বিশ্বজমিন

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধে জিতবে না কেউ

অনিম আরাফাত

২০ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

চীনা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, যুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ নয়। বিপক্ষ দলের এক হাজার সেনা হত্যা করতে হলে নিজ দলেরও প্রায় সমান সংখ্যক সেনা হারাতে হয়। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো যুদ্ধে যেই জিতুক না কেন প্রকৃতপক্ষে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বের এক নম্বর ও দুই নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, চীনের কাছে বাজার মুক্ত করে দিলে যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৮০ হাজার কোটি ডলার। চীনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, চীনের কাজ হচ্ছে যেভাবেই হোক পণ্য বিক্রি করা। চীনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, লাখ লাখ মানুষ বেকারে পরিণত হয়েছে।

এ বছরের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প টুইটারে বেশ দর্পের সঙ্গে বলেছিলেন, তার দেশ বাণিজ্য খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে। তাই, বাণিজ্য যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনবে এবং যুক্তরাষ্ট্র সে যুদ্ধে সহজেই জয়লাভ করবে। এখন সত্যি সত্যি তার বাহাদুরির পরীক্ষা দেয়ার সময় এসেছে। গত সপ্তাহে তিনি চীনের বিরুদ্ধে সরাসরি বাণিজ্য যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যের উপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ডনাল্ড ট্রাম্প চীনের সকল পণ্যের উপরে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে। এর জবাবে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের অযৌক্তিক শুল্ক আরোপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের উস্কে দেয়া এই বাণিজ্য যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কি? কে জয়লাভ করবে এ যুদ্ধে? উত্তর অত্যন্ত সহজ। একটি বাণিজ্যযুদ্ধে কেউই জিততে পারে না। এবং এর সঙ্গে শুরুতে বলা চীনা প্রবাদের দারুণ মিল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যে দেশই এ যুদ্ধে জিতুক না কেন উভয় দেশই ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। হিসাবটা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে কার এই যুদ্ধের ধাক্কা হজম করার ক্ষমতা বেশি!

এখন পর্যন্ত যতদূর দেখা গেছে ডনাল্ড ট্রাম্পের এ ধরনের হুমকি মূলত তার নতুন এক কৌশল। এক দেশকে হুমকি দিয়ে তিনি অন্য দেশ থেকে তার দাবি ও সে দেশে কম শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানি নিশ্চিত করেন। কিন্তু সমস্যা হলো কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোসহ যেসব দেশকে উদ্দেশ্য করে তিনি এ ধরনের হুমকি দেয়ার কৌশল ব্যবহার করেছেন সেসব দেশের কেউই তার দাবি পূরণের চেষ্টা করেনি। ডনাল্ড ট্রাম্প সফল হননি এ ক্ষেত্রে। তাই তিনি চীনের বিরুদ্ধে নতুন করে কঠোর অবস্থান নিয়ে তার বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোকে বুঝাতে চাইছেন যুক্তরাষ্ট্র এত সহজে ছাড় দেবে না। এরকম পরিস্থিতিতে চীনও বাণিজ্য ক্ষেত্রে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেও একজন ব্যবসায়ী। তিনি যা চান তা অন্যের থেকে জোর করে হলেও আদায় করে নেয়াই তার কাছে সফলতা। কিন্তু চীনের জন্য এই যুদ্ধটি বাণিজ্যের থেকে ও রাজনৈতিকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যিক ক্ষতির কথা খুব একটা ভাবাচ্ছে না চীনকে। চীনের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডনাল্ড ট্রাম্প শুধু চীনের উত্থান থামাতেই এ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেনি। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান শি জিনপিং-এর নেতৃত্বকে খাটো করা। মার্চে চীন তার সংবিধান পরিবর্তন করেছে। এ নিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে সমালোচনার ঝড়ও বয়ে গেছে সে সময়।
পশ্চিমা ও চীনের অনেক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ বাণিজ্য যুদ্ধে চীনের জয়লাভ করার সম্ভাবনা তেমন নেই। কিন্তু কোনো প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই ট্রাম্পের দাবি মেনে নেয়াও চীনের জন্য ভালো হবে না। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা একে তাদের দুর্বলতা হিসেবেই দেখছে। কিন্তু একইসঙ্গে এ যুদ্ধে ট্রাম্পকেও অনেক সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। তার দেশের গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। দেশের জনগণ, কংগ্রেসের দিকে তাকিয়েও তার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে চীন রাজনৈতিকভাবে নিজ দেশে অত্যন্ত শক্তিশালী। পশ্চিমাদের চোখে যা চীনের স্বৈরশাসন, তাই এখন তাদের শক্তির উৎস হয়ে উঠেছে। কিন্তু সবশেষে কথা থেকেই যায়। যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে তা আসলে কোনো দেশের জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যেই জিতুক না কেন সে জয় নিয়ে খুশি হওয়ার মতো কিছুই আর থাকবে না। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ এমন এক যুদ্ধ যাতে সত্যিকার অর্থে কেউ জিতবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status