ঈদ আনন্দ ২০১৮

উপন্যাস

অন্ধকার জগতের কাহিনী

নঈম নিজাম

৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৪:৫৩ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: মাসুক হেলাল

দাদী আমার দিকে তাকালেন। মনে হলো চোখের এই দৃষ্টি বড় নিষ্ঠুর। আমি আবার বললাম, দাদী এই বাড়িতেই আমি থাকতে চাই। তুমি আমাকে চলে যেতে বলবে না। আর যাবই বা কোথায়? মামাদের কাণ্ড দেখলে ভালো লাগে না। তারা আমাকে দেখলেই গালাগাল শুরু করেন। মামিরা খেতে দেন না। থাকতে দেন না। সাতকুলে তুমি ছাড়া আর আছে কে?
আমার কথায় দাদীর মন গলে না। তার সোজাসাপটা কথা- আমার বাড়িতে তোরে রাখব না। তুই চলে যা ওই হারামজাদির কাছে। খানকিটা আমার পোলাডারে খাইছে। তুই ও তার নাগরের ঘরে গিয়া থাক।
দাদীকে এমন বাজেভাবে কথা বলতে জীবনেও দেখিনি। দাদী অনেক উঁচু বংশের নারী। ছোটবেলা থেকে তাকে অন্য রূপে দেখে আসছি। তার চলনে একটা ভাব ছিল। আমার দাদাও দাপুটে পরিবারের মানুষ ব্রিটিশ আমল থেকে। তাদের কাহিনীগুলো রূপকথার মতো। পারিবারিক সেই সব ঐতিহ্য আজ আর নেই। সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেছে। এমনকি বাবার রহস্যময় মৃত্যুর পর থেকে দাদীও বদলে গেলেন। ছোটবেলা থেকে দাদী আমাকে ভীষণ আদর করতেন। ঢাকার নামিদামি স্কুল থেকে দিল্লি পাঠালেন পড়তে। কিন্তু দিল্লিতে আমার ভালো লাগত না একাকী জীবন। ফিরে এলাম আমি। মা ততদিনে দাদীর বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মামাদের বাড়িতে মাস দুই থাকার পর মামারাও তাকে আর গ্রহণ করেননি। মায়ের জীবনটাও বদলে গেলো।
সব এলোমেলো অবস্থায় আমি দিল্লি থেকে ঢাকা ফিরে ‘এ লেভেল’-এ ভর্তি হই আবার। দাদী সব দেখতেন। তিনিই সব খরচ চালাতেন। এ লেবেল শেষ করেছি। ইউনিভার্সিটিতে আমার আর যাওয়া হয় না। বন্ধুরা সবাই ভর্তি হয়ে যায়। কেউ দেশে বেশিরভাগ বিদেশে। কিন্তু হঠাৎ করে কী হয়ে গেল আমার বুঝতে পারছি না। সময়টা আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠছে। দাদীর ধারণা, মায়ের মতো আমিও নেশায় জড়িয়ে পড়েছি। এ কারণে ইউনিভার্সিটিতে আর ভর্তি হইনি। দাদী চেয়েছিলেন আমাকে নর্থসাউথে রাখতে। কিন্তু পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না। সবাই আমাকে ভাবে মায়ের মতো আমিও নীলের ছোবলে পড়েছি। মামা-খালাদেরও একই ধারণা। সবার প্রতি আমার তীব্র অভিমান হয়। মনে হয়, কেউ আমাকে বোঝার চেষ্টা করে না। সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি যাই না। পড়ে আছি সবার অবহেলায়। দাদীকে আজকের মতো কঠোর হতে আগে দেখিনি।
আমি দাদীকে ম্যানেজের চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে আবার বললাম, দাদী, মায়ের কাছে কই যাব? তিনি নিজেই কষ্টে আছেন। তার বয়ফ্রেন্ড তারে ভালো রাখেনি। তার জীবন কি মানুষের মতো থাকা বলে? এভাবে কি মানুষ বাস করে?
-ওই হারামজাদির নাম আমার সামনে নিবি না। তুই চুপ থাক। তার নাগরটা মরে না কেন? বলতে হবে তোকে। ব্যাটা মরলে হারামজাদির রস বের হবে। বুঝবে কত ধানে কত চাল।
আমি চুপ মেরে যাই। কথা বাড়াই না। আজ আবহাওয়া ভালো না। ভালো থাকলে বলতাম- কেমনে বলি লোকটা মরে না কেন!
দাদীর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালাম। আস্তে করে আবার বললাম, আপনি আমারে বিষ কিন্যা দেন। কারণ আমার কাছে বিষ কেনার পয়সা নাই। গোপনে ওই বাড়িতে গিয়া খাবারে বিষ মিশাই দিমু। লোকটা মইরা ভূত হয়ে যাবে। তবে ভয় একটা আছে। ভূত হয়ে আপনারে আক্রমণ করতে এলে আমার করার কিছু থাকবে না।
আমার কথায় দাদী মহা খেপে গেলেন। এভাবে মজা করার চেষ্টাটা ঠিক হয়নি। সময়টা এখন আমার পক্ষে না। -হারামজাদা! বের হ আমার বাড়ি থেকে। তোর চেহারা এই জীবনে যেন না দেখি।
- ঠিক আছে এই বাড়ি থেকে চলে যাব! একটু ফোন করে নূরী ফুফুরে একটু বলে দাও। ওখানে যাব। ফুফা আমারে ভীষণ আদর করেন। তাদের দুই সন্তান বিদেশে। আমারে বলছেন সন্তান হিসেবে নিয়া নিবেন। তোমার ঝামেলা শেষ।
-তুই জাহান্নামে যা। আমি কোথাও কিছু বলতে পারব না। তোর বাপ জালেমটা যন্ত্রনা দিয়েছে সারা জীবন। এখন তুই দিচ্ছিস। তোদের বাপ পোলার যন্ত্রনা সামলানো আমার কাজ না।
- দাদী আমারে গালি দেন ঠিক আছে। কিন্তু আসলে কি আপনার পোলা জালেম ছিল?
দাদী ভয়ানক রেগে গেলেন। চিৎকার শুরু করলেন। বললেন, আমার পোলারে টানিস কেন? তোর জন্ম ওই বেটির ঘরে। তুই ভালো হবি কী করে? ভাগ এখনই আমার বাড়ি থেকে। তোর চেহারা দেখতে চাই না বাকি জীবন।
দাদীর রাগ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় এই বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। আমি বেরিয়ে আসি। অনেকদিন থেকে এ বাড়িতে আমার ঠাঁই নেই ভালোভাবে। মাঝে মাঝে আসি। দাদীকে খেপিয়ে তুলি। মামার বাড়িতে গেলে তারাও আমাকে রাখতে চান না। আমার সমস্যা কেউ বলেন না। কিন্তু আমারে সবাই অপছন্দ করেন। এখানে সেখানে রাত কাটাই। মসজিদেও থাকতে হয়েছে দুই চারবার।
বের হয়ে চিন্তা করলাম, আমি কোথায় যাব? ফুফা আমাকে ভালো জানেন কথাটা ঠিক নয়। পুরোটাই মিছা কথা। ফুফা মানুষটা সুবিধার নন। আজকালের বাস্তবতায় অনেক কিছুই মিলছে না। ছোটবেলায় এই ফুফু আর ফুফার অন্য চেহারা দেখেছি। কত আদর করতেন। বলতেন, তোরে আমরা নিয়া যাব। বাবা হাসতেন। আজ মনে হচ্ছে, জগতে বাবা না থাকলে চারপাশ বদলে যায়। কিন্তু কীভাবে বদলে যায় এর নমুনা আমি দেখেছি গত দুই বছরে। এ দুই বছরে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। বাবা গেলেন আমার ১৯ বছরে। এখন আমি একুশ পার করছি।
আজ আমার বয়স হলো ২২ বছর। অথচ অনেক বছর জন্মের এই দিনটা ছিল আমার জন্য অন্যরকম। জন্মের পর দাদাকে দেখিনি। আমার দাদা, নানা দুজনই মিনিস্টার ছিলেন। দাদা ছিলেন পাকিস্তান আমলে। নানা মন্ত্রী হন আমার জন্মের কয়েক বছর আগে। মায়ের কাছে শুনেছি, আমার প্রথম জন্মদিনে দাদী চার এতিমখানায় খাবার পাঠিয়ে হুলুস্থূল বাঁধিয়ে ফেলেন। দুনিয়ার মানুষকে উপহার পাঠান। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে সকালবেলায় আমার কানের পাশে ফুঁ দিয়ে দোয়া করেছিলেন, বড় হয়ে যেন আমি দাদার মতো বড় মাপের কিছু হতে পারি। কারণ, দাদার সন্তান হয়ে বাবা কিছু করতেন না। বাবা ছিলেন অনেকটা আলসে মানুষ। বাবাকে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করিয়ে আনেন দাদা। আশা ছিল আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতি করবেন। দাদা ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। পাশাপাশি মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে মন্ত্রী হন। তার প্রতিটি কাজ ছিল গোছালো। এই গোছালো মানুষটির পুত্র হন চরম অগোছালো। কোন উচ্চ বিলাস ছিল না।
মা একবার কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছেন, তোর বাপ হলো বাদাইম্যা। তোর দাদার নামের ওপরই আমাকে বিয়ে করার সুযোগ পেয়েছে। তার আলসে স্বভাব জানলে আজ এত ঝামেলা হতো না। মার কথার আগামাথা বুঝতে পারি না। কারণ, বাবা-মায়ের বিয়ের সময় দাদা জীবিত ছিলেন না। আমার ফুফু নূরী বেগম বলেছেন, নানার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান দাদী। আমার দাদার নাম ডাক ছিল। খান্দানী খ্যাতি বলে কথা! শুনেছি নানা উৎসাহ নিয়ে বিয়েতে সম্মতি দেন। মাও এই বিয়েতে রাজি ছিলেন। আমার মা সোহানা চৌধুরীর দুধে-আলতা রং। এখনো দুর্দান্ত সুন্দরী। দেমাগী নারী ছিলেন। কিন্তু এখন মানুষ তাকে নিয়ে কত কথা বলছে। সমালোচনা করছে। মা এর কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে বুকটা ভেঙে যায়। হাহাকার তৈরি হয়। কিন্তু বাবা মাকে নিয়ে মানুষের কোনো কথাই আজকাল আমাকে আঘাত করে না। আমি কেমন যেন অন্যরকম হয়ে উঠছি। আমার কোন কিছুই এখন নেই। আতা্মীয়রা বলেন, না পেলাম দাদার বাড়ির আভিজাত্য, না নানার বাড়ি। আমাদের দুই পরিবারের একমাত্র ছোট মামা রাজনীতি করেন এখন। তিনি সাবেক এমপি ও বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু নানার বাড়ির কেউই আমাকে পছন্দ করেন না। কেন করেন বুঝতে পারি না। তারা শুধু আমাকে নয়, এখন মাকেও দেখতে পারেন না। ছোট ফুফু একদিন গোপনে বলেছেন, আমি নাকি মার মতো হয়েছি। বুঝতে পারি তিনি অন্য কিছু বুঝিয়েছেন। মায়ের এখনকার কান্ড কারখানা ইংগিত করেছেন ফুফু।
চেহারা চুরুতে আসলে আমি দেখতে কার মতো ? সবাই তো বলে, আমার চলন-বলন, চেহারা বাবার মতোন। তবে আমার বাবা ছিলেন নিরীহ টাইপের একজন মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে ছিলেন না। চুপচাপ ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পরিবারের সেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেননি ব্যারিস্টার সাহেব। আইন পেশায় জড়ানোর জন্য বাবার বন্ধুরা অনেক বলেছেন। মা-ও অনুরোধ করতেন। বাবা না করতেন না। কিন্তু কোনটাই বাস্তববায়ন হতো না। তবে পুরো জীবনে মায়ের অনুরোধের একটা অংশ রক্ষা করেছেন। হাইকোর্ট থেকে সনদ নিয়েছেন। মতিঝিলে চেম্বারও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চেম্বারে বাবা যেতেন না। তার ভালো লাগতো না আদালতে গিয়ে টানা বক্তব্য রাখা। মক্কেলদের সময় দেওয়া।
ফুফু একবার আমাকে বলেছিলেন, তোর বাপের মাথাটা আউলা হয়েছিল তোর মায়ের কারণে। তোর বাবা অনেক মেধাবী ছিলেন। আমার তা মনে হয় না। বাবাকে আমার মনে হতো একজন সহজসরল মানুষ। অন্যরকম। তিনি চেয়েছিলেন চুপচাপ থেকে একটা জীবন পার করে দিতে। কিন্তু আমাদের সমাজ তার মতো নয়। এই কথা বুঝতে তারও হয়তো অনেক সময় লেগেছিল। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সবাই আমাকে আদর করতেন। দিনভর মাতিয়ে রাখতেন। আর জন্মদিনে তো কথাই নাই। আমাকে নিয়ে কত হইচই হতো বাড়িজুড়ে। বাবা কেমন যেন পাগলা পাগলা হয়ে যেতেন। মা বুকে আগলে রাখতেন। আদরে আদরে ভাসিয়ে দিতেন। মামারা আসতেন, কত কী নিয়ে। গত দুই বছরে সব শেষ হয়ে গেল। ধ্বংসের কিনারে চলে গেলাম আমরা সবাই।
দাদীর বাড়ি থেকে বের হয়ে নেমে এলাম রাস্তায়। কোথাও যাওয়ার নেই। গুলশানের ২১২ নম্বর সড়কের এ বাড়িটি আমার দাদার আমলের। ফ্ল্যাটবাড়ির অত্যাচারেও দাদী তার মরহুম স্বামীর সম্পদ আগলে রেখেছেন। দোতলা লাল দালানের এমন বাড়ি এখন আর গুলশান বনানীতে বেশি নেই। আমাদেরটা রয়েছে। আর এই বাড়িতেই আমার বেড়ে ওঠা। জন্ম। মাঝে মাঝে নানার বাড়িতে যেতাম ছোটবেলায়। নানার বাড়িও কম নয়। কিন্তু আমাদের এই বাড়িটি আমার শরীর ও মন জুড়ে। কারণ, এখানেই বাবার সব স্মৃতি। ছোটবেলায় আমি আর বাবা লুকোচুরি খেলতাম। হৈ চৈ করতাম। বাবা আমার লুকানো দেখে ফেলতেন। কিন্তু তিনি আমাকে খুঁজতেন। ভাব করতেন আমাকে পাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে আমাকে পেতেনও না। তখন খুঁজতে খুঁজতে বাবা আকুল হয়ে যেতেন। পাবার পর জড়িয়ে ধরতেন। চিৎকার করে বলতেন, পেয়েছি, পেয়েছি। আমার ছেলেকে পেয়েছি। আমার বাবার কোলে মুখ ঘষতাম। মা বলতেন, ঢং কমাও।
বাবা একবার সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন ব্যবসায়িক কাজে। কত আর আমার বয়স হবে? পাঁচ অথবা ছয়। রাতে আমার ঘুম ভেঙে যেত। শুধু মানুষটাকে খুঁজতাম। কিন্তু তাকে দেখতে পেতাম না। মা আবার ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু চুপ করে থাকতাম। কখনো ডুকরে কেঁদে উঠতাম। মা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতেন। ছড়া কাটতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। সোনামণি আমার! মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আমি সারা বাড়ি ঘুরেছি। এসব কথা মা আগে আমাকে বলতেন। গুলশানের বাড়ির সেই সব দিন কোথায় হারিয়ে গেল! কেন এমন হলো আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। এখনো মনে হয়, বাস্তবে যা দেখছি তা কঠিন স্বপ্ন। আমার সবকিছু আগের মতোই আছে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের জীবনটা বড় অদ্ভুত। এক জীবনে একজন মানুষ অনেক কিছু দেখে থাকে। সব কথা কাউকে বলে না। আমিও আমার সব কথা কাউকে বলতে পারি না। জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণাকে আড়াল করি। মাঝে মাঝে ভাবী, মা কি তার জীবনের বড় কোনো কষ্টকে ভুলতে নেশার জগতে জড়ালেন? মা দিন দিন ধ্বংসের কিনারের দিকে চলে যাচ্ছেন। আমার অবস্থাও কি মায়ের মতো হবে?
এক সকালে বাবা ফিরলেন সিঙ্গাপুর থেকে। বাবার শরীরের গন্ধে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। আমার মনে হলো, বাবাকে আর ছাড়ব না। ছাড়লে আমার বাবা হারিয়ে যাবেন। আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। বাবাও আমাকে কঠিন করে ধরে রাখেন। যেন ছাড়লে আমি হারিয়ে যাবো। কোনদিন আমরা কেউ কাউকে খুঁজে পাবো না।
 এক রাতে বাবা মায়ের ভয়ংকর ঝগড়ার মাঝে আমার ঘুম ভাঙলো। মা বাবাকে বললেন, কাজটা করেছ?
বাবা বললেন, কোন কাজটা?
