ঈদ আনন্দ ২০১৮

ফিরে দেখা বিশ্বকাপ ১৯৩০-২০১৮

সামন হোসেন

৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৫:৩৫ পূর্বাহ্ন

১৯০৪ সালের ২১শে মে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেল ইন্টারন্যাশনাল দে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ফিফা)। কিন্তু বৈশ্বিক একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে তাদের সময় লাগে ২৬ বছর। ১৯২১ সালে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলে রিমে ফিফা’র তৃতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অলিম্পিকে বিভিন্ন দেশের ফুটবলের দারুণ সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন জুলে রিমে। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি আলাদা একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করার চিন্তা-ভাবনা করেন। আর এরই ফলস্বরূপ ১৯৩০ সালে ফিফা প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন করে উরুগুয়েতে। সেবার প্রতিবেশী আর্জেন্টিনাতে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপা জিতে নেয় স্বাগতিক উরুগুয়ে। এরপর প্রতি ৪ বছর অন্তর এই আসর নিয়মিত বসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কখনও আমেরিকায়, কখনও ইউরোপে, কখনও আফ্রিকায় আবার কখনও এশিয়ায়। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর কারণে ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ এই ২টি বিশ্বকাপের আসর বসেনি। এ পর্যন্ত ২০টি বিশ্বকাপে ৮টি দেশ শিরোপা জিতেছে। সর্বোচ্চ পাঁচবারের শিরোপাজয়ী দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। একমাত্র ব্রাজিলই এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সবগুলো আসরে অংশগ্রহণ করেছে। ব্রাজিল ছাড়া ইতালি ৪, পশ্চিম জার্মানি ৪ ও আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে দু’বার শিরোপা জিতেছে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন শিরোপা জিতেছে একবার করে। ২০টি বিশ্বকাপ আয়োজনে মাত্র ৬ বার স্বাগতিক দেশ বিশ্বকাপ জিতেছে।


১৯৩০ বিশ্বকাপ: উরুগুয়ে
চ্যাম্পিয়ন: উরুগুয়ে, রানার্স আপ: আর্জেন্টিনা
১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতে স্বাগতিক উরুগুয়ে। ১৯৩০ সাল ছিল উরুগুয়ের স্বাধীনতার ১০০তম বছর। স্বাধীনতার শত বছর উদযাপনের জন্যই তারা ফিফা’র কাছে প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক হতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার শততম বছর তারা ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ জিতে অনন্য কীর্তি স্থাপন করে। ১৩টি দলের অংশগ্রহণের প্রথম বিশ্বকাপে অল-দক্ষিণ আমেরিকা ফাইনালে উরুগুয়ে ৪-২ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। এর আগে ১৯২৮ সালের অলিম্পিকের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে একই ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল উরুগুয়ে।
১৯৩৪ বিশ্বকাপ: ইতালি
চ্যাম্পিয়ন: ইতালি, রানার্স আপ: চেকোসেøাভিয়া
প্রথম বিশ্বকাপের ৪ বছর পর ১৯৩৪ সালে ইতিহাসের দ্বিতীয় বিশ্বকাপও জেতে স্বাগতিক দেশ। আর সেবারের আয়োজক ছিল ইউরোপের দেশ ইতালি। ফাইনালে তারা চকোসেøাভিয়াকে ২-১ গোলে হারায়। ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপে উরুগুয়ে সফর করতে অস্বীকৃতি জানায় ইতালি। ফলে ইতালির মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও সফর করা থেকে বিরত থাকে উরুগুয়ে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে চাম্পিয়ন দেশের পরের টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ না করার ঘটনা এই একটিই। ইউরোপের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপে ১৬টি দল অংশগ্রহণ করেছিল।
১৯৩৮ বিশ্বকাপ: ফ্রান্স
চ্যাম্পিয়ন: ইতালি, রানার্স আপ: উরুগুয়ে
