘা জমির বাদাম তুলে পাওয়া গেছে ১২০ মণ। রোদে শুকানোর পর তিনি পেয়েছেন মোট ৮২ মণ। অন্যান্য ফসল আবাদের চেয়ে বাদাম আবাদে পরিশ্রম ও খরচ অনেক কম হওয়ায় লাভ পেয়েছে বেশ ভালো। শুধু কৃষক মহাম্মদ আলী নয়, কৃষক আকবর আলী, মিয়া চাঁদ, সাগর সরকারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ বছর তারা বাদাম আবাদ করে ভালো ফলন ও দাম পেয়েছেন।
সুজানগর উপজেলার শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের কৃষক জুয়েল মৃধা জানান, তিনি এ বছর ৫ বিঘা জমিতে ঢাকা-১ জাতের বাদাম আবাদ করেছেন, প্রতি বিঘা জমিতে ফলন হয়েছে প্রায় ১১-১২ মণ যা, অন্য বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তাছাড়া বর্তমানে হাট-বাজারে চিনাবাদমের দামও বেশ ভালো। ভায়না গ্রামের কৃষক আব্দুর রউফ জানান, প্রতি বিঘা জমিতে চিনাবাদাম আবাদ করতে সার, বীজ ও শ্রমিকসহ উৎপাদন খরচ হয় প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা, বর্তমান বাজার মূল্যে প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদিত চিনাবাদামের মূল্য প্রায় ২৫০০০-২৬০০০ টাকা যা, উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় ১৮ হাজার টাকার বেশি। ফলে চিনাবাদাম চাষিরা বর্তমান বাজার দরে ভীষণ খুশি। বেড়া উপজেলার চরপেচাকোলা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কৃষকেরা জমি থেকে বাদাম তুলছেন। কৃষাণি ও কিশোর-কিশোরীরা গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে স্তূপ করে রাখছে। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা জমি থেকে বাদাম হাটে নিয়ে বিক্রি করছে। বিত্তবান চাষিরা বাদাম শুকিয়ে গোলাজাত করে রাখছেন। স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক বললেন, বাদাম চাষ করে চরাঞ্চলের কয়েক হাজার কৃষক পরিবারে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা। দূর হয়েছে তাদের নিত্য অভাব-অনটন। মলিন মুখে ফুটেছে হাসি। আর এই বাদাম চাষকে ঘিরে বেড়া উপজেলার নাকালিয়া ও নগরবাড়িতে গড়ে উঠেছে বাদাম বিক্রির পাইকারি মোকাম এবং বাদাম কারখানা। প্রতিদিন চরের কৃষকরা নৌকায় করে নাকালিয়া ও নগরবাড়ি মোকামে বাদাম বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাদাম ব্যবসায়ীরা বাদাম কেনার জন্য এই মোকামে আসছেন। বাদাম কেনাবেচার জন্য দু’টি মোকাম ২০-২২টি আড়ত গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় আড়তদারের মাধ্যমে বাদাম কিনে এখান থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু বড় ব্যবসায়ী বাদাম কিনে মেশিনে খোসা ছাড়িয়ে সরবরাহ করছে দেশের বড় বড় কারখানাগুলোতে। কাশিনাথপুর বাজারের পাইকারি বিক্রেতা ইদ্রিস আলী বলেন, তিনি নগরবাড়ি মোকাম থেকে বাদাম কিনে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকেন। তিনি এই ব্যবসা করে আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। তার মতো অনেকে নগরবাড়ি ও নাকালিয়ে মোকাম থেকে বাদাম কিনে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে তার মতো স্বাবলম্বী হয়েছে।

ঢাকার বাদাম ব্যবসায়ী আজাহার জানান, গুনগত মান ভাল হওয়ায় এ অঞ্চলের বাদামের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তিনি নগরবাড়ি ও নাকালিয়ায় হাট থেকে বাদাম কিনে আড়তদারের গুদামে রাখেন। পরে আড়ত থেকে নৌপথে বাদাম ঢাকা নিয়ে বিভিন্ন চানাচুর তৈরির কারখানায় পাইকারি সরবরাহ করেন। এই ভাবে তিনি প্রতি সপ্তাহে ৫শ’ থেকে এক হাজার মন বাদাম ঢাকায় পাঠান। পাবনা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক বিভূতি ভূষণ সরকার বলেন, পাবনা জেলার চরাঞ্চলের মাটি বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কৃষি বিভাগের কর্মীরা সব সময় কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পরার্মশ দিয়ে থাকে। উন্নত উন্নত জাতের বাদ চাষে উদ্ভুদ্ধ করা হচ্ছে। বাদাম চাষে লাভ হওয়ায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এ অঞ্চলে বাদম চাষ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status