ঈদ আনন্দ ২০১৮

ভ্রমণ

যেথায় নদী-পাহাড় সবুজের মিতালী

মিনহাজ উদ্দিন

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৭:০১ পূর্বাহ্ন

দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশখ্যাত ওলিকুল শিরোমণি হয়রত শাহজালাল ইয়ামনি (রহ.) ও হযরত শাহপরান ইয়ামনি (রহ.) স্মৃতি বিজড়িত পুণ্যভূমি  সিলেটের আনাচে কানাচে রয়েছে অগণিত পর্যটন স্পট। জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট, লালাখাল, ফাটাছড়া, পান্তুমাই মায়াবতি ঝর্ণা, পাহাড়টিলাময় মালনিছড়া চা বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রভাত, চায়ের রানী শ্রীমঙ্গলের অবস্থানও সিলেট বিভাগে। সিলেট বিভাগের এসব পর্যটন স্পটে বছরজুড়েই ঢল নামে লাখ লাখ ভ্রমণ পিয়াসী পর্যটক দর্শণার্থীর। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের অপার ভাণ্ডার সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোকে স্রষ্টা যেন আপন হাতে সাজিয়েছেন।
নজর কাড়া, স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশে শোভিত এখানাকার সবকটি পর্যটন স্পট। প্রকৃতির নান্দনিকতার অপরুপ সাজে শোভা পাচ্ছে প্রতিটি স্থান। পাহাড়, টিলা, গাছপালা, নদী, পাখির গান, নদীর কলতান প্রকৃতির চির সবুজ রূপ লাবণ্যতার মাঝে জড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি পর্যটন স্পট। দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের ভিড়ে সারা বছরই প্রতিটি স্পটই থাকে লোকে লোকারণ্যময়। দেশের সবকটি জেলা, শহরের মানুষের পাশাপাশি এসব পর্যটন স্পটগুলোতে দেশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। দেশের নাম করা যেকটি পিকনিক স্পট রয়েছে তার সিংহভাগই স্থান করে নিয়েছে সিলেটে। সিলেটের এসব পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের মনের ক্লান্তি অবসাদ মেটানোর তীর্থস্থানও। এখানে এসে ইট পাথর, কংক্রিটের সঙ্গে আবদ্ধ মানুষগুলো পায় প্রকৃতির সতেজতা। নুড়ি পাথরের সঙ্গে স্বচ্ছ জলরাশির আলিঙ্গনে গা ভাষায় ক্লান্ত অবসাদের ঘেরাটেপে আবদ্ধ মানুষ। ডিঙ্গি নৌকায় প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে বনের গহিন অরণ্যে হারিয়ে যেতে থাকে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ। আগন্তকরা ঝর্ণার বেয়ে আসা জলেও গা হেলান দিয়ে মেতে ওঠে আনন্দের খানিক সময়। আর এসব পর্যটনস্পট সমূহের বেশির ভাগেরই অবস্থান সিলেটের  গোয়াইনঘাট উপজেলায়। দেশের মানচিত্রের পরিসংখ্যানুসারেই এখানেই রয়েছে জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, ফাটছড়া ঝর্ণাধারা, পান্তুমাই মায়াবতি ঝর্ণা, মাচাং ঘর আর পান সুপারির সারি সারি বাগানের আদিবাসী খাসিয়া পল্লী (পুঞ্জি), বাংলাদেশের একমাত্র সমতল জাফলং চা বাগানের অবস্থান। পাশের উপজেলা জৈন্তাপুরেই রয়েছে, লালাখাল চা বাগান, পাহাড়টিলাময় গুয়াবাড়ি, শ্রীপুর, সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র, উৎলারপাড়সহ নানা দৃষ্টিনন্দন স্পট। হাওরজুড়ে রয়েছে সবুজে আবহ। এসব স্পট ঘুরে আসতে চোখে পড়ে ওপারে ভারতের মেঘালয়ের জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা সারি সারি গাছপালা আর বনজঙ্গল বেষ্টিত সবুজ উচু পাহাড়ের