নিজেদের মাটিতে শিরোপা জয়ের চার পর এবার ফ্রান্সের মাটি থেকে শিরোপা জেতে ইতালি। এবার তারা ফাইনালে হারায় প্রথম শিরোপাজয়ী দেশ উরুগুয়েকে। এবারের আসরে মোট গোলের সংখ্যা ৮৪টি এবং ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৭ গোল করেন ব্রাজিলের লেওনিদাস। প্রথম রাউন্ডের একটি ম্যাচে ব্রাজিল ৬-৫ গোলে হারায় পোল্যান্ডকে। ওই ম্যাচে লেওনিদাস হ্যাটট্রিক করেন। এবারের বিশ্বকাপে ১৫টি দেশ অংশগ্রহণ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১১ বছর বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি
১৯৫০ বিশ্বকাপ: ব্রাজিল
চ্যাম্পিয়ন: উরুগুয়ে, রানার্স আপ: ব্রাজিল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৯৮ সালের পর ১২ বছর বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এবারের টুর্নামেন্টটি ছিল পৃথিবীর সব দেশের জন্য উন্মুক্ত। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য কোন দলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এবার ১৩ দল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। ১৯৫০ এর বিশ্বকাপে খেলতে সুযোগ পেয়ে ব্রাজিল পর্যন্ত গিয়েছিল এশিয়ার দেশ ভারতেও। কিন্তু খালি পায়ে খেলার আবদার তোলায় ভারতের আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। এই বিশ্বকাপ উপলক্ষে ব্রাজিলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম নির্মাণ করে। মারাকানর ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলে স্বাগতিক ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। ২,০০,০০০ দর্শক মাঠে বসে ওই ফাইনালে উপভোগ করেছিল। বিশ্বকাপের প্রথম দুই আসরের আয়োজক হয়ে উরুগুয়ে ও ইতালি শিরোপা জিতেছিল। ব্রাজিলও ১৯৫০ বিশ্বকাপের স্বপ্নে বিভোর ছিল। কিন্তু প্রথমবারের বিশ্বকাপের আয়োজন ব্রাজিলের জন্য বিস্বাদপূর্ণ করে দিয়েছেল উরুগুয়ে। ব্রাজিলের ২,০০,০০০ দর্শককে কাঁদিয়ে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে নেয় উরুগুয়ে।
১৯৫৪ বিশ্বকাপ : হাঙ্গেরি
চ্যাম্পিয়ন : পশ্চিম জার্মানি, রানার্সআপ : হাঙ্গেরি
১৯৫৪ সালে পঞ্চম বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করে সুইজারল্যান্ড। এবছর ১৬টি দল চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করে। ১৬টি দল ৪টি গ্রুপে খেলে। এই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল-হাঙ্গেরির ম্যাচটি শারীরিক শক্তি প্রয়োগের এক বীভৎস রূপ লাভ করায় ‘বর্ণের যুদ্ধ’ হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছে। ম্যাচটি নিয়ন্ত্রণে আনতে রেফারিকে ৩টি লাল কার্ড ও ২টি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিতে হয়। খেলার পরও দু’দলের খেলোয়াড়রা মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। ফাইনালে হাঙ্গেরিকে সম্পূর্ণ নতুন এক জার্মান দলের মুখোমুখি হতে হয়। হাঙ্গেরি ফাইনালের আগে টানা ৩১ ম্যাচ অপরাজিত ছিল। পশ্চিম জার্মানি সেই হিসেবে ছিল বেশ দুর্বল। ফাইনালের আগেই সবাই হাঙ্গেরির খেলোয়াড়দের হাতেই শিরোপা দেখছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় হাঙ্গেরি। অসুস্থ অবস্থায় এদিন মাঠে নামনে হাঙ্গেরির কিংবদন্তি পুসকাস। পুসকাস ও বিজরের গোলে প্রথম ৮ মিনিটের মধ্যেই ২-০ তে এগিয়ে গিয়েছিল হাঙ্গেরি। কিন্তু জার্মানিরা অসাধারণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ৩-২ জিতে এই বিশ্বকাপটি।
সিমারমানকে বিস্মিত করে দিয়ে জার্মানরা খেলায় ফিরে এলো প্রথমার্ধেই দুইটি গোল শোধ দিয়ে। দ্বিতীয় অর্ধে পুশকাসের হাঙ্গেরির একচেটিয়া আক্রমণ একে একে ফিরিয়ে দিল জার্মান গোলকিপার টনি টুরেক। একইসাথে গোলপোস্টে লেগে ফিরে গেল অনেকগুলো শট। শেষমেশ বাঁ পায়ের জাদুতে দুইজন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে খেলার ৮৪ মিনিটে জয়সূচক গোলটি করলেন হেলমুট রাহন। জার্মানি প্রথমবারের মতন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!