জেনে আবার ঢং করছ কেন! এদেশে আমি থাকবো না। এদেশে আর বাস করার অবস্থা নেই। কানাডার ইমিগ্রেশন ল ইয়ার এখন ঢাকায় আছেন। তার সঙ্গে কথা বল।
বাবা আবার বললেন, কেন থাকব না? আমাদের সব আছে। বাড়ি ভাড়া পাচ্ছি চট্টগ্রাম থেকে। আমাদের ছেলে পড়াশোনা করছে। ও বড় হয়ে পড়তে যাবে আমেরিকা, কানাডা, লন্ডন, সিডনি যেখানে খুশি। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। এ দেশ ছেড়ে যেতে পারব না। ছেলে বাইরে থাকতে চাইলে তাকেও বুঝিয়ে নিয়ে আসবো। কোন বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করলে মেয়েটাকে বুজিয়ে নিয়ে আসবো।
মা বললেন, জানি তুমি কিছুই করবে না। তাই আমি আবেদন করছি। বিজনেস কোটায় হয়ে গেছে। নতুন নকশা বের করবে না? আমরা চলে যাব। ছেলের একটা ভবিষ্যৎ আছে।
বাবা কথা বাড়ালেন না। চুপ মেরে গেলেন। আমার বাবা এমনই ছিলেন। কোনো কিছু নিয়ে তার বাড়াবাড়ি ছিল না। মেনে নিতেন সবকিছু চুপ করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে হয়তো অভিমানটুকু জমা করে রাখতেন আলাদা করে। তা কেউ বুঝত না। হয়তো বোঝার চেষ্টাও করত না। দুনিয়াতে মানুষ কেউ কাউকে বুঝে না। সবাই আপন আলোয় নিজেকে নিয়ে চলে।
এর কিছুদিন পরই পরিস্থিতি আরও বদলে যায়। মা যত দিন যাচ্ছে তত কঠিন হয়ে ওঠছেন। অনেক কিছু আমি বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারি কোথায় যেন সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একটা জটিলতায় পড়তে যাচ্ছি আমরা।
মা কানাডা যাওয়ার ব্যাপারে সবকিছু গোছাতে শুরু করেন। একদিন বাবার কাছে প্রস্তাবও করেন গুলশানের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার। মা জানেন, এ বাড়ি বাবার নামে নয়। এ বাড়ি দাদীর নামে দাদা উইল করে দিয়ে গেছেন। দাদা মৃত্যুর আগে সব সম্পদ দাদীর নামে রেখে গেছেন। কোনোকিছু বাবার নামে নেই। চট্টগামের আমাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাড়া তুলে বাবা দাদীর কাছে এখনো পুরোটা এনে দেন। দাদী সংসার চালান। এর মাঝে বাবার হাতে তুলে দেন কিছু টাকা। এনিয়েও মায়ের ক্ষোভ অনেক দিনের।
মায়ের আচরণে বাবা চুপ মেরে যান। বাবা এমনিতেও ঝগড়া করতে চান না কারো সঙ্গে। তবুও সবকিছু বুঝার জন্য বললেন, কানাডা গিয়ে রেসিডেন্স কিভাবে হবো?
মা রাগ করে বলেন, সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তানভীর সহায়তা করেছে। ও সব দেখছে। বেচারা আমাদেরকে নিয়ে খাটা খাটনি করে চলছে।
মায়ের মুখে এই নামটা শুনে থমকে গেলেন বাবা। চোখটা বিমর্ষ হয়ে ওঠে সাব্বির হাসান চৌধুরীর। কথা বেশি বাড়ালেন না। শুধু বললেন, বাড়িটা বিক্রি করার ক্ষমতা আমার নেই। চাইলেই পারব না। তুমি সবই জানো। শুধু বাড়ি কেনো কোন কিছু বিক্রি করতে পারবো না।
-পারবে না কেন? তোমার মাকে বুঝিয়ে বল। তিনি তোমার কথা শুনবেন। তোমার প্রতি তার প্রচণ্ড ভালোবাসা রয়েছে। আর তুমি তার একমাত্র ছেলে। তোমার বোন তার মতো আছে। দরকার হলে তার পাওনা তাকে বুঝিয়ে দেবে। অকারণে আগেই নেগেটিভ থিংক করবে না।
বাবা হঠাৎ করে বলে ফেললেন, বাড়ি বিক্রির এই বুদ্ধি কার তানভীরের ? এই জটিল চিন্তা তোমার মাথা থেকে আসার কথা নয়।
এই কথায় বারুদে আগুন জ্বলসে ওঠে। মা প্রচণ্ড খেপে গেলেন। চিৎকার শুরু করলেন। আজকাল কারণ অকারণে মা হৈ চৈ করেন। আগে এমন ছিলেন না। মা ছিলেন অনেক চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। ঝামেলা বেশি পছন্দ করতেন না। আমাদের সংসারটাও ছিল ছিমছাম। বাবা খুব একটা কিছু না করলেও তার চট্টগ্রামে বাড়ি, মার্কেট থেকে ভাড়ার টাকা আসত। সেই টাকার পরিমাণও একেবারে কম নয়। বাবা নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য করারও চেষ্টা করতেন। ব্যবসা করার টার্গেট নিয়েই আইন পেশায় গেলেন না। তবু আমরা ভালো ছিলাম। ঝামেলাটা তৈরি তানভীর নামের লোকটা আমাদের সংসারে আসার পর থেকেই। শুধু তানভীর নন, মায়ের আরও কয়েকজন বান্ধবী আছেন। এই আন্টিগুলোও মাকে উসকাতে শুরু করেন। আমি প্রায় আড়াল থেকে তাদের কথোপকথন শুনি। তারাই প্রথম মাকে বলতেন, তোর জীবনটা শেষ হয়ে গেল। তুই ছিলি আমাদের মাঝে বেস্ট। অথচ তোকে দেখলে মায়া লাগেরে। কেনো যে এমন হয় বুঝি না। আমি মানুষটা ছোট হলেও আন্টিদের কথাগুলো বুঝতে পারতাম। মা প্রথমদিকে গুরুত্ব দিতেন না তাদের কথা। কিন্তু পরে আন্টিদের সঙ্গে একমত হয়ে যেতেন। অথচ এই আন্টিদের কারও জীবনই স্বাভাবিক নয়। রীনা আন্টির বাসায় আগে নিয়মিত যেতাম। আন্টি তার বাবার বাড়িতে বনানী থাকেন। এ পর্যন্ত চারজনকে আমাদের বাড়িতে এনে পরিচয় করিয়েছেন তার স্বামী হিসেবে। নতুন আংকেলদের দিকে আমি তাকাতাম। আর ভাবতাম আরেকজন কবে আসবেন। আমার এক বন্ধু বললো, ঢাকা শহরে এখন স্বামী বদল, স্ত্রী বদল স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
দিন দিন মায়ের গ্রুপ বাড়তে থাকে। রীনা আন্টির আরেকজন বান্ধবী ছিলেন। নাম রেবা। রেবা আন্টির দ্বিতীয় স্বামী সরকারের একজন সচিব। এই রেবা আন্টির মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে তানভীর নামের লোকটির পরিচয়। এ লোকটিকে বাবা এবং আমার কারোই পছন্দ নয়। লোকটা প্রথম আমাদের বাড়ি এলেন রেবা আন্টির সঙ্গে। আন্টি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে। এমনকি দাদীর সঙ্গেও। দাদী তার দিকে তাকালেন সরু চোখে। তারপর বললেন, তোমার কীসের ব্যবসা?
লোকটি বললেন, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট।
দাদী বললেন, কী এক্সপোর্ট করো? আর কী ইমপোর্ট করো? বাংলাদেশের সবাই এখন ব্যবসায়ী। দাদীর কথায় সব সময় একটা ঝাঁজ মেশানো থাকে।
লোকটি থতমত খেলেন। তারপর বললেন, সুতা আর রং আমদানি করি। টেক্সটাইল মিলে সাপ্লাই দিয়ে থাকি।
দাদী কথা বাড়ালেন না। তিন তলায় চলে গেলেন নিজের রুমে। কাজের মেয়েটি তার পিছু পিছু চলে গেল।
দাদী কী কারণে তানভীরকে অপছন্দ করলেন তা প্রথমে না বুঝলে এখন বুঝতে পারি। দাদীর দূরদর্শিতা হয়তো অনেক বেশি। যা বাবার ছিল না। আমারও নেই। দাদীর বাড়ি থেকে বের হতে হতে পুরাতন দিনগুলো ভাবছি। যাই দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। আমার হয়েছে তাই। মানুষের জীবনে সুখের ছোঁয়াও বেশি থাকে না। খুব কম সময় ভালো কাটে মানুষের। বাকিটা পুরোই এলমেলো। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি দাদী কী আসলেই আমাকে এই বাড়িতে আর সত্যি-সত্যি প্রবেশ করতে দেবেন না। কিন্তু আজ কেন যেন কোন টেনশন ফিল করি না। টেনশনকে দিয়েছি ছুটি। পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। শম্পাকে ফোন করলাম। ফোন যাচ্ছে না। ব্যালান্স নেই। শম্পা আমার সঙ্গে ‘ও লেভেল’ করেছে। ‘এ লেভেল’ শেষ করে পড়ছে নর্থ সাউথে। আমাদের বেশির ভাগ বন্ধুই চলে গেছে আমেরিকা, কানাডা, বৃটেন ও অস্ট্রেলিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। বাকি যারা দেশে তারা বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বন্ধু শম্পাও থেকে গেল। জীবনের কোথায় যেন আমাদের মিল আছে। এই মিলগুলো পারিবারিক। তবে এই পারিবারিক বিষয়টি শম্পারটা আমার চেয়ে আলাদা। তার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হলো বছরখানেক আগে। শম্পারা দুই বোন থাকে মায়ের সঙ্গে উত্তরায়। তাদের বাবা বনানী ১১ নম্বর সড়কের বাড়িতে নতুন বউ নিয়ে উঠেছেন। এই বউয়ের বয়স শম্পার বড় বোনটির সমান। গ্রাম থেকে মেয়েটিকে আনা হয়। শম্পার বাবা ইসমাইল মিয়া ভাগ্যবান মানুষ। তার ব্যবসার ভয়াবহ উত্থান বলা যায় হঠাৎ করেই। গত ২০ বছরে প্রচুর সম্পদ করেছেন। ভালোই ছিল ওরা। আমি মাঝেমধ্যে শম্পাদের বাড়ি যেতাম। তাদের সংসারও অশান্তির অনল জ্বলবে কখনো ভাবতেও পারিনি। বড় অদ্ভুত। এই অল্প অনেক জটিল প্রশ্নের কোন জবাব পাচ্ছি না। কিছুদিন আগে শম্পার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অনেক কথা হয়। শম্পা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আন্টির কি খবর রে ? আন্টি কি ড্রাগ ছাড়তে পেরেছেন?
আমি চুপ মেরে যাই। জবাব দিতে ভালো লাগে না। আজকাল এমন প্রশ্ন শুনলে মনটা এলোমেলো হয়ে যায়। শম্পা আমার দিকে তাকাল। বলল, আই অ্যাম সরি। আসলে তোকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করিনি। প্রশ্ন করলাম জানার জন্য। এভাবে বলা ঠিক হয়নি। বাবা-মায়ের ডিভোর্সের পর আমার মাথা ঠিক নেই। আমান বোনটাকে সেই দিন দেখলাম সিগারেট খাচ্ছে। বোনটা আমাকে নিয়ে, আমি তাকে নিয়ে ভয়ে থাকি। মা আমাদের দুইজনকে নিয়ে চিন্তায় থাকেন। বোনের আজকাল ফেসবুকে স্টাটাসগুলো বিষণ্নতার। তাকে আমি বুঝাই। কিন্তু ওর মাঝে ডেম কেয়ার ভাব আছে। এই কারণে ভয় লাগে। হিম শীতল ভয়। চারদিকে কত কি হচ্ছে।
-আমি কথা অন্যদিকে নিতে বললাম, আমাকে নিয়ে ভয় করিস না? আমিও তো ভালো নেই। আমাদের পুরো জেনারেশনটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাপ-মায়েরা তাদের নিয়েই ভাবেন। আমাদের নিয়ে না। তোর মায়ের কথা আলাদা। কেমন আছেন তোর মা?
- মা অনেক বদলে গেছেন। একটা সময় বাবার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে দিন কাটাতেন। সেখান থেকে ডিভোর্স। এখন মা আমাদের নিয়ে টেনশন করেন। আমারও ভালো লাগে না চারপাশের সব দেখে।
-আমাদের জীবনগুলো যেন কেমন হয়ে উঠেছে। সবকিছুতে একটা অনিশ্চয়তা। কোথায় গিয়ে থামব জানি না। শম্পাকে পেলাম না। ও ফোন ধরলে তার সাথে দেখা করতে যেতাম। সময়টা খারাপ কাটতো না। শম্পা আমার সাথে পড়লেও তার যুক্তিগুলো অনেক সময় বয়স্কদের মতো। আমাকে দুনিয়ার জ্ঞান দিয়ে যায়।
এলোমেলো ভাবনায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ছোট ফুফুর বাড়ি। ফুফু থাকেন নিকেতনে। বেল টিপতেই দরজা খুলে ফুফু আমাকে দেখে মুখ কালো করে ফেললেন। বললেন, তুই ভিতরে আসবি না।
-কেনো কি করলাম নতুন করে?
- তোর ফুফার মানিব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চুরি হয়েছিল। সেই দিন একমাত্র বাইরের মানুষ তুই ছিলি এই বাড়িতে। কাজের লোকদের তন্ন তন্ন করে তল্লাশি হয়েছে। ফুফা খেপে আছেন। তিনি ভাবছেন, কাজটা তোর। নেশার জন্য সবাই নাকি তাই করে। তোর এই কান্ডগুলো ভালো লাগেনারে।
-আমি অবাক হয়ে বললাম, টাকা নিলাম কবে?
-কেন, তুই ছাড়া আর কেউ তখন ছিল না। তুই চলে গেলি টাকাটাও হাওয়া।
টাকাটা আমি নিয়ে গেছি কথাটা সত্য। সেই দিন এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। টাকাটা আমার দরকার ছিল। এক দোকানে বাকি খাই। সেখানে বকেয়া পড়ে গিয়েছিল। আর কিছু মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে। এই টাকাটা চাইলে তারা দিতেন না। কেউ দিত না। আমি ভেবেছিলাম, দাদীর সঙ্গে এর মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। আমি পুরো টাকাটা এনে ফেরৎ দিয়ে সবাইকে চমকে দেব। তা হলো না। ফুফুর সাথে টাকা নিয়ে কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, আজ আমার জন্মদিন। না খেয়ে আছি সকাল থেকে। অল্প কিছু খেতে দেবে।
 ফুফু আমার দিকে তাকালেন। তারপরও বললেন, তুই কোন বংশের ছেলে জানিস? এখন আমাদের এত টাকা-পয়সা নেই। কিন্তু তোর দাদার কী ছিল না? সেই বংশের ছেলে হয়ে তুই এখন চুরি করিস। নেশা করিস। আবার বলছিস না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! এটা কোন কথা হলো?
ফুফুর দুই চোখ টলমল। আমি বুঝলাম। এ বাড়িতে থাকার অনুমতি না মিললেও আপাতত খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। ফুফুটি বড় মায়াবি। ছোট বেলায় আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। নিজের দুই সন্তান আছে। তাদের চেয়ে আমাকে কম আদর করতেন না। বেশি করতেন। এখন তার সন্তানরা বাইরে পড়তে গেছে।
-আমি আবার বললাম, ফুফু, তুমি ভুলে গেছ আজ আমার জন্মদিন। তোমারতো ভুলে যাওয়ার কথা না। সবাই আমাকে ভুলে গেছে!
আমার কথায় দরজায় দাড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন আমার ফুফু। এ কতটা আবেগী আমার জানা আছে। আর আছে বলেই এখানে আসা। শুনেছি, দাদা নাকি ছোটবেলায় তাকে আদর করে নূরী বেগম নামে ডাকতেন।
তবে বাবা ও দাদী ফুফিকে ডাকেন বেবী বলে। বড় হয়ে নামটা যায়নি। আমার মনে হয় এখনো তাই রয়ে গেছেন। আমার প্রতি জন্মদিনে তার একটা গিফট থাকত। সেই গিফটা থাকত দামি। তিনি আমার সামনে গিফটা নিয়ে বলতেন, এটা কার জন্য বলত দেখি?
আমি জানি, বাবাকে এই মহিলা অনেক ভালোবাসতেন। এখনো আমার সাত খুন মাফ একমাত্র তার কাছেই শুধু বাবার কারণে। বাবার নাম কেউ নিলেই হাউমাউ করে ফুফি কেঁদে ফেলেন। তার কান্না ১০ দিনে থামে না। ছোট বেলায় নিজের বাবাকে হারিয়েছিলেন ফুফি। বড় ভাই তাকে অনেক ভালোবাসতেন। তাদের দুই ভাইবোনের এমন কঠিন বন্ধন খুব আছে।
ফুফি বললেন, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবি? না আসবি?
