ঈদ আনন্দ ২০১৮

স্মৃতিকথা

জিয়াউদ্দিন জানতে পারলেন বাবাকে হত্যা করা হয়েছে

মনিজা রহমান

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:৪৬ পূর্বাহ্ন

চার দিকে নিহতদের রক্তাক্ত দেহ আর আহতদের আহাজারিতে হাসপাতালে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডাক্তার শামসুদ্দীন আহমদ। আজকের কাহিনীর মূল চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা ড. জিয়াউদ্দিন আহমদের বাবা। তখন ড. শামসুদ্দীন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান। ওই থাকতে চাওয়াই মৃত্যুর কারণ হলো তার। পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে হাসপাতালে দায়িত্বরত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করল ডাক্তারকে। তার দোষ, কেন তিনি আহতদের চিকিৎসা করাবেন। এত বছর পরে সেদিনের সেই কথা মনে করে বেদনা ও গর্বে সিক্ত হলেন জিয়াউদ্দিন। ফিলাডেলফিয়ার ডেক্সসেল ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিনের প্রফেসর তিনি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
‘বাবার কথা বলতে গিয়ে জানান, ‘কোনো ডাক্তারকে হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসারত অবস্থায় হত্যা করা জেনেভা কনভেনশনের নীতির বিরোধী। কোনো যুদ্ধে এই ধরনের নজির নেই। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা কতখানি নির্মম ও পাশবিক ছিল।’
তরুণ বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। তবু তার স্মৃতি জিয়াউদ্দিনের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সকল কাজের প্রেরণা। সমপ্রতি আমেরিকার সম্মানজনক এলিস আইল্যান্ড মেডেল অব অনার পদক পেয়েছেন তিনি। নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডে জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠানে তাকে এই সম্মাননা দেয়া হয়েছে। জিয়াউদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, যেকোনো সম্মান প্রাপ্তি নিজের কাজ ও দায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৮৬ সাল থেকে প্রবর্তিত এই সম্মান পাওয়ার তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সাতজন প্রেসিডেন্টের নাম রয়েছে। জিয়াউদ্দিন মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বাবার সন্তান হওয়া, নিজে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া এর চেয়ে গৌরবের আর কিছু নেই। সেই উত্তাল দিনগুলোর কথাই শুনবো তার মুখে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, তার আগে স্বাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া- সবকিছুতে বাবার সমর্থন ছিল শতভাগ। আসলে বাবার সমস্ত গুণই ছিল পুত্রের মধ্যে বিদ্যমান। বাবার বদলির চাকরির কারণে জিয়াউদ্দীনের জন্ম হয় নারায়ণগঞ্জে। শামসুদ্দীন আহমদ তখন ওই শহরের সরকারি ডাক্তার। তবে মায়ের চাকরির কারণে এক সময়ে নিজ শহর সিলেটেই থিতু হন তারা। জিয়াউদ্দীনের মা হোসনে আরা বেগম ছিলেন সিলেট উইমেন্স কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। সিলেট এলাকা থেকে প্রথম নারী যিনি কলকাতায় গিয়ে এমএ পাস করেন। মাত্র ছয়জন ছাত্রী নিয়ে যে কলেজের যাত্রা শুরু করেছিলেন, বর্তমানে কলেজের ছাত্রী সংখ্যা হাজারেরও বেশি। এখন যে ঘটনাটার কথা এখন বলব, সেই খবর প্রথম এসেছিল মায়ের কাছেই। আর এই ঘটনাটাই জিয়াউদ্দীনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
১৯৬৯ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় জিয়াউদ্দীনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তখন তিনি মাত্র সিলেট এমসি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সিলেটের কালীঘাটে পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী আজমল আলী চৌধুরীর বাড়ি ছিল। জিয়াউদ্দীন ও তার বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তান সরকারের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে আজমল আলীর বাড়িতে কালো পতাকা ওড়াবেন। জিয়াউদ্দীন যেহেতু পোলভল্টে চ্যাম্পিয়ন, তাই তাকেই পতাকা ওড়ানোর কাজটা করতে হবে। সিদ্ধান্ত মতো সবকিছু করা হলো। কিন্তু তাদের দলে এক বিশ্বাসঘাতক ছিল, যে গিয়ে সব ঘটনা পুলিশকে বলে দিল। পুলিশ ওই দলের নেতা ও জিয়াউদ্দীনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল।