১৯৫৪ এর বিশ্বকাপ বিজয় জার্মান জাতির জন্য শুধু সামান্য একটি খেলার জেতা নয়। এই বিজয় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করল, তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে দিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলার অধিকার না থাকার পরও মাথা নত করে হাল ছেড়ে না দেবার উদ্যম তাদেরকে আবার বিশ্বের দরবারে ফিরিয়ে আনল। সেই থেকে আর পিছু ফিরতে হয়নি তাদের। শুধু ফুটবল নয়, জাতি হিসেবেও তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে হিটলারের অপকীর্তিকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তাদের অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করল।
হাঙ্গেরির বিস্ময় পুসকাস ১১টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা কৃতিত্ব দেখান এই আসরে।
১৯৫৮ বিশ্বকাপ: সুইডেন
চ্যাম্পিয়ন: ব্রাজিল, রানার্স আপ: সুইডেন
বিশ্বকাপের সর্বাধিক পাঁচবারের শিরোপাজয়ী দেশ ব্রাজিল। তাদের এ মিশন শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। সেবার স্বাগতিক সুইডেনকে ফাইনালে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে সাম্বা নৃত্যের দেশ ব্রাজিল। এ বিশ্বকাপেই ব্রাজিল আবিষ্কার করে তাদের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে’কে। তিনি টুর্নামেন্টে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল উপহার দিয়ে ৬টি গোল করেন। ফাইনালের সুইডেনের বিপক্ষে ১৭ বছর বয়সী পেলে করেন জোড়া গোল। এতে ব্রাজিল শিরোপা জেতে ৫-২ গোলে। সেবারের টুর্নামেন্টে তৃতীয় স্থান অর্জন করে ফ্রান্স। ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড ফন্টেইন মাত্র ৬ ম্যাচে ১৩ গোল বিল কৃতিত্ব দেখান। ১৬টি দলের অংশগ্রহণে এই টুর্নামেন্টে ৩৫টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। টুর্নামেন্টে মোট গোল হয় ১২৬টি।
১৯৬২ বিশ্বকাপ: চিলি
চাম্পিয়ন: ব্রাজিল, রানার্স আপ: চেকোসেøাভাকিয়া
টানা দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল শক্তি ব্রাজিল। ১৯৫৮ সালে সুইডেনের মাটিতে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ছিলেন ১৭ বছরের পেলে। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপেও তিনি ছিলেন দলে। তবে ইনজুরির কারণে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকতে পারেননি তিনি। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে চেকোসেøাভাকিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে মারাত্মক ইনজুরিতে পড়েন পেলে। ফলে বিশ্বকাপটাই শেষ হয়ে যায় তার। তবে জিতো, ভাভা ও গারিঞ্চারা ছিলেন স্বপ্রতিভাত। জিতো ও ভাভা ফাইনালে দু’টি গোল করেন। তবে গারিঞ্চা ছিলেন বিশ্বকাপ জয়ের আসল নায়ক। তিনি সেবার করেন ৬ গোল। এই বিশ্বকাপে ফুটবলের ৪-৩-৩ কৌশলে আক্রমণের প্রথম ধারণা জন্ম দেয় ব্রাজিল।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ: ইংল্যান্ড
চ্যাম্পিয়ন: ইংল্যান্ড, রানার্স আপ: পশ্চিম জার্মানি
১৯৩০ ও ১৯৩৪ সালে বিশ্বকাপের প্রথম দুই আসলে শিরোপা জেতে স্বাগতিক দেশ উরুগুয়ে ও ইতালি। ৩২ বছর পর এবার স্বাগতিক দেশ হিসেবে শিরোপা জেতার কৃতিত্ব দেখায় ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো জুলেরিমে ট্রফি আয়োজনের দায়িত্ব পায়। এবারও টুর্নামেন্টে ব্রাজিল ছিল টপ ফেভারিট। তবে বিশ্বকাপে ‘ব্রাজিল ঠেকাও‘ আন্দোলন বেশ জোরদার ছিল। পরপর দু’বার চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে ঠেকানোর জন্য সব দলই উঠে পড়ে লাগে। বিশেষ করে পেলেকে আটকে দেয়ার পরিকল্পনা চলতে থাকে। প্রথম ম্যাচেই বুলগেরিয়ার বিপক্ষে আহত হতে হয় পেলেকে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে পর্তুগাল আবারও পেলেকে আহত করে। রেফারি তা এড়িয়ে যান। ফলে ব্রাজিল এই প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পায়। শেষ পর্যন্ত ফাইনালে ওঠে পশ্চিম জার্মানি ও স্বাগতিক ইংল্যান্ড। নির্ধারিত