- তুমি না সরলে আসবো কি করে?
ফুফি হাসলেন। বললেন, আস ভেতরে। তোর চেহারা কি হয়েছে, সোজা বাথরুমে চলে যা। শাওয়ার করে টেবিলে আস। আমি খাওয়া তৈরি করি। বাসায় তেমন কিছু নেই। আমরা দুইজন মানুষ থাকি। আমাদের বাজার সদাই করতে হয় না। তার জন্য স্পেশাল কিছু করতে পারবো না।
সোজা বাথরুমে প্রবেশ করি। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সারলাম। মাঝে মাঝে এখন গোছল করি না। লম্বা গ্যাপ দেই। পানির অপচয় হয় না। অনেক কিছুতেই আমার আলসেমি। আর এই আলসেমি নিয়েই দাদী সকালে আমাকে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। টেবিলে বসেই হতবাক হয়ে যাই। পোলাও, রোস্ট, গলদা চিংড়ি, ডিম ভাজি সব আমার পছন্দের খাবারই আছে। মা এক সময় এভাবে খাবার সাজাতেন। দাদী টেবিলে আসতেন না। দাদী খেতেন তার ঘরে। কাসার প্লেট, গ্লাস, বাটি দাদীর সব কিছু আলাদা। বাবা আমাকে নিয়ে আয়েস করে বসতেন। মাও বসতো আমাদের সাথে। আমরা গল্প করতাম। স্কুলের খবর নিতেন বাবা। কিন্তু অনেক দিন আয়োজন করে খাওয়া হয় না। এখন আমি যেখানে যেমন জীবনে আছি।
ফুফু আমার সামনে বসে আছেন। এই মহিলার দুই সন্তান বাইরে পড়াশোনা করছে। সন্ধ্যার পর ব্ল্যাক লেবেলের বোতল খোলা ছাড়া আর কোনো বাজে অভ্যাস নেই ফুফার। সিগারেট খেতেন। সেটা ফুফুর নির্দেশে বন্ধ। তবে হুইস্কি বন্ধ করার মতো কঠোরতা ফুফু দেখান না। আগে ক্লাবে গিয়ে চার পেগ খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। এখন ক্লাবে যান না। এ বাড়িতেই একটা ছোটখাট বার সাজিয়েছেন। তাকে সাজানো আছে ড্রিংকের বোতল। ফুফার মদ খাওয়ার লাইসেন্স আছে বলে শুনেছি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি তা নিয়েছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে। এ ধরনের লাইসেন্স নিতে ডাক্তারের একটা সার্টিফিকেট জমা দিতে হয়। যাতে লেখা থাকে স্বাস্থ্যগত কারণে এই রোগীকে নিয়মিত কয়েক পেগ হুইস্কি খেতে হবে। ফুফা তার ড্রিংক করার লাইসেন্স সঙ্গে রাখতেন। বলতেন, আর্মি ধরলেই দেখিয়ে দেব মদের বোতল রাখার অধিকার আমার রয়েছে। আমাকে তোমরা মদপানে মামলা দিতে পারবে না। ফুফার এক বন্ধু এক বোতল মদ বাসায় রাখার দায়ে আসামী কয়েকদিন জেল খেটে বের হয়েছে।
ফুফু আরেকটা বড় চিংড়ি ও রোস্ট তুলে দিলেন পাতে। আমি না করি না। কতদিন এমনভাবে খাই না। অথচ খাওয়া নিয়ে আমাকে কোনো দিন কষ্ট করতে হয়নি। আমি খেতে চাইতাম না। মায়ের চেয়ে দাদী, ফুফি খাবার নিয়ে আমার পিছু পিছু বেশি ঘুরতেন। ফুফি হঠাৎ বললেন, আজ যদি তোর বাবা থাকতেন, তাহলে তোর বাদাইম্যা স্বভাবটা হতো না। তুই কত মেধাবী ছিলি। বিদেশে পড়তে যেতি। এক সময় আমার বাচ্চাদের বলতাম তোর মতো হতে। এখন ওরা বিদেশ পড়ছে। আর তুই ঘুরে ঘুরে নেশা করিস, টাকা চুরি করিস। আমার এত কষ্ট তোকে নিয়ে।
-বিদেশে এখন পড়তে গেলে খরচটা কে দেবে?
- কেন তোর দাদী দেবে। মার কাছে এখনও পয়সা আছে। তোর জন্য তার কষ্টের কি শেষ আছে। তিনি ভাবতে পারছেন আমাদের বংশের মান সম্মান তুইও নষ্ট করবি। তোর মা’র কষ্ট সহ্য করতে পারছি না কেউ। তার মাঝে যোগ হলি তুই।
- আমি নেশাখোর না। আর টাকা চুরি করি কথাটা ঠিক নয়। তোমার এইখান থেকে একবারই নিয়েছিলাম পাঁচ হাজার টাকা। কী করব, পকেটে টাকা ছিল না। আমার কথায় কোনো অপরাধভাব নেই।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নূরী বেগম। তার চোখ এখনো ছলছল। হয়তো তার ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। সবকিছু আমারও মনে পড়ে। কিন্তু আমাকে কোনো কিছু স্পর্শ করে না। আমি কি বদলে যাচ্ছি? বাইশ বছরে পা দিয়ে মনে হচ্ছে, আমার বয়স এখন ৪২ বছর। গত দুই-তিন বছরে এত কিছু দেখেছি যা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সময় ও পরিবেশ আমাকে বদলে দিয়েছে।
ফুফি বললেন, তুই কানাডা চলে যা, মাকে বলে তোর জন্য খরচের ব্যবস্থা করব। পড়াশোনা শুরু কর। মা তোর ওপর খেপে আছেন অন্য কারণে। আমি চেষ্টা করব মাকে বোঝাতে। আর তোর মার কাছ থেকে দূরে থাকবি। তার ধারে-কাছে ঘেঁষবি না। তোর মায়ের কাছে গেলে আমার কাছে আসবি না। খাওয়া শেষ করে উঠলাম। ফুফু আমাকে বললেন, খাওয়া শেষ, তুই চলে যা। আমার হাতে একটা খাম দিলেন। বললেন, এই খামটা তোর জন্য। ইচ্ছামতো কেনাকাটা করবি। কোন বাজে কাজে ব্যবহার করবি না। আর যদি করিস আমার কাছে এই জীবনে আসবি না। আমি ফুফুকে কদমবুচি করলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন, ঢং করতে হবে না। চলে যা, এই টাকাটা শুধুই তোর কেনাকাটার মনে থাকে যেন।
-ফুফুকে বললাম, আমি কই যাব? দাদীকে একটা ফোন দাও। আমাকে থাকতে দিতে বল বাড়িতে।
-তোর দাদী, তুই ম্যানেজ কর। কীভাবে ম্যানেজ করবি তোর ব্যাপার। মা যেসব কারণে খেপে আছেন তা দূর কর। তোর বাবার মতো হতে হলি না কেন? শুধু নিজের মায়ের বদগুণগুলো নিয়ে বেড়ে উঠছিস!
-ফুফুর বাড়ি থেকে বের হলাম। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এই পড়ন্ত বিকালে। শম্পাকে আবার ফোন করার কথা ভাবছি। কিন্তু মেয়েটাকে একবার ফোনে না পেলে সবকিছু হাওয়া। কোথায় যে যায়!

সিএনজি নিলাম, বনানী যাব। অনেক দিন পর মুখটা আবার দেখব। আজ আমায় যেতেই হবে। ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে মানুষটাকে। এক সময় ভাবতেও পারতাম না তাকে ছাড়া আমার থাকতে হবে। কী দুঃসহ অবস্থা।
বেল টিপলাম। দরজা মা নিজেই খুলে দিলেন। আমি ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিতেই বললেন, তানভীর বাসায় নেই। আয় ভেতরে। ভিতরে যাব কিনা ভাবছি। মায়ের চেহারা অনেক বদলে গেছে। দুই বছরে মাকে বুড়ি বুড়ি লাগছে। চেহারার আভিজাত্যও নেই। জৌলুস চলে গেছে। মনে দ্বিধা নিয়েই ঘরে প্রবেশ করলাম। কয়েক মাস আগে এই বাসা থেকে আমাকে বের করে দিয়েছিলেন তানভীর। মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। ভুল বললাম, রীনা আন্টি বলেছেন বিয়ে হয়নি। লিভ-টুগেদার। বাবা থাকার সময়ই মা এই লোকটার সঙ্গে থাকা শুরু করলেন। তারা একসঙ্গে কানাডা গেলেন। আমি আর বাবা গেলাম না। মা আমাদের ছেড়ে দিলেন। আমি বাবার কাছে থেকে গেলাম। সেই রাতের কথা এখনো মনে আছে। বাবা সাফ জানিয়ে দিলেন, কানাডা যাবেন না। বাবা আগেই হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন অনেক কিছু। কারণ শেষদিকে তানভীর লোকটি আমাদের বাড়িতে যখন-তখন আসতেন। নানা তখন মিনিস্টার। মামারা দাপুটে। বড় মামা একদিন আমাদের বাড়ি এলেন। কারণ, তানভীর ততদিনে মাকে নিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরতেন। এর মাঝে একবার তারা ব্যাংককও ঘুরে আসেন। বাবা একদিন এ নিয়ে প্রশ্ন করলে মা খেপে গেলেন। বললেন, তুমি একটা ছোটলোক। মনটা বড় করতে পারলে না। তানভীর আমার বন্ধু। আমরা এক সাথে ঘুরলে কি হয়েছে? পুরো জীবনটা নষ্ট হলো তোমার মতো ছোটলোকের সঙ্গে চলে। বাবা চুপ মেরে যান। কথা বাড়ান না। শেষ দিকে বাবা কেমন যেন হয়ে যান। সবকিছুতেই নিস্প্রভ। বাবার এই নিস্পৃহ অবস্থান কেউ সমর্থন করেননি। এমনকি নানা, মামারাও না। তারা ভাবতেন বাবা শাষন করলেই মা ঠিক হয়ে যাবেন। এনিয়ে একদিন বড় মামা বাবার সঙ্গে বসলেন। দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন তানভীর লোকটাকে নিয়ে। বাবাকে সব বললেন। বাবা হঠাৎ বললেন, ওরা বন্ধু। অন্য কিছু নয়।
মামা খেপে গেলেন। বললেন, তোমার কারণেই সোহানা ডুবছে। এভাবে একদিন গভীর পানিতে তলিয়ে যাবে। আমি সব খবর নিয়েছি। তানভীর, রীনা, রেবাদের পাল্লায় পড়ে সোহানা ওপেন সিগারেট, মদ খায়। ক্লাবে যায়। বাবাও অনেক কথা শুনেছেন। ঢাকা শহরের সবাই জানে। আলাপ করে। আমাদের কানে সব আসে। মান ইজ্জত সব ধুলোয় মিশলো।
-বাবা বললেন, আপনারা তার ভাই। আপনারা কথা বলুন তার সঙ্গে। আমি কিছু বললেই চিৎকার করে ওঠে। ওর লাগাম পাওয়া মুশকিল। আমার কথার কোন দাম নেই।
-মামা আবারও খেপলেন। বললেন, নিজের বউ সামলাতে পারো না কেন? তুমি পাল্টা অবস্থান নাও। তাহলে ও ঠিক হয়ে যাবে। যেমন কুকুর তেমন মুগুর দরকার। না হলে একদিন সবাই চিৎকার করেও লাভ হবে না।
বাবা কথা বাড়ালেন না। মামা চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, আমরা কথা বলেছি। লাভ হয়নি। ও নেশাতে ডুবছে। নিজের বোন পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে।
মায়ের সামনে বসে পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে গেল। মায়ের পিছু পিছু ভিতরে গেলাম। বসলাম ড্রইং কাম ডাইনিং রুমে। ছোট্ট একটা বাসা। সবকিছু সাদামাটা। শুনেছি, তানভীর এই বাসাতে মাকে একাকী রাখেন। মাঝে মাঝে আসেন। সব সময় থাকেন না। তানভীর তার বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন গুলশানে। মায়ের নেশার টাকা, বাড়ি ভাড়া তানভীর দেন। মা কী করে এই জীবন কাটাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে মায়ের বন্ধু-বান্ধবীরাও এই বাড়িতে আসে। সবাই মিলে পার্টি করে। পার্টিতে সব থাকে। আমার বিশ্বাস হয় না।
মা আমার দিকে তাকালেন। সর্বশেষ যখন এসেছিলাম, মা বলেছিলেন, তুই এখানে আর আসবি না। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর আসবো না। কিন্তু নিজের কাছে বলা অঙ্গীকার রাখতে পারলাম না। আবার আমি এলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো মা ভুলে গেছেন, আজ আমার জন্মদিন। অথবা এখনো কি তিনি ইয়াবার নেশায় আছেন? নেশা আমিও করেছি। নেশায় গেলে মানুষ কি ভুলে যেতে পারে? আমার সব মনে পড়ে যায়। তবে কমে যায় শুধু কষ্ট। মাঝে মাঝে কষ্ট বেড়েও যায়। বেড়ে যায় বলেই এখন আর ও পথে কম যাই।
চিন্তায় ছেদ পড়লো মায়ের কথায়। মা পায়েসের বাটি নিয়ে এলেন। আমার মুখে তুলে দিলেন। মিস্টি করে হাসলেন। বার্থ ডে বয়ের দিন কীভাবে কাটছে, দাদীর সঙ্গে ঝগড়া করে? নাকি শম্পার সাথে আড্ডা দিয়ে। মায়ের কাছ থেকে পায়েসের বাটি তুলে নিলাম। হঠাৎ মনটা এলোমেলো হয়ে গেল। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, চলে যাচ্ছি। এমনিতে এসেছি। তুমি এবং তোমার নাগরকে জ্বালাতে আসিনি। আমার দিনটা কিভাবে কাটছে তা তোমার চিন্তা না করলেও হবে। তুমি তোমার সুখ চিন্তা করে সব ছেড়েছো। তুমি সুখে থাকো।
আমার ব্যবহারে মা বিস্মিত হলেন। এর আগে আমি এমন খারা
প ব্যবহার মায়ের সঙ্গে করিনি। আজ করলাম। কেনো করলাম জানি না। মায়ের চোখের কোনে কিঞ্চিত জল বয়ে আসে। আমি তাকালাম না। তাকাতে ইচ্ছা করছে না। আমাদের একটা পরিবার ছিল। আমরা তিন জন মানুষ ছিলাম। দাদী ছিলেন। ফুফু ছিলেন। আত্মীয় পরিজন ছিল। আজ মা কিংবা আমার কেউ নেই। আমি হনহন করে বেরিয়ে আসি। রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে থাকি। আমার চোখে জলের ধারা বইছে। কাছ ঘেঁষে হেটে যাওয়া মানুষগুলো হয়তো দেখছে। দেখুক সবাই। বাবাকে মনে পড়ছে। বাবা থাকলে হয়তো বলতেন, বুড়ো ছেলের চোখে পানি থাকতে নেই। তুমি এখন অনেক বড় হয়েছ। চোখ মুছো। বাবার সঙ্গে গল্প করো। আর সব সময় ভাববে তোমার পাশ ঘেঁষে বাবা আছে।
বাবা আজ নেই। বাবা তুমি কোথায়? বাবা কোথায়? বাবা কেনো এমন করলে? দুনিয়ার ওপর তোমার এত অভিমান ছিল? আমার কথা একবারও ভাবলে না? আমি তোমাকে ছাড়া ভালো নেই বাবা। অনেক দিন জেনেভা ক্যাম্পের দিকে যাওয়া হয় না। ওখানে একদল বন্ধু জুটেছে। তারা বড়লোকের ছেলে মনে করে সম্মান দেয়। অনেক সময় বাকি-বকেয়া দেয়। কিন্তু তারা জানে না, আমার অবস্থা তাদের চেয়েও খারাপ। এর মাঝে ব্যতিক্রম এক ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে জেনেভা ক্যাম্পে । আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। বড়লোকের ছেলে। থাকে ধানমন্ডিতে। প্রথমদিকে আমাকে ওখানে দেখে মেজাজ খারাপ করে। বলল, এই বাচ্চা ছেলে, এখানে তোমার জায়গা নয়। এখানে যেন তোমাকে আর না দেখি। এই হারামজাদারা লাভ করতে সবার কাছে নেশা বিক্রি করে। আমি একদিন সবাইকে দেখে নেব।
আমি অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকাই লোকটার দিকে। তার চেহারা-সুরতে আভিজাত্য আছে। মেজাজটা খারাপ হয়। তাই পাল্টা বললাম, এখানে আপনারও জায়গা নয়। আপনি এখানে কেনো? আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন তিনি। দুই চোখ জুড়ে নেশার হাতছানি। কাছে ডাকলেন আমাকে। বললেন, তুই আমার অনেক ছোট। তোরা নষ্ট হবি কেনো? আমরা হয়ে গেছি সমাজের কারণে। পরিবারের কারণে। তোদের সবাইকে নষ্ট হতে হবে কেনো? ভাইয়ার নাম আবীর। তার বাবা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। সিডনিতে সেকেন্ড হোম করেছেন তারা। কিন্তু এর মাঝে বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তিনি। তার গল্প জমে ওঠে। আমার কথাগুলোও শোনেন তিনি। আমি সব কথা তাকে বলি না। কিছু কথা গোপন করি। এক জীবনে সব কথা বলা যায় না সবাইকে। কিন্তু আজকাল আমার মনে হয় শম্পাকে বলা যায়। শম্পা সব কথা শোনার মতো একটা মেয়ে। অন্য দশ জনের থেকে আলাদা। জীবনের পরতে পরতে ডুবে থাকা কষ্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। আমাদের সোসাইটির হয়েও মেয়েটি কেমন যেন আলাদা। আসলে আমরা একেকজন মানুষ যার যার মতো। কেউ কারো মতো নই। যেমন আবীর ভাই।
আবীর ভাই এক বিকালে জেনেভা ক্যাম্পে আমাকে বললেন, তুমি কাল থেকে এখানে আসবে না। তোমাকে এখানে আমি দেখতে চাই না।
-কেন ভাই! আপনি এলে আমি কেন আসব না?
