ঈদ আনন্দ ২০১৮

স্মৃতিকথা

বাইসাইকেল

আশরাফুল নওশাদ

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

অতি প্রয়োজনীয় এবং স্বল্প ব্যয়ে ব্যবহারযোগ্য এক দ্বিচক্রযানের নাম বাইসাইকেল। বাইসাইকেল নারী পুরুষ উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য। সবার কাছে সহজলভ্য এবং পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। এখন থেকে দু’শ’ বছরেরও বেশি আগে অর্থাৎ ১৮১৬ সালে কার্ল ভন নামে এক ব্যক্তি জার্মানীতে প্রথম সাইকেল তৈরি করেন। তবে তা আধুনিক সাইকেলের মতো ছিল না। চেইন প্যাডেল ছিল না। পা দিয়ে ঠেলে সেই সাইকেলের মাধ্যমে হাঁটার গতিকে বাড়ানো যেতো মাত্র।
পরবর্তীতে সেই ধারনা অনুসরণ করে বিভিন্ন ধরনের সাইকেল আবিষ্কার হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে চেইন প্যাডেলসহ দ্রুতগতির আধুনিক সাইকেল আবিষ্কার হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে দেশে বিভিন্ন কোম্পানী নানা ধরনের সাইকেল প্রস্তুত করতে থাকে এবং তা পৃথিবীর সব দেশেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। চীন,জাপানসহ ইউরোপ, আমেরিকার পুরুষের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মহিলারা বাইসাইকেল ব্যবহার করে থাকেন। বাইসাইকেলের প্রয়োজনীয়তা একেক জন মানুষের কাছে এক একরকম। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্কুল কলেজে যাওয়া আসা, খেলার মাঠে যাওয়া আসার জন্যে প্রয়োজন। অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে সময় মতো যাওয়া আসতে করতে পারে এবং ন্যূনতম খরচে তা ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে স্বল্প উন্নত দেশগুলোতে একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর জন্যও খুবই প্রয়োজন। সংসারের খরচ বাঁচানোর জন্যে সাইকেল হয়ে উঠে তার একমাত্র বাহন হিসেবে। এর বাইরে যারা সাইকেল ব্যবহার করেন তারা শখ,স্বল্প পাল্লার যাতায়াত এবং শারীরিক ব্যায়ামের নিমিত্তে। নিয়মিত সাইকেল চালালে আলাদাভাবে ব্যায়ামের প্রয়োজন হয় না। সাইকেল চালনা নিঃসন্দেহে ভালো ব্যায়াম। মূল ঘটনা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছি। আমি বাইসাইকেল চালনায় মোটামুটি পারদর্শী বলতে পারি। সেই ছোটবেলা অর্থাৎ প্রাইমারী স্কুল থেকেই সাইকেল চালনা শিখেছি। সাইকেলের ত্রিভুজের ভিতরে পা ঢুকিয়ে সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে এই দুর দেশে এসেও তার সঙ্গ ছাড়ি নাই। দুই যুগেরও বেশি সময় ঢাকায় বসবাস কালীন সময়ও সাইকেল সঙ্গী হিসেবে ছিল। ঢাকা শহরে অত্যাধিক ট্রাফিক জ্যামের কারণে যদিও সাইকেল চালনা বিপজ্জনক তার পরও সুযোগ পেলেই চালিয়েছি। পাশাপাশি ব্যয়ামের নিমিত্তেও সাইকেল চালিয়েছি প্রায়শঃই। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে সাইকেল ব্যবহার হয় না। যদিও স্বল্প খরচে সাইকেল ব্যবহার করা যায় তথাপি সমীক্ষায় দেখা যায় তুলনা মূলকভাবে স্বল্প উন্নত এবং গরিব দেশের চেয়ে উন্নত দেশগুলোতে বাইসাইকেলের ব্যবহার বেশি। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ ভ্রমন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্য ভারত, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিংগাপুর অন্যতম। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাইকেল ব্যবহার হয় জাপান, চীন এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। বাংলাদেশে সাইকেলের ব্যবহার মূলত পুরুষের মধ্যই সীমাবদ্ধ। তবে ইদানীং উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ রংপুর দিনাজপুর এলাকায় কিছুসংখ্যক মহিলাদের সাইকেল ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারা সাইকেল ব্যবহার করে থাকেন সমানতালে। জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর জাপান এর রাজধানী টোকিও। তিনকোটিরও বেশি মানুষের বাস এই শহরে। অথচ এতো নিয়ম শৃঙ্খলায় মেনে চলার কারণে বোঝার কোন উপায়ই নাই এই শহরে এতো মানুষ বাস করে। তার উপর রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে স্বীকৃতি। আমি বেশ কিছুদিন টোকিও শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। যে সব আবাসিক