সময়ে খেলায় ২-২ গোলে সমতা ছিল। ফলে খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। ইংল্যান্ডের থার্স্ট অতিরিক্ত সময়ে ২টি গোল করে দেশকে শিরোপা পাইয়ে দেন। এই বিশ্বকাপে আরও মজার যে ঘটনাগুলো ঘটে তা হলো ইংল্যান্ডের তৃতীয় গোলটি, গোল লাইন অতিক্রম না করলেও রেফারি গোল দিয়ে দেন। জার্মানদের চাপের মুখে রেফারি মাথা নত করলেও ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি। ফাইনাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূচিত হয় আরেক কলঙ্কময় অধ্যায়। উধাও হয়ে যায় ‘জুলেরিমে’ কাপটি। সবকিছুতেই সমালোচনায় জর্জরিত হলো ইংল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত ‘পিকলস’ নামে একটি কুকুর সেই ‘জুলেরিমে’ কাপ উদ্ধার করে নরওয়ের একটি বাগান বাড়ি থেকে। পর্তুগালের ইউসেবিও টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় হন। তিনি মোট ৯টি গোল করেন। পর্তুগাল তৃতীয় স্থান অধিকার করে এই বিশ্বকাপে।
১৯৭০ বিশ্বকাপ: মেক্সিকো
চ্যাম্পিয়ন: ব্রাজিল, রানার্স আপ: ইতালি
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের আসর বসেছিল মেক্সিকোতে। ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন ও ইতালি রানার্স আপ হয়। এ আসরে নান্দনিক ফুটবলের জনক ব্রাজিল অনন্য এক রেকর্ড গড়ে। ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালের পর ব্রাজিল ১৯৭০ সালের আসরেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব দেখায়। একমাত্র দল হিসেবে সর্বোচ্চ তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে চিরতরে ‘জুলেরিমে’ ট্রফি ঘরে তোলে ব্রাজিল। ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের মূল তারকা ছিলেন পেলে ও জাইরজিনহো। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। প্রথমবারের মতো এবার বিশ্বব্যাপী টিভি’র মধ্যমে সম্প্রচার করা হয়। পশ্চিম জার্মানির গার্ড মূলার সর্বোচ্চ ১০ গোল করে গোল্ডেন বুট পুরস্কার পান। এ আসরে ইংল্যান্ড দলে ন্যক্কারজনক এক ঘটনা ঘটে। মদ্যপান, চুরিও অশালীন আচরণের অভিযোগে ইংল্যান্ড তারকা ববি মুরকে গ্রেপ্তার করে মেক্সিকো পুলিশ। এ ছাড়াও ১৯৭০ বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, স্পেন ও পুর্তগালের মতো বিশ্বসেরা দলগুলোর আসরে সুযোগ না পাওয়ার। বাছাই পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায় এ সেরা চার দল।
১৯৭৪ বিশ্বকাপ: পশ্চিম জার্মানি
চ্যাম্পিয়ন: পশ্চিম জার্মানি, রানার্স আপ: নেদারল্যান্ডস
তিনবার বিশ্বকাপ জেতায় ১৯৭০ সালে চিরতরে ‘জুলেরিমে’ কাপ দিয়ে দেয়া হয় ব্রাজিলকে। তাই দশম বিশ্বকাপ আয়োজনের আগে আরেকটি নতুন ট্রফি তৈরির প্রয়োজন পড়ে। ফিফা একটি নতুন কাপ তৈরি করে- নাম দেয়া হয় ‘ফিফা কাপ’। এ বছর কাপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে ফিফার সভাপতিরও বদল হয়। স্যার স্ট্যানলি রাউসের ১৩ বছরের দায়িত্ব পালনের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ব্রাজিলের জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ। এ সময় আরও একটি সিদ্ধান্ত হয়- কোন দেশ তিনবার বা তারও বেশি চ্যাম্পিয়ন হলেও কাপটি চিরতরে নিতে পারবে না। এই বিশ্বকাপে স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি সেরা বাজি হিসেবে খেলে। পশ্চিম জার্মানি ছাড়াও হল্যান্ড ও পোল্যান্ড নতুন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হল্যান্ডের কোচ রিনাস মিশেল ফুটবলের ইতিহাস ‘টোটাল ফুটবল’ নামে ফুটবলের নতুন এক কৌশল উদ্ভাবন করেন। পুরো দলকে একই সঙ্গে আক্রমণ ও রক্ষণ করার দূরূহ কাজটি অনুপম দক্ষতার সম্পন্ন করার কৌশলই ছিল টোটাল ফুটবল। এই বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানির অধিনায়ক বেকেনবাওয়ার হল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম ফিফা কাপ জয়ের অনন্য কৃতিত্ব দেখান। ‘ফিফা কাপ’ নামক প্রথম ট্রফি যায় পশ্চিম জার্মানির ঘরে। ফাইনাল ম্যাচটি ছিল উত্তেজনায় ঠাসা। ম্যাচের প্রথম মিনিটেই পশ্চিম জার্মানির বিপদসীমার মধ্যে ফাউল করা হয় ডাচ্? স্ট্রাইকার জন ক্রুয়েফকে। পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন রেফারি। এতে গোল করে এগিয়ে যায় নেদারল্যান্ডস। বিশ্বকাপের ফাইনাল প্রথমবারের মতো পেনান্টি দেখে। তবে পরে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি।