খবরটা পৌঁছাল মায়ের কানে। জিয়াউদ্দীনের এক বন্ধুর নানা ছিলেন পুলিশের এসপি। তিনি খবর পাঠালেন, ‘সাদেক (জিয়াউদ্দীনের ডাকনাম) যদি একটা কাগজে স্বাক্ষর করে বলে যে সে আর আন্দোলনে থাকবে না। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। নয়তো ওর বাবার সরকারি চাকরিতে সমস্যা হতে পারে।’ পুরো ঘটনায় রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তরুণ জিয়াউদ্দীন। একদিকে মায়ের বকা, অন্যদিকে পুলিশি পরোয়ানা, আবার বাবার চাকরি চলে যাবার হুমকি- তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন কাগজে স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু বাবা বললেন- ‘না’।
জিয়াউদ্দীনের বাবা শামসুদ্দীন আহমেদ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত এক আপসহীন মানুষ। কথা বলতেন আস্তে আস্তে, কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের প্রত্যয় ফুটে উঠত। ছেলেকে যে কে বললেন, ‘যা করবে ‘পরিণাম’ কী হবে, জেনে করবে। আমার চাকরি চলে গেলে সবাই মিলে উপোস করতে হবে ভেবো না- প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ আছে। শোন, কোনো কিছু ভাগাভাগি করবে না। আন্দোলন করতে চাইলে সেটা আন্দোলনের মতো করেই করবে।’ বাবার কথায় চোখ খুলে গেল জিয়াউদ্দীনের। মৌলভীবাজারে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন গা ঢাকা দিতে।
শামসুদ্দীন আহমদের চাকরি যায়নি। কারণ পুরো দেশে তখন স্বাধিকার আন্দোলনের প্রচণ্ড ঢেউ। ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে ভয়াবহ আহত হলেন ড. শামসুজ্জোহা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে উনার অপারেশন করেছিলেন শামসুদ্দিন আহমদ। বাঁচাতে পারেননি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলেছিলেন, শামসুজ্জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে জখম করার পরে গুলি করা হয়। যদিও পাকিস্তান সরকার এটাকে ক্রসফায়ার বলে চালাতে চেষ্টা করেছিল। শামসুদ্দীন আহমদ সেই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সব পত্রিকাতে পাঠিয়েছিলেন। শামসুজ্জোহার মৃত্যুর পরে প্রথম শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন। যে সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক সরকারি রোষানলের ভয়ে আসেনি।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দেশপ্রেম বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন জিয়াউদ্দীন। তাই তো ১৯৭০ সালে সাইক্লোন দুর্গত মানুষদের কাছে সেই দুর্গম চর জব্বারে চলে গিয়েছিলেন। জিয়াউদ্দীন তখন সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্র। সততার প্রতীক শামসুদ্দীন আহমদ ছেলেকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে দিতে চাননি। যদি তার বিরুদ্ধে কেউ স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনে। আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে ছেলের ইন্টারমিডিয়েটের ফল ভালো হয়নি। তখন সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘ওর ম্যাট্রিক-ইন্টারমিডিয়েট মিলে মোট নম্বর অনেকের চেয়ে বেশি। ওকে যদি এখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি না করাও তবে হতাশা থেকে বখে যেতে পারে।’  অবশেষে বাবা রাজি হলেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ভয়াল সেই কালরাত্রির পরে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সবাই স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু অনেক চেষ্টা করেও গণতান্ত্রিক উপায়ে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। ওনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হল পাকিস্তানে। জিয়াউদ্দীনের ভাষায়, ‘প্রথম কিছুদিন অবিশ্বাস্য দুঃস্বপ্নের মতো কাটল। সিলেট শহরে পথে ঘাটে নিরীহ মানুষের লাশ আর লাশ। হঠাৎ মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় বুঝতে পারলাম বাঙালি সৈনিকরা জেগেছে। নিজেদের রেজিমেন্টে পাকরা দুজন বাঙালি অফিসার লে. ডা. মঈন ও ক্যাপ্টেন মাহবুবকে গুলি করে হত্যা করে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে যায়। যে হাসপাতালের দায়িত্বে ছিল আমার বাবা। কার্ফু ভাঙার পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম বাবার চিন্তিত মুখ। পুরো হাসপাতাল প্রায় ডাক্তারশূন্য। অথচ হাসপাতালে ভর্তি আহত লোকজন। আমার বাবা তখন রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসায় হাসপাতালে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমাকে দেখে বললেন, হানাদারকে এখন চ্যালেঞ্জ করতে হবে সমরাস্ত্র দিয়ে, তীর-বল্লম আর গাদা বন্দুক দিয়ে নয়। বেশি দেরি হয়ে গেলে বাঙালি জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।’
