ঈদ আনন্দ ২০১৮

ভ্রমণ

বালির বালুকা বেলা

মিতালী হোসেন

৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৫:০৮ পূর্বাহ্ন

শুনতেই ইন্দোনেশিয়া কাছের দেশ। ফুঃ! সাত ঘণ্টা শুধু উড়তেই হলো। মাঝে কুয়ালালামপুরে তিন ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। সব মিলিয়ে দশ ঘণ্টা। এরও আগে পিছে আছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর অব্দি পৌঁছুতে ঘণ্টা দেড়েক। বিমানবন্দরে রিপোর্ট করতে হবে দু’ঘণ্টা আগে। তাই মোটেও এই কাছে পিঠেই যাচ্ছি ভাবনাটা বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তবুও বেড়াতে যাচ্ছি নতুন দেশে সেই আনন্দে কষ্টকে উপেক্ষা করাই যায়। আশ্চর্য এবারে আমাদের যাত্রার শুরুটা খুব নির্বিঘ্নে হলো। কোনো ঝামেলা ছাড়াই। দরজা বন্ধ হলো ঠিকমতো। চাবি হারালো না। বাসার লোকজন সবাই খুব সহযোগিতা করলো। বিমানবন্দরেও কোনো ঝামেলা হলো না! আমি ভাবলাম যাক বাবা এবারের ভ্রমণ ঝামেলাহীন হবে। তা হলো কি? মোটেও না। ঢাকা বিমানবন্দরের স্কাই লাউঞ্জে ঢুকেই মোজাম্মেল একগাদা (পাঁচ ছয় টুকরা) ভেড়ার মাংস খেয়ে নিল। দেখেতো আমার চোখ কপালে! কারণ মোজাম্মেল স্বল্পাহারি। খুব বেশি কখনোই খায় না। আজ কি হলো! আমি বলতে চেষ্টা করলাম এতগুলো খেও না। সে রাগি গলায় বললো সব সময় এত টোকাটুকি করবা না তো। আমি মনে মনে বললাম কেন যে টুকছি নিজেই বুঝবে।
বালি যাওয়া মানে ইন্দোনেশিয়া যাওয়া নয়। বালি দেখা মানে ইন্দোনেশিয়া দেখা না। এ হলো ঘুরে আসার পর আমার অভিজ্ঞতা। ইন্দোনেশিয়া এক আজব কিসিমের দেশ। আমার মনে হয় দুনিয়ায় এমন দেশ একটাই আছে। ভারত মহাসাগরের এই দেশটি মোট ১৭ হাজার ৫৬০টি দ্বীপ মিলে। আর দ্বীপগুলো মোটেই গায়ে গা লাগিয়ে নয়। এর মধ্যে প্রায় ১১ হাজার দ্বীপেই মানুষের বাস নেই। কেউ যদি পুরো ইন্দোনেশিয়া দেখতে চায় আর সব দ্বীপে একদিন করে থাকে তাহলে কি হবে? পুরো ইন্দোনেশিয়া দেখে বাড়ি ফিরতে কেটে যাবে ৩০ বছর এক মাস! বা তার চেয়েও বেশি! তাই বলছিলাম ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে গিয়েছি না বলে বালি গিয়েছি বলাই যুক্তিসঙ্গত। জার্কাতা, জাভা, সুমাত্রা নামগুলো আমাদের কাছে পরিচিত। যেমন আমরা জানি বালির নাম। কিন্তু এই দ্বীপগুলো একটা থেকে অন্যটা এত দূরে যে প্লেনে করে গেলেও দু’ঘণ্টা আড়াইঘণ্টা লাগে। সে কারণেই ইন্দোনেশিয়া দেখলাম কিছুতেই বলা চলে না। আমি তো আর ৩০ বছর ধরে ইন্দোনেশিয়া দেখতে পারব না। তাই বালিতে যেতে পেরেই আমি খুশি। কারণ বালিকে বলা চলে দেশের মধ্যে আর একটা দেশ। বালির রয়েছে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম আর ঐতিহ্য। যা পুরো ইন্দোনেশিয়া থেকে ভিন্নতর। যা একান্তই বালিনিজদের।
ইন্দোনেশিয়া একটি জনবহুল দেশ। ২০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ ইন্দোনেশিয়া। জনসংখ্যার বিচারে ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর চতুর্থ স্থানে আছে। কিন্তু বালিকে তেমন জনবহুল বলা যায় না। বালির জনসংখ্যা ১৩ লাখ। বালি দ্বীপ আয়তনে খুব বেশি বড়ও না। ১৫০ কিলোমিটার লম্বা আর ৭০ কিলোমিটার চওড়া এই সুন্দর দ্বীপটি। ইন্দোনেশিয়ার অন্য দ্বীপগুলোর তুলনায় বালিকে ক্ষুদ্রই বলা চলে। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে সাগরে অনেকগুলো নতুন দ্বীপ জেগে উঠেছে বালিকে ঘিরে। যা কিছুদিনেরই মধ্যেই বালির আয়তনে যোগ করবে নতুন ভূমি। কিছুটা তো ইতোমধ্যেই যোগ হয়েছে। ছোট হলেও বালি অনন্য তার নিজস্বতার জন্য। ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মুসলিম দেশ। কিন্তু বালির ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু! যারা নিজেদের ‘বালিনিজ হিন্দু’ বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুধু হিন্দু বললে খুশি হয় না। সংশোধন করে বলে আমরা ‘বালিনিজ হিন্দু’। বালিনিজরা ঘরে নিজেদের ভাষায় কথা বলে। যা তারা তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকেই শেখে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায়। যদিও অল্প কিছুকাল আগ অব্দি বালিনিজরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। বালিনিজদের জীবন ঐতিহ্য, পারিবারিক শিক্ষা আর পরম্পরানির্ভর। যে কারণেই বালির মানুষরা নিজেদের ‘বালিনিজ হিন্দু’ বলে। কারণ, যখন হিন্দু ধর্ম বালির জনগণের কাছে এসেছিল-তখন তো তাদেরও ধর্ম বা বিশ্বাস ছিল। প্রথা ছিল। সংস্কৃতি ছিল। বালির মানুষ হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলেও নিজেদের বিশ্বাস প্রথা আর সংস্কৃতিকেও বর্জন করেনি। বরং, দুটো খুব সুন্দর করে মিশিয়ে নিয়েছিল। যে কারণেই তারা এখন গর্বের সঙ্গে বলে আমরা ‘বালিনিজ হিন্দু’।
বালিনিজরা বিশ্বাস করে সব ধরনের শিল্পকর্ম-নাচ, গান, ছবি আঁকা মৃৎশিল্প, ভাস্কর্য, বুনন, বয়ন সব কিছুই ঈশ্বরকে খুশি করে। আর সে কারণেই নাকি বালির সব মানুষই অল্পস্বল্প হলেও শিল্পী। বালিতে হিন্দু ধর্মের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব জনপ্রিয় এবং পরিচিত। কিন্তু ওদের নিজস্ব গডের নাম ‘সাং হিয়াং উইডি’। এটা হিন্দু ধর্মের কোনো গডের নাম কিনা সেটা অবশ্য জানা হয়নি। বালির মানুষদের শিল্পবোধ তাদের ধর্ম বিশ্বাসেরই অংশ। আর শিল্প নিপুণতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে বালির সর্বত্র। বালিতে পাম গাছের মতোই একটা গাছ আছে যাকে ওরা বলে বেনজর (BENJOR)। সেই পাতা দিয়ে এমন অসাধারণ শিল্পকর্ম হয় যা দেখলে চক্ষু সার্থক হয়। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে দোকানে পথের ধারে বেনজরের পাতা দিয়ে নানা রকম শো পিস বানিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে বালিনিজরা। আর সে সবই কিন্তু ছোটখাট কিছু না। কোনো কোনোটা ১০-১২ ফিট পর্যন্ত উঁচু। কত কি যে বানায় এই পাতা দিয়ে। পদ্ম, শাঁখ, ফুল লতাপাতা পাখি। কত কি। এছাড়া রয়েছে নারকেল পাতা। আহা তার যে কত রকমের ব্যবহার। কত সম্মান। নারকেল পাতা দিয়েও হয় অনেক সুন্দর বাহারি শোপিস। যা ঝোলে তাদের ঘরে বারান্দায় সদর দরজায়। নারকেল পাতা কাটার প্রশিক্ষণ ছোটরা পায় বড়দের কাছ থেকে। গাছকে ব্যথা না দিয়ে নারকেল পাতা আনতে হবে। কারণ, নারকেল গাছ ওদের কাছে ঈশ্বরের প্রতীক। যে কোনো উৎসবে পূজায় নারকেল পাতা, নারকেল, ডাবের উপস্থিতি অনিবার্য।
বালিতে কোনো উঁচু দালান নেই। যা আমাকে একটু অবাক করেছিল। সবচেয়ে উঁচু দালান চারতলা। আমি সুদেবীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম উঁচু দালান নেই কেন? আমার মনে হয়েছিল হয়তো বালিতে উঁচু দালান নির্মাণ করা যায় না। কিন্তু সুদেবী জানাল বালিতে উঁচু দালান নির্মাণ নিষিদ্ধ। বালির প্রধান মন্দির আর নারকেল গাছের থেকে উঁচু দালান নির্মিত হবে না বালিতে! ওহঃ সুদেবীর পরিচয় তো বলাই হলো না। সুদেবী আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্সির ডেপুটি ডিরেক্টর। সে দুদিন আমাদের গাইড হিসেবে ছিল। এমবিএ করা সুদেবী যেমন সুন্দরী তেমনি বুদ্ধিমতি। কিন্তু ওর কথা আমার ঠিকমতো বিশ্বাস হয়নি। তাই পরদিন যখন গাইড হয়ে গিয়ানা এলো তখন ওর কাছেও জানতে চাইলাম উঁচু দালান নেই কেন? গিয়ানা চোখ বড় করে বললো-ও? জান না বুঝি! বালিতে নারকেল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু দালান নির্মিত হবে না।
কেন?