দীর্ঘকায় বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। আছে নদী। আছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ন্যায় পাহাড় বেয়ে আসা ওখানকার ঝর্ণার গড়িয়ে পড়া পানির মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী। সময় নিয়ে বেড়াতে আসলে  বিভাগীয় শহর সিলেট থেকে সহজেই এসব পর্যটন স্পট ঘুরে আসা যায় অনায়াসেই। দীর্ঘদিন থেকে  মেরামত, সংস্কারহীন সড়ক যোগাযোগে ভোগান্তির কারণে এসব পর্যটন স্পটে আসা পর্যটক দর্শনার্থীদের দুর্ভোগ যন্ত্রণাও ভোগ করতে হচ্ছে।
জাফলং: বিভাগীয় শহর সিলেট থেকে ৬৫ কি.মি দূরবর্তী স্থানে বিধাতার আপন হাতের ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছে দেশের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান জাফলং। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান জাফলংয়ের। দিগন্তজোড়া  মেঘালয়ের চির সবুজ সারি সারি গাছপালা বেষ্টিত পাহাড়, আকাশের মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের আলিঙ্গন, ভারতের ওমঘট নদীর উপর স্থাপিত ঝুলন্ত ব্রিজ, পিয়াইনের বুক চিরে বহমান স্বচ্ছ নিলাভ জলারাশি আর নুড় পাথরের কলতানে ডিঙ্গি নৌকায় করে ভেসে বেড়ায় পর্যটকরা। জাফলং জিরো পয়েন্টে রয়েছে বিশালাকারের পাথর স্তূপ। দিনভর ঘোরাঘুরি ফটোসেশন চলে এখানে। প্রকৃতির কাছে এসে চাঞ্চল্যতা ভরে ওঠে আগন্তকের হৃদয়। সাঁতার কাটেন তারা পিয়াইনের স্বচ্ছ জলে। মুষ্টি ভরে নিজ হাতে তুলে আনে নুড়ি পাথর বালি। এখানে বেড়াতে এসে সারা দিনই হই হুল্লোড়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন পর্যটক, দর্শনার্থীরা। সবুজ শ্যামল দিগন্তজোড়া পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের আলিঙ্গনসহ মনোমুগ্ধকর নানা দৃশ্য নজর কারে পর্যটক দর্শনার্থীদের। এখানকার
সবুজের বেষ্টনিতে গড়ে ওঠা ওপারে মেঘালয়ের পাহাড়ের গায়ে সারি সারি গাছপালা আর জুমচাষের দিকে তাকালে ভ্রমণের তৃষ্ণায় ভরে ওঠে মন। বিধাতার সুনিপুণ হাতে প্রাকৃতিকভাবে সবুজের সমারোহে গড়ে ওঠা পাহাড় টিলা, নদী, সবুজ প্রকৃতি, বিস্তৃত হয়ে জড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের একমাত্র সমতল চা বাগানের সবুজ সতেজতা, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খাসিয়াদের জুমচাষ পদ্ধতি, পুঞ্জিগুলোতে সারি সারি মাচাং বাড়িঘর জীবনযাত্রা। এখানে আসলে চোখে পড়ে ফাটাছড়া ঝর্ণার বেয়ে পড়া জলারাশির অপরূপ মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী। জাফলংয়ে বনবিভাগের সবুজ গ্রিনপার্কও পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর একটি মনোরম স্থান। ক্লান্ত অবসাদাচ্ছন্ন হৃদয়ে আসা পর্যটক দর্শনার্থীরা এখানে এসে বিমুগ্ধ হন প্রকৃতির অমিয় বন্ধনে। সবুজের সতেজতায় ভরে ওঠে তার ভ্রমণপর্ব, বিমুগ্ধ হয় ভ্রমণে আগন্তকের মনোবাসনা। এখানে আসলে মনে হয় যেন দিগন্ত এসে মিশে গেছে পাহাড়ের গায়। ঈদ, পূজা পার্বণসহ সবকটি জাতীয় দিবসে এখানে ঢল নামে পর্যটক দর্শনার্থীর। ২০০৮ সালে সরকারি সফরে প্রকৃতির এ মনোমুগ্ধকর স্থানে ঘুরতে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী একান্ত সাক্ষাৎকারে মানবজমিনকে বলেছিলেন, একবার আমরা উগান্ডা গিয়েছিলাম, সেখানে গড়ে ওঠা source Of the nine এর অনেক স্পটই আমরা ঘুরে দেখেছিলাম। কিন্তু সেই সৌন্দর্য্যও আমার কাছে জাফলংয়ের ধারে কাছে আছে বলে মনে হয় না। জাফলংয়ের সৌন্দর্য্যের কাছে মনে হয়েছে source Of the nine is nothing ।
