শেষের পাতা

আরিফকে সমর্থন জানিয়ে সরে দাঁড়ালেন সেলিম

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

২০ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী ও মহানগর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। একই সঙ্গে তিনি সমর্থন জানালেন বিএনপি’র সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে। গতকাল বিকালে মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর বাস ভবনে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এই সমর্থন জানালেন। আর এই সমর্থনের মধ্য দিয়ে সিলেট বিএনপি’র নেতাকর্মীরা তাদের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিলেন। এখন বাকি কেবল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতা। 

গতকাল বদরুজ্জামান সেলিমের বক্তব্যের আগে প্রেস ব্রিফিংয়ের পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ আমান জানালেন- ‘জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশা করি পজিটিভ ফলাফল আসবে।’ এদিকে- আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়র প্রার্থীর পদ থেকে বদরুজ্জামান সেলিম পদত্যাগের পর মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর বাসভবন থেকে বের হওয়া যানবাহনে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন আরিফুল হক চৌধুরী। শেষে তিনি সিলেটের রিটার্নিং অফিসার মো. আলিমুজ্জামানের কাছে গিয়ে পুলিশের বাড়াবাড়ির বিষয়ে অভিযোগ দিয়ে এসেছেন। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান সিলেটে এসেছেন মঙ্গলবার রাতে। তিনি এসেই আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে প্রচারণায় নেমেছেন।

পাশাপাশি তিনি সিলেট বিএনপি’র ভেতরে মেয়র প্রার্থিতা নিয়ে দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই অবস্থায় বুধবার দুপুরে সিলেটে আসেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান আমন উল্লাহ আমান ও সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম। তারা দুইজন সিলেটে এসে পা ফেলার সঙ্গে বিএনপি’র ভেতরে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বুধবার রাত ১০ টার পর নগরীর শাহী ঈদগাহ্‌স্থ হাজারীবাগ আবাসিক এলাকায় বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিমের বাসায় যান তারা। তাদের সঙ্গে সেখানে যান সিলেট বিএনপি’র মনোনীত মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন বদরুজ্জামান সেলিমকে। এ সময় আমান উল্লাহ আমান ও নাজিম উদ্দিন আলম কথা বলেন- বদরুজ্জামান সেলিমের মা ও স্ত্রী এবং স্বজনদের সঙ্গে। সবার সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে কিছুটা মন গলে বদরুজ্জামান সেলিমের। তবে- রাতে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের স্পষ্ট কিছু জানাননি। চিন্তা করে তার সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানান।

ওদিকে- বৈঠকের পর রাতে বদরুজ্জামান সেলিমের বাসায় আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে দাওয়াতও খান কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। সকাল হতেই বদরুজ্জামান সেলিমকে নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয় সিলেটে। তিনি পদত্যাগ করছেন- বিএনপি’র তরফ থেকে এমন ঘোষণা দেয়া হয়। তবে- স্বাভাবিক নিয়মেই গতকাল সকালে নিজ বাসা থেকে বের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন আরিফুল হক চৌধুরী। দুপুরে তিনি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট সামসুজ্জামান জামানকে সঙ্গে নিয়ে নগরীর মীরাবাজার, শিবগঞ্জ এলাকায় গণসংযোগ করেন। গণসংযোগের একপর্যায়ে দুপুর ১২ টার দিকে আরিফুল হক চৌধুরী হঠাৎ করে গাড়িতে উঠে চলে যান। তার গাড়ি গিয়ে থামে শাহী ঈদগাহ্‌স্থ হাজারীবাগ এলাকার বদরুজ্জামান সেলিমের বাসভবনে।

সিলেট বিএনপি’র নেতারা জানান- আরিফুল হক চৌধুরীর গাড়ি বদরুজ্জামান সেলিমের বাসায় পৌঁছার পরপরই সেখানে ছুটে যান বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা মো. শাহজাহান, আমান উল্লাহ আমান সহ সিলেটের নেতারা। সেখানে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ছিল। এ সময় মেয়র প্রার্থী আরিফ সহ সবাই বদরুজ্জামান সেলিম, তার মা এবং স্ত্রীকে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে আসেন নগরীর কুমারপাড়াস্থ আরিফুল হক চৌধুরীর বাসভবনে। সেখানে মা ও স্ত্রীর সামনে বদরুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি’র নেতারা। মোবাইল ফোনে কথা হয় ঢাকায় থাকা বিএনপি’র নেতাদের সঙ্গে। যখন আরিফুল হক চৌধুরীর বাসভবনে ওই বৈঠক চলছিল তখনই জরুরি সংবাদ সম্মেলনের জন্য ডাকা হয় সাংবাদিকদের।