-তিনি বললেন, তোমার মা আসেন এখানে। আমরা বসে বসে এখানে সময় কাটাই। তিনি নিয়ে চলে যান।
-আপনি আমার মাকে চেনেন? আমাকে চেনেন? আপনি জানেন আমি কে?
-চিনব না কেন? তোমাদের ফ্যামিলিকে ঢাকা শহরের সবাই চেনে। আমিও চিনি।
আমি চুপ মেরে যাই। শুনতাম মা ড্রিংক করেন অতিরিক্ত। কিন্তু এখানেও আসেন ড্রাগ নিতে? মা নেশার ভয়ঙ্কর জগতে প্রবেশ করেছেন বুঝতে পারি। জানতে পারি।
আবীর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কেন নেশা করি জানিস?
-বললাম, না।
-শোন, দ্রুত আমাকে শেষ করে দিতে চাই। অনেক হয়েছে। বাবা-মা দুজনই চান তারা তাদের মতো থাকবেন। আমি আলাদা হব। এসব নেশায় জড়াব না। মন দিয়ে পড়াশোনা করব। তারা আমাকে ঢাকা রাখতে চান না। সিডনিতে পাঠিয়ে দিতে চান। ওখানে আমাদের বাড়ি আছে। কিন্তু তারা বুঝতে চান না আমি তাদের চেয়ে আলাদা নই। আমি তাদের অংশ। এই সমাজে আমার বাস। তাদের ডিভোর্স আমাকে কুরে কুরে মারে। তাদের আলাদা বসবাস মেনে নিতে পারি না। কিছু ভালো লাগে নারে। একদিন সব ছেড়ে চলে যাবো।
-এভাবে বলবেন না। নিজেকে সামাল দেন।
-তুমি আমাকে বোঝাচ্ছ বাছা!
-ভাই, বোঝাচ্ছি না। আপনি এখানে আর আসবেন না।
-তুই কেন এখানে একটা বাচ্চা ছেলে? এর জন্য তুই দায়ী নস। তবুও তোকে আসতে হয়। আমাকে আসতে হয়। আমাদেরকে আসতে হয়। এটাই আমাদের জীবন।
জবাব দিতে পারি না। চুপ মেরে যাই। আবীর ভাই আমার চেয়ে বড়। মানুষটা ভেতরে ভেতরে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। এক সময় তিনিও আমার মতো বাবা মায়ের সাথে থাকতেন। এখন থাকেন বাবার সাথে। বাবা ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে। এরপর অনেক দিন আবীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা নেই। জেনেভা ক্যাম্পে আরেকদিন গিয়ে শুনলাম চলে গেছেন সিডনি। মনটা ভালো হয়ে গেল। মানুষটি এখন বদলে গেলেই হয়। কিন্তু না, বেশি দিন এই ভালো খবরে থাকতে পারি না। জেনেভা ক্যাম্পে আরেকদিন গিয়ে শুনলাম খবরটা। খুব খারাপ খবর। আবীর ভাই নেই। সিডনিতে অতিরিক্ত হুইস্কির সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট নিয়েছিলেন। এই ঘুম তার শেষ ঘুম। যা আর ভাঙেনি। খবরটা শুনে ভেঙে পড়লাম। এরপর অনেক দিন আর যাইনি জেনেভা ক্যাম্পে। আমার মনে হয়, আমি গেলেই আবীর ভাই আসবেন। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বলবেন, তোকে না করলাম এখানে আসতে, তারপরও কেন এলি? এবার যা এরপর আর আসবি না। আবীর ভাই কেন এমন করলেন? আমরা এই প্রজন্মের একটা বড় অংশই তার মতো দুঃখ নিয়ে বেড়ে উঠছি। সবাই কি একদিন তার মতো করে চলে যাব?
 আবীর ভাইর সাথে স্বল্প পরিচয়। কিন্তু অনেক স্মৃতি। আমাকে যেতে না করতেন, আবার অনেক দিন আমার জেনেভা ক্যাম্পের টাকা আবীর ভাই দিয়ে দিতেন। আবার আমাকে বোঝাতেন আমি যেন ওখানে না যাই। আবীর ভাইর পড়শোনাও দারুন। নেশার পর তিনি শিল্পসাহিত্য সব নিয়ে কথা বলতেন। অনেক কিছুই আমি বুঝতাম না। এমন বুঝদার মানুষকে কেন চলে যেতে হবে? দুনিয়াটা অনেক জটিল। গত দুই বছরে কিছুটা অনুধাবণ করে আবীর ভাইয়ের খবরটা আরও ভালোভাবে শুনলাম। তার বাবা-মায়ের ভুল বোঝাবুঝি অনেক দিনের। তার সঙ্গে আমার মিল আছে কিছু। তার মা নেশায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। তার বাবা ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে। বাবা মায়ের দূরত্বে থেকে আবীর ভাই জড়িয়ে পড়েন ইয়াবায়। একপর্যায়ে তা আর ইয়াবায় থাকেনি। সব ধরনের নেশার অন্ধকার জগৎ আবীর ভাইকে ঘিরে ধরে। তার বাবা তাকে নিয়ে যান সিডনি। ধারনা ছিল ছেলে বদলে যাবে। নতুন পরিবেশ অন্যভাবে শুরু করবে। প্রথম কিছু দিন তাই ছিলেন। তারপর আবার আগের মতো। সেখানেও নেশার সাম্রাজ্য খুঁজে পান আবীর ভাই।
বাবা ছেলেকে রেখে চলে আসেন ঢাকায়। বুঝতেও পারেননি ছেলের সাথে এটাই হবে শেষ দেখা। একদিন ছেলে দুনিয়াকে গুডবাই জানিয়ে দেয়। বাবা-মা হয়তো এখন বুঝবেন। অথবা জানি না বুঝবেন কিনা। তবে মানুষটার জন্য আমার খারাপ লেগেছিল অনেক দিন। কী সুন্দর চেহারা। আমাকে শাসনের সুরে বলতেন, তুমি এখানে কেন! আমারও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করতো আপনি ওখানে কেন? আমরা ওখানে কেন?
জীবন বড়ই সস্তা। আমার বাবা ফাঁকি দিলেন। আবীর ভাই চলে গেলেন। এই মানুষটার কথা মনে পড়তেই জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। তা ছাড়া ভাবলাম, অনেক দিন অর্থকষ্টে আছি। এই টাকা ফুফু দিয়েছেন জন্মদিনের উপহার কেনার জন্য, নেশার রঙিন জগতের জন্য নয়। টাকা দেওয়ার সময় তার চোখে ছিল অবিশ্বাস্য চাহনি। ভাবছিলেন এই টাকা আমি আবার নেশার জগতে নষ্ট করব কিনা। ফুফু আমি চেষ্টা করবো বদলাতে। পারবো কিনা জানি না।
এলোমেলো চিন্তা নিয়েই দাদীর বাড়ির পথে হাঁটতে থাকলাম। গেট খুললেন কালাম ভাই। এ বাড়ির পুরনো কর্মচারী। দাদার আমল থেকেই আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ছাদের রুমে চলে যান। চুপচাপ। কোনদিকে তাকাবেন না। দাদী দেখলে হইচই করবেন। ওখানে খাবার পাঠিয়ে দেবো। আমি বিড়ালের মতো চলতে শিখেছি। আমার চলাতে কেউ টের পায় না। চুপচাপ চলে গেলাম ছাদের রুমে। এই কয় বছরে অনেক কিছু আয়ত্ত করতে হয়েছে। ছাদের এই রুমটা খারাপ লাগে না। সামনে খোলা ছাদ। চিলেকোঠার এ রুমে পুরাতন জিনিসপত্রের স্তুপ রাখা। এই কারণে এখানে দাদীর নজর নেই। অথবা দাদী জেনে শুনে না জানার ভান করছেন আমায় নিয়ে। কোন কিছুই আমার খারাপ লাগে না। জীবন চালানো বলে কথা।
ছাদে গিয়ে বসলাম আমি। ভাবছি শম্পাকে ফোন করবো। তার সাথে কথা হয়নি আজ সারাবেলা। এই মেয়েটির মনেও আমার মতো অজানা দুঃখ লুকিয়ে। সেই দিন বলল, আচ্ছা এখন দেশে কি বেশি হচ্ছে জানিস?
বললাম, কোন বিষয়ে?
শম্পার সাফ জবাব তুই আসলে গাধাই থাকলি। এখন দেশে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ডিভোর্স। আর গ্রামে পুরুষ আর শহরের নারীরা ডির্ভোসে এগিয়ে। বাড়ছে সিঙ্গেল মাদার, ফাদার। ওরা সংসার করতে পারবে না তারপরও বিয়ে কেনো করছে বুঝতে পারি না। শালার ওসবে আমি নেই।
-তোকে যেতে কে বলল?
-কেউ বলতে হবে কেন? আমি আমারটা বুঝি না। আমি কি তোর মতো মহা গাধা টাইপ?
মেয়েরা ছেলেদেরকে গাধা ডাকতে পারলে মজা পায়। শম্পারও হয়েছে তাই।
ভাবতে ভাবতে শম্পার ফোন বেজে ওঠে।
-কোথায় রাত কাটাস? রেল ষ্টেশন না মোহাম্মদপুর, মীরপুরের বস্তি?
-দাদীর বাড়ির চিলেকোটা। আর কোথায়ও না।
-এত ভালো ছেলে? মেয়েগুলো শুনলে গলে গলে পড়বে।
- তুই না বললি মেয়েদের কাছ থেকে দূরে থাকতে। তাই আমি তো বিয়ে শাদী করবো না। কারো গলে পড়ার দরকার নেই। বিয়ের মতো জটিল জিনিস করে পরে সবকিছু তাসের ঘরের মতো ভেঙেচুরে ফেলার কোন কারণ নেই।
- হয়েছে। বেশি জ্ঞানী কথা বলার দরকার নেই। এমনিতে তুমি দিন-দিন ভাবুক হয়ে ওঠছো। আর দরকার নেই।
- আছো তো মায়ের আচলের নিচে। টের পাওনা দুনিয়াদারি।
-থাক আর টের পেতে হবে না। সব জেনে এত খোঁচানোর দরকার নেই। বার্থ ডে বয়ের সারাদিন কিভাবে কাটলো? খুব পার্টি করলি আমাকে রেখে?
-ফুফুর ওখানে খেলাম। আজ বনানীতেও গেছি। কিন্তু ছিলাম না বেশি।
- থাকবি না কেন? ওনি তোমার মা। ভুল করলেও মা। শুদ্ধ করলেও মা। দুনিয়াতে মায়েরা সন্তানদের জন্য সব সময় একরকম থাকে।
- আমার ব্যাপারটা জানিস সব। আগের মায়েরা সব একরকম ছিলেন। এখনকার মায়েরা বদলে গেছেন। তারা শুধুই আধুনিকা।
-দুনিয়ার সব মানুষ এক নন। কিন্তু হয়তো তোর মায়েরও কোন অজানা কষ্ট রয়েছে। যা তাকে ঠেলে দিয়েছে অন্য জগতে। যা আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। বেশিরভাগ মানুষই আমরা কেউ কাউকে বুঝি না। সমস্যা এখানেই। অথচ কখনো কখনো ভান করি সবাই সব বুঝি। বাদ দেয় ওসব। আমাদের জীবনের অনেক কিছুই অন্যরকম। এই জেনারেশনকে কেউ বুঝে না। সমস্যা এখানেই বেশি।
এনিয়ে কথা আমিও বাড়াই না। ভালো লাগে না। বাবার সাথে ছাড়াছাড়ির পর সন্তানদের নিয়ে শম্পার মা উত্তরা ১৪ নম্বরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। তার বাবা নতুন মাকে নিয়ে থাকে গুলশানে তাদের বাড়িতে। শম্পার এই নতুন মাকে আমি দেখেছি একদিন। তার বাবা কম বয়সি এই বউ নিয়ে এক রেষ্টুরেন্টে খেতে ঢুকেন। আমি ছিলাম। শম্পার বাবাকে দেখে সটকে পড়ি। মানুষটা আমাকে দেখেননি।
শম্পাকে বিষয়টি বলেছিলাম। শম্পা সবটুকু না শুনেই ক্ষেপে গেলো। বললো, তুই যা ওই বেটির পা ধুয়ে দেয়। তুই ওখানে যাবি কেন?
আমি বুঝলাম না আমার সাথে এই ব্যবহার কেনো করলো?
শম্পা আমার সব কিছুই জানে। বর্তমান বাউন্ডুলে জীবনও। মাঝে মাঝে দাদী বের করে দিলে থাকার জায়গা থাকে না। এক রাতে বায়তুল মোকাররক মসজিদে ছিলাম। আরেকবার কাকরাইল মসজিদে। বায়তুল মোকাররমে কেউ কিছু প্রশ্ন করেনি। চুপচাপ ঘুমালাম। ভোরে চলে এলাম। কাকরাইলে ভোরে ইবাদতের জন্য ডাকা হলো। তারপর সকালে সবার সঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। খাওয়াটা খারাপ লাগেনি। দুই দিন তাবলিগ জামায়াতের সাথে ঘুরেও বেড়াইছি খিলগাঁও এলাকায়। মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দেওয়ার অভিজ্ঞতাও শম্পা জানে।
ভাবতে ভাবতেই শম্পার ফোন। তার কথাবার্তা শুরুই হয় অন্যভাবে। সেই দিন বলল, তুই আমাকে এত বেশি জ্বালাস কেনো? খবরদার বলে দিচ্ছি ভুলেও আমার প্রেমে পড়বি না। ছেলেরা আমার চোখের বিষ। এই জীবনে কোন বিয়ে শাদী করবো না। একলা জীবন কাটাবো। একলা জীবন কাটানোর মজা আলাদা। তুই কোনটাই বুঝবি না। অবশ্য তোর বয়স হয়নি।
আমি বলতে চেয়েছিলাম, আমার বয়স হয়নি তোর হয়েছে? আর তোকে নিয়ে এই সব ভাববো কেনো? আর তুই আজব আজব কথা আমাকে কেনো বলিস? এই সব কথা বলা হয় না। আমি অনেক কিছুই মনে ধারন করি। বলতে পারি না। আমার ভেতরে থেকে যায় অনেক অজানা কথা। অনেক সময় কথা বলি নিজের সাথে নিজে। এই কাজটা খারাপ না। নিজের সাথে কথা বলার মজা আলাদা একবার।
শম্পাকে নিয়ে গুলশানে এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। আমাদের পাশের টেবিলে ছিপছিপে সুন্দর একটি মেয়ে একা বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর সিগারেট ফুকছে। শম্পা আমাকে বললো, দেখ মেয়েটা অনেক সুন্দর না?
আমি বললাম সুন্দর। কিন্তু তার সিগারেট খাওয়া ভালো লাগছে না। এভাবে তাকে মানাচ্ছে না।
শম্পা বললো, তুই সারাজীবন গাধাই থেকে যাবি। এই মেয়েটাকে দেখে আমি আকুল হয়ে ওঠছি। সত্যি সত্যি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। ওর সিগারেট খাওয়ার স্টাইলটাই আলাদা। আমি থমমত খেয়ে যাই কথা শুনে। কি বলছে এই সব? আমার চেহারার ভাব দেখে শম্পা মিস্টি করে হাসলো, আর ইউ জেলাস?
 বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। আমি জেলাস হবো কেনো?
