শেষের পাতা

অছাত্রদের হাতেই যাচ্ছে ছাত্রদলের নেতৃত্ব

কাফি কামাল

২০ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ১০:১২ পূর্বাহ্ন

বিএনপি’র সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে তোলপাড় চলছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। যেখানেই অনুমোদন দেয়া হচ্ছে নতুন কমিটি সেখানেই নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। অভিযোগ উঠেছে, দলের সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর এ উদ্যোগকে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ করে তুলেছে অর্থ উপার্জনের উপলক্ষ।

বিএনপি’র নানা জেলা ও মহানগরের কতিপয় নেতার কাছে সুবিধা নিয়ে তাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে পকেট কমিটি। বড় অংকের টাকার বিনিময়ে অচেনা এবং নিষ্ক্রিয়রাও হাসিল করে নিচ্ছেন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ। সংগঠনের যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের পাশ কাটিয়ে নেতৃত্বের ব্যাটন তুলে দেয়া হচ্ছে অছাত্র, বিবাহিত, বিতর্কিত, নিষ্ক্রিয় ও সরকার দলীয় নেতাদের আত্মীয়-স্বজনদের হাতে। ফলে যে উদ্দেশে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা মুখ থুবড়ে পড়ছে সবখানে।

একের পর এক জেলা ও মহানগরে পদত্যাগ-প্রত্যাখ্যান, বিক্ষোভ-ভাঙচুরের পাশাপাশি ত্যাগীদের বঞ্চিত করায় দলের ভেতরে বইছে উত্তাপ। এদিকে সংগঠনকে গতিশীল করতে যেখানে জেলা ও মহানগর কমিটি পুনর্গঠন চলছে সেখানে খোদ কেন্দ্রীয় কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে দুই বছর আগে। ২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই বছরের জন্য ২০১ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার দুই বছর পরও তাদের নেতৃত্বেই চলছে ছাত্রদল। সংগঠনটির শীর্ষ তিন নেতা ইতিমধ্যে বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত হয়েছেন। আগামীতে তারা জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এলাকায় প্রচারণাও শুরু করেছেন।  

সর্বশেষ ১৮ই জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখাসহ ১০টি ইউনিটের আংশিক কমিটি অনুমোদন করেছে ছাত্রদল। ছাত্রদলের প্রতিটি ইউনিট গঠনের পরপরই উঠেছে নানা অভিযোগ। কিন্তু এবারের অভিযোগ ব্যতিক্রম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের ৫ সদস্য বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস কমিটির তিনজনের বিরুদ্ধেই উঠেছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন সাইফুল ইসলাম বাদশা। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখলেও ক্যাম্পাসের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক নেই তার। ক্যাম্পাসে তাই স্বাভাবিকভাবে তার কোনো কর্মী-সমর্থকও নেই।

কিন্তু তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে দায়েরকৃত একটি মামলায় চার্জশিটভুক্ত একজন আসামি। ২০১৭ সালের ৮ই অক্টোবর হাজারীবাগ থানায় দায়েরকৃত ওই মামলায় তিনি ৮ নম্বর আসামি। প্রস্তাবিত কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদে তার নাম উল্লেখ করা হলে মামলার কারণে মেডিকেলের সিনিয়র ছাত্রনেতারা তার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সে বিরোধিতা আমলেই নেয়া হয়নি। অন্যদিকে সিনিয়র সহ-সভাপতি হাসেমী রাফসান ও সাংগঠনিক সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম দুইজনই বর্তমানে অছাত্র।

ঢাকা মেডিকেল থেকে একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে তারা ইতিমধ্যে যোগ দিয়েছেন চিকিৎসা পেশায়। পেশাগত চর্চার পাশাপাশি তারা এখন বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে সেখানে তাদের কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। তার ওপর সিনিয়র সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে রয়েছে আরেকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটে বিবাহিত ইস্যুতে যখন সাংগঠনিকভাবে দক্ষ অনেক ছাত্রনেতাকে বাদ দেয়া হয়েছে সেখানে বিবাহিত হলেও পদে পেতে সমস্যা হয়নি ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার নতুন সিনিয়র সহ-সভাপতির।