কেন তা তো জানি না। তবে এটাই নিয়ম। প্রথাও বলতে পার। আর সব বাড়ির ছাদই ছনের। সে গরিবের কুঁড়েঘরই হোক আর পাঁচ তারকা হোটেলই হোক। আজকাল কেউ কেউ ছাদ করছে। কিন্তু বালিনিজরা সেটা ভালো চোখে দেখে না। এক নিশ্বাসে বলে গেল গিয়ানা।
আমিও খেয়াল করে দেখলাম সত্যিই তাই। আমরা ছিলাম শেরাটন হোটেলে। পাঁচ তারকা শেরাটন হোটেল চারতলা উপরে। আর মাটির নিচে তিনতালা। ছাদটা ছনের। ছনের নিচে নকশি করা পাটি দিয়ে সিলিং করা। বালির শপিং মলও তাই। তিনতলা দালান ছাদ ছনের। আসলে খুব গরম তো। তাই ছাদ ছনের হওয়াটা খুবই বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু উঁচু কোনো নারকেল গাছের থেকে বেশি হবে না সেটা বুঝিনি। কিন্তু বিষয়টা ভালো লেগেছে। বালি চোখকে আরাম দেয়। বেশ একটা শান্তিশান্তি ভাব বিরাজ করে। আর এসবই বালিনিজদের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। বালিনিজদের অতি প্রাচীন ধর্ম মতে যে পূজা বা প্রার্থনা ছিল সেটা করা হতো পৃথিবী ও পূর্ব পুরুষদের। পৃথিবী মানে সাগর পাহাড় বন গাছ সবই ছিল পূজনীয়। আর পূর্ব পুরুষদের জন্য পূজা করা হতো কারণ বালিনিজরা বিশ্বাস করত মৃত পূর্ব পুরুষদের আত্মা তাদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে। যে, বিশ্বাস এখনও অটুট। আর সে কারণে বালির প্রতিটি বাড়িতে ছোট ছোট পাঁচ থেকে ১৫-২০টি অব্দি মন্দির থাকে। এমনিতেই প্রত্যেকটি বালিনিজ পরিবারের একটি করে নিজস্ব মন্দির থাকে। সঙ্গে থাকে ছোট ছোট মন্দির। পরিবারের মৃত পূর্ব পুরুষদের জন্য এই মন্দির স্থাপিত হয় এই মন্দির পূজার মধ্য দিয়ে। তারা বিশ্বাস করে এই মন্দিরগুলোতে বসত করে মৃত পূর্ব পুরুষদের আত্মা। যে আত্মারা তাদের রক্ষা করে। বালিনিজরা সেই ধারাবাহিকতা আজও ধ
রে রেখেছে। এখনও সব পরিবারের নিজস্ব মন্দির আছে। আছে পূর্ব পুরুষদের জন্য স্থাপিত মন্দির।
অষ্টম শতাব্দীতে বালিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের আগমন হয়। সে সময়ের বালি শাসকের আশ্রয়ে এই দুই ধর্মই নিজের মতো করে প্রসারিত হয়। কিন্তু তার মানে কিন্তু এই নয় যে বালিনিজরা তাদের আগের ধর্মকে ত্যাগ করল। তারা নতুন আসা ধর্মকে মিশিয়ে নিল নিজেদের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে। আপন করে নিল মহাভারতকে। সব কিছু মিলিয়ে বালির ধর্মীয় ব্যবস্থা বেশ জটিল। কিন্তু ধর্মীয় জীবন নয়। কারণ যাপিত জীবনে ধর্মের চেয়ে প্রথার অবস্থান অনেক বেশি শক্ত। এর অনেক পরে আসে ইসলাম ও খৃষ্ট ধর্ম। যদিও ইন্দোনেশিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। অন্য ধর্মের অবস্থান খুবই অল্পপরিসরে।
বালির জন্ম অগ্ন্যুৎপাতের মধ্য দিয়ে। এখনো একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। যা মাঝে মাঝেই ফুঁসে ওঠে। আগ্নেয়গিরিকে ওরা বলে আগুন (AGUN) আর বালিনিজদের দিকনির্দেশনা হয় এই আগুনকে ধরে। আমরা রাস্তায় বেরুলে বলি পূর্বে বা পশ্চিমে যাচ্ছি। বালিনিজরা কখনো তা বলে না। ওরা দিকনির্দেশ করে উপরের দিকে আগুন (মানে আগ্নেয়গিরি) নিচের দিকে সাগর। অথবা বলবে ডান দিক বা বাম দিক। এটা হলো বালিনিজদের পৃথিবী ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের একটা বিশেষ দিক। বালিনিজদের গ্রাম, মন্দির, বাড়িঘর এমন কি শোবার বিছানা পর্যন্ত এই নিয়ম মেনেই নির্মাণ করা হয়। যাতে মাথার দিকে আগুন মানে পাহাড় আর পায়ের দিকে সাগর থাকবে! মানে সদর পাহাড়ের দিকে পিছন বা নিচের দিকে সাগর। এটা হলো বালিনিজদের জীবন দর্শন। যেমন নদী পাহাড় থেকে নেমে আসে। অনেকটা পথ পেরিয়ে মিশে যায় সাগরে।
বালির যে কোনো গ্রামে ঢোকার মুখেই বিশাল এক গেট। রাস্তার দু’পাশে পাথরের সুদৃশ্য ভাস্কর্য। এই গেট পেরিয়ে যেতে হবে গ্রামে। হাজার বছর ধরে বালিবাসীরা বিশ্বাস করে এই দরজা তাদের রক্ষা করে সকল অশুভ শক্তির কাছ থেকে। বিশাল ফসলের মাঠ। সেখানে ঢুকতেও এমন গেট। কিন্তু সেগুলো অবশ্য অত বেশি কারুকাজ করা না। কিছুটা সাদামাটা।
বালিকে বলা হয় আইল্যান্ড অভ গডস (island of the gods)। দু’কদম হাঁটলেই একখানা মন্দির। প্রতিটি বাড়িতে একখানা করে মূল মন্দির আবার তাকে ঘিরে একাধিক মন্দির। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটি মন্দির। একটি আগ্নেয়গিরির দিকে। অন্যটি সমুদ্রের দিকে। ওদের এত রকমের গড! এত রকমের পূজা পার্বণ যা রীতিমতো ভীতিকর। সুদেবীর বক্তব্য বালিনিজদের বছরে চৌদ্দটা বড় পূজা। যা খুবই উৎসবমুখর। আর আছে অনেক ছোট ছোট পূজা। পারিবারিক পূজা। জন্ম মৃত্যু বিয়ে। সব মিলিয়ে বছরের বেশির ভাগ দিনই কিছু না কিছু আছে। যে কারণে কোনো দেশি-বিদেশি কোম্পানি, ব্যাংক অফিসে বালিবাসীদের চাকরি দিতে চায় না। বড় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের ভর্তি নিতে আগ্রহী না। কারণ বালিনিজরা অনেক বেশি ছুটি নেয়। গিয়ানার মতে পড়াশোনা বা কাজের জন্য সময় বের করাই মুশকিল পালা পার্বণের কারণে! ওদের সঙ্গের ছেলেটি যে গাইড এবং ড্রাইভার। নাম টেডি। সে খ্রিষ্টান। গিয়ানার সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। গিয়ানা বললো, টেডিকে আমি হিংসে করি। ওর কোনো সময় নষ্ট হয় না। ডিসেম্বরের শেষে একবার মাত্র ছুটি নেয়। বসও ওকে বেশি পছন্দ করে। বেতন বেশি দেয়। ও সব কিছু খায় বলে বাড়ি থেকে খাবার বয়ে আনতে হয় না।
বেশির ভাগ বালিনিজ নিরামিষভোজী। কিন্তু কিছু উৎসবে অবশ্যই আস্ত শুয়োরের রোস্ট হয়! মুসলিম আর খ্রিষ্টানেরা গরু মুরগি মাছ খায়। আর কোন বাড়িটা হিন্দু বাড়ি নয় সেটা বোঝাও খুব সোজা। যে বাড়িতে কোনো মন্দির নেই সেই বাড়ি মুসলিম বা খ্রিষ্টানের। খ্রিষ্টানদের বাড়ির দরজায় ক্রস আছে।
মজার বিষয় হলো এত অমিলের পরেও বালিতে সবাই বেশ শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বাস করছে। কেউ কারো বিষয়ে বিরক্ত নয়। কাছাকাছি মন্দির আর মসজিদ। একই সময়ে মসজিদে আজান হচ্ছে মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে! প্রত্যক্ষ না দেখলে বিশ্বাস হতো না। বালিনিজরা ফটফট করে ইংরেজি বলে। পশ্চিমা পোশাক পরে। মেয়েরা গাড়ি বাইক চালায়। ডিসকোতে যায়। কিন্তু নিরামিষ খায়। ক্লান্তিহীনভাবে পুঁজা-পার্বনে মত্ত থাকে! সুদেবীরা পাঁচ বোন। বড় তিন বোন বালির বাইরে পড়তে গিয়ে মুসলিম ছেলে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এক বোন বিয়ে করেনি। আর সুদেবী বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করবে। গিয়ানার দু’বোন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছে। টেডির মতে এত আঁটসাট অবস্থার মধ্যে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে কে আর তা হাতছাড়া করতে চায় বল। বালিকে গডেসের দ্বীপ বলার পাশাপাশি মোটরসাইকেল আর ফুলের দ্বীপও বলা যেতে পারে। মোটরবাইক দিয়ে কিনা করে ওরা। ব্যক্তিগত যাতায়াত মালপত্র বহন, বাইকের পিছনে ট্রলি লাগিয়ে ফসল বহন সবই চলে। সব পরিবারেই আছে একাধিক বাইক। মোটরবাইক আর বাইসাইকেল। আর আছে ভাড়ার মোটরবাইক। রিকশার মতো পথের ধারে বসে থাকে বাইকওয়ালা। চাইলেই নিয়ে যায় গন্তব্যে। এছাড়া দিন চুক্তিতেও ভাড়া পাওয়া যায় বাইসাইকেল, মোটরবাইক। প্রচুর শ্বেতাঙ্গ পর্যটক দিন চুক্তিতে বাইসাইকেল মোটরবাইক ভাড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে যারা বয়সে তরুণ।
বালিতে পথে-ঘাটে, হাটে-মাঠে ফুলের মেলা। প্রতিটি বাড়িতেই দু’চারটে ফুলের গাছ। ধানের জমির আলে সারি করে ফুলের গাছ! কাঠগোলাপ প্রায় সব বাড়িতে আছে। এত ফুল যে দেখে বিস্ময় জাগে। গাঁদা, দোপাটি, গোলাপ চন্দ্রমল্লিকা জিনিয়ার ছড়াছড়ি। আরও কত যে নাম না জানা ফুলের সঙ্গে আছে জবা। বালিনিজরা বলে- ফুল হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