এই জাফলংকে বলা হয়ে থাকে সৌন্দর্য্যের রানী, বলা হয় সিলেটের প্রকৃতি কন্যাও। এতদ সত্ত্বেও জাফলংয়ে সরকারিভাবে পর্যটনের জন্য তেমন কোনো অবকাঠামো কিংবা পর্যটন সম্ভাবনাময় উল্ল্যেখযোগ্য কিছুই গড়ে উঠছে না। যা আছে তা নামে মাত্র, অপ্রতুল।
ফাটছড়া ও পান্তুমাই মায়াবতী ঝর্ণা: সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং জিরো পয়েন্টের অদূরে অবস্থিত ফাটাছড়া ঝর্ণার অবস্থান। ভারতের মেঘালয়ের ডাউকীর অদূরে ওমসিম, গ্রীপ, কংওয়াংসহ আশপাশের খাসিয়াদের গ্রাম হয়ে প্রমত্তা পিয়ানের বুকে পড়ে ফাটছড়া ঝর্ণার পানি। সুদীর্ঘকাল থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠী খাসিয়ারা এ ঝর্ণাকে ফাটাছড়া ডেকে আসলেও সাম্প্রতিককালে এটাকে মায়া ঝর্ণাও বলছেন কেউ কেউ। ফাটাছড়া ঝর্ণা জাফলংয়ের অন্যতম সম্ভাবনাময় স্থান। প্রতিনিয়তই বাড়ছে এখানকার পর্যটক দর্শনার্থী সংখ্যা। বিশেষ করে বর্ষাকালে উক্ত ঝর্ণার রুপ লাবণ্যতাকে উপভোগ করতে ঢল নামে পর্যটকদের। অপর দিকে ভারতের মেঘালয়েরই আরেকটি ভারতীয় ঝর্ণা রয়েছে পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের পান্তুমাই গ্রামের অদূরে। জাফলং থেকে ৬ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত এ ঝর্ণার নাম পান্তুমাই মায়াবতি ঝর্ণা। জাফলং বেড়াতে এলে এখানেও সিএনজি
, মাইক্রো, মোটরসাইকেলে করে ঝর্ণার মায়াবী বারিধারা উপলব্ধি করেন পর্যটকরা।
যেভাবে জাফলং যাবেন: প্রকৃতিকন্যা জাফলং যেতে হলে দেশের যেকোনো স্থান থেকে আপনি প্রথমেই আপনাকে বিভাগীয় শহর সিলেটে আসতে হবে। ঢাকা থেকে সিলেটের সঙ্গে বাস, ট্রেন, বিমান যোগাযোগ আছে। সিলেটের কদমতলিস্থ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি জাফলংগামী বাস সার্ভিস আছে। গেটলক, বিরতি বাসে করে দুই থেকে তিন ঘণ্টায় জাফলং যেতে পারেন অনায়াসে। এ ছাড়াও মাইক্রো ভাড়া করে কিংবা সিএনজিতে করেও জাফলং যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে আহমদ পরিবহন ও টাঙ্গাইল থেকে এপোলো পরিবহন, শাহাজালাল পরিবহন, নেত্রকোনা থেকে জালালাবাদ নামের জাফলংগামী সরাসরি বাস সার্ভিসও রয়েছে।
যেখানে থাকবেন: জাফলংয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য সরকারি,  বেসরকারিভাবে ভালো মানের সেরকম কোনো হোটেল, মোটলে, রিসোর্ট গড়ে ওঠেনি। জাফলংয়ে সরকারিভাবে জেলা পরিষদ কর্তৃক বল্লাঘাট পিকনিক সেন্টারে একটি দ্বিতল বাংলো, নলজুরিতে একটি দ্বিতল বাংলো, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃক গুচ্ছগ্রামে একটি ছোট পরিসরের পর্যটন মোটেল স্থাপিত হয়েছে। একই এলাকায় জাফলংয়ে বনবিভাগের একটি আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর গ্রিনপার্ক গড়ে ওঠেছে। এ ছাড়া সোনাটিলায় সড়ক ও জনপথের একটি পরিদর্শন বাংলো রয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে স্থানীয় মামার বাজার, বল্লাঘাট, সোনাটিলা এলাকায় বেশকটা রিসোর্ট, আবাসিক হোটেল রয়েছে। তার