বাবার কথা শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন জিয়াউদ্দীন। দিনটা ছিল ৪ঠা এপ্রিল। যার পাঁচ দিন পরে এই হাসপাতালে মুমূর্ষ মানুষদের সেবার করার সময় তিনজন সঙ্গীসহ শহীদ হন ডাক্তার শামসুদ্দীন। সেদিনই ছিল বাবা আর ছেলের শেষ দেখা। বাবার কাছ থেকে বেরিয়ে কয়েকজন বন্ধুসহ বিয়ানীবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন জিয়াউদ্দীন। তার আগেই দেখা হয়ে গেল কর্নেল রবের (পরবর্তীকালে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) সঙ্গে। তিনি ওদের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে রিপোর্ট করতে বললেন। করিমগঞ্জ হয়ে আগরতলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর তেলিয়াপাড়াতে এসে পৌঁছুলেন জিয়াউদ্দীন আর তার সঙ্গীরা। সেখানে তখন বাঙালি সমরনায়কদের প্রথম ঐতিহাসিক বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের নকশা তৈরি হচ্ছিল।
রাইফেল শুটিংয়ে প্রথম হওয়া জিয়াউদ্দীন দুই দিনের মধ্যে সাবমেশিন গান, লাইট মেশিন গান ও গ্রেনেড ছোঁড়ার ট্রেনিং নিয়ে মিশে গেলেন দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে। যার কমান্ডার মৃদুভাষী মেজর শফিউল্লাহ (পরবর্তীকালে অব. লে. জেনারেল ও সেনাপ্রধান) ছোট্ট করে একটা দৃঢ় বক্তব্য রাখলেন, ‘অন্যায়ভাবে বাঙালিদের ওপর হত্যা, ধ্বংস ও বর্বরতা শুরু করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এখন জাতীয় কর্তব্য হলো, দেশকে শত্রু মুক্ত করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। কত দিন যুদ্ধ চলবে জানি না, তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয় আমাদের হবেই।’
পুলিশ, ইপিআর ও ছাত্র-জনতা দিয়ে তৈরি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলো জিয়াউদ্দীনকে। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া আর্মি ক্যাডেট হিসেবে। ভারত থেকে তখনও কোনো সামরিক সাহায্য আসা শুরু হয়নি। বেঙ্গল রেজিমেন্ট সীমিত লোকবল ও অস্ত্র দিয়ে হানাদারদের মোকাবিলা করছে। তখনই একদিন হঠাৎ করে ক্যাম্পে হাজির হলো একজন সুদর্শন বাঙালি লেফটেন্যান্ট, এক হাতে যার প্লাস্টার করা, যুদ্ধের সময় গুলি লেগে ভেঙে গেছে। কিন্তু তাতে সে দমবার পাত্র নয়। আরেক হাত দিয়ে গ্রেনেড ছোড়া কিংবা মেশিন গান চালাতে পারবে বলে জানাল সে। আরও বলল, স্পেশাল প্লাটুনের পরিকল্পনা। যার অর্থ আত্মঘাতী অভিযান।
সেই সুদর্শন তরুণ হলো বর্তমান বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ। সেদিন তার কথা শুনে জিয়াউদ্দীনের মনে হলো, এত দিন যেন তিনি এই মানুষটির জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন। ট্রেনিং দেয়া বাদ রেখে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলেন তিনি। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে ১৪ জন সৈনিকের স্পেশাল প্লাটুনের সদস্য হয়ে মাধবপুর ঘাঁটিতে গেলেন জিয়াউদ্দীন। যাদের দায়িত্ব হলো শত্রুর কাছাকাছি থাকা ও সুযোগ বুঝে হামলা চালানো। কারণ, তারা যদি শত্রুকে ব্যস্ত রাখতে পারে তবে ক্যাপ্টেন নাসিমের (পরবর্তীকালে সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে নিয়মিত বাহিনী ওদেরকে ঘায়েল করতে পারবে। প্রথম অপারেশন ছিল শাহবাজপুরে ব্রিজে দখলকৃত পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করা।