ফুলের সঙ্গে আছে প্রজাপতি আর পাখির মেলা। শালিখ চড়ুই, ঘুঘু, বক, লাভবার্ডস ফিঙে, এমন সব চেনা পাখিদের দেখেছি নির্ভয়ে ঘুরছে মানুষের চারপাশে। বেশ লাগে দেখতে। সাগরের আকাশে সিগাল আর পানিতে ডলফিনের দেখা মিলেছে। প্রচুর বাদুর আছে বালিতে। কিন্তু বাদুড়কে পাখির দলে ফেলা যায় কি না জানি না।
বালির বাড়িগুলোর একটা বিশেষত্ব হলো বাড়িতে ঢোকার সদর দরজাটা বেশ ছোট। বাড়িগুলোর ভিতরটা সমান নয়। নানা রকম ধাপ আছে। সব ঘরের বারান্দা আছে। কোনো ঘর একটু উঁচু তো কোনোটা নিচু। মোট কথা বাড়ির আঙিনাতেও নানা রকম ধাপ। শোবার ঘর রান্নাঘর তো আছেই। সঙ্গে আছে একটা খোলা ঘর। যেখানে কেউ মারা গেলে তাকে রাখা হয়! এই যে নানা রকম স্টেপ এটা হোটেল রেস্তোরাঁ শপিং মলেও আছে। রাস্তা থেকে ছটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে রেস্তোরাঁর বারান্দা। এবার চার সিঁড়ি নেমে মূল রেস্তোরাঁ। হিন্দু মুসলিম সবার বাড়িঘরই এমন। বালিনিজরা বিশ্বাস করে অশুভ শক্তি এই সব নানা রকম ধাপ অতিক্রম করে তাদের ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।
বালির লোকেরা ঘরে কখনো জুতো নিয়ে ঢোকে না। জুতো অবশ্যই খুলে ঘরে যায়। ওরা বিশ্বাস করে মানবদেহ হলো ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড। যেমন আকাশ জমি আর পাতাল। মাথা অবশ্যই আকাশ। শরীরের মাঝখানটা মাটির দুনিয়া। আর পা হলো পাতাল। জুতো খুলে পা ধুয়ে তবেই ঘরে যাওয়া। বালির রাজধানী দেনপাসার (DENPASAR) ছাড়া আর কোথাও বিশেষ করে গ্রামে একতালার বেশি দালান নেই। কারণ অন্যের মাথার উপরে হেঁটে বেড়ানো ওদের মোটেও পছন্দ নয়। বর্তমানে বালিনিজরা পশ্চিমা পোশাকেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। প্যান্ট শার্ট, টি-শার্ট, স্কাট-টপসই পরে। কিন্তু উৎসবে পার্বণে এখনও নিজস্ব পোশাক পরে। পুরুষরা সারং (লুঙ্গি) শার্ট পরে। সারাং-এর উপরে এক টুকরো আলগা কাপড় থাকে। যেটা কোমর থেকে হাঁটু অব্দি। মাথায় ফেটা বাঁধে। যার একদিক উঁচু অন্যদিক নিচু। ডান দিকটা উঁচু মানে পজেটিভ। বামদিকটা নিচু।
মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী সাজসজ্জা সত্যিই মোহনীয়। মেয়েরাও সারং (লুঙ্গি)-এর সঙ্গে নেটের টপস পরে। কোমরে চওড়া বেল্ট বা কোমর বন্ধনী বাঁধে। উঁচু করে খোপা করে। আর খোঁপায় ফুল দেয়। দেখতে খুব সুন্দর লাগে। বাটিকের অসাধারণ সুন্দর সুন্দর সারং পাওয়া যায়। যার বেশির ভাগই ভেষজ রং-এর। যদিও এখন দামের জন্য স্ক্রিন প্রিন্টের কাপড় বেশি বেচাকেনা হয়।
সবচেয়ে বিস্ময় হলো বালির আবহাওয়া। এমনিতে সব সময়ই গরম। তাপমাত্রার খুব বেশি হেরফের হয় না। সকাল দশটার পর থেকেই সাগরের পাড় উত্তপ্ত। গরমও লাগে খুব। বিকালে তাপ কমে। বৃষ্টিও যখন তখন। বিশেষ করে বিকেলে। ঋতু মোটে দুটো। গ্রীষ্ম আর বর্ষা। মে থেকে অক্টোবর গ্রীষ্ম, নভেম্বর থেকে এপ্রিল বর্ষাকাল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য কোন ঋতুর দরকার হয় না। সে যখন তখন, যেখানে সেখানেই হতে পারে। এই এখানে বৃষ্টি ঝরে পড়লো কিন্তু কয়েক মিটার দূরেই রোদ ঝলমল করছে। আর সাগর থেকে যতই পাহাড়ের দিকে যাবে ততই ঠাণ্ডা। সেও মাত্র আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা গাড়ি ড্রাইভ করলেই। এই রোদে ঝলসে যাচ্ছিল, এক ঘণ্টা গাড়ি ড্রাইভ করলেই শীতের কাপড় গায়ে দিতে হয়। আর সেটা সারা বছরই এক রকম। বালি দ্বীপের মাঝখানে হলো সবচেয়ে উঁচু পাহাড় মানে বড় ভলকানো। যেটা তিন হাজার মিটার উঁচু। এছাড়াও আছে আরও দুটো ভলকানো যার উচ্চতা দুই থেকে আড়াই হাজার মিটার উচ্চতায়। যেখানে অবিরাম কুয়াশা ঝরে। কনকনে শীতের হাওয়া।
বালির সী বিচের খুব সুনাম। বালিতে অনেকগুলো বিচ আছে। যদিও পুরো দ্বীপটি সাগরের মাঝে অবস্থান করছে। এর মধ্যে দেনপাসারের কুটা বিচ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আর নতুন জেগে ওঠা অংশে পাণ্ডব বিচ। মহাভারতের পঞ্চ পাণ্ডবের নামে রাখা হয়েছে এই নাম। ওরা বলে পাণ্ডুয়া বিচ। এই বিচে যেতে পথের ধারে পাহাড় কেটে পাথরের পঞ্চপাণ্ডবের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। সঙ্গে আছে তাদের মা কুন্তি। বিচ পর্যটকদের কাছে খুব প্রিয়। তাদের জন্য রয়েছে সব সুযোগ। আনন্দ করার ব্যবস্থা। কিন্তু বালিনিজরা সমুদ্র থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসে। অল্প কিছু জেলে ছাড়া বাকি বালিনিজদের সাগরের সঙ্গে কোনো সখ্যতা নেই। সাগরপাড়ে বেড়াতে যাওয়া বা সমুদ্রে স্নানে সামান্যতম আগ্রহ নেই বালিনীজদের। আজকের বালিনীজরা শুধু গাইড হিসেবেই সাগর পাড়ে যায়। আমি দেখলাম গিয়ানা সাগর পাড়ে গিয়ে সাগরের দিকে চেয়েও দেখল না। ও বরং অনেক বেশি উত্তেজিত ভলকানো নিয়ে। পাহাড় নিয়ে। আর সে কারণেই হয়তো বালির সমুদ্র এখনো অনেকটা দূষণমুক্ত। সাগরে এখনো কোরাল শ্যাওলা ডলফিনেরা নিরাপদে আছে। বালিনীজরা শুধু মৃতদেহের ছাই ভাসাতেই সাগরে নামে। বালির উত্তর দক্ষিণ দিকের বিচ সারা বছরই খুব উত্তপ্ত থাকে। কিন্তু এই ছোট্ট দ্বীপটি বৈচিত্র্যে ভরপুর। বিচগুলো একেকটা একেক রকম। একেক বিচের বালি (SAND) একেক রঙের! যা সত্যি অবাক হওয়ার মতো। দেনপাসার বিমানবন্দরের পেছনে পেনিনসুলার কাছের বিচের বালি (SAND) এক্কেবারে সাদা। বালির সবচেয়ে লম্বা বিচ কুটাবিচ। প্রায় পনের মাইল লম্বা। এই বিচের বালি (SAND) কিছুটা কালো। যত উত্তরে যাবে বিচের বালির রঙ ততই বেশি কালো দেখতে। আর এই কালো বালিতে ঝিকমিক করে সোনালি বালির কণা। দেখতে খুব ভালো লাগে। তানালথ বিচ এক্কেবারে অন্যরকম। নিরেট কঠিন পাথরের বিচে আছড়ে পড়ছে সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ।
এত ছোট একটা জায়গায় প্রকৃতির এত বৈচিত্র্য অবাক হবার মতো। দ্বীপের যে গ্রামগুলো সবই শস্যে সবুজে উপচে পড়ছে যেন। প্রচুর বনজঙ্গল। বড় বড় গাছ। বুনো ফুলের সমারোহ। আবার নিরেট কালো পাথরের পাহাড়। কাঁকড়, ঝিনুক শামুকে বিছানো সমুদ্রতট। দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া বিস্তৃত জলরাশি। আর বিশাল উঁচু পাহাড়ে আগ্নেয়গিরি! ভারি অদ্ভূত লাগে। কি বিচিত্র্য বৈপারিত্য। আগুন আর জলের পাশাপাশি বসবাস। কখনো আগুন গড়িয়ে যায় জলে। জলে তখন আগুন জ্বলে।
নভেম্বরের এক তারিখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুই তারিখ দুপুরে গিয়ে পৌঁছুলাম বালি। শুনতেই কাছে। পাক্কা চৌদ্দ ঘণ্টা পার করে বালি পৌঁছুলাম। প্লেন থেকে নেমে আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ওরে বাবা কি রোদ। আর চিরবিড়ে গরম। বিমানবন্দরে নেমে মনে হলো যে কোনো রাজপ্রাসাদে এলাম। বিমানবন্দরের দালান এমনই দেখতে। বালি যেতে ভিসা লাগে না। আমরা ভেবেছিলাম বিমানবন্দরে ভিসা দেয়া হবে। ইমিগ্রেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই সে ভাবে। একটা ভিসা কাউন্টার দেখে এগিয়ে গেলাম। কাউন্টারে বসা মেয়েটি বললো কদিন থাকা হবে? এই পাঁচ ছদিন।
ওহ! তা হলে কিছুই লাগবে না। চলে যান। অবহেলা ভরে মনোযোগ দিল অন্য প্যাসেঞ্জারের দিকে। আমরা বেরিয়ে এলাম কিছুটা অবাক হয়ে। এর আগে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি।
বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল সুদেবী। ছোটখাটো সুন্দরী তরুণী সুদেবীর হাসিমুখ দেখেই দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি উধাও।