-আরে গাধা এই দেশে এখনো এই সব নেই। ইউরোপ আমেরিকা হলে সমস্যা ছিল। সবাই সন্দেহের চোখে দেখতো।
আমি কিছু বলি না। মাঝে মাঝে ভাবি, এই সুন্দর মনের মেয়েটির মাথা নষ্ট নয় তো? কিন্তু তাও প্রকাশ করি না। কারণ শম্পা আমার একমাত্র বন্ধু। ওর কথাবার্তা বয়স্ক মানুষদের মতো। তবুও আমরা ভালো বন্ধু। সুখ-দুঃখ শেয়ার করি। তার জীবনেই সমস্যার শেষ নেই। মানব জীবনের অনেক জটিল জটিল গল্প আমি তার কাছে শুনি। ঢাকা শহরে কি হচ্ছে তাও কিছু অনুধাবন করতে পারি। কিছুদিন আগে তাদের বাসায় গিয়েছিলাম। শম্পা পরিচয় করিয়ে দেয় তার এক খালামনির সাথে। ভদ্র মহিলা ডাক্তার। আমাকে পরে বলল, আমার এই খালাকে দেখে কি বুঝলি?
-ভালো। তোকে অনেক আদর করে না?
- আরে দূর আমার এই খালা হচ্ছেন প্রেম কুমারী। তিনি নতুন নতুন প্রেমিক খুঁজে বের করেন। তবে একজন আছে ফিক্সড।
-যা এই বয়সে কিসের প্রেম। ওনার না স্বামী আছে?
- স্বামী থাকলে সমস্যা কি? খালা মনির স্বামীটা মেন্দা মার্কা ডাক্তার। ঢাকার বাইরে পোস্টিং। ইচ্ছা করলে খালা তাকে বদলি করে ঢাকায় নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু আনেন না। বরং রেখে দিয়েছেন তদবির করে। খালার গভীর প্রেম এক আদম সুরুতের সাথে। আদম বুঝলি? এই আদম তদবির করে খালামনির স্বামীকে ঢাকায় আনতে দেন না।
- তোর মাথাটা নষ্ট হয়েছে। নিজের খালাকে রেহাই দিতে চাস না। তোর খালাকে আমারতো ভালো লাগে। রুপবতী নারী। দেখতে অনেক গ্ল্যামারাস। তিনি এমন হবেন কেন? আর আরেক ভদ্রলোককে আদম বলবি কেন?
- গাধা একটা। লোকটা আদম ব্যবসা করে। রেস্টুরেন্টও আছে একটা। দেখতে ভয়াবহ। খালার মতো মেয়ে লোকটার প্রেমে মসগুল কেনো জানিস? একটাই কারণ লোকটা খালার জন্য দুই হাতে খরচ করে। নানুকে নিয়ে খালা উত্তরা যে বাসায় থাকেন তার ভাড়াও লোকটার দেওয়া। মাঝে মাঝে দুই জন মিলে চলে যায় বিদেশ।
- কি সব বলিস! তোর খালু জানে না?
-সবাই জানে। দুনিয়ার মানুষ জানে। কিন্তু আমার খালু হলো মেন্দা মার্কা। তিনিও জানেন। আর জেনেই সব মেনে নিয়েই চলেন। এখন এই যুগে সবাই সংসার সুখের করতে অনেক কিছু মেনে নেয়। এইগুলো নিয়ে নাক গলায় না। সোসাইটি বলে কথা। হাই সোসাইটিতে ডোন্ড মাইন্ড হতে হয়। তাহলে আর ঝামেলা কম। তোর বাপটা ডোন্ড মাইন্ড হতে পারলো না। আর পারলো না বলেই সব শেষ।
বাবার কথায় মন খারাপ হয়ে যায়। আমার মন খারাপে শম্পার কিছু যায় আসে না। ও একটু পাগলাটে আছে। তবুও বললো, ওলে বাবু সোনা এত মন খারাপ দেখাতে হবে না। জীবনে কথায় কথায় মন খারাপ। কিভাবে বাকি জীবন কাটাবি? নাদুস নদুস হওয়ার দরকার নেই তোর।
মেজাজটা একটু খারাপ হয়। হঠাৎ বললাম- আমার জীবন কিভাবে কাটবে তা নিয়ে তোর এত ভাবনার কিছু নেই। যার যার জীবন তার তার। তোরটা নিয়ে তুই ভাব। আমারটা আমার।
শম্পা বিস্ময় নিয়ে তাকায়। অনেকক্ষণ আমরা কথা বলি না। তবে পরিবেশ হালকা করতে শম্পা নিজেই আবার গল্প জুড়ে দেয়। এবার বলল, খালার আরেক বান্ধবী আছে রিয়া আন্টি। এখনো যা সুন্দর না, দেখলে তুইও প্রেমে পড়ে যাবি। রিয়া খালা ফেসবুকে আমার সাথে এড আছে। রিয়া আন্টির এক ছেলে। রিসেন্টলি হাজব্যান্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি। আন্টি একা থাকেন। রাজনীতি করেন। কলেজ শিক্ষিকা। দারুণ রোমান্টিক। কিছুদিন আগে একজন প্রেম নিবেদন করে কান্নাকাটি। আন্টির সাফ কথা, এই সব লুতুরফুতুর টাইপ পোলাপান দিয়ে চলে না। রিয়া আরও বললো, আন্টির প্রেমিক সংখ্যা কম করে দশ। এর মাঝে বেশ কয়েক জনের সাথে ডেটিং করেন। আন্টি যদি একবার কাউকে টার্গেট করেন, তাকে তিনি ছাড়েন না।
থতমত খেয়ে যাই। এমন আজব টাইপের রিয়ার আরও অনেক গল্প আছে। সব ওর কাছ থেকে শুনি। রিয়া আন্টির আরও অনেক গল্প আমি অন্যখানেও শুনি। আন্টি সমানে ঘুরে বেড়ান। স্টাইল করে সিগারেট ধরান। জমজমাট পার্টি করেন। একবার এক পার্টিতে আমাকে এমনভাবে হাগ করেন দম বন্ধের মতো অবস্থা। আন্টি বলেন, বাছা সোনা তুমি অনেক কিউট! এটা শম্পা জানে না। জানলে খবর আছে।
 শম্পা শুধু অন্যদের নিয়ে গল্প বলে তা নয়। মাঝে মাঝে আমাকেও আজব আজব কথা বলে বসে। আমার আজকাল মনে হচ্ছে, শম্পা আমার সাথে এভাবে কথা বলে ইচ্ছা করেই। কারণ বাবার চলে যাওয়ার পর থেকে আমার এলোমেলো জীবন বদলে দেয়ার চেষ্টা তার প্রথম থেকেই। নিজে অনেক সমস্যার মধ্যে বাস করলেও আমাকে ও মাতিয়ে রাখতে চায়। ভুলিয়ে দিতে চায় সবকিছু। একদিন মধ্য দুপুরে রিয়া ফোন করে বলল, শোন রিয়াজ তোর সাথে জরুরি কথা আছে।
আমি বললাম, কি কথা নতুন কোন আজব গল্প? তোর খালা না রিয়া আন্টি কাকে নিয়ে?
-কাউকে নিয়ে না। তুই আমাকে বিয়ার খাওয়াতে পারবি?
-আমি বিয়ার খাই না।
-ভালো জিনিস কিভাবে খাবি? তুই খাস খারাপ জিনিস। ইয়াবা, ফেনসিডিল। ওয়াক থু! এই জঘন্য জিনিস খেতে পারবো না। আমার জন্য বিয়ার। তবে এই জিনিসটাও নাকি তিতা? মানুষ খায় কি করে ওসব ছাই। আর শোন টাকা তোকে দিতে হবে না। তুই শুধু আমার সাথে যাবি কোরিয়ানাতে। বিয়ার অথবা রেড ওয়াইন। রেড ওয়াইন খেলে মেয়েদের চেহারায় গ্লেজ দেয়। কিন্তু আমি বিয়ার খাবো। আর বিয়ার খেলে একটু মোটা হয়। আমি একটু মোটা তাজা হতে চাই।
শম্পার সাথে আমার যাওয়া হয় না। কিন্তু শম্পা আমাকে কয়েক দিন পরই জানায়, বিয়ার এবং রেড ওয়াইন দুটার টেস্ট সে নিয়েছে। তার কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকাই। শম্পা বলল, এত চমকে যাওয়ার কি আছে। এখন সবাই খায়। তুই-ও খাস। বাট তোর খাওয়ার নেশাটা বড্ড বেশি সস্তা। বাজে! তুই আসলে সস্তা টাইপ একটা ছেলে। তাই সস্তা টাইপ জিনিস খাস। আমার মতো ভালো কিছু খা!
শম্পার কথাগুলো আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়। আমি তার সঙ্গে কথা বাড়াই না। আসলে-ও এমনই। আমি কি করি না করি ওটা আমার নিজস্ব। এই যুগে বন্ধু বান্ধব এমন হয় না। মাঝে মাঝে আমার মেজাজ গরম হয়। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করি না। কারণ শম্পার সঙ্গে কথা বলে আমার সময়টা খারাপ কাটে না। এই সময়ে ভালো কিছু পাওয়া মুস্কিল। বিশেষ করে চলার মতো মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের ভালো সঙ্গী কমছে। আমি ভাগ্যবান। বড্ড খারাপ সময়ে কিছু ভালো বন্ধু পেয়েছি। তাদের সঙ্গে চলা যায়। কিন্তু এখন আমার কোন কিছুই ভালো লাগে না। এর মাঝে শম্পা আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। তার সঙ্গে চলা যায়।
 মাঝে মাঝে রাগও হয়। শুধু শম্পার ওপর নয়, দুনিয়ার সব মানুষের ক্ষেপে উঠতে ইচ্ছা করে। কখনো কখনো সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দিতে ইচ্ছা করে। মনে মনে ভাবি অনেক দূরে চলে যাবো। তখন আমি নিজের মাঝে গুটিয়ে থাকি। একলা চলি। আমার চারপাশ নীল হয়ে ওঠে। রক মিউজিক ভালো লাগে। সেই সময়ে ঘর বাড়িতেও আসতে ভালো লাগে না। নদীর তীরে, জলে জঙ্গলে হারিয়ে যাই। এমন অনেক বার হয়েছে। আর সেই সব প্রিয় দিনগুলোর পর যখন ফিরে আসি লোকালয়ে দাদী ক্ষেপে যায়। ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি করে। আমি দাদীর রোষাণলেই এখন আছি।
ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। আকাশে আজ মেঘের খেলা নেই। তারাগুলো জ্বলছে। ছোটবেলা থেকে শুনতাম মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায়। তারাগুলোর দিকে বাবাকে মনে পড়ছে। বাবা কি তারা হয়ে আমাকে দেখছে? আমি তাকিয়ে থাকি। খুঁজি বাবাকে। মাঝে মাঝে এমন হয়।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত এখনও ১টা। ফোনের রিং এর শব্দে চমকে ওঠি। ফোন করেছে শম্পা।
-হ্যালো বার্থডে বয় হাউ আর ইউ।
-বার্ড ডে চলে গেছে। একুশে পার করলাম। একটা উইশও করলি না। আসলে তোর কাছে উইশ আশা করবো কেনো? আমি কারো কাছেই এখন আর কিছুই আশা করি না। দুনিয়াটা আমার চেনা হয়ে গেছে।
-ওরে বাবা তোর দেখি মুখ ফুটেছে। মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না। একুশ পার করছেন ওনি। এবার তোকে তো বিয়ে করাতে হয়। বাইশে পা বলে কথা। সাপের পা দেখেসনিতো।
- তোর ওপর আমার মেজাজটা খারাপ আছে। বাজে কথা বন্ধ। আর ফালতু কথা এই মধ্য রাতে শুনতে রাজি নই। যা বলার সরাসরি বলবি। মানুষকে নিয়ে ফালতু গল্পও জুড়ে দিবি না।
- ফালতু গল্প আমি করি না। এখন আমার ঝগড়ার ম্যুড চলছে। আজ শুরু করেছি বাবাকে দিয়ে। মায়ের সাথে হৈ চৈ করেছি। এখন আরও লোকের সন্ধানে আছি। চিন্তা করলাম, ঝগড়ার জন্য মানুষ হিসেবে তুই একবারে খারাপ না। তাই একবার দুপরে তোর ফোনের রিং বাজতে দেখলাম। কিন্তু ধরিনি। ঝগড়ার কঠিন ম্যুড দরকার। তখন তা ছিল না। এখন পুরোপুরি আছে। তুই রেডি তো?
-আমি কারো সঙ্গে ঝগড়া করি না।
-তুমি কোত্থকে করবে লুতুফুতু। দাদীর ভয়ে কম্পমান। দাদীর সঙ্গে এত ঝামেলার কি দরকার? দাদী যা বলবে তাই শুনবি। তোর দাদীকে আমার চেনা আছে। তিনি তোকে ভালোই সহ্য করেন। আমি হলে তাও করতাম না।
- তোকে সহ্য করতে বললো কে?
-এই তো ঝগড়ার ম্যুড পাচ্ছি। বল, শুনতে খারাপ লাগছে না।
-বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে দাদী কারো সঙ্গেই কথা বলেন না ভালো করে।
- আপনি যখন অন্য কিছুতে চলে যান তখন দাদী কি করে সহ্য
করবেন? দাদী তার ছেলে হারিয়েছেন। তোর মা চলে গেছে সব ছেড়ে। তুই দাদীকে জ্বালালে তিনি কেনো মানবেন? তার চেয়ে দাদীকে ম্যানেজ করে বিদেশে পড়তে চলে যা। একটা দুইটা সেশন মিস হলে কি যায় আসে।
- বিদেশে পড়তে গেলে টাকা কে দেবে তোর বাপে? না তুই?
-আমার বাপে কেনো দেবে? তোর বাপের মা দেবে। তবে বাপ ফোন করেছে আজ। বলেছে, দেশ বিদেশে আমাদের দুই বোনের সব খরচ দেবে। মেজাজ ভালো ছিল না। তাই বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছি। এই লোকটার ওপর আমার একটা তীব্র ক্ষোভ আছে। এই ক্ষোভটা কষ্টের। কত ভালো ছিলাম আমরা। লোকটা সব শেষ করে দিল। আমার মা এখন স্কুলে চাকরি করেন। কষ্ট করেন। আমরাও কষ্ট করি। অথচ আমাদের এমন হওয়ার কথা ছিল। ছোট্ট একটা ভুল একটি সংসার তছনছ হয়ে যায়।
-তোর সঙ্গে ওনার যোগাযোগ আছে না?
-ধুর আমার সাথে ওভাবে নেই। আমার ভালো লাগে না কথা বলতে। আমরা কথা বললে মা মন খারাপ করেন, কিন্তু বুঝতে দেন না। মা খুব জেদি। এই লোকটা আমার মাকে অপমান করেছে। তবে আমার আপুটা অন্যরকম। তার কথা বাবার দায়িত্ব তাকে পালন করতে দেয়া উচিত। তার কাছ থেকে টাকা পয়সা না নিয়ে ফকিরের মতো চলার অর্থ হয় না। আপুর সঙ্গে বাবার যোগাযোগ আছে। মায়ের ভয়ে আপু স্বীকার করে না। কিন্তু আমি জানি। লুকিয়ে আপু বাবার সঙ্গে কথা বলে। দেখা করে। বড় মেয়েরা একটু গাধা হয়। মেয়েরা শুধু না, ছেলেরাও হয়। যেমন তুই। কঠিন গাধা। দুঃখ ভুলার জন্য হাবিজাবি খাস। তার চেয়ে ঘাস খেতে পারিস। গাধারা ওটা খায়। আরেকটা কাজ করতে পারিস, টেকনাফ চলে যা বদির সামাজ্য। ওখানে সারাদিন ইয়াবা খাবি।
-তুই সারা দিন আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলিস কেন? তোর সমস্যা কি?
- বলি কারণ তুই আসলে জেনুইন একটা গাধা। সত্যি কথা কারোই ভালো লাগে না। যদি ভালো লাগে সব ছেড়ে দিবি প্রমিজ কর জন্মদিনে।
- ব্ল্যাক মেইল করবি না। তুই কি জানিস আমার বাবা কিভাবে মারা গেছে?
-জানি। জানবো না কেনো? সারা দুনিয়ার মানুষ জানে। সব পত্রিকাগুলো বিস্তারিত লিখেছে। মন্ত্রীপুত্র, মন্ত্রী জামাতা বলে কথা। পত্রিকাগুলো ছেড়ে দেবে? তারা ব্যবসা করবে না।
-পত্রিকা যা লিখেছে তার বাইরে অনেক কিছু আছে। যা লেখা হয়নি, কেউ জানে না।
-কঠিন আমাদের সবার জীবন। আমাদের বাবা কি সুন্দর সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এক বালিকা বিয়ে করে সংসার করছেন যে বাড়িতে আমরা বেড়ে ওঠেছিলাম সেই বাড়িতে। মানুষটা তার স্ত্রীকে ছেড়েছে। সন্তানরা তার থেকে দূরে। এখন এই মহিলার ঘরে নতুন সন্তান আসবে। তা নিয়ে থাকে। ভুলে যাবে সব কিছু। আমরা ছিলাম একদিন তার মনে থাকবে না। তোর কষ্টটা আমি বুঝিরে। এই কষ্টটাকে ঘিরে নিজেকে নষ্ট করার কোন মানে হয় না। ওপার থেকে তার বাবাও খুশি হবে না তোকে খারাপ দেখলে। তার চেয়ে জীবনটা নতুন করে ভাবনায় নিয়ে আসো।
-এত উঠতে সব সিরিয়াস আলোচনা ভালো লাগছে না?
