ঈদ আনন্দ ২০১৮

ভ্রমণ

দুই দিগন্ত

রেজাউল করিম

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৭:০৩ পূর্বাহ্ন

ব্যক্তিগতভাবে নিজের চিকিৎসার জন্য বেশ অনেকবার ভারত ছুটে যেতে হয়েছে। এটাকে নিছক বেড়াতে যাওয়া বললে ভুল হবে। রথ দেখা ও কলা বেচা- বাংলায় এই প্রবাদটির মোক্ষম ব্যবহার করার চেষ্টা ভেতরে সবসময়ই থাকে। তাই নিজের কিডনি জটিলতায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যাওয়ার সুবাদে এদিক-ওদিক মন ভুলাতে বেড়িয়েছি। তবে এই ক্ষুদ্র লেখায় দুটি দেশ যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোকপাত করবো। আর এই দেশগুলো নিজের নানান তাগিদ থাকায় দেখার সুযোগ হয়েছে। একটি দক্ষিণ কোরিয়া আর অন্যটি সিঙ্গাপুর।
দুই প্রান্তের এই দুটি দেশ নানাভাবে আলোচিত। উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়া দুনিয়াজুড়ে আলোচনায় বিভেদ আর অনৈক্য নিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে বেশি আলোচিত দক্ষিণ কোরিয়া। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর আমাদের কাছে অনেকটাই স্বপ্নের মতো। এই দেশটির উন্নয়ন আর জীবনমানের শৃঙ্খলা সত্যিই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য শিক্ষণীয়। কি করে কাদা মাটির একটি দ্বীপ লি কুয়ান নিয়ে গেছেন পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে। এটিকে সত্যিই বিস্ময়কর। যারা সিঙ্গাপুর না গেছেন তাদের শুধু বলে বা ব্যাখ্যা করে বুঝানো সম্ভব নয়। একটি ছোট দ্বীপ কিভাবে দুনিয়ার বুকে গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে দুবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। পর পর দুবছর একেবারে নিকট সময়ে। ২০১৪ আর ২০১৫ সালে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট এই দ্বীপটি বাণিজ্যিক মেরুকরণে এটি বিশ্বের মধ্যে অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মাত্র ৫২ বছরের ব্যবধানে এই নগরী এখন আধুনিকতার আইকন। ৯ই আগস্ট ১৯৬৫ সালে প্রতিবেশী মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই এই দ্বীপকে একটু একটু করে নিজ হাতে গড়ে তোলেন লি কুয়ান। ৭১৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সিঙ্গাপুরের পুরোটাই পর্যটন দেশ। সিঙ্গাপুরে দুবারের ভ্রমণে এই শহরের নান্দনিকতা আর আভিজাত্যকে উপভোগের সুযোগ হয়েছে। সমুদ্র তীরে ঘুরে বেড়ানো ছাড়াও এখানকার পার্ক সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এশিয়ান সিভিলাইজেশন মিউজিয়ামের কথা না বললেই নয়। যেখানে সভ্যতার নানান পারদ সংরক্ষণ করা আছে। টাইম মেশিন আপনাকে মুহূর্তেই নিয়ে যাবে ইতিহাসের নানান বাঁকে। আর শহরের পরিচ্ছন্নতার কথা ভাষায় বলে শেষ করা যাবে না। এর ট্রাফিক ব্যবস্থা যেকোনো শহরের কাছে কল্পনার মতেই মনে হবে। সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবন দেখার সুযোগ হয়েছে। যদিও শ্রমিক জীবন খুব একটা সুখের নয়। এক মানবতের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে কাটে শ্রমিকদের জীবন। সেখানে গড়ে শ্রমিকরা চার ঘণ্টার বেশি বিশ্রামের সুযোগ পান না। আমাদের এখান থেকে কম টাকায় শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়া হয় কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে। তারা যেখানে বাস করে সেখান থেকে কাজের জায়গা অনেক দূরত্বে। ফলে কোম্পানির বাস চলে আসে এই শ্রমিকদের নিয়ে যেতে ভোর চারটায়। আবার কাজ শেষে তাদের ফিরতে রাত এগারোটা-বারোটা বেজে যায়। খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম। তিন-চার ঘণ্টা ঘুম শেষে ফের প্রস্তুতি নিতে হয় কাজের। এটাই জীবন। আহারে শ্রমিক জীবন! খুব কষ্ট করে এরাই রেমিটেন্স পাঠায় দেশের জন্য, পরিবারের জন্য।  
দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ২০১৬ সালের মে মাসে। এই যাত্রায় বাসেদ সরকার ছিলেন আমার সঙ্গী। সাধারণত দক্ষিণের এই দেশটিকে সকলেই যেভাবে ট্রাভেল ভিসা নিয়ে কাজে যোগ দেয়। আমার তা করতে হয়নি। বন্ধু বাসেদ সরকার ব্যবসায়ী বলে এটা আমার জন্য সত্যিকার একটি ভ্রমণের সুযোগ ছিল। যেখানে খুব কাছ থেকে আমি বেশকিছু কারখানা আর বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবন দেখার সুযোগ পেয়েছি। উইকিপিডিয়ার বরাতে জানতে পারি দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে নানান তথ্য।
দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ যা কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশটি নিয়ে গঠিত। এর সরকারি নাম কোরীয় প্রজাতন্ত্র। সিউল হচ্ছে দক্ষিণ  কোরিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়ার সময় জাপানিরা সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়ত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার ফলে অবিভক্ত কোরিয়া ২ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালে সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে চলে যায়, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদী আমেরিকার মতাদর্শে এর পুঁজিবাদী ব্লকে যোগদান করে।
পুঁজিবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এই দেশটিতে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করেন বিভিন্ন কোম্পানিতে। সরজমিন বেশকিছু কোম্পানি দেখার সুযোগ হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। কথা হয়েছে বেশকিছু বাঙালি শ্রমিকের সঙ্গেও। ২০১৬ সালের ২০শে মে ইনসোন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৌঁছালাম। তারপর থেকেই নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো। তার কিছুটা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।