দেনপাসার বিমানবন্দর থেকে আমাদের হোটেলে পৌঁছুতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো লাগল। যেতে যেতে দুপাশে চোখ রাখলাম। চারদিকে সবুজের সমারোহ। আর ছোট বড় বাড়ি। বিশাল বিশাল বেশকটি ভাস্কর্য। কোনো সড়ক দ্বীপ খালি নেই। ভাস্কর্য মানেই রামায়ণ মহাভারতের চরিত্ররা দণ্ডায়মান। কুন্তি পঞ্চপাণ্ডব কৃষ্ণ দ্রৌপদির ছড়াছড়ি। বিমানবন্দর আর আমাদের হোটেলের মাঝামাঝিতে এক বিশাল ভাস্কর্য। এত বিশাল যে পেরিয়ে যেতে তিন মিনিট সময় লাগল। বিশাল জায়গাজুড়ে একত্রিত হয়েছে মহাভারতের চরিত্ররা। বালির প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অগুনতি ভাস্কর্য। ইন্দোনেশিয়ার প্রতীক (!) সব ভাস্কর্যই কালো পাথরের। বাড়িঘর মন্দির সবই কালো পাথরের। দেখে মনে হয় পাথরগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। সেই পাথর দিয়ে যেমন ভাস্কর্য বানানো হয়েছে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। আর এই শক্ত পাথরে হাতুড়ি ছেনি চালিয়ে কি যে অপূর্ব কারুকাজ! বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
হোটেলে এসে শুরু হলো ঝামেলা। চেক ইন করার সময় ১২টায় কিন্তু আমাদের জন্য বরাদ্দ করা ঘরের অতিথি দুটোয় বেরুবে। তার প্লেন পাঁচটায়। অতএব, তারা এখন যাচ্ছে না। আমরা বসলাম লবিতে। ততক্ষণে সুদেবীর সঙ্গে বেড়ানোর প্রোগ্রাম ঠিক করে নেয়া যেতে পারে। সুদেবী তার বিশাল ব্যাগ থেকে বিভিন্ন রকম ব্রোশিয়ার বের করে দিল। সকাল ছয়টা থেকে বেড়ানোর শুরু। চলবে রাত অব্দি। তাতে যেমন দর্শনীয় স্থান আছে তেমনি আছে বিচ, শপিং, ডিসকো। আমি সুদেবীকে সরাসরি বললাম যে সকাল দশটার আগে বেরুতে পারব না। তাতে বেড়ানো হোক বা না হোক। সুদেবী বললো তাতে খরচ বাড়বে। কারণ তোমরা দুজনে একটা গাড়ি নিয়ে যাবে। গাইড নেবে। আমি কর্তার দিকে না তাকিয়েই বলে দিলাম তাই সই। এই বয়সে ভোরে উঠে হুড়পাড় করে বেরুতে পারব না। আর তিন চারদিনে সব কিছু দেখে ফেলব এমন মনোভাবও নেই। ঘর পেতে পেতে চারটে বেজে গেল। সুদেবীকে বিদায় জানালাম। যাওয়ার আগে সুদেবী বলে গেল আগামীকাল তার জন্মদিন। সে উপলক্ষে তার বাবা মা পূজা রেখেছে। সারা দিন সে উপবাস করবে। তাই আসতে পারবে না। পূজা উপলক্ষে তার হবু স্বামীও আসবে পরিবারসহ। বিকালে সাগরে অঞ্জলি দিয়ে পূজা সমাপ্ত হবে। তারপর পুরোহিত ভোজন শেষে খেতে পাবে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম প্রতি বছর এমন আড়ম্বরে পুজো হয় তোমার জন্মদিনে? না না তা নয়। এ বছর আমার পঁচিশ বছর পূর্ণ হবে। পঁচিশ হলে এই পূজা করতে হয়। অনেক খরচও হয় পূজায়।

যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না তারা কি করে?
তারাও পুজো করে কিন্তু গ্রামের কয়েকজন মিলে করে।
মানে?
ধর গ্রামে তিন চারজন ছেলেমেয়ে পঁচিশ পূর্ণ করলো। বা কেউ দু-এক বছর আগেই পঁচিশ পূর্ণ করেছে। সবাই মিলে একত্রিত হয়ে উৎসবটি করে। সবাই মিলে ভাগ করে খরচ করে।
জন্ম মৃত্যু সবেই তাদের একই অবস্থা। সুদেবীর কাছে শুনে তো আমার মাথায় হাত। পরিবারের কেউ মারা গেলে তার শ্রাদ্ধ শান্তি করতে গিয়ে বহু পরিবারকে তাদের জমি অব্দি বিক্রি করতে হয়। তাহলে দরিদ্ররা কি করে? সেই একই ব্যবস্থা। কয়েক মাস বা বছরব্যাপী অপেক্ষা করে- কয়েকটি পরিবার মিলে শ্রাদ্ধশান্তির আয়োজন করে। কোনো পরিবার যদি সেটাও না করতে পারে তাহলে গ্রামবাসী মিলে চাঁদা দিয়ে ব্যবস্থা করে। বালিতে কৃষি কাজই একমাত্র উপার্জনের পথ। আর আছে পর্যটন। পর্যটন শিল্পে বালিনীজদের অংশগ্রহণ খুব প্রবল নয়। পর্যটন শিল্পে নিচের দিকে কাজ করে বালিনীজরা। আর দোকানে পথে ঘাটে। বড়সড় কাজ পেতে হলে যে যোগ্যতা লাগে সেটা অর্জনে বালিনীজরা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
সুদেবীকে বিদায় দিয়ে নিজেরা স্নান সারতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। হোটেলের রুমে এসি আছে। কিন্তু লবিতে বা অন্য কোথাও নেই। গরমে ঘেমে গোবর হয়েছিলাম। স্নান করতে পেরে বাঁচলাম। রাতের খাবারের জন্য গেলাম হোটেলেরই রেস্তরাঁয়। ভেবেছিলাম এদের খাবার থাইল্যান্ডের মতো হবে। হায় কপাল! কোনো মিলই নেই। যেমন ঝাল তেমনি মশলা। কি যে দিয়েছে তরকারিতে আল্লাহই জানেন। খাবার নিয়ে বসে কিছুতেই খেতে পারা গেল না। ধ্যাত বলে খাবার সরিয়ে রেখে ওয়েটারকে বললাম দুধ হবে এক কাপ। ঠাণ্ডা দুধ আর দুটো বনরুটি নিয়ে খেয়ে নিলাম। কিন্তু আমার কর্তা সেই ঝাল মাংস আর ভাত খেল। আমি বাধা দিতে চাইলাম। যথারীতি ব্যর্থ হলাম। ঢাকা বিমানবন্দরে, কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে দু’জায়গাতেই সে নানা রকম খাবার চেখে দেখছে। মনে মনে ভাবলাম হয়েছে। আছে কিছু কপালে। এরপর যে ক’দিন বালিতে ছিলাম খাওয়া নিয়ে ঝামেলা লেগেই ছিল। তবে নিজের মতো করে কিছু ব্যবস্থাও করে নিয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়ান একটা ডিশ আমার খুব প্রিয়। যেটা ব্যাংকক গেলে খাই। সেটা একটা সম্পূর্ণ ডিশ। নাম হলো ‘নাসিগোরান’। ফ্রায়েড রাইস, একটা ডিম পোচ আর একটা টুকরো মুরগির ভাজা। নাসিগোরানেও অনেক মশলা থাকে। তবে ঝাল একটু কম। আমি সকালে কন্টিনেন্টাল নাস্তা খেতে পছন্দ করি দেশের বাইরে। দুপুরে স্যান্ডুইচ আর কফি। রাতে ভাত খেতে গেলেই ঝামেলা। মাছ ভাজা আর ভাত সালাদ খেয়েছি। মাছ মানে অবশ্যই সামুদ্রিক মাছ। কিন্তু ঝোল তরকারি বা ইন্ডিয়ান ডাল খেতে গেলেই ঝামেলা। যেমন ঝাল তেমনি মশলা। আর সঙ্গে নারকেল বাটা, নারকেল এর দুধ রান্নাও নারকেল তেলে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। আমি ভাত মাছ ভাজা আর সালাদে খেয়ে নিতাম। খেতাম হাত দিয়ে। মাছের ল্যাজা মাথা চিবিয়ে বেশ মজা করে খেতাম। কিন্তু বেচারা মোজাম্মেল এসব শুকনো খাবার খেতে গিয়ে মহাবিরক্ত। আমার কিন্তু ভালই লাগতো। শুধু ওয়েটারদের বলে সালাদে কাঁচা পেঁয়াজ কাঁচামরিচ চেয়ে নিতাম। আমি যখন রাতে খেতাম তখন আশপাশের টেবিলে খেতে আসা শ্বেতাঙ্গরা আড়চোখে চেয়ে চেয়ে দেখতো বিষ্ময়ের সঙ্গে। একদিন আমি মাছের এত বড় মাথা চিবিয়ে ছাতু করে পাশের প্লেটটাতে ফেলছি। মাছের কাটা চিবিয়ে ফেলছি। পাশে বসা দু’জন মহিলা। খুব মন দিয়ে তরুণী আমার খাওয়া দেখছিল। খাওয়া শেষে আমি গেলাম হাত ধুতে। হাত দিয়ে খেয়েছি তো। হাত ধুয়ে ফিরছি তখন তরুণী মিষ্টি হেসে যা বললো বাংলা করতে তা এরকম- ওহঃ দারুণ। অসাধারণ লাগছিল তোমার খাওয়া দেখতে। খুব মজার ছিল তোমার মাছ ভাজা তাই না।
আমি হেসে বললাম হ্যাঁ।
কাল আমি এই ডিশটা খাব। আমার নাম ক্লারা। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছি। হাত বাড়িয়ে দিল ক্লারা। আমি ওর হাতে হাত রেখে নিজের নাম বললাম।
কাল সকালে আমার ফিঁয়ানসে আসছে। তাই রাতের জন্য আমি এটা প্ল্যান করেছি। আমার ফিঁয়ানসেরও এটা ভাল লাগবে আশা করি।
হ্যাঁ অবশ্যই ভাল লাগবে। যদি তুমি হাত দিয়ে খাইয়ে দাও তা হলে আরও বেশি ভাল লাগবে খেতে। জোরে হেসে ফেললো ক্লারা।
বিদেশিরা জানে না হাত দিয়ে খেতে খাবারের স্বাদ দ্বিগুণ হয়ে যায়। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। বালিতে কিছু খাবার খুব ভালো। তার মধ্যে ডাব, ফল আর কফি। যারা ফল খেতে ভালোবাসে তাদের জন্য খাবারের অভাব হবে না। কাঁচা কলার চিপস, মিষ্টি আলুর চিপস, কলা পোড়া পাকা কলার কলাগুণী (বেগুনীর মতো করে বেসনে ডুবিয়ে ভাজা) বালির জনপ্রিয় খাবার। খেতেও ভালো। কাঁকড়া, অক্টোপাস ইত্যাদি সামুদ্রিক প্রাণী আছে। যারা এসব খায় তাদের রসনা তৃপ্ত করবে। পর্ক আছে যত্রতত্র। তাই খাবারের অভাব নেই। অভাব হলো স্বভাবে। কারণ আমরা তো সবকিছু খাই না। দুপুর বেলা ভুট্টা সেদ্ধ কলা পোড়া খেয়ে দিব্বি কাটিয়ে দেয়া যায়। একবেলা অল্প চারটি ভাত-ডালের জন্য মন আনচান করে এই যা।