মধ্যে মামার বাজারের হোটেল পর্যটন, হোটেল প্যারিস, হোটেল গার্ডেন, হোটেল হিলভিউ, বল্লাঘাটে হোটেল শাহ আমিন, সোনাটিলায় রয়েছে মেঘমালা নামের একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন রিসোর্ট। এসব সরকারি বেসরকারি হোটেল, মোটেল রিসোটেই পর্যটকরা অবস্থান করেন যা জাফলং বেড়াতে আসা পর্যটক, দর্শনার্থীর প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খাবারের জন্য জাফলংয়ে রয়েছে সোনাটিলায় জাফলংভিউ, মেঘমালা, মামার বাজারে হোটেল ঢাকা বিক্রমপুর, দিরাই মনি, নাজিয়া রেস্টুরেন্ট, হোটেল তাজ মহল, বল্লাঘাটে জাফলং পিকনিক সেন্টার রেস্টুরেন্ট, ক্ষুধা রেস্টুরেন্ট, ঢাকা নারায়নগঞ্জ হোটেল, নরসিংদী রেস্টুরেন্ট, কুমিল্লা রেস্টুরেন্ট জাফলং বাজারে সাব্বির রেস্টুরেন্টসহ বেশকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এসব হোটেল রেস্টুরেন্টসমূহ আগত পর্যটক দর্শনার্থীদের খাবারের চাহিদা মেটানোর একমাত্র ভরসা। ঈদ, পূজা বিভিন্ন সরকারি ছুটির ফাঁকে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীর কারণে জাফলং আসার আগেই বুকিং হয়ে যায় স্থাপনাসমূহ। ফলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় সিলেট শহরেই রাত যাপন করে থাকেন সিংহভাগ পর্যটক। পর্যটন খাতে জাফলংয়ে সরকারিভাবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রকল্প গ্রহণ করে তাতে বিনিয়োগ করে এখাত থেকে বছরে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা থাকলেও সরকারের তরফে তা এখনো কার্যকর হচ্ছে না।
বিছনাকান্দি: নৈসর্গিক  সৌন্দর্য্যের আরো এক নিদর্শন সিলেটের গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি। এখানেও স্রষ্টা প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন আপন মহিমায়। পাহাড়, টিলা আর সবুজের গহিনতা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আগন্তকদের। এখানেও আছে পিয়াইনের স্বচ্ছ জলারাশি, আছে ছোট বড় নুড়ি পাথর ভাণ্ডার। দেশের সবকটি পিকনিক স্পটের মধ্যে হৈ চৈ ফেলে দেয়া পর্যটনের ক্ষেত্রে হালের সেনসেশন বলা চলে পর্যটন স্পট বিছনাকান্দিকে। দিগন্তজোড়া পাহাড়, নদী আর সারি সারি বন তরুণ উঠতি বয়সের পাশাপাশি সব বয়সের মানুষের অন্যতম প্রিয় হয়ে ওঠেছে বিছনাকান্দি পিকনিক স্পট। গোয়াইনঘাট উপজেলার ১নং রুস্তমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত প্রকৃতির এই নব দিগন্তের অবস্থান। দুঃসাধ্য কষ্ট আর যন্ত্রণাময় যাতায়াত ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও পর্যটন স্পট বিছনাকান্দিতে প্রতিদিনই ঢল নামছে হাজার হাজার পর্যটক দর্শনার্থীর। বিভাগীয় শহর সিলেট থেকে উত্তর পূর্বাংশের ৬৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত বিছনাকান্দি পর্যটন স্পট। এখানে আসা পর্যটকরা দিনভর ব্যতিব্যস্ত থাকেন সবুজের সঙ্গে। পিয়াইনের বুকে অবাধ সাঁতার আর জলকেলিতে মেতে ওঠেন সবাই মনের অবসাদ মিটাতে। ফটোসেশন, ভিডিও আর সেলফিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন তরুণরা। প্রকৃতির সঙ্গে ছবি সেলফিতে স্মৃতিরোমন্থন করেই বাড়ি ফেরেন তারা। জাফলংয়ের মতো সৌন্দর্য্য আর প্রকৃতির লাজুকতায় ভরপুর বিছনাকান্দির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পর্যটকদের