আরিফের বাসায় উপস্থিত থাকা বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন- অনেকটা নাটকীয়ভাবে বদরুজ্জামান সেলিমকে তার বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সামনে দিয়ে নিয়ে আসা হয়। বদরুজ্জামান সেলিম বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর বাসায় এসে অঝোরে কাঁদেন। এবং তিনি তার জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। বলেন- এতে আমার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ সময় বিএনপি নেতারা তার পাশে থাকার আশ্বাস প্রদান করেন। পাশাপাশি পুনরায় সেলিমকে তার সাধারণ সম্পাদক পদটি ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেন তারা। প্রায় দুই ঘণ্টা পরিবারের সদস্যদের সম্মুখে বৈঠকের পর বদরুজ্জামান সেলিম কিছুটা স্বাভাবিক হন। এরপর তিনি মা, স্ত্রী ও শ্যালক এবং বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে করে নিয়ে হাজির হন সাংবাদিক সম্মেলনে।

তার আগে আরিফুল হক চৌধুরীর বাসার সামনে পুলিশের একটি গাড়ি অবস্থান নেয়। এতে করে সাংবাদিক সম্মেলনের আগেই কিছুটা উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে- বিকাল পৌনে ৩ টার দিকে পরিবারের সদস্য ও বিএনপি নেতাদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন বদরুজ্জামান সেলিম। তার ডানপাশে বসা ছিলেন বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ও বামপাশে তার মা, এরপর স্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে সেলিম বার বার চোখ মুছেন। তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

সংবাদ সম্মেলনটি প্রথমে পরিচালনা করেন সিলেট জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ। পরে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা নাজিম উদ্দিন আলমকে। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ভূমিকা বক্তব্য রাখেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ আমান। তিনি বলেন- সিলেটের আরিফ ও বদরুজ্জামান সেলিম দুইজনই পরীক্ষিত নেতা। দল আরিফকে মনোনয়ন দিয়েছে। মনোক্ষুণ্ন্ন হয়েছেন সেলিম। তিনিও প্রার্থী হয়েছেন। এই মূহূর্তে আমাদের মা বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। তিনিও বদরুজ্জামান সেলিমকে মেসেজ পাঠিয়েছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কথা বলেছেন। আমরা সবাই তার সঙ্গে আছি। এখন বদরুজ্জামান সেলিম তার সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন। পরে বক্তব্য রাখেন- বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন- ‘বদরুজ্জামান সেলিম আজ নিরাপত্তা চান।

তিনি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন। আমরা সবাই শঙ্কায়।’ তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন- ‘এ রকম উত্তাপ ছড়ালে হয় মরবো না হয় সিলেট থেকে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবো।’ পরে বক্তব্য রাখেন বদরুজ্জামান সেলিম। তিনি বলেন- কারাগার থেকে বেগম খালেদা জিয়া তাকে চিরকুট দিয়েছেন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাদের তিনজনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। এ সময় তিনি বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর হাতে ধানের শীষের একটি ছড়া তুলে দেন।

আরিফুল হক চৌধুরীও বদরুজ্জামান সেলিমকে জড়িয়ে ধরেন। তারা একে-অপরকে কোলাকুলি করেন। সমাপনী বক্তব্যে বিএনপি’র আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন- সিলেটের বিএনপিসহ ২০ দল এখন ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ। সুতরাং দমন-পীড়ন চালিয়ে লাভ নেই। সিলেটে বিজয় হবে ইনশাআল্লাহ্‌। তিনি বলেন- নেতাকর্মীরা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রয়েছেন।

সরকারের এই কূটকৌশলের জবাব সিলেটবাসী দেবে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুুল মুক্তাদীর, বিএনপি’র ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান ও নেজামে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আবদুর রকিব, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক, ডা. শাহরিয়ার হোসাইন, সাবেক এমপি কলম উদ্দিন মিলন, মহানগর বিএনপির সভাপতি মো. নাসিম হোসাইন, জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ, মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আজমল বখত সাদেক, বিএনপি নেতা মাহবুব চৌধুরী, ইমরান আহমদ চৌধুরী, জিয়াউল গণি আরেফিন জিল্লুর, মিফতা সিদ্দিকী, সালেহ আহমদ খসরু, রেজাউল করিম নাচন সহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনের পর বদরুজ্জামান সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের আরিফুল হক চৌধুরীর বাসভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আরিফের বাসার প্রধান ফটকের বাইরের গলির মুখে পুলিশ ব্যারিকেড বসায়। তারা গলি দিয়ে বের হওয়া প্রত্যেকটি যানবাহনে তল্লাশি চালায়। সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি মোশারফ হোসেন ও এয়ারপোর্ট থানার ওসি গৌসুল হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ দলের তৎপরতা দেখে ক্ষুব্ধ হন আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বাসার বাইরে এসে পুলিশের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন। একপর্যায়ে ওসি মোশারফ হোসেন জানান- উপরের নির্দেশে তারা কাজ করছেন। বাধা না দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ জানান আরিফুল হক চৌধুরীকে। এদিকে- বিকাল সাড়ে ৩ টার দিকে আরিফুল হক চৌধুরী পুলিশের আচরণের কথা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়ে আসেন। আরিফ বলেন- পুলিশ নির্বাচনের ১০ দিন আগেই এ রকম আচরণ করছে। এ কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status