১৯৭৮ বিশ্বকাপ: আর্জেন্টিনা
চ্যাম্পিয়ন: আর্জেন্টিনা, রানার্স আপ: নেদারল্যান্ডস
১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম আসরে ফাইনাল খেলেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেবার উরুগুয়ের কাছে হেরে শিরোপা ছুঁতে ব্যর্থ হয় তারা। ৪৮ বছর পর নিজেদের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ। এ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী ছিল না অনেকে। বিশেষ করে ১৮ বছর বয়সী তরুণ স্ট্রাইকার দিয়েগো মারাদোনাকে বিশ্বকাপের দলে না রাখায় অনেকে ছিলেন ক্ষুব্ধ। তবে শেষ পর্যন্ত স্বাগতিক আর্জেন্টিনায়ই নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে। ডাচ্?রা টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে হারে। ফাইনালে আর্জেন্টিনা নির্ধারিত সময়ে নেদারল্যান্ডসের সাথে ১-১ গোলে অমীমাংসিতভাবে খেলা শেষ করে। ফলে ম্যাচ চলে যায় অতিরিক্ত সময়ে। আরও দু’টি গোল করে ৩-১ ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা।
১৯৮২ বিশ্বকাপ: স্পেন
চ্যাম্পিয়ন: ইতালি, রানার্স আপ: পশ্চিম জার্মানি
দ্বাদশ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় স্পেন। জাঁকজমকপূর্ণ ও নয়নাভিরাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বার্সেলোনায়। বার্সেলোনায় বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়। ৫০ মিনিট ধরে চলে এ অনুষ্ঠান। এ বিশ্বকাপের জন্য বাছাইপর্বে অংশ নেয় সর্বাধিক ১০৬টি দেশ। অংশগ্রহণকারী ২৪টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। লীগ ভিত্তিতে খেলা হয়। প্রতি গ্রুপের শীর্ষ দল সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ পায়। পশ্চিম জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে সেমিফাইনালটিকে শতাব্দীর সেরা খেলা বলা যায়। ১২০ মিনিটেও খেলার ভাগ্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। অপেক্ষা টাইব্রেকারের। তাতেও কোন ফয়সালা হলো না। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে খেলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় সাডেন ডেথ পথকেই বেছে নিতে হয়। উত্তেজনায় ঠাসা ও ম্যাচে পশ্চিম জার্মানি ৮-৭ গোলে জিতে ফাইনালে ওঠে। অপর সেমিতে পোল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পায় ইতালি। পশ্চিম জার্মানি-ইতালির মধ্যকার ফাইনালে ৩-১ গোলে জয় হয় ইতালির।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ: মেক্সিকো
চ্যাম্পিয়ন: আর্জেন্টিনা, রানার্স আপ: পশ্চিম জার্মানি
১৯৭৮ সালের পর ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে। এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। মারাদোনা এই টুর্নামেন্টের ৭ ম্যাচে করেন ৫ গোল। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তিনি একটি গোল করেন। এই আসরের কারণেই ফুটবলে অমরত্ব অর্জন করে মারাদোনা। তবে এ বিশ্বকাপে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল মারাদোনার ‘হ্যান্ড অব গড’-এর গোল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষের কোয়ার্টার ফাইনালের দু’টি গোল করেন মারাদোনা। একটি সেরার সেরা আর অন্যটি প্রবল বিতর্কিত। হাত দিয়ে করা সেই গোলটিকে ‘ঈশ্বরের হাত’- এর গোল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মারাদোনা নিজে। আর ইংল্যান্ডের ছয়জন খেলোয়াড় এবং গোলরক্ষক পিটার মিলটনকে কাটিয়ে অপর যে গোলটি করেন সেটার তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে জিতে এক বিশ্বকাপ বাদে নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।