- তাহলে কি আলাপ করবো প্রেমালাপ? তোর সঙ্গে প্রেম করার জন্য ফোন করিনি। উইশ করার জন্য ফোন করেছিলাম। আর শোন রিয়া আন্টির সামনে বেশি যাবি না। এই মহিলা তোর দিকে খাই খাই চোখে তাকায়।
-দূর তোর মুখে যত্ত বাজে কথা। সবাইকে নিয়ে তুই যা খুশি বলিস। ওভাবে বাজে সমালোচনা করবি না তো। সব মানুষ খারাপ না।
- খারাপ কিছু বলিনি। শুধু বলিসি রিয়া আন্টি থেকে দূরে থাকতে।
- ডাক্তার খালামনি থেকে থাকবো না?
-শুধু আজে বাজে কথা। খালামনিকে নিয়ে তোকে বেশি কথা বলতে হবে না।
- আমি কোথায় বললাম, তুই আমাকে বললি খালামনির প্রেমিক একটা আদম।
-আমার খালাকে নিয়ে আমি বলবো। অন্য কারো বলা চলবে না।
-হুম নিজের ঢোল নিজে বাজাও। অন্যকে দেবে না। দিলেই সমস্যা। আর এই বুড়িগুলোকে নিয়ে আমাকে আজে বাজে বলবি না।
- সাধে কি বলি? ব্যাটাগুলো সব খারাপ হয়। যা পায় তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাছ বিছার নেই।
- খালি খালি আজে বাজে কথা বার্তা।
-সত্যি কথা বলছি। আরেকটা কথা ফোন করেছি, আগামীকাল খালামনির বাসায় একটা দাওয়াত আছে। আমার সঙ্গে তুই যাবি।
-মানে কি?
- মানে আমি গেলে তুই ফ্রি। এখন তো দুনিয়াতে এটাই চলছে। আমার দাওয়াত। তুই যাবি ফাও।
-আমি তো দাওয়াত পাইনি। কেনো যাবো? ফাও খাওয়ার সময় নেই।
-আন্টি বলেছে, তোকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ওই বদ বেটির সাথে নো ঘেঁষাঘেঁষি।
-কোন বদ বেটি?
-আরে মিসেস প্রেম কুমারি রিয়া আন্টি, তিনি যেন তোকে মন ছুড়ে না মারতে পারে।
- আমাকে মন ছুড়ে মারলে তোর সমস্যা কি?
- সমস্যা আছে বাছা। এই বুড়ি বেটিগুলোর হাভভাব বেশি ভালো না। আজকাল অনেকে ইয়াং ছেলে ছোকরা খুঁজে নেয়। তোকে নিয়ে আমি সন্দেহে আছি। আগে থেকেই সাবধান। আর ফাইনাল কথা, একটু আগে চলে আসবি আমাদের বাসায়। এক সঙ্গে যাবো।
ফোনে কথা শেষ করে কিছুটা হালকাবোধ করি। নিচে কোন সাড়া শব্দ নেই। বুঝলাম, দাদী টের পাননি। আমি ঘুমাতে চলে গেলাম। ঘুমানোর আগে ভাবলাম একবার ফুফুকে ফোন করি। বলি, ফুফু থ্যাংকু। তোমার টাকাটা আমি নষ্ট করিনি। রেখে দিয়েছি নিজের কাছে। তোমার জন্য, দাদীর জন্য, শম্পার জন্য আমি চেষ্টা করবো আগের মতো হতে। আবার পড়াশোনা শুরু করতে। সবকিছু স্বাভাবিক করতে। ফোন করা হয় না। এত উঠতে তিনি জেগে নেই। ঘুম থেকে ওঠালে মনে করবেন আমি তার টাকায় নেশা করে বাড়ি ফিরেছি। তাকে না জ্বালানোই ভালো। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। কাল দাদী ওঠার আগেই দরকার হলে সরে পড়বো। ফিরবো উঠতে। আজকের দিনটা খারাপ কাটেনি। কাল কি হবে দেখা যাবে। আজকেরটা নিয়েই থাকি। কালকেরটা বাল বুঝা যাবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভালো লাগছে। বাবা বলতেন, শোন একটা কথা মানুষ চাইলে নিজের জীবন বদলাতে পারে। আমার চিৎকার করে জানতে ইচ্ছা করে, বাবা তুমি এত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে, কিন্তু নিজের জীবনটাই বদলাতে পারোনি। বাবা এটা কেমন কথা হলো। বাবা কার দোষ ছিল, জানি না, তোমাদের কারণে আজ আমি ভালো নেই বাবা। আজ আমি ভালো নেই।
উঠতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এই স্বপ্ন নেশার নীলে আমি অনেকবার দেখেছি। এই কারণে নেশার জগতে আমি বারবার গেছি স্বপ্নটা দেখার জন্য। বাবা, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, এই তোর এত চিন্তা কিসের? বাবা আছি না। বাবা যত দিন থাকে ছেলের কোন চিন্তা থাকতে নেই। বাবারা সব সময় ছায়া হয়েই থাকে। আর শোন মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবি না। তোমার মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। এত ভালোবাসে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। তোমার মা এখন কষ্টে আছে শুধু তোমার জন্য। অন্য কোন কারণে নয়। মায়ের সঙ্গে অভিমান করতে নেই বাবা। মাকে সরি বলে আসবে একদিন। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। মা আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
ঘুমটা ভেঙে যায়। মাকে মনে পড়ছে। ভীষণভাবে মনে পড়ছে। কি মায়াবি মুখ, সামনে বসলেই আমি ভেঙে চুরে যাই। বাবা এই মায়ের প্রতি অভিমান করেই চলে গেলেন। অনেক দূরে চলে গেলেন। সেই দিনটার কথা এখনো মনে আছে। আমার এ লেবেল ফাইনালের সময় থেকেই টানাপোড়ন শুরু। মা এই সময় ভীষণ ঝামেলা শুরু করেন কানাডা নিয়ে। এর মাঝে আমাদের পরিবারে নতুন উৎপাত হিসেবে যুক্ত হয় তানভীর। সব মিলিয়ে একটা এলোমেলো সময়। সেই সময়টার কথা ভাবতেই পারি না।
শনিবার সন্ধ্যা বেলায় উত্তরায় গেলাম। শম্পাদের বাড়ির নিচ থেকে খবর দিতেই ও নেমে এলো। আমরা রিকশা নিয়ে গেলাম শম্পার খালামনির বাসায়। এই ভদ্র মহিলা ডাক্তার। শম্পা যাই বলুক তাকে আমার খারাপ লাগে না। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো। আমি জানতে চেয়েছিলাম, তিনি সন্তান নেন না কেনো? শম্পা আমাকে বলেছিল, জীবনটা তিনি অন্যভাবে দেখেন। তাই সন্তান নেন না। আন্টি কাছে টেনে নিলেন আমাদের। পারফিউমের গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। মিউজিক হচ্ছে। আন্টি বললেন, তোমাকে আসতে বলার বিশেষ কারণ আছে। শম্পা মনি বললো, তোমার জন্মদিন ছিল। কয়দিন আগে ছিল আমার। তাই ভাবলাম, দুটি জন্মদিন এক সাথে করে ফেলি। আশা করছি তোমার খারাপ লাগবে না।
শম্পা বলল, খালামনি তোমান জন্মদিন একমাস হয়ে গেছে। এখনো কি রেশ রয়ে গেছে?
-রিয়া আন্টি বলল, তোর পাকনামি করতে হবে না। সব সময় ঝামেলা তৈরি করে।
আমি হাসলাম। অতিথি খুব বেশি এখনো আসেনি। এরমাঝে ঢুকলেন রিয়া আন্টি। ভীষণ হাসিখুশি। আমাকে এসেই বললেন, হ্যাপি বার্থ ডে। আজকের দিনটা বারবার ফিরে আসুক তোমার জীবনে।
আমি থ্যাংক ইউ বললাম। জবাবে আন্টি বললেন, ওয়েলকাম। শম্পার বড় বোন সিলভিয়া এলো একটু পর। বুজলাম অনুষ্ঠান ঘরোয়া। খুব বেশি মানুষ থাকবে না। আমাকে সারপ্রাইজ দিতে আড়াল থেকে সব আয়োজন শম্পার। এই মেয়েটিকে আমি বুঝে উঠতে পারি না। নারীদের আমি কম বুঝি। নিজের মাকেই বুঝলাম না। অনেক প্রশ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছি। শম্পার অনেক কিছু আমার ভাবনার বাইরে। কিন্তু ভালো লাগে তার কাঠিন্য ভরা জীবনের পরতে পরতে আমাকে আকড়ে রাখার চেষ্টা। অন্ধকার থেকে আলোর ছটায় ফেরানোর জন্য এই মেয়েটি লড়ছে।
ডাক্তার খালামনির আরও কিছু বন্ধুরা এসেছে। আমার স্কুলের পুরাতন বন্ধুদের কয়েকজনকে বলেছে শম্পা। বিব্রত হচ্ছি আমি। এভাবে বাইরের মানুষের আড্ডায় যাওয়া হয় না এখন। এক সময় জন্মদিন হতো বাড়ির ভেতরে। আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে। কেককাটা, খাওয়া-দাওয়া সব থাকতো। আজকের পরিবেশ শুধুই বন্ধুদের। আন্টিদেরও বন্ধুই মনে হচ্ছে। তাদের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করে তোলে। বিস্ময় নিয়ে সব দেখছি। কেক কাটার আনুষ্ঠিকতা শুরু হয়। মোবাইল ফটো সেশনও থাকে। সেলফির হিড়িক পড়ে। সামাজিক গণমাধ্যম সেলফিকে জনপ্রিয় করে তুলছে। যেকোনো অনুষ্ঠান মানে এখন সেলফি। এগিয়ে যাও বাংলাদেশ। রিয়া আন্টি আমার হাত ধরে কেক কাটতে নিয়ে যান। আমি খুঁজছি শম্পাকে। এভাবে আন্টির হাত ধরা দেখলে খবর আছে। কাছেই ছিল শম্পা। মিস্টি করে হাসছে। আমাকে চোখ টিপলো। আমিও হাসলাম। কেক কাটার সময় শম্পা আমার পাশেই ছিল। তুমুল হৈচৈ শুরু। আড্ডার মাঝে রিয়া আন্টি বললেন, রেডওয়াইন এনেছি। কেউ পান করতে চাইলে সবাই আজ এলাউ। ছোট বড় বলে কিছু নেই। আজ সবাই বন্ধু। আমি কোক নিলাম। শম্পা আমার পাশে। কানে কানে বললো, ওয়াইন নেবে না?
-আমার ভালো লাগে না ওসব। কখনো ট্রাই করিনি।
-অন্য নেশাগুলো করলে ওয়াইন কি কেউ নেয় না? শুনেছি খারাপ নেশাগুলোর পর সাধারণ ড্রিংক আর কেউ করতে পারে না। তখন মেইনস্টিম ভালো লাগে না।
- আমি জানি না। শুনেছি হুইস্কি, বিয়ার, ওয়াইন এক জগতের। এই জগত হলো ফ্যাশন দুনিয়ার। আর আমাদের জগৎ আলাদা। আমরা হলাম পৃথিবী থেকে আলাদা বাসিন্দা। ওখানে থাকাকালে আমি মায়ার জগত দেখেছি। আকাশে ওড়েছি, নীল একটা জঙ্গলে মৃগ হরিণের সন্ধান করেছি। আমার চারপাশ, গাছপালা আমার সঙ্গে কথা বলছে। আমিও বলছি। আরেকটা কথা কি জানিস বিশ্বাস করবি না। তবুও বলছি নেশার নীলে বাবার সাথে আমার দেখা হতো নিয়মিত। আমরা কথা বলতাম দুইজন মিলে। এই কারণে আমি নীল নেশায়। অন্য কোন কারণ নেই। বাবার বিষয়টি আমি আজও মেনে নিতে পারিনি।
আমরা খেয়াল করি না আমাদের পাশে দাঁড়ানো আন্টির আরেক বান্ধবী আমাদের কথা শুনছিলেন। এই আন্টির নাম ফারজানা। তিনিও ডাক্তার। সাইকোলজি নিয়ে কাজ করেন। আমাদের দুইজনকে ডাকলেন। বারান্দার দিকে। ওখানে গিয়ে দেখলাম রিয়া আন্টি সিগারেট খাচ্ছেন। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। সিগারেট খাবো কিনা জানতে চাইলেন। আমি না বললাম। ফারজানা আন্টি বললেন, রিয়া তুই একটু ভেতরে যা। ওদের দুইজনের সঙ্গে একটু আড্ডা দেবো। তুই থাকলে বোর হবি। রিয়া আন্টি চলে গেলেন ভেতরে। বললেন, বয়স্ক টাইপ আলোচনা আমার ভালো লাগে না। তোমরা কথা বলো। আমি ভেতরে যাচ্ছি। কোন কিছু লাগলে খবর দেবে।
ফারজানা আন্টি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, আমি সাইকোলজি নিয়ে কাজ করি। তুমি আমার চেম্বারে এসো একদিন। চিনতে সমস্যা হবে না, ধানমন্ডি ২ নম্বরে। এতক্ষণ তোমার কথাগুলো আমি শুনছিলাম। তুমি নিজের মতো একটা জগত তৈরি করেছো। এই জগত একান্ত তোমার নিজস্ব। বড় ধরনের কোন আঘাতের কারণেই তোমার ভেতরে একধরনের কঠিন কষ্ট তৈরি হয়েছে। যাতে বসবাস একাধিক মানুষের। মানুষ বিভিন্ন ভালো মন্দে অথবা নেশায় জড়িয়ে নিজের মতো করে একটা জগৎ তৈরি করে। এই জগৎটা তার ব্রেনে ঢুকে যায়। এই জগৎটা একান্তই তার। এখানে কেউ কেউ ইহকাল পরকাল দেখে। মৃত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে। সমুদ্র,পাহাড় আকাশে ওড়ে। হাসি কান্নার এই জগৎটা তোমাদের মতো তরুণদের নিজস্ব একটা দুঃখ বিলাস থেকে। এই বিলাশ এক সময় প্রলয় সৃষ্টি করো। এই বিলাসের মাধ্যমে নিজের জগতটা ধ্বংসের। একবার প্রবেশ করলে কেউ আর বের হতে চায় না। সমস্যা এখানে হয়। চারপাশ তখন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তারা বুঝতে চায় না ধ্বংশে কোন আনন্দ নেই। জীবন অনেক সুন্দর। এই সুন্দরকে সাজিয়ে নিতে হয় নিজের মতো করে।
ফারজানা আন্টি একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যান। আমি তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনি।
-আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেক এই কঠিন। এই শহরে এখন কি হচ্ছে টের পাচ্ছেন না। একটা জেনারেশন পুড়ছে নিজের মতো করে তাদের প্যারেন্টসদের কারণে। কেউই নিজের জন্য নয়। অপরের দায়ভার তাদেরকে নিতে হচ্ছে। আমাদের প্রজন্মটা লড়ছে তাদের বাবা মায়ের কারণে। নিজেদের জন্য না। অথচ কেউ তা বোঝে না। এই প্রজন্মের কাছে প্রেম ভালোবাসা মোহ নয়, পারিবারিক কষ্টগুলোই বেশি।
আন্টি হাসলেন। বললেন, শোন তোমাদের প্রজন্ম অনেক মেধাবি। প্রযুক্তির ছোয়ায় তোমরা বেড়ে উঠছো। এর পজেটিভ এবং নেগেটিভ দুটোই রয়েছে। তুমি যেদিকে ধাবিত হবে সেই দিকে যাবে। তোমার জীবনের তুমিই চালিকাশক্তি। তুমি এক মুহূর্তে সারাপৃথিবী সম্পর্কে জানতে পারছো। গুগল তোমাকে সব জানিয়ে দিচ্ছে। আমাদের এই সুযোগ ছিল না।
-না আন্টি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা অনেক কিছু জানি ও বুঝি। কিন্তু মানবিক দিকগুলো থেকে আমাদেরকে চালাচ্ছে আপনাদের এই সমাজ। এখানে আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না। আমাদের বাবা মায়েরা কি তাদের জীবনের সিদ্ধান্ত আমাদেরকে জানিয়ে করেন? না আমাদের পরামর্শ নেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন তাদের নিজেদের ভালো থাকার জন্য।
-তোমাদের বাবা মায়েদেরও একটা জীবন আছে। সেই জীবনের ভালো মন্দ আছে। তোমরাও হয়তো তাদেরকে বুঝতে পারা না। তবে দায়িত্বের জায়গাতে তাদের অবস্থান আরও অনেক বেশি থাকা যেমন দরকার তেমনি তোমাদেরও বুঝার চেষ্টা করতে হবে তাদেরকে।
-আন্টি বইয়ের কথা আর বাস্তবতা অনেক জটিল।
-তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগছে। বয়সের তুলনায় তোমার কথায় স্পষ্টতা অনেক বেশি। তোমার বয়সি অন্যরা সবকিছু এতটা ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করে না। তুমি অনেকের চেয়ে আলাদা। আমার ভালো লেগেছে। তুমি আসবে আমার কাছে। ডাক্তার মনে করে আসবে না। আন্টি মনে করে তোমার কথাগুলো শেয়ার করবে।
-অবশ্যই আসবো আন্টি।
ভেতর থেকে রিয়া আন্টি টেতে করে রেড ওয়াইন নিয়ে আসলেন। বললেন, এবার সবাই একটু দেখতে পারো।
ইটালি, প্যারিস দুটোই ছিল। তোমাদের জন্য প্যারিস আনলাম। ফারজানা আন্টি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, নিতে পারো। এটা অল্প এক অথবা দুই পেগ খেলে সমস্যা নেই। বেশি কোন কিছুই ভালো নয়। শম্পা একটা গ্লাস তুলে নিলো। আমাকে নিতে বলল। আমিও নিলাম। ফারজানা আন্টি হাসলেন। তিনিও নিলেন। বললেন, রেড ওয়াইনটা ভালো। তুমি মাঝে মাঝে রেড ওয়াইন নিতে পারো। অন্য কিছু না।
ওয়াইনের টেস্টটা আমার কাছে মজার মনে হলো না। তবু চুমুক দিলাম জীবনে প্রথমবারের মতো। আমার অবস্থা বুঝতে পারে তারা দুইজন। ফারজানা আন্টি বললেন, পশ্চিমারা ওয়াইন দিয়ে রান্না করে। শুধু তাই নয়, ডিনারের টেবিলে ওয়াইন মাস্ট থাকবে। পরিবারের সবাই এক সঙ্গে ওয়াইন নেয়। কোন কিছু মনে করে না। তাদের জীবনধারা আমাদের মতো না। প্রতিটি মানুষের আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। আমাদের আগের ট্রাডিশনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
- আন্টি গ্রামের কথা জানি না। আমাদের দেশেও অনেক পরিবারে এখন অনেক কিছু স্বাভাবিক। শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া অনেকে জোর করে আনার চেষ্টা। কিন্তু আল্টিমেটলি কোনটাই তারা পায় না।
আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, গ্রামের মানুষগুলো এখনো কষ্টকরে জীবন চালায়। তাদের আন্তরিকতা শহরের মতো মেকি না। তোমার সঙ্গে আরও গল্প হবে। আশা করি আমার সঙ্গে কথা বলে তোমার খারাপ লাগেনি।
- না আন্টি আপনার সঙ্গে কথা বলে মজা পেয়েছি। আপনি কি আমার সব কিছু জানেন?