বালির ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্য পোশাকেই স্বচ্ছন্দ। একটু বাইরের দিকে গেলেই দেখা যায় ওদের নিজেদের পোশাক। মেয়েরা একটা লুঙ্গি আর উপরে শার্ট, টি-শার্ট পরে। যারা কিছুটা ফ্যাশন দুরস্ত তারা উপরের টপসটা বানায় লেসের কাপড় দিয়ে। খোঁপায় ফুল প্রায় সব বয়সি নারীই দেয়। সে নারী হাটে মাঠে অফিসে যেখানেই কাজ করুক। পুরুষদের লুঙ্গি শার্ট খুব কমন পোশাক। মেয়েদের লুঙ্গিকে ওরা বলে স্যাম। আর উপরের টপটা হলো কাবাইয়া। বালিনিজদের পোশাক খুব সুন্দর। কিন্তু একটু সেক্সি লাগে দেখতে। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। মেয়েরা প্রচুর সাজে। মুসলিমরা এই পোশাকের সঙ্গে মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধে। গয়নাগাটি খুব পরে মেয়েরা। আর সাজতেও জানে। ভালো লাগে দেখতে। বালিনিজরা দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু ওদের দেবদেবীগুলোর প্রায় সবই বীভৎস চেহারার বালিনিজদের শিব বিষ্ণুদের চেহারা প্রায় রাক্ষস ক্ষোখসের মতো। সেই যে ছোটবেলায় আম্মার কাছে গল্প শুনেছি কুলার মতো কান। মূলার মতো দাঁত। আগুনের গোলার মতো চোখ। ভারত বা আমাদের দেশের দেব-দেবীদের সঙ্গে বালিনিজ হিন্দুদের দেবতার কোনো মিল নেই। অবশ্যই হিন্দু হলেও ওরা তো ওদের পূর্ব পুরুষের ধর্ম বিশ্বাসকে বর্জন করেনি। বরং, দুটোকে বেশ সুন্দর করে মিশিয়ে নিয়েছে।
বালির বাতাসে বুঝি ঘুমের ওষুধ মেশানো আছে। সকালে ঘুম থেকে জাগতেই ন’টা বেজে গেল। তৈরি হয়ে বেরুতে প্রায় ১১টা। রোদেয় ঝলমল করছে চারদিক। চিড়বিড়ে গরম। লবিতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল গাইড গিয়ানা আর জ্যাক। একেবারে বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো। আমি তো কিছুটা দমিত হয়ে গেলাম। এদের সঙ্গে যেতে হবে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করেছিল গিয়ানা জ্যাক দুজনেই। জ্যাক গাড়ি চালায় গিয়ানা গাইড। জ্যাক খ্রিষ্টান। বাড়ি জাভায়। সে বালি কলেজে পড়ে। আর চাকরি করে ট্রাভেল এজেন্সিতে। গিয়ানাও পড়ছে কলেজে। গিয়ানা ইসকনের মন্দিরের সদস্য। তার পরিবারের কেউ ইসকনের মন্দিরে যায় না। এই নিয়ে পরিবারের সঙ্গে তার মতবিরোধ হচ্ছে। কিন্তু গিয়ানা তার সিদ্ধান্তে অটল। জ্যাক খুব সুন্দর দেখতে। ভালো গাড়ি চালায়। সে জানাল গিয়ানা না এলেও সে আমাদের ঘুরিয়ে আনতে পারতো।
লবিতে বসে প্রথমে গিয়ানা একখান লম্বা লিস্ট বের করল। তাতে লেখা সেদিন আমাদের কোথায় কোথায় যাবার কথা। কি কি দেখার কথা। আমাদের বের হবার কথা সকাল সাতটায়। সাধারণত পর্যটকেরা তাই যায়। কারণ, তাদের অনেক রকম ইভেন্ট থাকে। আমরা তো বের হতেই ১১টা বেজে গেল। গিয়ানা চিন্তিত। আমি ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম রাখ তো। কোনো চিন্তা নেই। চল বেরিয়ে পড়ি।
কোথায়? অসহায় চেহারা গিয়ানার। বালি দেখব। বালির জীবন। গ্রামের জীবন দেখব।
হুম। দেখাতে পারব। কিন্তু দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার কি হবে?
কোনো চিন্তা নেই। সকালের প্রোগ্রাম তো বাদ। চল উলুনডালু টেম্পল। যাবার সময় গ্রামের পথ দিয়ে যাব। একটু ঘুরপথ হবে হয়তো। অসুবিধা হবে তোমাদের?
না না কোনো অসুবিধে নেই। বললো চালক।
বালি আমার চেনা পৃথিবী থেকে একটু অন্যরকম। এখানে আধুনিকতা আর আদিমতা মিলেমিশে একাকার। দেনপাসার থেকে বের হতে খুব বেশি সময় লাগে না। তারপরেই শুরু হয় গ্রামীণ জীবন। পুরোটাই তো পাহাড়। প্রচুর ফসল। ফসলের চেহারাও দারুণ ঝকঝকে। জুম চাষও আছে। ধান ভুট্টা সবজি ক্ষেতের আলপথ আলো করে আছে গাঁদা দোপাটি আর জবা ফুল। প্রায় সব বাড়িতেই একটা দুটো কাঠ গোলাপের গাছ আছে। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। আর কোনো দেশে আমি এটা দেখিনি। ফুলের চাষ হয়। মাইল মাইল ফুলের ক্ষেত দেখেছি। কিন্তু ধান কপি লেটুসের জমির কোনে হঠাৎ হেসো ওঠা গাঁদা ফুলের ঝোপ আমাকে চমকে দিয়েছে। মাঠে কৃষানের সমপরিমাণ কৃষানীদের দেখা গেল সক্রিয়। হয়ত নারীদেরই অবদান।
উলুন ডানু টেম্পলে যাবার পথে একটা গ্রাম পরল। যার নাম বাঙালি (ইঅঘএঅখও)। দেখে তো আমি বিস্মিত উল্লসিত। ভাবলাম হয়ত এই গ্রামে বাঙালিরা থাকে। গিয়ানা আমার উল্লাসে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়ে বললো এটা হিন্দু ব্রাহ্মণ প্রধান গ্রাম। কেউ বাংলায় কথা বলা তো দূরে থাক বাংলা হয়তো শোনেওনি। গ্রামে তিনটি মন্দির আছে ব্রাহ্মণদেব। যেখানে অন্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আর আছে সাংহিয়াং উইডির মন্দির। সেখানে অবশ্য সবাই যেতে পারে।
বোরাপাথ লেকের পাড় ধরে গাড়ি ছুটছে উলুন ডানু টেম্পলের দিকে। লেকের দু’পাশেই উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের শরির পেঁচিয়ে লেকের পাড় ধরে রাস্তা। আহা কি দারুণ মন ভরানো প্রকৃতি। ঝকঝকে নীল আকাশ ভর্তি সাদা মেঘের ভেলা এক অমোঘ আকর্ষণে ছুটছে পাহাড়ের দিকে। বিশাল এলাকা নিয়ে মন্দির। পুরোটা হেঁটে ঘুরলে কয়েক মাইল হাঁটা হয়ে যাবে। আর হেঁটেই ঘুরতে হবে। এত রকম ধাপ! আমি আর কোথাও দেখিনি। কত রকমের যে সিঁড়ি! এত্তো চওড়া, বড় বড় উচু ধাপ, ছোট ধাপ, সরু সিঁড়ি। চারিদিকে ছড়ানো বড় মাঠকে ঘিরে বিশাল বিশাল গাছ। গেটের এক ধারে শপিং আর রেস্তোরাঁ। মন্দিরের ছাদ ছনের। একেবারে ট্রাডিশনাল দরদালান, নাটমন্দির। প্রচুর স্থাপনা। অনেক পুরোহিত ঘোরাঘুরি করছে। মূল মন্দিরে কেউ যেতে পারে না। এমন কি গিয়ানাও নয়। তবে গিয়ানা মন্দিরের বিষয়ে একটুও আগ্রহী নয়। সে ব্যস্ত আমাকে নিয়ে। আমার সঙ্গি নাট মন্দিরের মেঝেতে পা ঝুলিয়ে বসে। পরেছে। তার নাকি দেখা হয়ে গিয়েছে! অগত্যা আমি আর গিয়ানা। পাথরে খচিত মূত আর বিমূর্ত আলপনা দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। যেতে যেতে খেয়াল করিনি আকাশের মুখ কালো হয়েছে। হঠাৎই আকাশ পাতাল এক করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। গিয়ানা দৌড়ে গিয়ে একটা শেডের নিচে আশ্রয় নিল। আমার বিশাল বপু নিয়ে দৌড় দিয়ে হাস্যকর দৃশ্যের অবতারণা করার কথা অবচেতন মনে এলেও সেটা করতে চেতনা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জোর পায়ে হেঁটে ছাদের তলায় আসতে আসতেই কাকভেজা হয়ে গেলাম। উফ: কি ঠাণ্ডা পানি যে ঢালল আকাশ। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হলো। এর মধ্যে এক ছাতা মাথায় দিয়ে আর এক ছাতা হাতে করে এলো জ্যাক। এক ছাতার নিচে গিয়ানা আর জ্যাক। আর এক ছাতা মাথায় দিয়ে আমি পৌঁছে গেলাম নাট মন্দিরে। আমার সঙ্গী বিরস বদনে বসে আছে। আমি আসার সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাঁকিয়ে তাকাল। পা থেকে মাথা অব্দি দেখল। তারপর যা হয়। আমার আবার যখন তখন ঠাণ্ডা লাগে। মাথা ভার গলা ব্যথ্যা থেকে বুকে কফ জমা পর্যন্ত গড়িয়ে যায় কখনো কখনো। তাই তার রেগে যাওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত। যদিও গিয়ানা তাকে বোঝাল যে বালির আবহাওয়া এমনই। যখন তখন ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প আগ্নুৎপাত সুনামি যে কোনো কিছুই হতে পারে। কিন্তু গিয়ানার কথায় চিড়ে ভিজল না। আমার এই খুটিয়ে দেখার স্বভাব তার মোটেও পছন্দ না সেটা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করল। সঙ্গে এও নিশ্চয়তা দিয়ে দিল যে বেড়ানো খতম। কাল তো জ্বরজারি হবেই ইত্যাদি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে কিছু খাওয়া হয়নি। এমনিতেই মাথা গরম। আমারও তখন একটু ভয় হলো। সত্যিই তো যদি ঠাণ্ডা বসে যায়। আমি গিয়ানাকো বললাম তোমরা দুজন রেস্তরাঁতে যাও। আমি দোকানগুলোতে দেখি কোনো কাপড় পাওয়া যায় কিনা। মোজাম্মেল বিস্মিতভাবে বললো তোমার মাপের রেডিমেড পোশাক!