১৯৯০ বিশ্বকাপ: ইতালি
চ্যাম্পিয়ন: পশ্চিম জার্মানি, রানার্স আপ: আর্জেন্টিনা
আগের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল আর্জেন্টিনা ও পশ্চিম জার্মানি। সেবার শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা। এবারও ওই দু’টি দলই ফাইনালে ওঠে। এবার ঘটে বিপরীত ঘটনা। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় পশ্চিম জার্মানি। বিশ্বকাপের এই আসরটি বসে ফুটবলের আরেক পরাশক্তি ছন্দময় ফুটবলের দেশ ইটালিতে। মোট খেলা অনুষ্ঠিত হয় ৫২টি। মোট গোলের সংখ্যা ১১৫টি। টপ স্কোরার সর্বোচ্চ ৬টি গোল করেন। পশ্চিম জার্মানি তৃতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ইতালির এই আসরে। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের জন্য এই বিশ্বকাপটি ছিল অনন্য ইতিহাস সৃষ্টির। তিনি ১৯৭৪ সালের দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন খেলোয়াড় হিসেবে। আর ১৯৯০ সালে পশ্চিম জার্মানিকে বিশ্বকাপ এনে দেন কোচ হিসেবে।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ: যুক্তরাষ্ট্র
চ্যাম্পিয়ন: ব্রাজিল, রানার্স আপ: ইতালি
১৯৯৪ বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল যুক্তরাষ্ট্র। অনেক ঘটনা, দুর্ঘটনা ও নাটকীয়তার সঙ্গী এ আসর। আর্জেন্টাইন লিজেন্ড দিয়েগো মারাদোনাকে ডোপিংয়ের অভিযোগে বাদ দেয়ায় আরও বেশি আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ। ১৯৭০ সালের পর এবারের বিশ্বকাপ জেতে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। এবারের টুর্নামেন্টে ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করার মূল নায়ক ছিলেন স্ট্রাইকার রোমারিও, বেবেতো ও রবার্তো ব্যাজিও। রোমারিও করেন ৭ ম্যাচে ৫ গোল। অভিজ্ঞ ও চতুর ফরোয়ার্ডের কাঁধে ভর করেই কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। কিন্তু শিরোপা জয়ের মূল নায়ক রোমারিওকে বিশ্বকাপের আগে দলেই নিতে চাননি তখনকার কোচ পেরেইরা। তবে শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের অনুরোধে রোমারিওকে দলে সুযোগ দিতে বাধ্য হন পেরেইরা। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের সঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার সুযোগ হয় তার। শেষ পর্যন্ত এই রোমারিওতে ভর করেই শিরোপা জেতে ব্রাজিল। ইতালির বিপক্ষে ফাইনাল শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গড়ায়। বিশ্বকাপের ফাইনালের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিরোপা নির্ধারণের জন্য টাইব্রেকারের আশ্রয় নিতে হয়।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ: ফ্রান্স
চাম্পিয়ন: ফ্রান্স, রানার্স আপ: ব্রাজিল
ফিফা’র প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্স। ফিফা বিশ্বকাপের স্বপ্নদ্রষ্টা জুলেরিমে ছিলেন এই ফ্রান্সের অধিবাসী। কিন্তু যাদের হাতে বিশ্বকাপ সৃষ্টি তারাই এতোদিন ছিল ট্রফিশূন্য। অবশেষে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার ৬৮ বছর পর অধরা শিরোপা ছুঁয়ে দেখে তারা। ফাইনালে হারায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রতাপশালী ফুটবল দল ব্রাজিলকে। নিজেদের মাটিতেই শেষ পর্যন্ত শিরোপা জেতে ফ্রান্স। বিশ্বকাপ জিতিয়ে ফ্রান্সের নায়ক হয়ে ওঠেন জিনেদিন জিদান। আর আসরে সর্বোচ্চ ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট জেতেন ক্রোয়েশিয়ার দেভর সুকর। আর গোল্ডেন বল জিতে নেন ব্রাজিলের রোনালদো। এই বিশ্বকাপে ৩২ দেশ মূলপর্বে অংশগ্রহণ করে। আটটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শক্তি পরীক্ষায় নামে তারা।
২০০২ বিশ্বকাপ: কোরিয়া-জাপান
চ্যাম্পিয়ন: ব্রাজিল, রানার্স আপ: জার্মানি