- সব জানি না। কিছু কিছু জানি। সব ধীরে জানবো। চলে এসো একদিন। শম্পা নিয়ে আসবে। ও আমার চেম্বার চেনে।
শম্পা মাথা নাড়লো।
আমি বললাম, আসবো আন্টি একদিন। সমস্যা নেই।
ডাক্তার আন্টি এসে আমাদেরকে ভেতরে ডেকে নিলেন। বললেন, একদিনে সব কথা শেষ করলে হবে না। আর খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে। খাবার নিয়ে নাও সবাই। আমার ড্রিংকের গ্লাস শেষ। খেয়াল করলাম শম্পা আগেরটাই শেষ করেনি। ও গ্লাসটা রেখে দিলো শেষ না করেই। ফারজানা আন্টি শেষ করেছেন। আমরা দুইজনই আরেক গ্লাস করে নিলাম। রাত বাড়তে থাকে।
খাবার শেষ করে বেরিয়ে এলাম। উবার নিলাম। প্রথমে শম্পাকে নামালাম তার বাসায়। শম্পা গাড়িতে তেমন কথা বললো না। আমার ও কথা বলার আর ম্যুড নেই। বাড়িতে এসে সোজা ছাদের ঘরে। খাবার লাগবে কিনা কালাম ভাই জানতে চাইলেন। বললাম, লাগবে না। খেয়ে এসেছি। দাদী কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কালাম ভাই বললেন, হুম। দাদী ৯টায় ঘুমিয়ে যান। এই কারণে উঠতে আমি দেরি করে আসলে সমস্যা হয় না। শুধু কালাম ভাই গম্ভীরভাবে বলেন, এভাবে দেরি করলে আমি জেগে থাকতে পারবো। সাহেবের কথা চিন্তা করে আপনাকে কিছু বলি না। আমি সব সময় হাসিমুখে বলি, কালাম ভাই আর এমন হবে না। দাদীকে কিছু বলবেন না। তিনি মন খারাপ করে বেরিয়ে যান।
আজকের রাতটা আমার কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে। অনেকগুলো বিষয় মাথায় গিজগিজ করছে। বাবার মৃত্যুর বিষয়টি আমার কাছে প্রশ্নবোধক। দাদীর কাছেও। এই কারণে দাদী প্রতিনিয়ত অতি মেজাজে থাকেন। এই মেজাজ আমার ওপর দিয়েও যায়। বাবা মায়ের ঘরে অনেক দিন প্রবেশ করা হয় না। খুব ইচ্ছা করছে তাদের ঘরে যেতে। ঘরটা আগের মতোই সাজানো আছে। দুইজনের ছবি দেয়ালে বড় করে টানানো। দাদী কোন কিছু বদল করেননি। কালাম ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে কাজের অন্য লোকজন সপ্তাহে রুমটি একবার পরিষ্কার করে। তারপর আবার তালা আটকে দেয়। এই রুমের একটি আলাদা চাবি আমার কাছে রয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে দিয়েছিলেন। একটা লকারে টাকা থাকতো। মা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাবা আমাকে দিয়েছিলেন। মা এই বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন টরেন্টো ছিলেন তানভীরের সঙ্গে। তারপর চলে আসেন ঢাকায়। এখন ঢাকাতেই বেশি থাকেন মা। যে টরন্টো যাওয়া নিয়ে এত কথা সেখানে তিনি আর যান না। কাগজ হয়েছে। তারপরও কেন যান না জানি না। ছোট মামা কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিলেন, তুই চলে যা টরেন্টো। সেখানে তোমার মায়ের কাগজপত্র আছে। তোমারও হয়ে যাবে। পড়াশোনার জন্য কানাডা ভালো। মাকে তারা পছন্দ করেন না এখন, তারপরও আমাকে কেন এই কথা বললেন বুঝতে পারছি না। তাদের ধারণা মা তাদের পারিবারিক ইমেজ সব শেষ করে দিচ্ছেন। মায়ের সঙ্গে আমার অভিমানটা কিসের বুঝি না। আজকাল নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, কিন্তু উত্তর পাই না।
সবকিছু আমার এখনো মনে আছে। আমার ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো। পারিবারিক সমস্যাগুলোর কারণে এমনিতে পড়শোনার ডিস্টার্ব ছিল। আমি ঠিকভাবে পড়ায় মন বসাতে পারছিলাম না। মা টানছেন কানাডা যেতে। বাবা বলছেন, ঢাকা ছাড়া যাবে না। দোটানায় দিশাহারা ছিলাম। দাদী আমার খোঁজ রাখতেন সারাক্ষণ। বাবার একটা পরিবর্তন খেয়াল করি মা চলে যাওয়ার পর। বাবার চেহারা বদলে গেছে। তিনি হঠাৎ করে দাড়ি রাখতে শুরু করেছেন। ধর্ম নিয়েও কথা বলেন মাঝে মাঝে। এক উঠতে আমাকে ডেকে বললেন, তোমার আর কয়টা পরীক্ষা বাকি আছে। আমি বললাম, শেষ হয়ে আসছে বাবা। খুব বেশি বাকি নেই। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এলাম। দাদীর সাথে বসে খাবার খেলাম। বাবা সকাল থেকে ঘুমাচ্ছেন। কাজের লোক কালাম ভাই জানালেন, বাবাকে যেন আমি ডেকে তুলি। তিনি ভোর থেকে ওঠছেন না। আমি বাবার ঘরে গেলাম। একবার ডাকতেই বাবা ওঠে পড়লেন। আমি বললাম, বাবা ওঠ। তোমার কি শরীর খারাপ?
বাবা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, না খারাপ না। সব ঠিক আছে। তোমার পরীক্ষা শেষ হলো?
- হ্যাঁ বাবা শেষ হয়েছে আজ। খুব ভালো হয়নি।
-আল্লাহ ভরসা। আশা করছি খুব খারাপ তুমি করবে না। তোমার ওপর আমার অনেক ভরসা।
বাবার চেহারা কেমন যেন এলোমেলো। চোখের কোনায় কালি। উস্কো চুল দাড়ি।
-বাবা তোমাকে কিন্তু বিধ্বস্ত লাগছে। অনেক বুড়ো বুড়ো লাগছে। দাড়িগুলো কেটে ফেলো।
- বাবা হাসলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, তোমার মা কি তোমাকে ফোন করে?
-মাঝে মাঝে করে।
- মায়ের ওপর অভিমান রাখবে না। আফটার অল তোমার মা কিন্তু তোমাকে অনেক ভালোবাসে। মায়ের কথা শুনবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে।
-পড়াশোনা করতে আমার একদম ভালো লাগে না। আমার কিছুই ভালো লাগে না বাবা।
-এই ছোট্ট বয়সে অনেক ঝড় যাচ্ছে তোমার ওপর। কিন্তু তাতে মন খারাপ করবে না। তুমি অনেক বড় হবে। আমি পারিনি অনেক কিছু করতে। তোমার দাদা দাদীর স্বপ্ন পূরণ করতে। আমি চাই তুমি তোমার দাদা নানাকেও ছাড়িয়ে যাও।
- আমি কি পারবো বাবা?
- অবশ্যই পারবে। তুমি না পারলে আর কেউ পারবে না। দুনিয়াতে তোমার চেয়ে মেধাবী আর কেউ নেই। তুমি অনেক দূর যাবে। মনযোগ দিয়ে কোন কিছু করলেই সাফল্য আসে। লেগে থাকতে হয়। আমি কোন কিছুতেই মন দিতে পারিনি। তুমি পারবে। পারতে হবেই। সব সময় ভুল পথে চলেছি।
বাবার সাথে এটাই আমার শেষ কথা। পরের দিন সকালে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। বাবার হাতে একটা ব্যাগ। আমার রুমে আসলেন। আমার কপালে হাত রাখলেন। বললেন, চট্টগ্রাম যাচ্ছি। তিনদিন থাকবো। তারপর ফিরে আসবো।
আমি ঘুমঘুম চোখে বিছানা থেকেই বললাম, ভালোভাবে ফিরে এসো। গিয়ে কল করবে।
-বাবা বললেন, অবশ্যই ফোন করবো। তুমি সাবধানে থাকবে।
 বাবা দরজা পর্যন্ত গেলেন। তারপর ফিরে এলেন আমার বিছানার কাছে। আমার হাত ধরে এক মিনিট বসলেন। কপালে চুমু খেলেন। আবারও বললেন, চললাম। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম অনেক বেলা পর্যন্ত। বিকেলে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা কি ফোন করেছে? দাদী বললেন, না ফোন করেনি। সেই উঠতেও বাবার ফোন আমরা পাইনি। দাদী চট্টগ্রাম ফোন করলেন, জানলেন বাবা চট্টগ্রাম যাননি। দাদী চিন্তিত হলেন।
পরের দিন সকালে বাড়ির কাজের পুরানো লোক কালাম ভাই-ও আমাকে ডাকলেন। বললেন, বাবু তোর বাবা কি ফোন করেছে? দাদী আমাকে বাবু বলেন ডাকেন ছোটবেলা থেকে। আমি বললাম, না দাদী ফোন করেননি। দাদী অস্থির হয়ে ওঠলেন। দাদী কালাম ভাইকে বললেন, ড্রাইভারকে ডাকতে। ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলেন, বাবাকে কোথায় ছেড়ে এসেছে। ড্রাইভার জানালো বিমানবন্দরে। দুপুরের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা। দাদী কালামকে বললেন, খোঁজ নাও ফ্লাইটে। আমি বললাম, আমিও খোঁজ নিতে পারি। ফ্লাইটে যাত্রীদের নাম থাকে। তালিকা দেখলেই জানা যাবে। আমি যাবো এয়ারপোর্ট?