সেদিন ছিল অমাবশ্যার রাত। ভারী অস্ত্র হাতে, গ্রামের কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে সবাই হাতে হাত রেখে চলেছিলেন সেদিন। কেউ যাতে অন্ধকারে হারিয়ে না যায়, তাই হাত ধরে রাখা। সকাল হলে একটা মসজিদে আশ্রয় নিলেন তারা। দুজন সাহসী হাবিলদারকে পাঠানো হল চাষির বেশে গরু নিয়ে রেকি করে আসার জন্য। সন্ধ্যায় অপারেশনে বের হলেন। পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী যে যার পজিশন নিলেন। দুই ইঞ্চি মর্টার দিয়ে হেলাল মুর্শেদের আক্রমণের পরে সবাই ব্রাশ ফায়ার শুরু করল। আচমকা পেছন থেকে আক্রমণে হৈচৈ পড়ে গেল পাকিস্তানিদের মধ্যে। শত্রুরা সামলে পাল্টা আক্রমণ চালাল। হঠাৎ সামনের বাংকার থেকে ভারি মেশিনগানের গুলি জিয়াউদ্দীনের মাথার খুব কাছ থেকে গেল। উনি দেরি না করে বাংকারের উদ্দেশ্যে গ্রেনেড ছুড়ে কানে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। স্তব্ধ হয়ে গেল শত্রুর বাঙ্কার। হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে প্রত্যেকে জীবন নিয়ে ফিরে এলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। গ্রামবাসীর কাছ থেকে পরে তারা জেনেছিল, পরদিন ২২ জন শত্রুর সেনার লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখেছে তারা। এমন আরো অপারেশনে অংশ নিয়েছে এই স্পেশাল প্ল্যাটুন।
এমন একটি অপারেশন থেকে ক্যাম্পে ফেরার পরে খেতে বসেছে সবাই, তখন একটা লোক এল পায়ে প্লাস্টার করা। লোকটা জিয়াউদ্দীনকে দেখে বলল, ‘তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।’ ভদ্রলোকের ‘ছিলেন’ কথাটা কানে লাগল জিয়াউদ্দীনের। ছিলেন মানে, এখন কী নেই। এই প্রশ্ন করতে জিয়াউদ্দীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালাম কাঁদতে শুরু করল। সালাম জানতো, জিয়াউদ্দীনের বাবার মৃত্যুর কথা। কিন্তু বলেনি। মেজর শফিউল্লাহও জানতেন। মন খারাপ হবে ভেবে জিয়াউদ্দীনকে জানায়নি। কিন্তু সেক্টর কমান্ডারকে গিয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জানাল, ‘যেকোনো মূল্যে হোক তাকে পরিবারের কাছে যেতে হবে।’ তিনি অনুমতি দিলেন। বন্ধু সালাম সঙ্গে যাবার অনুরোধ করল। তখন সিলেট শহরে যাবার পুরো রাস্তা প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু একটা উপায় চোরাচালানিদের নৌকায় করে যাওয়া। তাতেই দুই বন্ধু পাটাতনের ভেতরে ঢুকে চললেন। তারপর শহরে ঢুকলেন বাড়ির কাজের লোকের ছদ্মবেশে।
শামসুদ্দীন আহমদের মতো জিয়াউদ্দীনও যুদ্ধে শহীদ হয়েছে, এটাই জানত বাড়ীর সবাই। তাই তাকে পেয়ে মা, ভাই-বোনরা আনন্দে আত্মহারা হলো। জিয়াউদ্দীনের একটা আহত পা থেকে তখন পুঁজ ঝরছে। ডাক্তার মামা এসে বললেন, চিকিৎসার জন্য বিশ্রাম নিতে হবে। বাবাকে কবর দেয়া হয়েছে হাসপাতালের সামনে। ওনার মৃত্যুর পরে একমাত্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেই যে সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান, তিনি। এজন্য তাকে গুম করে ফেলা হয়। তার জায়গায় নতুন প্রিন্সিপালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এক বিহারীকে। সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে জিয়াউদ্দীনকে স্থানান্তর করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। পৈশাচিক হতাযজ্ঞের পরে পাকিস্তানিরা এখন সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। সিলেট থেকে ঢাকায় যেতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সিলেট থেকে সীমান্ত এলাকায় যাওয়া দুঃসাধ্য। কারণ তারা চোরাচালানিদের পথও জেনে ফেলেছে। অগত্যা জিয়াউদ্দীন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তার আর যুদ্ধে ফেরা হয়নি।
আত্মঘাতী প্লাটুনের হয়ে জিয়াউদ্দীন যুদ্ধে গিয়েছিলেন মরে যাবার জন্য। তিনি জীবিত থেকে গেলেন। আর হাসপাতালে আহত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে জীবন দিলেন তাঁর বাবা শামসুদ্দীন আহমদ।  ‘আমার বাবা ১৪ ডিসেম্বর মারা যাননি বলে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় ঠাঁই পাননি। কিন্তু তিনি আজীবন থাকবেন আমার হৃদয়ে।’  এভাবে ইতিহাস মনে রাখেনি অনেক মানুষের আত্মত্যাগের কথা, যেন সেই গানের ভাষায়- হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/ বড় বড় লোকেদের ভিড়ে/ জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/ তোমাদের কথা কেউ কবে না/ তোমাদের কথা রবে সাধারণ মানুষের ভিড়ে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status