এশিয়ার মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন করে যৌথভাবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। শতাব্দীর প্রথম সহস্রাব্দেরও প্রথম এই আয়োজনটি ছিল অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে বাছাই পর্বে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ করে ১৯৮টি দেশ। ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিল। মাঝে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে সেটা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ব্রাজিলকে ফাইনালে হারিয়ে শিরোপা জেতে ফ্রান্স। তবে এক বিশ্বকাপ বাদে আবারও নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম কোন পাঁচবার বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব দেখায়। রোনালদো এই বিশ্বকাপে করেন সর্বোচ্চ ৮ গোল। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে জার্ড মুলারের ১০ গোল করার এটিই কোন আসরে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত গোল ছিল। জার্মানির বিপক্ষের ফাইনালে ব্রাজিলের হয়ে দু’টি গোলই করেন রোনালদো। ফাইনালে প্রতিপক্ষকে ২-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ব্রাজিল। অথচ এই বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সময় ব্রাজিলের পক্ষে বাজি ধরার মতো কেউ ছিল না। তারা অনেক কষ্ট করে বাছাই পর্ব পেরিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিল।
২০০৬ বিশ্বকাপ: জার্মানি
চ্যাম্পিয়ন: ইতালি, রানার্স আপ: ফ্রান্স
এই বিশ্বকাপে হট ফেভারিট ছিল স্বাগতিক জার্মানি। সবাই ধরে নিয়েছিল ১৯৭৪ সালের মতো স্বাগতিক দেশে হিসেবে এবারও শিরোপা জিতবে জার্মানি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। ফাইনালে উঠেছিল ফ্রান্স ও ইতালি। শিরোপার চূড়ান্ত লড়াইটি ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। ২০০৬ সালের বর্ষসেরা খেলোয়াড় ফ্রান্সের জিনেদিন জিদানের ‘ঢুস কান্ড-’ ঘটে এই ফাইনালে। ইতালির খেলোয়াড় মার্কো মাতেরাজ্জিকে মাথা দিয়ে গুঁতো দিয়ে চিত করে ফেলে দেন জিদান। তখনকার বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে প্রবল চাপে পড়ে ফ্রান্স। শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময়েও খেলা ১-১ গোলে ড্র থাকে। শিরোপা নির্ধারণের জন্য খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে ফ্রান্সকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ইতালি। জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা এই আসরে সর্বোচ্চ ৫টি গোল করেন। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে সবচেয়ে চমক দেখায় পর্তুগাল। তরুণ তুর্কি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর কাঁধে সওয়ার হয়ে এই বিশ্বকাপে পর্তুগাল সেমিফাইনালে ওঠে। ১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপে এটি ছিল তাদের প্রথম সেমিফাইনাল। তবে শেষ চারে ফ্রান্সের কাছে হেরে তারা বিদায় নেয়। অন্যদিকে এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রোনালদো ঢুকে যান বিরল ইতিহাসে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৫ গোল করার রেকর্ড গড়েন তিনি এই আসরে।
২০১০ : দক্ষিণ আফ্রিকা
টিকিটাকায় মাতিয়ে স্পেনের বিশ্বজয়
রানার্সআপ : নেদারল্যান্ডস
ঘুষের বিনিময়ে ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করে দক্ষিণ আফ্রিকা! এমন তথ্য রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দেয় ফুটবল বিশ্বে। তবে, এমন সমালোচনার আগে ১৯তম ফিফা বিশ্বকাপ সফলভাবেই আয়োজন দক্ষিণ আফ্রিকা। সে আসরে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি জেতে স্পেন। ২০১৫ সালে ফিফার দুর্নীতি দমন ইউনিটের তথ্য বিশ্বকাপের আয়োজন বাগিয়ে নিতে ঘুষ বিনিময় করে দক্ষিণ আফ্রিকা! অভিযোগ স্বীকারও করেন ফিফা নির্বাহী চাক ব্লেজার। আগে-পরের ওইসব বিতর্ক ফেলে মাঠের ফুটবল যথারীতি সৌন্দর্য ছড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার নয়নাভিরাম ১০টি স্টেডিয়ামে বসে ৩২টি দেশের লড়াই। এবারই প্রথম একসঙ্গে চার ফুটবলার সর্বোচ্চ ৫টি করে গোল করেন। তবে উরুগুইয়ান দিয়েগো ফোরলানের হাতে ওঠে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে জোহানেসবাগের ফাইনাল। মুখোমুখি দুই ইউরোপিয়ান স্পেন ও নেদারল্যান্ড। ম্যাচের পুরোটা সময়ে টোটাল ফুটবলের সঙ্গে টিকিটাকার লড়াইয়ে হার মানেনি কোন দলই। তবে অতিরিক্ত সময়ে ইনিয়েস্তার গোল বিবর্ণ হয়ে পড়ে কমলা রং। এ নিয়ে তিনবার ফাইনালে উঠেও, ডাচদের কাছে অধরা ফুটবল বিশ্বকাপ।