বিগত এক বছর ধরে বিবাহের মাধ্যমে সংসার জীবন-যাপন করছেন তিনি। প্রস্তাবিত কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সহ-সভাপতি পদে উল্লেখ ছিল মাকসুদুর রহমান শাহীন, মইনউদ্দিন শরিফ, সেলিম রায়হান, অনিকসহ কয়েকজনের নাম। একইভাবে সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে রাসেল ঢালী ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আবদুল্লাহ আর রায়হানের নাম প্রস্তাব ছিল। এমনকি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের রাজনীতিকে সক্রিয় করতে প্রথম থেকে তৃতীয়বর্ষে অধ্যয়নরত অনেকের নামও বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে তার নাম নেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার ছাত্রদলের একাধিক নেতাকর্মী জানান, সামপ্রতিক বছরগুলোতে দলীয় কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে নিবেদিত ছিলেন ইয়াসিন আরাফাত বিপুল। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালের ২৬শে জানুয়ারি ডা. ফজলে রাব্বি হলে ধরে নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছিল। আড়াই মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। পায়ে ফ্র্যাকচারের কারণে তিনি এখনও ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের প্রস্তাবিত কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদে ছিল তার নাম। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক পদ পেয়েছেন তিনি। এ পদে পদায়নের মাধ্যমে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে সামপ্রতিক বছরগুলোতে দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা ও কর্মীবান্ধব আচরণের মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সবচেয়ে সক্রিয় ও জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হয়ে উঠেছিলেন আবদুল্লাহ আর রায়হান। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে কোথাও নেই তার নাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জানান- অছাত্র, বিবাহিত, নিষ্ক্রিয়, বিতর্কিত, প্রশ্নপত্র ফাঁস মামলার আসামির সমন্বয়ে একটি আজগুবি কমিটি গঠন করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

এ ধরনের আজগুবি কমিটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইতিহাসে আর হয়নি। বিশেষ কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য এ কমিটি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের রাজনীতিকে সক্রিয় করতে বা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো কাজে আসবে না। রাফসান ও মঞ্জুরুলের মতো পড়াশোনা শেষে পেশায় যোগ দেয়া চিকিৎসকদের মাধ্যমে ছাত্রদলের কমিটি করতে চাইলে অন্তত ৪০-৫০ জন নতুন চিকিৎসক রয়েছেন যারা মেডিকেল কলেজ শাখার নেতৃত্বে আসতে পারতেন।

এর আগে ১৩ই জুন সিলেট জেলার ২৮ সদস্যবিশিষ্ট ও মহানগরের ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু কমিটি ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘোষিত কমিটিকে ‘ভারসাম্যহীন’ আখ্যায়িত করে দলের যোগ্য ও ত্যাগীদের বঞ্চিত করে অছাত্র, বিবাহিত, ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও অযোগ্যদের দিয়ে কমিটি গঠনের প্রতিবাদে জেলা ও মহানগর শাখার নবগঠিত কমিটিরই ৯ নেতা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে ১৪ই জুন ঝাড়ু মিছিল করেছে বিক্ষুদ্ধ একটি অংশ।

পদত্যাগকারী ৯ নেতাকে দ্বন্দ্ব নিরসনে ১৫ই জুলাই ঢাকায় তলব করে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব আলোচনা করলেও তারা তাদের প্রতিবাদ থেকে সরে দাঁড়াননি। একইভাবে ৮ই জুন কমিটি গঠনের পর তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে পরদিন পদত্যাগ করেন বাগেরহাট জেলা ছাত্রদলের ২ নেতা। পাশাপাশি পকেট কমিটি গঠনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে তারা জেলা বিএনপি’র সভাপতি এমএ সালামের কুশপুত্তলিকাও দাহ করেন। মানিকগঞ্জে ছাত্রদলের কমিটি গঠনে অগ্রাহ্য করা হয়েছে জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতামত। কমিটিতে পদবঞ্চিত এক নেতা মোবাইল মেসেজ পাঠিয়ে ছাত্রদলের শীর্ষ এক নেতার কাছে টাকা ফেরত চেয়েছেন।

ওদিকে ৬ই জুন সুনামগঞ্জ জেলা কমিটি গঠনের ৭ ঘণ্টার মাথায় ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের সুনামগঞ্জে গিয়ে আন্দোলন করার আমন্ত্রণ’ জানিয়ে পদত্যাগ করেন নতুন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আজিজুর রহমান সৌরভ। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর ৬ই জুন বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বিক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত নেতাকর্মীরা।

নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিপক্ষে ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে অছাত্র, অযোগ্য, অচেনা ও আওয়ামী লীগের এজেন্টদের দিয়ে কমিটি কিনে নেয়ার অভিযোগ তুলে। বিক্ষোভকারীরা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের ছবি পুড়িয়ে তাদের বিপক্ষে জুতো ও ঝাড়ু মিছিল করেন। তারা অভিযোগ করেন- এমন একজনকে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি বানানো হয়েছে তার দুই মামাতো ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি এবং মামা স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।

একইভাবে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর ৬ই জুন সংগঠনের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে জুতো ও ঝাড়ু মিছিল করে দলের পদবঞ্চিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা। ঘোষিত কমিটিতে কাঙিক্ষত পদ না পেয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ১১ জন। সেখানে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা পকেট কমিটি গঠনে কুমিল্লার সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তোলেন।

এছাড়া ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে নড়াইল ও রাজবাড়ীতে ১৪ই জুন বিক্ষোভ মিছিল ও দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। এসব কমিটি নিয়েই ত্যাগী নেতাকর্মী ও পদ বঞ্চিতদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। দলের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে বিএনপি চেয়াপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যার আঁচড় পড়তে শুরু করেছে। লিখিত অভিযোগের স্তূপ জমছে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের টেবিলে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status