কেন নয়। এই যে চারপাশে এত এত বিদেশিনী। ওদের অর্ধেকেরও বেশি জন তো আমার চেয়েও বিশাল।
পঁচিশ ত্রিশটা দোকান। প্রায় সবই নারীদের পরিচালনায় চলছে। বেশির ভাগই হস্তশিল্প। আর বাটিকের কাপড়। আমি প্রথম দোকানটায় ঢুকে ভয়ে ভয়ে বললাম দেখ একদম ভিজে গিয়েছি। পোশাক পাল্টানো দরকার। কিন্তু আমার মাপে কিছু কি পাওয়া সম্ভব?
অবশ্যই। কটা পোশাক চাও তুমি। তরুণী হাসি মুখে আমার হাত ধরে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেল। তারপর ওর হাত ধরেই পুরো এক প্রস্থ পোশাক কিনে পাল্টে নিলাম। তরুণীর নাম সুদেষ্ণা। চায়নিজ টাইটস আর বালির বাটিকড প্রিন্টের কাফতান। সঙ্গে থাইল্যান্ডের স্কার্ফ। দারুণ আন্তর্জাতিক সম্মিলন। কৃতজ্ঞতায় গলে গিয়ে সুদেষ্ণার কাছ থেকে আরও কটা জিনিস কিনে নিলাম। দোকান থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে সুদেষ্ণা বললো তুমি যদি চুল শুকিয়ে নিতে চাও নিতে পার। আমাকে বিস্মিত করে কাপড়ের ভিতর থেকে একটা হেয়ার ড্রায়ার বের করে নিয়ে এলো। আমার অবাক ভাব বুঝে বললো এটা আমার নিজের ব্যবহারের জন্য। যা হোক চুল শুকিয়ে নতুন পোশাক পরে গর্বিত ভঙ্গিতে রেস্তরাঁয় ঢুকে দেখলাম গিয়ানা মোজাম্মেল দুজনেই উদাসভাবে বসে আছে। তাদের সামনে কোনো খাবার নেই। কারণ গিয়ানা নিরামিষ ছাড়া খায় না। মোজাম্মেল বুঝতে পারছে না কি খাবে। শেষ আব্দি চিকেন স্যান্ডুইচ আলু ভাজা আর কফি খেয়ে পেটকে শান্ত করতে হলো। কারণ এটাই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি সার্ভ করতে পারল ওরা।
গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। জ্যাক বললো এবার আমরা অন্য পথ দিয়ে যাব। ছোট ছোট শহর পরবে পথে। সেনানিবাস, নেভি বেইজ ক্যাম্প দেখতে পাবে পথে।
যাচ্ছিা কোথায়? হোটেলে? জানতে চাইলাম আমি।
 না না তা কেন। তানালথ টেম্পলে যাচ্ছিা আমরা।
আবার টেম্পল! মোজাম্মেল হতাশ। গিয়ানা মুখে একগাদা খাবার নিয়ে বললো- না টেম্পল নয়। তানালথ বিচে যাচ্ছি আমরা। গাড়িতে উঠেই গিয়ানা তার খাবার বক্স খুলে বসেছিল। আমি উঁকি দিলাম ওর খাবারে। ভাত বেগুন ভাজা, সয়াবিন মিষ্টি আলু ভাজা। গিয়ানার খাওয়া দেখে বুঝলাম বড্ড খিদে পেয়েছে মেয়েটার।
তানালথ-তানালথ পৃথিবীর বিখ্যাত ফটোগ্রাফারদের প্রিয় বিচ। এই বিচের সূর্যাস্তের ছবি তুলে না কি অনেক ফটোগ্রাফার বিখ্যাত হয়েছে। ছোট জনপদ। কিছুটা শহুরে। বেশ বড় এক মসজিদ রয়েছে। রাস্তা থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। যেই না পাহাড়ের ধাপ পেরিয়ে মন্দিরকে পাশে রেখে নিচে নেমেছি আমি তো বিস্ময়ে হতবাক। কারণ এই দৃশ্য আমি আগেও দেখেছি ছবিতে। নিরেট পাথরের বিচ। বিশাল বিশাল পাথর। নানা আকৃতির। খয়েরি ঘেঁষা কালো পাথরগুলো প্রকৃতির গড়া ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। সামনে নীল জলরাশি। সগর্জনে আছড়ে পরছে পাথরের ওপর। একেকটা ঢেউ সাত আট ফিট উঁচু হয়ে আসছে। যদিও তখন ভাটা শুরু হয়েছে। আকাশ লাল হয়ে গিয়েছে। সূর্যটা মেঘের আড়াল থেকো মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল। তানালর্থ বিচ থেকে সাগরের ভিতরে তিন চারশ’ মিটার ভিতরে একটা উঁচু পাহাড়। ইংরেজি অক্ষর ইউকে উল্টো করলে যেমন দেখতে হবে ঠিক তেমনি। পাহাড়ের চারদিকে সাগর। মাঝে গুহাটাও সাগর। ভাটায় পানি সরে যায়। অল্প পানি থাকে। জোয়ারে পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। পাহাড়ের উপরে মন্দির। কিন্তু দর্শন নিষিদ্ধ। ভাটা বলে তীর থেকে হেঁটে পাহাড়ের নিচ অব্দি যাওয়া যায়। অনেকেই যাচ্ছে। দেখে আমিও যেতে চাইলাম। গিয়ানাও খুশি। কারণ, তার না কি মানত আছে। গেলাম পাহাড়ের নিচে। গুহার মুখে পুরোহিত বসে আছে। অনেকেই পুজো দিচ্ছে। গিয়ানা পুজো দিল। প্রসাদ নিল। আমি জানতে চাইলাম কিসের মানে কোন দেবতার উদ্দেশে পুজো?
সাপ! আমি বিস্ময়ে হতবাক।
হুম, সাপ। এই গুহায় শত শত সাপের বাস। এই সাপ খুব স্পেশাল। এরা অলৌকিক। কেউ যদি এই সাপকে ছুঁয়ে দিতে পারে তবে সে রাজা হবে। পুজোতে খুশি হলে মনের সব বাসনা পূর্ণ হবে।
তুমি বিশ্বাস কর এসব!