প্রথম ইউরোপীয়ান দল হিসেবে নিজ মহাদেশের বাইরে থেকে শিরোপা জেতে সোনালী যুগের স্পেন। আর প্রথম আয়োজক দল হিসেবে প্রথম রাউন্ড থেকেই ছিটকে পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০১৪ : ব্রাজিল
চ্যাম্পিয়ন : জার্মানি, রানার্সআপ : আজেন্টিনা
ফুটবলের ইতিহাসে ব্রাজিলের এই বিশ্বকাপ আর দশটা বিশ্বকাপের থেকে হয়ত অন্যভাবে লেখা হবে। কারণ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের ঝান্ডার হাতবদল হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে ইউরোপের প্রথম বিশ্বকাপ জয় হয়েছে। জার্মানির পাওয়ার ফুটবলের কাছে নিজেদের মাঠে পর্যন্ত, অপমানিত হয়েছে ব্রাজিলীয় সাম্বা ফুটবল। ৯ই জুলাই সেমিফাইনালে জার্মানির হাতে ৭-১ গোলে পরাজয়ের পর পিচে ব্রাজিলীয় খেলোয়াড়দের আর গ্যালারিতে সমর্থকদের হতভম্ব, অপদস্থ চেহারা, চোখের পানির এই দৃশ্য টিভির পর্দায় যারা দেখেছে তারা আজীবন ভুলবে না।
১৯৯০ সালে শেষবারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে শংলেছিল জার্মানি। ডিয়াগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল তারা। ১৯৯০-এরই পুরনরাবৃত্তি হল ২০১৪ সালে। শুধু তফাৎ এবার ম্যারাডোনা নয়, পরাজিত হল মেসির আর্জেন্টিনা। জার্মানি আবারও প্রমাণ করল ফুটবল দলের খেলা, একনায়কতন্ত্রের গুরুত্ব এ খেলায় নেই। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালে যেই জিতুকনা কেন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে দুই দলেই। দুই দলের কঠিন ডিফেন্সের মুখে বারবার বাধা পেয়েছে একে অপরে। আর তার জন্যই তো বারবার সুযোগ এলেও ৯০ মিনিট খেলার পরেও গোল দিতে অসফল দুই দলই। খেলা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। ১১২ মিনিট পর্যন্ত খেলার স্কোর ০-০। কিন্তু রবিষ্ঠ খেলোয়াড় মীরাসেøাভ ক্লোজেকে তুলে তাঁর জায়গায় মারিও গটজাকে মাঠে নামানোই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াল জার্মানির পক্ষে। ১১৩ মিনিটের মাথায় গটজার দুরন্ত গোলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল জার্মানি। বিশ্বকাপে এই নিয়ে তৃতীয়বার খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়াল। ২০০৬ সালে ১-১ গোলে ড্র হওয়ার পর পেনাল্টি শুটআউটে ফ্রান্সকে হারিয়েছিল ইতালি। ২০১০ সালে ১১৭ মিনিটে গোল করে ডাচেদের হারায় স্পেন। খেলা শুরুর কয়েক মিনিটের মাথায় গোলে বল ঢোকানোর সুযোগ পেয়েও তা হারায় আর্জেন্টিনা। হিগুয়েন গোলে বল ঢোকানো সত্ত্বেও অফসাইডের কারনে সে গোল বাতিল হয়ে যায়। মেসি কয়েকবাল বলকে জার্মানির গোল বক্সে ঢোকালেও জালে ঢোকাতে অসফল হন। জার্মানের তরফে বেনেডিক্টের দুরন্ত হেডার গোল পোস্টে লেগে ফিরে আসে। দ্বিতীয়ার্ধেও ছিল টানটান উত্তেজনা। তবে মেসির আর্জেন্টিনার থেকে জার্মানিকে দ্বিতীয়ার্ধে বেশী শক্তিশালী মনে হয়েছে। ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে পৌছনোর ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোর ভূমিকা উলেখযোগ্য। রোমেরোর দুরন্ত পারফরম্যান্স না থাকলে জার্মানি হয়তো অতিরিক্ত সময়ের আগেই জয়ী হয়ে যেত। তবে আর্জেন্টিনা দলে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার অনুপস্থিতি এদিন প্রকট হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন সময়ে। মেসির নড়রকাড়া পাস থাকলেও সে বল এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাননি মেসিও। ত



   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status