যাতায়াত বিড়ম্বনা আর ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক পথ আর বর্ষায় নৌকায় যাতায়াত করতে হয় এখানে। তবে, সড়ক পথের অবস্থা চরম দুর্ভোগ ভোগান্তিময়। পর্যটকদের থাকার জন্য সরকারি, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনো মানসম্মত হোটেল- মোটেল, রিসোর্ট গড়ে ওঠেনি। খাওয়া দাওয়া কিংবা পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাও একেবারেই নাজুক।

যেভাবে যাবেন: সিলেট শহর থেকে বিছনাকান্দির দূরত্ব ৩৬ কি.মি.। সিলেট থেকে আপনাকে  বিছনাকান্দিতে আসতে হলে আপনি সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সিলেট-সালুটিকর- গোয়াইনঘাট সড়ক হয়ে সরাসরি সিএনজি অথবা মাইক্রোযোগে হাদারপার আসতে হবে। সেখান থেকে ৪ কি. মি. দূরবর্তী উত্তর দিকে বিছনাকান্দিতে যেতে হলে আপনাকে ইঞ্জিন নৌকা কিংবা হেঁটেই আসতে পারেন। হাদারপার থেকে ইঞ্জিন নৌকাযোগে বিছনাকান্দিতে যেতে হলে ৬০০-৭০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
সরজমিন শুক্রবার বিছনাকন্দিতে গেলে ঢাকা ও রাজশাহীর বেশ ক’জন পর্যটক জানান, বিছনাকান্দির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সত্যি মনোরম, পাহাড়টিলা, নদী, স্বচ্ছ জলারাশি। দিগন্তজোড়া পাহাড়ের সবুজ শ্যামলিমার এ নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্রকে সরকারিভাবে পরিকল্পনা নিয়ে সাজাতে পারলে সরকার এখান থেকে বছরে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। হাদাপার বাজারে এখানকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন শিহাব জানান, বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটে প্রতিনিয়তই ঢল নামছে পর্যটক দর্শনার্থীর। বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাও বাড়ছে। তিনি জানান, সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখানে পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তুলে বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব। তিনি জানান, স্থানীয় আনফরের ভাঙ্গায় একটি ব্রিজ ও হাদারপার থেকে বিছনাকান্দি পর্যন্ত সড়কটি পাকাকরণ করলে মাত্র পাঁচ মিনিটে বিছনকান্দি পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়া যাবে। পর্যটক দর্শনার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে এ বিষয়ে দ্রুত সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট: নিস্তব্ধ অরণ্যঘেরা গহিন বন সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট। হিজল, করচ, বনজাম, মুর্তা, জালিবেতসহ বনজ লতানো সারি সারি হাজার হাজার গাছপালা। গহিন এ বনে রয়েছে গাছে গাছে পাক পাখালি গাছালির বাসা। বানর, কাটবিড়ালী, বিষধর নানা জাতের সাপ, বিচ্ছুর নিরাপদ অবাসস্থল এই বনভূমি। এখানকার করচ হিজল গাছের উচু ডালে চোখে পড়ে অগণিত মৌ-চাক।   ভাণ্ডারখ্যাত এ সংরক্ষিত বনকে রাতারগুল জলারবনও বলা হয়। এখানে রয়েছে মিঠা পানির মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম। শীতকালে এখানে আগমন ঘটে হাজার হাজার অতিথি পাখির। রাতারগুলই দেশের মিঠা পানির এক মাত্র সোয়াম ফরেস্ট। সিলেট বনবিভাগের আওতাধীন সারি রেঞ্জের তিন হাজার একরের বেশির বনভূমির মধ্যে  ৫০৪ একর বনাঞ্চলকে বিশেষ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। গহিন এ বনের ভেতরে ঢুকলে প্রকৃতি আর সবুজের সজীবতায় মিশে যায় মানুষের হৃদয়।  রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টের জীববৈচিত্র্য দেখতে প্রতিদিন ঢল নামে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক-দর্শনার্থীদের। কাক ডাকা ভোর হতে ছোট ছোট নৌকায় করে সারাদিন পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান এ বন দেখতে আসা প্রকৃতি প্রেমীরা। তাদের কোলাহলে রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট মুখরিত থাকে সারাদিন। উচু থেকে সৌন্দর্য্য অবলোকনে এখানে বনবিভাগের তরফে একটি ওয়াচ টাওয়ার স্থাপিত হয়েছে। এই ওয়াচ টাওয়ারের উপরে ওঠে দূরবীক্ষণ যন্ত্র, খালি চোখেও সবুজ ঘন এ বনের অপরূপ সৌন্দর্য্য অবলোকন করেন আগন্তক পর্যটক দর্শনার্থীরা। ছোট ছোট  নৌকায় করে রাতারগুলে ঘুরে বেড়ানো আর সবুজের সঙ্গে একাকার হয়ে স্মৃতিরোমন্থন করেন ক্যামেরায়। স্মার্টফোনের ছবি, সেলফিতে  তোলা আপলোড করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ নানা সাইটে। বনাঞ্চলে অবস্থানরত জীববৈচিত্র্য পরিবেশ নষ্ট না করে এ বন ঘুরে দেখতে প্রশাসন, বনবিভাগের দায়সারা কড়াকড়ি থাকলেও আগন্তকদের চিৎকার চেচামেচি থাকে সব সময়। উচুস্বরে মাইক, সাউন্ড বক্সের অবাধ অনুপ্রবেশ, প্যাকেটজাত খাবারের কার্টন, প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনে নষ্ট করা হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ। রাতারগুল সোয়াম বিশেষ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষিত এলাকার স্থানীয় কমিটির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহজান সিদ্দীকি বলেন, জীব বৈচিত্র্য সুরক্ষা আর স্থানীয়দের জীবন জীবিকাসহ এখানকার পরিবেশ ও বনরক্ষায় স্থানীয়রাসহ সবাইকে আরো সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। দেশের একমাত্র এ জলারবন রক্ষায় স্থানীয় এলাকাবাসীর ভূমি সমস্যা, কৃষি আবাদে তাদের বনবিভাগের তরফে পরামর্শসহ সহযোগিতা দান, বনবিভাগের লোকবল সংকটসহ বিদ্যমান সব সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
যেভাবে যাবেন: রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টটি সিলেটের গোয়াইনঘাটের সর্ব দক্ষিণে ৬নং ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। সিলেট শহর থেকে রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টের দূরত্ব মাত্র ১১ কি.মি.। সিলেটের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল কদমতলি, সোবহানীঘাট থেকে বাসে করে হরিপুর হয়ে, কিংবা ভাড়া করা মাইক্রো, সিএনজিতে হরিপুর এসে সিএনজিতে ফতেহপুর সড়ক হয়ে যেতে পারেন রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টে। আবার শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজি, মাইক্রো ভাড়া করে যেতে পারেন রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টে। রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টে প্রবেশে রাতারগুল ও মহেষখেড় ঘাট ব্যবহার করতে পারেন। নিরাপদ আরামদায়ক ভ্রমণে এখানে ৫-৬ জন পর্যটক বহনে সক্ষম ছোট ছোট নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় ৭৫০ টাকায়।