আমি কেন সব বালিনিজই করে।
কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পরলাম ওখান থেকে। কি জানি বাবা এদের এই অলৌকিক সাপ যদি আমার নজরে পরে তবে তো আমি এখানেই জ্ঞান হারাব।
তানালর্থ বিচে সূর্যাস্ত দেখা সত্যিই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সূর্য অস্ত গেল পাহাড়ের গুহার ঠিক মাঝখানে। টুপ করে আকাশ থেকে ঝরে পড়ল সাগরের জলে। আর তখনই এক সঙ্গে মসজিদ থেকে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। মন্দিরে বেজে উঠল ঘণ্টা। আমার মনে হলো কয়েক মুহূর্ত যেন থমকে গেল চরাচর। আজানের সুর আর ঘণ্টাধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিশে গেল আকাশে সাগরে পাহাড়ে। তার পরেই ঝুপ করে নেমে এলো সন্ধ্যা।
রাতে ঘুমিয়ে সকাল বেলা জেগে উঠলাম দারুণ এনার্জি নিয়ে। বারান্দায় বসে বসে সূর্য উঠতে দেখলাম। সকালে খুব সুন্দর বাতাস বইছিল। নাস্তা খেয়ে বেরুতে দশটা বাজল। পথে বের হয়ে বুঝলাম
সকাল দেখে দিনের অনুমান চলবে না। বেলা যত বাড়ে গরমও বাড়ে। রাতে সুদেবীকে বলেছিলাম নাচ দেখতে চাই। বালির নাচ। গিয়ানা জানালো আমাদের প্রথম গন্তব্য হেরিটেজ পার্ক। সেখানে নাচের শো দেখব। এই শো বালির ট্রাডিশনাল ডান্স শো। হেরিটেজ পার্কে আরো অনেক কিছু আছে দেখবার। গুহা চিত্র, যা অনেক প্রাচীন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে খোদাই করে আজকের শিল্পীদের আঁকা ছবি। বিষ্ণুর বিশাল মূর্তি। বন জঙ্গল। চিত্রশালা ইত্যাদি। আমাদের বের হতে যেহেতু দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই হেরিটেজ পার্কে ঢুকেই শো’তে বসতে হলো। বিশাল মঞ্চ। মঞ্চ ঘিরে অর্ধচন্দ্রাকৃতির গ্যালারি। আমরা সহ শ’তিনেক দর্শক। যার প্রায় সবাই বিদেশি। শুরু হলো অনুষ্ঠান। আমাদের দেশের যাত্রাপালার মতো প্রথমে বাদকের দল এলো। তারা কিছুক্ষণ বাজাল। তারপর বন্দনা। এরপর নৃত্যানুষ্ঠান। মহাভারতের গল্পকে নিয়ে নাচের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। গল্পগুলো ওরা ওদের মতো করে বলেছে। সাজ-পোশাক, নৃত্যভঙ্গিমা, মুদ্রা, পায়ের কাজ অনেকটাই ভরত নাট্যমের মতো। হাতের মুদ্রা খানিকটা যেন মণিপুরী নাচের মতো। রাজা রানী রাজকন্যা রাক্ষস সবই আছে নাচে। আছে রাজপুত্র। এক সময়ে বালি রাজা শাসিত ছিল কিন্তু পুরোহিতরাও ছিল রাজার মতো ক্ষমতাধর। এখন রাজা নেই কিন্তু পুরোহিতরা আছেন। আর তাই নৃত্যনাট্যেও তাদের ভূমিকাও আছে। নাচের অনুষ্ঠান দেখে বালির ট্রাডিশনাল নাচ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। শিল্পীদের পারফর্মেন্সও ভালোই। শো মন্দ না। শো থেকে বের হয়ে বাইরে এসে দেখি আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছে। ওরে বাবা কি গরম। প্রায় দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমাদের সঙ্গে এসেছিল সুদেবী। গাড়িও সেই চালাচ্ছিল। গাড়ি ছুটল পাণ্ডুয়া বিচের দিকে। ভারত মহাসাগরে জেগে ওঠা নতুন দ্বীপ। যা বালিসংলগ্ন। সেই নতুন দ্বীপটাকে বালির সঙ্গে জুড়ে নেয়া হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। পাণ্ডুয়া মানে- মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের নামে পাণ্ডুয়া বিচ। এই বিচটা বালি মানে স্যাণ্ডিবিচ। বিশাল বিশাল পাহাড় কেটে পথ বানানো হয়েছে। বড় বড় সেতু বানিয়ে দ্বীপটাকে জুড়ে নেয়া হয়েছে বালির সঙ্গে। বিচের কাছের সব পাহাড়ের মাথা সুন্দর করে সমান করা রয়েছে। সে সব পাহাড় চূড়ায় বানানো হচ্ছে বড় বড় হোটেল, রিসোর্ট। যার সবগুলোর মালিক অস্ট্রেলিয়ান, আমেরিকান আর চায়নিজরা। একটা নতুন দ্বীপ আধো জাগ্রত হয়েছে সাগরে। সেটা কোন এক আমেরিকান কোম্পানি কিনে নিয়েছে। পাণ্ডুয়া বিচে গিয়ে দশ মিনিটের বেশি থাকতে পারলাম না। কারণ কি যে অসম্ভব গরম আল্লাহ্‌। দৌড়ে গাড়িতে উঠে জান রক্ষা করেছিলাম। তবে পাণ্ডুয়া বিচে যাবার পথে একটা জিনিস দেখে দারুণ মজা পেয়েছিলাম। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা হয়েছিল। বিচের কাছাকাছি পাহাড়ের গায়ে বড় বড় ছ’টা গুহা বা ঘরমত করে তাতে পঞ্চপাণ্ডব মানে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব ও তাদের মা কুন্তির ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ভাস্কর্যগুলোর আকার আকৃতি সাজাসজ্জা এক্কেবারে আদিম বালিনিজদের মতো। এত হাস্যকর লাগছে দেখতে যে না হেসে পারছিলাম না।
সুদেবী আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিল। সন্ধ্যায় আমরা নৌভ্রমণে যাব। জ্যাক একাই আসবে। সুদেবী বিদায় নিল। পরদিন দেখা হবে বলে। আমরা যাব আগ্নেয়গিরি দেখতে। যেখান থেকে এখনো ধোঁয়া উঠছে। জীবন্ত আগুন। আমরা যাবার আগে আর একটা আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। সেটা বন্ধ। সেখান থেকে সব মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন সেটা নিষিদ্ধ এলাকা।
সন্ধ্যায় নৌভ্রমণে গিয়ে যথেষ্টই হতাশ হলাম। প্রমোদ তরীর মান ভালো না। ব্যবস্থাপনাতে পেশাদারিত্বের যথেষ্ট অভাব। রাত নামার আগে অব্দি বাইরে বসে সাগর দেখলাম। এসব প্রমোদতরী কোনো দেশেই গভীরে যায় না। তাই পানিতে বসে ডাঙ্গাও দেখা যায়। ভালোই লাগছিল। আচমকা বৃষ্টি এলো। রাত নামল। তাই ভেতরে যেতেই হলো। সেখানে তখন চলছে উদ্দাম নাচের ঝড়। এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতির নাচ ভালোই লাগল। আর ভালো লাগল শোভা সেনের সঙ্গে আলাপ হয়ে। শোভা কলকাতার বাঙালি। ট্যুর গাইডের কাজ করে স্বামী স্ত্রী দু’জনেই। স্বামী একদল বয়স্ক মানুষ নিয়ে এখন আছে জুরিখ। আর সে বালিতে। বাড়িতে কিশোরী কন্যা আর বালক পুত্র রয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ির হেফাজতে। দু’জনের একই সঙ্গে ট্যুর সাধারণত হয় না। তেমন হলে শ্বশুর-শাশুড়ি এসে থাকে। জাহাজে বসেও শোভা দুবার ফোন করলো বাড়িতে। ওর সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পেরে খুব আরাম হলো। যদিও শোভার বাংলায় হিন্দির প্রবল প্রভাব। কারণ ওর স্বামী দিল্লির ছেলে। থাকেও দিল্লিতে। কিন্তু ওর মন পড়ে থাকে কলকাতায়। আমার মতো শোভাও এই প্রমোদতরী ভ্রমণ উপভোগ করলো না। আমাকে বললো ভালো হবে না জানতাম। কিন্তু এতটা বাজে হবে ভাবিনি। যাদের সঙ্গে করে এসেছে তারা বেশির ভাগই বয়স্ক। মধ্যবিত্ত। খুব না কি বিরক্ত করছে খাওয়া নিয়ে। ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে। ঘুমানো নিয়ে, বাসে বসার সিট নিয়ে। কিন্তু কিছু করার নেই। চারদিন এদের সব বাহানা সহ্য করতে হবে। তাও হাসিমুখে।
সকাল ৮টায় আমাদের হোটেল থেকে তুলে নিল সুদেবী আর জ্যাক। গন্তব্য কিন্তামণি আগ্নেয়গিরি। বালি থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। তবেই পৌঁছাবো কিন্তামণি। পাহাড় শরীর বেয়ে গাড়ি উঠছে উপরে। আরো উপরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শীত লাগতে লাগল। সম্পূর্ণ বিপরীত আবহাওয়া! আকাশে মেঘের ছোটাছুটি। গাড়ি উঠছে তো উঠছেই। কিন্তামণি পাহাড়ের উপরে ছোট্ট একটু জনপদ। লোকের গায়ে গরম পোশাক। আমরাতো কিছুই নিয়ে আসিনি সঙ্গে। পথের ধার থেকে কাপড় কিনে পরে ফেললাম। কুয়াশা ঝরছে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মতো। আমাদের নিয়ে গাড়ি থামল একটা রেস্তোরাঁয়। নানা জায়গা থেকেই আগ্নেয়গিরি দেখা যায়। কিন্তু বেঈমান আবহাওয়ার জন্য রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেল সুদেবী। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছিল। জ্যাক আমাদের সঙ্গে এলো। সুদেবী তার খাবারের বক্স নিয়ে দূরে বসলো জ্যাককে সঙ্গে নিয়ে। আমরা বসলাম বাইরে লম্বা টানা বারান্দায়। উঁচু চৌকি মাঝে টুল। চৌকিতে বসে টুলে খাবার রেখে খাওয়া। বালির ট্রাডিশনাল পদ্ধতি। বারান্দার রেলিং এরপরেই গভীর খাদ। পাহাড়ের শেষ সীমা। নিচে কিছু দেখা যায় না। শুধু মেঘের ছোটাছুটি। নিচে লেক। লেকের পাড়ে খুব ছোট ছোট কিছু গ্রাম। তারপরেই সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে পাহাড়, সেটাই আগুন। অগ্ন্যুৎপাত নেই। কিন্তু অবিরাম ধোঁয়া উঠছে উপর দিকে। কখনো বোন্দা বোন্দা ধোঁয়ার কুণ্ডলি। কখনো হুঁশ করে একগাদা ধোঁয়া। আবার কখনো ধোঁয়ার ক্ষীণ রেখা। যেখানে আমরা বসে এই দৃশ্য অবলোকন করছিলাম সেখান থেকে কিন্তামণি আগ্নেয়গিরি প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে। কিন্তামণি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পনেরশ’ মিটার উঁচু। হুঁশ করে ধোঁয়ার বোন্দা উঠে গেল উপরদিকে। আমার মনে হলো যদি এখন অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে যায়। কি হবে তাহলে। মনে করতেই ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল শিরায় শিরায়। দুই পাহাড়ের মাঝে যে লেক সেটার নাম বাটুর লেক। লেকের পাড়ে জনবসতি আছে। কিন্তু সেটা আগ্নেয়গিরি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে মানুষের যাওয়া নিষিদ্ধ। খাবার নিয়ে বসলাম বটে কিন্তু খেলাম কতটা মনে নেই। সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কেটে গেল ঘণ্টা। নিরেট পাথরের পাহাড় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে কত আগুন বুকে নিয়ে। যেকোনো সময় হতে পারে বিস্ফোরণ! ধ্বংস করে দিতে পারে জনপদ। কেন জানি না শাওনের লেখা একটা কবিতা মনে এলো-