আমি কোরিয়ায় একটা কারখানায় গেলাম-কারখানাটিতে গাড়ির যন্ত্রপাতি তৈয়ার করা হয়, অ্যালুমিনিয়াম হলো প্রধান কাঁচামাল- এসব বুঝতে হলে পদার্থ বিজ্ঞানে অথবা বিজ্ঞানের অন্য বিষয়ে ধারণা থাকতে হয় আমার তার কিছু নেই, থাকার সুযোগ কোনো দিন পাইনি। আমার প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল শ্রমিকের জীবন ও তার কাজ। আমি একরাত শ্রমিকদের সঙ্গে থাকলাম- যে শ্রমিকরা কাজ করেন তারা বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, কোরিয়ান বা অন্যান্য দেশের। কারখানায় বাংলাদেশের প্রায় সাতজন কাজ করেন- তাদের সঙ্গে মজুরি নিয়ে আলাপ করলাম- সেখানে মজুরি হয় ঘণ্টা হিসেবে যাদের সঙ্গে কথা বললাম তার কাজ করেন ঘণ্টায় ৫০০ টাকার মতো। ৫টার পর অতিরিক্ত মজুরি প্রদান করা হয়- কোরিয়ায় রোববার ছুটি-কাজ করলে দ্বিগুণ মজুরি-তবে বেশির ভাগ সময় ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। কারখানার মালিক মজুরি বাদে খাওয়ার পয়সা আলাদা দেয়-বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। শ্রমিকরা খাবারে যে পয়সা পান তা দিয়ে তারা প্রতিদিন খাবার পর কিছু জমা রাখার চেষ্টা করেন। একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো কোরিয়ান শ্রমিক, বিদেশি বৈধ শ্রমিক বা অবৈধ শ্রমিকের মজুরির বিষয়ে কোনো কম বেশি নেই। যারা বৈধ শ্রমিক তাদের চিকিৎসা মালিক ব্যবস্থা করেন-অবৈধদের নিজেদের করতে হয়, মালিক সহযোগিতা করেন-তবে হাসপাতালে কোন ঝামেলা হয় না।
আমি যে শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললাম- তার কাছে জানতে চাইলাম কোরিয়ায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন হয় কিনা। সে বললো, সেটার প্রয়োজন হয়নি-বেসিক অনুপাতে মজুরি নিয়মিত বৃদ্ধি পায়। সঠিক বিষয়টি জানা সম্ভব হয়নি। আরও একটা বিষয় হলো কোনো শ্রমিক যদি নতুন কাজে যায় রাষ্ট্র কর্তৃক ন্যূনতম মজুরি সে পাবে। তবে কোনো কোনো জায়গায় কোরিয়ান শ্রমিকের চেয়ে বাইরের শ্রমিকের বেতন কম। যারা কাজ করেন তারা প্রত্যেকে খুশি-তারা ভালো মজুরি পায়- কিন্তু আসলে কি তারা ভালো মজুরি পায়? আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক ৮ ঘণ্টা বা তার কম কাজ করবে- সেখানে ১২-১৪ ঘণ্টা। এসবের ব্যাখ্যা কে দেবে ধনীদের সংগঠন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন- যিনি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন?
আমরা প্রথম রাতের খাবার খেলাম গঙ্গা নামের একটি রেস্টুরেন্টে, যেখানে ৬টা রুটি ও এক বাটি ডাল ২৫০০ টাকা! বাস, ট্রেন ভাড়া প্রচুর-সে রকম দেশে একজন শ্রমিক ১ দিন কাজ ছাড়া চলতে পারে না। কোরিয়ায় চাষের জমি কম, যতটুকু চাষ হয় তা গ্রিন হাউজ প্রক্রিয়া এবং আধুনিকভাবে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় মালিকরা শ্রমিকের থাকার ব্যবস্থা করেন কোয়ার্টার-ডরমেটরি অথবা কারখানার সঙ্গে। অন্য স্থান কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত আমার জানা নেই। তবে আমি যে কারখানায় শ্রমিকদের সঙ্গে ছিলাম, তাদের আবাসন উন্নতমানের বলা যাবে না- স্যাঁতসেঁতে ফ্লোর, বদ্ধঘর। অবশ্য শীতপ্রধান দেশ, তাপমাত্রা ২০ পর্যন্ত থাকে। তবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর আরও কঠিন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status