থাকা খাওয়া: রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টে ভ্রমণে আসা পর্যটক দর্শনার্থীর থাকা খাওয়ার প্রয়োজনে সরকারি তরফে এখানে এখনো কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্প্রসারিত হয়নি। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটক, দর্শনার্থীরা সিংহভাগই সিলেট শহরে রাত যাপন, খাওয়া দাওয়া সারেন। বেড়াতে আসা পর্যটকরা শহর থেকে প্যাকেটজাত খাবার নিয়ে  নৌকা নিয়ে বনে প্রবেশ করে সেখানেই খাবার সারেন।
লালাখাল: সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দক্ষিণ পূর্বাংশে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে পুরাতন লালাখাল চা বাগান। বৃটিশ আমলে নির্মিত ভারত সীমান্তঘেঁষা সবুজ বেষ্টনির লালাখাল চা বাগানের পাশাপাশি চির সবুজের সারি সারি গাছপালার বেষ্টনি ছোট বড় টিলা, পাহাড়, চা বাগানের সবুজের সমারোহের সঙ্গে সারি নদীর স্বচ্ছ নীলাভ জলের অপরূপ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য পর্যটক দর্শনার্থীর কাছে টানে। লালাখালে সারি নদীর বারকি শ্রমিকের নুড়ি পাথর, বালু উত্তোলন আর জীবন জীবিকার দৃশ্যও নজর কাড়ে আগন্তকদের। গ্রীষ্ম কিংবা শীতকাল সারা বছরই লালাখালে ঢল নামে দেশি বিদেশি লাখো পর্যটক দর্শনার্থীর। চারদিকের সবুজের সমারোহের লালাখালের অনিন্দ্য সৌন্দর্য্য তৃষ্ণা মেটায় পর্যটকদের। লালাখালে ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারে পর্যটক সমাগম বেশি চোখে পড়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অপরূপ লীলা ভূমি লালাখালে সরকারি উদ্যোগে কোনো পর্যটন অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন হয়নি। তবে, বেসরকারি উদ্যোগে এখানকার সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম কামরান চৌধুরী ‘নাজিমগড়’ নামের একটি পর্যটন রিসোর্ট নির্মাণ করেন যা এখানকার বেড়াতে দেশি-বিদেশি পর্যটক দর্শনার্থীদের একমাত্র ভরসা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকারি উদ্যোগে লালাখালে পর্যটনখাতে বিনিয়োগ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্থানীয়দের পাশাপাশি বেড়াতে আসা পর্যটকরা জোর দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে।
যেভাবে যাবেন: লালাখালে যেতে হলে আপনাকে দেশের যেকোনো স্থান হতে সিলেট শহরে আসতে হবে। সিলেট শহরের কদমতলিস্থ টার্মিনাল থেকে বাস, মাইক্রো, সিএনজি ভাড়া করে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক দিয়ে ৩৯ কি.মি. সারিঘাট আসতে হবে। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সারি নদী হয়ে অথবা সিএনজি, অটোবাইকযোগে সারিঘাট থেকে ছয় কি.মি. পূর্ব উত্তর দিকে  লালাখাল যেতে হবে। লালাখাল ১০-১২ জন পর্যটক বহন ক্ষমতা সম্পন্ন ভাড়ায়চালিত নৌকা করে যেতে হলে আপনাকে ১২০০-১৫০০ টাকা গুণতে হবে। এ ছাড়াও লালাখাল ভ্রমণে নাজিমগড় রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের বেসরকারি ব্যবস্থাপনার বেশকটি স্প্রিড বোডও তাদের নির্ধারিত ভাড়ায় নিতে পাবেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status