হেসো না অত হেসো না
ঐ হাসিতে কষ্ট অনেক
তা মনের দুয়ারে ঢেকো না।
কষ্ট হলো বারুদ সম
বিস্ফোরিত হবেই
তখন যদি দাঁড়াতে পার
বলব নারী তবেই।

দুটো বিষয়ের মধ্যে আসলে হয়তো কোনো মিল নেই। কিন্তু তবুও সেদিন এই কবিতাটাই মনে এসেছিল। পাহাড় আর নারীকে কেউ তুলনা করেছে এমন শুনিনি। নারীকে তো চিরকাল নদীর সঙ্গেই তুলনা করা হয়। কিন্তু কিন্তামণি পাহাড়ের আগ্নেয়গিরিকে সামনে রেখে সেদিন আমার মনে হয়েছিল নারীও এমন বেদনার লাভা বুকে নিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। কয়জনই বা অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়? সবই, সবাই মৃত আগ্নেয়গিরি। জ্বলে জ্বলে পোড়া পাথর হওয়া।
ঘণ্টা খানেক পরে বেরুতেই হলো। নইলে ফিরতে রাত হবে। আমি জোর করে বাটুর লেকের কাছে কিছুটা সময় দাঁড়ালাম। পাহাড় থেকে রাস্তা আছে লেক অব্দি যাবার। কিন্তু খাড়া পাহাড়ি পথ। মোজাম্মেল সুদেবী কেউই আগ্রহী নয়। সিঁড়ি দিয়েও নামা যায়। সেও কয়েকশ’ সিঁড়ি, আমার অসাধ্য। তাই উপরে দাঁড়িয়ে বাটুর লেককে দেখতে হলো। জলের ধারে যাওয়া হলো না।
গত দিন কিন্তামণি থেকে ফিরতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি নেমেছিল। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ। তার উপর ট্রাফিক জ্যাম। তবে আমার বিরক্ত লাগেনি। পথের ধারে দাঁড়ানো নারীদের কাছ থেকে রঙ্গিন মিষ্টি আলু, কলার চিপস কিনে নিলাম। রাস্তার ধারের দোকানে দু’বার কফি খেলাম। দশটায় হোটেলে ফিরে কি খাবার পাব তাই নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম। তখন সুদেবী বললো একটা ভালো মুসলিম রেস্তোরাঁ আছে। যেতে চাইলে নিয়ে যেতে পারি। গেলাম। মাংস রুটি কিনে হোটেলে ফিরলাম। ভিজে কাপড়, ঠাণ্ডা, গরম হাঁটাহাটিতে এতোটাই ক্লান্ত ছিলাম যে সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দশটা। সুদেবী এসে লবিতে বসেছিল। আমি বললাম বেড়ানোর প্ল্যান বাদ। আজ বাটিকের দোকানে যাব। কাঠের তৈরি জিনিসপত্রের কারখানায় যাব। তারপর সী বিচে বসে থাকবো। আমাদের হোটেল অবশ্য সী বিচেই। জানালার পর্দা সরালেই সমুদ্র।
বাটিকের জন্য ইন্দোনেশিয়া বিখ্যাত। তেমনি বিখ্যাত উড কারভিং এর জন্য। বিশেষত বালির শিল্পীরা। আহা কাঠ দিতে যে কত কি করা যায়! কাঠের গায়ে হাতুড়ি বাটালের আঘাতে যে কি অসাধারণ ছবি ফুটে ওঠে সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ইন্দোনেশিয়ার চন্দন কাঠ খুব বিখ্যাত। আমার খুব ইচ্ছে ছিল চন্দন কাঠের কিছু একটা কিনবো। হায় আল্লাহ কি দাম, কি দাম। কড়ে আঙ্গুলের সমান চন্দন কাঠের শো পিসের দাম ত্রিশ ডলার থেকে শুরু। গিজগিজ করছে শ্বেতাঙ্গ পর্যটকে। তারা শো পিস থেকে ফার্নিচার সবই কিনছে! এগুলো নেবে কি করে? কেন জাহাজে। দোকানই বুক করে পাঠাবে। এটা সরকারি দোকান। জবাব দিল সুদেবী। আমি কিনতে পারলাম না। শেষমেশ একটা সাধারণ কাঠের গরুড় পাখির ভাস্কর্য কিনে বেরিয়ে এলাম।
তবে মুগ্ধ হলাম বাটিকের কাজ দেখে। আহা কি অপূর্ব সব শিল্পকর্ম। বিশেষ করে বাটিকের পেইন্টিং। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব হতো না। এখানে আবার শ্বেতাঙ্গিনিদের ভিড় বেশি। কারণ এদের দর্জি আছে। বুড়ি থেকে ছুঁড়ি শ্বেতাঙ্গিনীরা মিডি, মিনি স্কার্ট, গাউন, কাফতান বানাতে দিচ্ছে পছন্দমতো কাপড় কিনে। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি দিয়ে দেয় হোটেল রুমে। প্রতিদিন লাখ লাখ ডলারের বিক্রি হয় এই সব দোকানে! তবে প্রত্যেকটা জিনিস এতো সুন্দর যে দামের প্রশ্ন অবান্তর মনে হয়। এই কমপ্লেক্সে তাঁত আছে। বাটিকের ছোট কারখানা আছে। দর্জি আছে। শো রুম তো আছেই। আমি আমার তিন নাতি-নাতনির জন্য তিনটা গেঞ্জি করিয়ে নিলাম। ওখানে বসে ছবি পছন্দ করে দিলাম। ওরা এঁকে দিলো। বাটিকের পেইন্টিং সত্যিই অসাধারণ। চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু দাম! কোনটাই পাঁচশ’ ডলারের নিচে না। তাই ছবি তুলেই মন ভরাতে হলো। আমরা কিছু কিনতে পারলাম না বলে সুদেবী বললো কৃষ্ণাতে চলো। ওখানে কিছুটা সস্তা। আসলেও তাই। কৃষ্ণাতে গিয়ে দেখলাম প্রচুর ভারতীয় ঘুরছে। বিশাল এক দোকান। জিনিসে ঠাসা। বাটিক প্রিন্টের অনেক কিছুই আছে। তবে সবই মেশিনে প্রিন্ট করা। পিওর সুতি বা সিল্ক নেই। সবই মিক্সড। অনেক কিছুই চীন থেকে করে আনা! আমি অল্প ঘুরেই বেরিয়ে এলাম। দেখলাম দোকানটায় শ্বেতাঙ্গরা প্রায় নেই। দু’চারজন ঘোরাঘুরি করছে। আমিও কিছুই কিনতে পারলাম না। যদি প্রথমেই ওই দুটো জায়গায় না যেতাম তবে হয়তো কিনতে পারতাম।
সুদেবীদের বিদায় দিলাম বিচে এসে। সন্ধ্যায় আসতে বললাম। রাতের বালি দেখব বলে। গিয়ানা আগ্রহ করে রয়ে গেল আমাদের সঙ্গে। আমরা তিনজন মিলে পেট ভরে ডাব আর ডাবের শাঁস খেলাম। গিয়ানা নাচ দেখাল। সামনে সমুদ্র থাকলে মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। দুপুর থেকে রাত অব্দি সময়টা সাগরকে দিলাম। সাগরের হাওয়ায় মিশে গেল আমার অনেক আনন্দ-বেদনা।
প্রত্যেক সন্ধ্যায় সমুদ্রের পাড়ে আতশবাজি পোড়ানো হয়। বোধ হয় বাচ্চাদের কথা ভেবে। সারাদিন যে কিশোর তরুণ পর্যটকরা সার্ফিং করে। যে তরুণী সারাদিন সমুদ্রে স্নান করে তারা তো বটেই বাচ্চা বুড়ো সবাই জড়ো হয় আতশবাজি পোড়ানো দেখতে। আর ছোটে নাইটক্লাব, ডিসকো বারে। তবে সে সবই এখন কিছুটা রেখে-ঢেকে হয়। পর্যটন এলাকার অনুষঙ্গ পতিতা, হুকার চোখে পড়েনি। অন্তত পথে ঘাটে। এমনকি রাতবিহারে যখন গাড়ি নিয়ে ঘুরছিলাম তখনও না। কোনো নাইটক্লাব বা ডিসকো বারের সামনেও এদের দেখিনি। সুদেবী বললো আছে, তবে খুব গোপনে। আর নাইটক্লাবে বা ডিসকো বারে যেসব মেয়েরা নাচ গান করে তাদের মধ্যে এক পারসেন্টও ইন্দোনেশিয়ান নয়। এদের প্রায় সবাই পূর্ব ইউরোপ আর ভাঙ্গা রাশিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে আসে। এরা না কি বলিউডি নাচেও পারদর্শী। বলেই হিঃ হিঃ হিঃ হাসি।
মধ্যরাতে আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল গিয়ানা আর জ্যাক। সকালে আমাদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে সুদেবী একাই আসবে। গিয়ানা আর জ্যাককে বিদায় দিতে গিয়ে চোখে পানি চলে এলো। কি মিষ্টি ছেলেমেয়ে দুটো। প্রতি মুহূর্ত আমার এতো খেয়াল রেখেছে যে মনেই হয়নি ভিনদেশে আছি। হয়তো ওদের প্রশিক্ষণ ওরিয়েন্টেশন ভালো বলেই এতোটা যত্ন করেছে। তবে হৃদয়ের উষ্ণতাও অনুভব করেছি প্রতিক্ষণে। যা প্রশিক্ষণে অর্জিত নয়। গিয়ানা আর জ্যাক আমাকে মাম বলে ডেকেছে। সুদেবী ম্যাম। ভালো লেগেছে মা ডাক।
বেড়ানোর জন্য বালি খুব ভালো। যাদের খুব বেশি ঘোরাঘুরি ভালো লাগে না বা রিল্যাক্স করতে চায় তারা ইচ্ছে করলেই বালি চলে যেতে পারেন। মোটামুটি টাকায় বেড়ানো সম্ভব। বালির সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য দারুণ। পাঁচ রকমের মন্দির। বারো মাসে চৌদ্দ রকমের পূজা। বালিনিজরা হিন্দু হয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে। আর তাই বালি জীবনের প্রতি পরতে পরতে বৈচিত্র্যের সমাহার। বালির বালুকা-বেলায় নিজেকে আবিষ্কার ও নিজেকে নতুন করে দেখার সুযোগ বারবারই নেয়া যেতে পারে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status