দাদী আমার দিকে করুণ চোখে তাকালেন। তার চোখে মুখে গভীর চিন্তা। তারপর বললেন, তোমার বের হওয়ার দরকার নেই। বাসায় থাকো। কালামকে বললেন, খোঁজ নাও। ড্রাইভারকে নিয়ে কালাম ভাই বিমানবন্দরে যান। চট্টগ্রামগামী সকল ফ্লাইটে খোঁজ নেন। বিমানে বাবার নামে বুকিং ছিল। কিন্তু তিনি বোর্ডিং কার্ড নেননি। চট্টগ্রাম যাননি। কালাম ভাই বাসায় ফিরে দাদীকে সব জানালেন। দাদী আত্মীয় স্বজনদের ফোন করা শুরু করেন। তাকে দিশাহারার মতো লাগছিল। আমাদের এক ব্যারিস্টার চাচা আছেন। বাবার সম্পর্কে মামাতো ভাই। ব্যারিস্টার ইশতিয়াক হাসান। চাচা চলে আসলেন দাদীর ফোন পেয়ে। বললেন, জিডি করা জরুরি। দাদী বললেন- আমি কিছু জানি না। তোমার যা মন চায় করো। ইশতিয়াক চাচা জিডি লিখলেন। আমাকে বললেন, চলো ব্যাটা থানায় এটা দিয়ে আসি। আমি চাচার সাথে বের হলাম। এই চাচা দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম। গুলশান থানার ওসি চাচাকে অনেক সম্মান দেখালেন। বললেন, আপনি কষ্ট করে এলেন কেন? কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হতো। চাচা বললেন, নিজেই এলাম কারণ যাকে পাওয়া যাচ্ছে না তিনি আমার ভাই। তার বাবা এবং শ্বশুর দুইজনই এদেশে মন্ত্রী ছিলেন। আমার ভাইও ব্যারিস্টার ছিলেন। আমার মতো প্র্যাকটিস করতেন না। করলে আমার ভাই এদেশের এক নম্বর আইনজীবী থাকতেন। তার মতো মেধাবী মানুষ আমি দ্বিতীয়টা দেখিনি। ওসি সাহেব একজন দারোগাকে ডাকলেন। বললেন, জিডি এন্ট্রি করে এখনই ফটোকপি স্যারকে দিয়ে দাও। থানায় নাকি জিডি করতে গেলে অনেক সমস্যা। আমাদের কোনটাই হলো না। ওসির রুমে বসে সব কাজ শেষ। দারোগা একটু পর এন্টি করে ফটোকপি দিলেন চাচার হাতে।
আমরা আবার গাড়িতে এসে উঠলাম। চাচা আমার দিকে তাকালেন, বললেন বাবাজি চিন্তা করো না। চলে আসবে বাবা। আমার এই ভাইটার দায়িত্বজ্ঞান হলো না। ঘরে মা আর ছেলে রয়েছে, ওদিকে নিজে লাপাত্তা হয়ে গেছে। এটা কোন কথা হলো। চাচা আমার দিকে আবার তাকালেন, বললেন কিছু খাবে নাকি? বললাম না চাচা বাসায় চলুন। দাদী চিন্তা করবে। আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। চাচা আরও কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। বাসায় এসে দেখছি ফুফি কোরআন তেলাওয়াত করছেন। পরিবেশ কেমন যেন। মনটা এলোমেলো হয়ে গেল। বাবার কিছু হলে আমার কি হবে? আমি কোন কিছু ভাবতেই পারছি না। চুপচাপ বসে আছি। আত্মীয়স্বজনরা আমার মায়ের ওখানেও খোঁজ নেন। না কোথায়ও নেই।
সারা শহর তন্ন তন্ন করে বাবাকে খোঁজা হয়। মেডিকেল কলেজ, সকল হাসপাতাল, পুলিশ সব খানে সন্ধান করি। ফুফা বললেন, আর একদিন দেখে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন। রাত ৮টার দিকে ইশতিয়াক চাচা ফোন করেন দাদীকে। তিনি ফুফাকে খোঁজ করলেন। ফুফা ছিলেন বাথরুমে। চাচা বললেন, বাথরুম থেকে বের হয়ে মাসুদ আলমকে বলো নিচে নামতে। তাকে নিয়ে একটু বাড্ডা যেতে হবে। গুলশানের ওসি ফোন করেছে। চাচা এর চেয়ে বেশি কিছু বললেন না। গোটা বাড়িতে নীরবতা নেমে আসে। ছোট মামা খবর পেয়ে এর মাঝে আসেন। তিনিও ফুফার সাথে নিচে নামলেন। আমি ছোট মামার সঙ্গে গাড়িতে উঠতে চাইলাম। তারা আমাকে নিলেন না। বললেন, তুমি দাদীর সাথে থাকো। পরে দরকার হয় তোমাকে নিয়ে যাবো। খবর দিলে দাদীকে নিয়ে আসবে। গুলশানের ওসি একটা ক্লু দিয়েছে। আমি তখনো বুঝতে পারি না কি ক্লু দিয়েছে। এই ক্লু আমার জীবনকে কোথায় নিয়ে যাবে। ফুফা, চাচা আর ছোট মামা গেলেন বাড্ডা প্রগতি সরণিতে। এখানেই একটা হোটেলে একজন মানুষের ঝুলন্ত লাশ পুলিশ শনাক্ত করেছে। সন্ধ্যায় পুলিশকে প্রথমে খবর জানায়, হোটেল কর্তৃপক্ষ। লাশের বর্ণনা শুনে ওসি সাহেব খবর দেন চাচাকে। চাচার বাসা আমাদের কাছেই। তিনি আমাদের বাড়ি থেকে ফুফা ও ছোট মামাকে তুলে নেন। তিনজন এক সঙ্গে যান বাড্ডা প্রগতি সরণির হোটেল প্যারাগনে। হোটেলের সামনে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি। এসবির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাও এসে গেছেন। হোটেল ম্যানেজার জানায়, ফাঁসিতে ঝুলে থাকা ভদ্রলোক একদিন আগে এই হোটেলে ওঠেন। তিনি নাম ঠিকানার ঘরে আবদুল হালিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম লিখেছেন। আজ সকাল থেকে রুমের দরজা খোলেননি। সবাই ভেবেছেন ঘুমাচ্ছেন। ঢাকা শহরের অনেক মানুষ ইদানীং ঘরবাড়ি ছেড়ে হোটেলে মাঝে মাঝে ঘুমাতে যান। তারাও ভেবেছিলেন তেমন কিছু। কিন্তু বিকেলের পর বিষয়টি হোটেল বয়রা ম্যানেজারকে জানায়। ম্যানেজার তালাভেঙে দেখেন ফ্যানে লাশ ঝুলছে।
ওসি এলাহি নেওয়াজ এর মাঝে ম্যানেজার ও দুই বয়কে আটক করেছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। ব্যারিস্টার চাচা এর মাঝে লাশের রুমে চলে যান। তিনি বিস্ময় নিয়ে প্রথম দেখেন, বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটি আমার বাবা। ফুফা চিৎকার করে উঠলেন, ভাইজান এইটা কি করলেন। তাদের পেছনে পেছনে কালাম ভাইও সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনিও চিৎকার করে ওঠলেন। কিন্তু যার উদ্দেশে তাদের চিৎকার তিনি দুনিয়ার সব কিছুর বাইরে চলে গেছেন। ওসি নেওয়াজ তার সহকারীকে বললেন, লাশ শনাক্ত হয়েছে। পোস্টমর্টেম করতে হবে। কেইস তদন্ত করতে হবে। সব কিছু একটু ঝামেলার মনে হচ্ছে। হোটেল ম্যানেজার বলল, স্যার ঝামেলার কিছু নেই। উনি এসে রুম চাইলেন। আমরা রুম দিলাম। আমরা বুঝতে পারিনি তিনি এই কাজ করে বসবেন। এমন টের পেলে কি আর রুম ভাড়া দেই! মানুষটা কি করলেন! কাজটা ঠিক করলেন না।
আমি আর দাদী সব জানলাম আরও পরে। দু’টি বেসরকারী টেলিভিশনে নাকি ব্রেকিং নিউজ দিয়েছিল- বাড্ডার আবাসিক হোটেল থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার। আমরা কেউই টিভি দেখিনি। পরে শুনেছি। রাত ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে আমাকে নিয়ে গেলেন ছোট মামা। ফুফাও সঙ্গে আছেন। তারা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারা ভাবলেন আমি চিৎকার শুরু করবো। আমি ভাবলাম, বাবা চট্টগ্রাম বিমান মিস করে সড়ক পথে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে এখন মেডিকেলে। অথবা কোন কারণে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অবস্থা গুরুতর। ছোট মামার কথাবার্তা অনেকটা সেই রকমই ছিল। মেডিকেলে গিয়ে বুঝতে পারি আমার বাবা আর নেই। পোস্টমর্টেম করতে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হলো লাশ ঘরে। আমার চোখের সামনে আমার বাবা লাশ হয়ে শুয়ে আছেন। আমি চিৎকার করতে গিয়ে পারছি না। আমার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। এরমাঝে কালাম ভাই ও কিছু আত্মীয় স্বজন কান্নাকাটি করছে। বাবার দুইজন বন্ধুও এলেন। তাদের চোখেও জল। তারা আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, বাবা তুই চিন্তা করিস না। চিন্তা করিস না-না-না। শব্দগুলো ভেঙে যাচ্ছে। তাদের কথা আমি বুঝতে পারছি না। আমি ঢাকা মেডিকেলে কেনো এলাম তাও আর মনে করতে পারছি না। এই মানুষগুলো আমার চারপাশের মানুষগুলো কেবল গুনগুন করছে মনে হলো। চারদিকে নীল আলোকরশ্মি। মৌমাছি উড়ছে। মাছিগুলোকে আমার মৌমাছি মনে হচ্ছে। ভাবছি এত মৌমাছি কোথায় থেকে এলো? ইশতিয়াক চাচা আমাকে বললেন, এভাবে চুপ হয়ে থাকবে না। তোমার মনের কষ্ট কমাতে হবে বাবা। একটু চিৎকার করে কাঁদো। তোমার বুকটা হালকা করার দরকার। এভাবে তুমি চুপ করে থাকলে কষ্টে বুক ভেঙে যাবে।
আমি চাচার কথা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি কি বলছেন? আমার আবার কিসের কষ্ট? কালাম ভাই এসে বললেন, ধোয়ার কাজ কি এখানে সেরে নেবেন? চাচা বললেন, হ্যাঁ এখানেই সেরে নেবো। ভালো গাড়ি নাও। লাশ যাতে অনেকক্ষণ রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। দুপুরে নামাজের পর জানাজা হবে আজাদ মসজিদে। তারপর বনানী গোরস্তানে দাফন। সেইভাবে আত্মীয়স্বজনদের বলে দাও। একটু পর আমরা লাশের গাড়ি নিয়ে যাবো বাসায়। সেখান রাখা হবে। কালাম ভাই সবাইকে ফোন করছেন। তাদের কথাই আমি বুঝতে পারছি না। বাবার কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। আমার কাছে মনে হলো বাবা আমাদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে আছেন। একটু পর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন। বলবেন, আমি যা পারিনি তোকে তা পারতে হবে। জীবনে চলার জন্য স্পিড দরকার। আমার এই জীবনে অনেক কিছুই পারিনি। ইশতিয়াক চাচা কথা বললেন ছোট মামার সঙ্গে। বললেন, তোমার বোনকে কি খবর দেবে? মামা বললেন, না তাকে খবর কেনো দেবেন? এই মানুষটা দুনিয়াটাকে মেনে নিতে পারেননি তার কারণে। সবার কাছে তাকে শরমিন্দা করলো আমার বোন। তাকে খবর না দেয়াই ভালো।
খণ্ড খণ্ড আলাপগুলো শুনছি। সবাই আলাপ করছেন। কথা বলছেন। আমার মাথায় কিছুই আসছে না। আমি ছোট মামাকে বললাম, মামা এখানে তোমরা কতক্ষণ থাকবে?
মামা বললেন, বেশিক্ষণ না। একটু পর লাশের গোসল শেষ হবে। তারপর ঝামেলা শেষ। আমি বুঝতে পারছি না লাশের গোসল কেন হবে? আমি বললাম- মামা বাড়ি যাবো। মামা আমার দিকে তাকালেন। ড্রাইভারকে বললেন, ওকে নিয়ে বাসায় নিয়ে যাও। তার এখানে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো। বাসায় ফিরে দেখি ফুফু চিৎকার করে কাঁদছে। দাদীকে দেখলাম না। আমাদের এক আত্মীয় বললেন, তোর দাদী তার রুমে আছেন। এই মাত্র খবর পেয়েছেন। তার অবস্থা ভালো না। তুমি দাদীর সঙ্গে দেখা করলে তার রুমে যাও। ফুফুকে কাঁদতে দেখে বললাম, ফুফু তুমি কাঁদছো কেন? সমস্যা কি? বাবা চট্টগ্রাম গেছে। এই বয়সে ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করবে না। তোমার ভাই কি হারিয়ে গেছে। ফুফু আমাকে আরও জোরে ধরে বিলাপ করছেন। আমার বিরক্ত লাগছে। আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার ভীষণ শীত করছে। এখন কি মাঘ মাস? প্রশ্নটা কালাম ভাইকে করা যায়। কিন্তু কালাম ভাইকে দেখছি না। আমাদের বাড়িতে এত মানুষ কেন এই প্রশ্নও কাউকে করা হয় না। ছোট মামাকে একটা প্রশ্ন করা দরকার তাকেও দেখছি না। পরে মনে পড়লো মামাতো হাসপাতালে। বাবাকে হাসপাতালের ভর্তি করিয়েছেন মামা। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
সেই রাতে ঘুমের মাঝে আমি একটা স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্নগুলো কখনোই কাল্পনিক মনে হয় না। মনে হয় স্বপ্ন হচ্ছে, আমার বাস্তব জীবনের অংশ। বাবা আর মায়ের সাথে আমি ঘুরতে বের হয়েছি সিঙ্গাপুর। সন্তোসা আইল্যান্ডে আমরা ঘুরছি। বাবা আমাকে বললেন, দেখ এই দেশটা কত দ্রুত বদলে গেলো। শুধুমাত্র ড্রিম, ভিশন আর দক্ষতা থাকলে একটা দেশকে বদলে দেয়া সম্ভব। অথচ আইল্যান্ডের জাদুঘরটা দ্যাখো এখানে তাদের অতীত লুকিয়ে আছে। তারা অতীতকে মুছে ফেলেনি। জানান দিচ্ছে, সবার একটা অতীত থাকে। মা আমাদের দুইজনকে টেনে নিয়ে গেলেন সমুদ্রের তীর ঘেঁষে বালুচরে। ব্যাগ থেকে একটা ছাদর বের করে বিছালেন বালুকনার ওপর। আমরা তিনজন হাত ধরাধরি করে বসলাম। মা গান ধরলেন, তোরা যে বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই। বাবা বললেন, তুমি গানটা করো। রেজওয়ানার চেয়েও তোমার গলা অনেক ভরাট। অনেক সুন্দর। তুমি গানটা খামাকা ছাড়লে। মা বাবার হাত ধরলেন শক্ত করে। বাবা আমার হাত ধরলেন। আমরা তিনজন চুপচাপ বসে আছি। সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমে এলো। বাবা বললেন, আরেকটু থাকবো। আজ এত সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। মনে হচ্ছে আজ ভরা পূর্ণিমা। বাবা আমার দিকে তাকালেন, ভরা পূর্ণিমা একবার আমরা সবাই মেঘনা নদীতে যাবো। বর্ষা থাকবে। আকাশে আলো আঁধারির খেলা থাকবে। ভয় ভয় নিয়ে পূর্ণিমাতে মাছ ধরা দেখবো। আমি বললাম বাবা সত্যি নিয়ে যাবে? বাবা কথা বলেন না। আমি আবার ডাকলাম বাবা আমাকে তুমি সত্যি নিয়ে যাবে? বাবার কোন সাড়া শব্দ নেই। আমি মাকে বললাম, মা বাবা কথা বলছে না কেন? আমাকে মাত্র বললো মাছ ধরা দেখাতে নিয়ে যাবে মেঘনা নদীতে। আর এখন কোন কথা বলছে না। মা বাবার হাত ধরে টান দিলেন। বাবা পড়ে গেলেন। বাবাকে আমি আর মা ধরে রেখে কথা বলানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তার কোন সাড়া শব্দ নাই।
ছোট ফুফু আমাকে জাগিয়ে তোলেন। বললেন, এই উঠতে এত ঘুমাতে হয় না। বাবার জন্য দোয়া করতে হবে ওঠো। আমি ওঠে বসলাম। আমি বললাম, ফুফু বাবা কি এসেছে? ফুফু কাঁদতে থাকেন। তারপর বললেন, তোমার বাবা এসেছে। আসো আমরা দোয়া করবো তার জন্য। আমি ফুফুর সঙ্গে নিচে নেমে এলাম। বললাম, ফুফু আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে। ফুফু বললেন, মরা বাড়ির মানুষের অনেক ক্ষুধা লাগে। কিন্ত এখন চুলা জ্বালানো যাবে না। মরা বাড়ির চুলা তিনদিন জ্বালাতে হয় না। আমি মগবাজার থেকে চা আনিয়ে রেখেছি সবার জন্য। ঘরে পাউরুটি আছে। তোকে চা আর রুটি দিচ্ছি। নিচের বারান্দায় আমি বসলাম। বাইরে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িতে লেখা লাশবাহী গাড়ি। এই গাড়িটি এখানে কেন বুঝতে পারি না। ফুফু আমাকে চা আর রুটি খেতে দিলেন। আমি দ্রুত খেয়ে নিলাম। ফুফু আমার পাশে বসলেন। বাবু সোনা তোর বাবারে আমরা হারিয়েছি। ফুফুর কথা আমার কানে যায় না। এই মানুষগুলো বাবাকে হারিয়েছি এই কথাটা বারবার কেন বলছে বুঝতে পারি না। বাবাতো হাসপাতালে আছেন। কিন্তু আমার কানে বাজতে বাজতে থাকে- বাবু সোনা তোমার বাবাকে আমরা হারিয়েছি। তোমার বাবাকে আমরা হারিয়েছি।
বাবাকে আমরা হারাবো কেন? মানুষের বাবারা কি হারিয়ে যায়? আমি চুপচাপ বসে থাকি। মসজিদে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে-‘আছসালাতুখাইরুম মিনান নাউম’......। নিয়ন লাইটের আলাতে আমি দেখতে পাই বাগানে গন্ধরাজ ফুটেছে। বাবার প্রিয় ফুল ছিল গন্ধরাজ, শিউলি। গন্ধরাজের তীব্র গন্ধ। এই গন্ধকে আতরের গন্ধের মতো মনে হচ্ছে। আগরবাতি অথবা ধুপের গন্ধও পাচ্ছিলাম। আমার বমি বমি লাগছিল। আমি চুপ বরে বসে থাকি। ফুফু আমাকে ডাকলেন। বললেন, আমি মায়ের ঘরে গেলাম। তুমি কি একাকী এখানে বসবে না নিচে যাবে? সবাই নিচে আছে। যাও তাদের সঙ্গে গিয়ে দোয়া পড়ো। আমি কথা বলি না। আমার নিচে যেতে ইচ্ছা করছে না। এখানেই একাকী বসে থাকতে ভালো লাগছে। আমার মনে হচ্ছে, আমি একা নই। বাবা আছেন পাশে। আমি দেখতে পাচ্ছি। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। বলছেন, বাবু তুমি একা বসে আছো কেন? আমার ছেলের এত সাহস! বড় হয়ে গেছো। বড় ছেলেদের সাহস থাকতে হয়। আমি অনুভব করি বাবার শরীরের গন্ধ। খুব ছোটবেলায় বাবার শরীরে নাক ঘষতাম। একটা মায়াবি গন্ধ আমাকে টানতো। বাবার শরীরে গন্ধ নিতাম। মা হাসতেন। বললেন, সারাদিন বাবাকে জ্বালানো। ছেলেদের এত ঢং করতে হয় না। আমার ছেলে রাজা হবে। তার থাকবে অনেক সাহস। যুদ্ধ করার সাহস।
আজ শুক্রবার। বাবার ঘরে গেলাম আমি। এই ঘরে অনেক দিন প্রবেশ করা হয় না। কালাম ভাই জানিয়েছেন, দাদী পীর বাড়িতে গেছেন। বাবার চলে যাওয়ার পর থেকে দাদী আজকাল পীর বাড়ি যান। বাবা মায়ের ঘরটি আগের মতোই আছে। সেই খাট, সেই ড্রেসিং টেবিল সবকিছু। আমি আলমারি খুললাম। মায়ের শাড়িগুলো সাজানো। আরেক পাশে বাবার কাপড়। বাবার টি-শার্ট বের করলাম। গায়ে জড়ালাম। সেই গন্ধ পাচ্ছি। ঠিক ছোটবেলার মতো। ভাবছি এটা পরে যাবো ফারজানা আন্টির ওখানে। আমার কথাগুলো সব বলবো তাকে। শম্পাকে ফোন করলাম। বললাম, শম্পা আমি বদলে যেতে চাই। বাবা যেমন চেয়েছিলেন তেমন। মাকে নিয়ে আসতে চাই। ফারজানা আন্টির কাছে মাকে নিয়ে যেতে চাই। আন্টি কি কোন সহায়তা করতে পারবে মাকে? শম্পা বললো, চল এক সঙ্গে আন্টির কাছে যাবো। তারপর তাকে আমরা নিয়ে যাবো ফারজানা আন্টির কাছে। দেখি না কি হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status