এলাকায় গিয়েছি সে সব এলাকায় এমন কোন বাড়ি আমার চোখে পড়ে নাই যে বাড়ির সামনে বা পাশে বাইসাইকেল নেই। প্রত্যেক বাড়িতে দু ধরনের সাইকেল দেখেছি। কোন কোন সাইকেল ঝুড়ি সম্বলিত কোন কোনটা ঝুড়ি ছাড়া। প্রত্যেক বাড়িতেই ন্যূনতম দুটি বা ততোধিক সাইকেল রয়েছে। দু’রকম সাইকেল কেন? এর কারণ জানতে গিয়ে জানলাম ঝুড়িওয়ালা সাইকেল পরিবারের মহিলা সদস্যরা ব্যবহার করে থাকেন। আশপাশে শপিং করার জন্যে। মূলত গাড়ি পার্কিং এর ঝামেলা এড়ানোর জন্য মহিলারা সাইকেল ব্যবহার করে থাকেন। আর ঝুড়ি ছাড়া সাইকেলগুলো সাধারণত পরিবারের পুরুষ সদস্য বা ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজে যাতায়াত বা ব্যয়ামের নিমিত্তে ব্যবহার করে থাকে। ঠিক তেমনি চীন এবং থাইল্যান্ডে সাইকেলের একই রকম ব্যবহার রয়েছে। ইউরোপের সব দেশেই সাইকেলের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে, তবে তা শপিং এর চেয়ে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার হয় বেশি। জনসংখ্যার গড় হিসেবে ইউরোপেই বাইসাইকেল ব্যবহার হয় বেশি। ইউরোপের ছোট্ট দেশ নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামকে বলা হয় সাইকেলের রাজধানী। এই শহরে প্রতিদিন মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ মানুষ সাইকেল ব্যবহার করে থাকে এবং ২২ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ও ১৬ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে। ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ শহরেও আমি দেখেছি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সাইকেল ব্যবহার করে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাইসাইকেলের ব্যবহারের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ ভ্রমণ না করলেও কুয়েত, কাতার ও আরব আমিরাতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এসব দেশে সাইকেলের ব্যবহার লক্ষণীয় নয়। আবার আফ্রিকান দেশগুলোতেও ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে সাইকেলের। তবে তা ইউরোপের কোন দেশের সাথে তুলনা হয় না। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও রয়েছে বাইসাইকেলের অত্যাধিক ব্যবহার। ইউরোপ, আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় শীতের মৌসুমে সাইকেলের ব্যবহার একেবারেই নগণ্য। আগেই বলেছি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ব্যাপক ভাবে সাইকেল ব্যবহার করে মানুষ। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও ব্যবহার করে থাকেন ব্যাপক হারে। পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতাসহ আশেপাশের অনেক জেলাতে দেখেছি বহু মানুষ সাইকেল ব্যবহার করে। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষরাও নিয়মিত সাইকেলে ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ করে বর্ধমান জেলার শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ ঐ এলাকার অনেক পুরুষ মহিলারা প্রচুর পরিমাণে সাইকেল ব্যবহার করে থাকেন। বড় শহর বোম্বে, দিল্লী ও আইটি শহর খ্যাত বাঙ্গালুরে সাইকেলের ব্যবহার রয়েছে সমধিক। অগণিত মানুষকে সাইকেল ব্যবহার করতে দেখেছি। পৃথিবীর অন্যতম ধনী এবং বৃহত্তম এক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে বাইসাইকেলের। সাইকেল আধুনিক রূপ লাভ করার পর ১৮৯৭ সালে যখন সাইকেল বাজারে আসে তখন সবচেয়ে বেশি সাইকেল ক্রয় করেন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা। প্রায় বিশ লক্ষ সাইকেল বিক্রি হয় শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে। প্রয়োজনীয় এবং জনপ্রিয় এই দ্বিচক্রযান সম্পর্কিত চমকপ্রদ এক তথ্য আপনাদের দেবো বলেই তার ইতিহাস, ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য এবং যৎসামান্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও গল্প বললাম। আমি আমেরিকায় এসেছি ২০১১ সালে। কয়েক মাস পর অর্থাৎ ২০১২ সালের প্রথম দিকে আমি একটি পুরনো সাইকেল কিনলাম মাত্র বিশ ডলারে একজন স্প্যানিশ ভাষী লোকের কাছ থেকে। আমার পরিচিত একভদ্রলোক বললেন এটা চুরির সাইকেল তাই এতো সস্তায় পেয়েছেন। আমেরিকায় নতুন এসেছি ভাবলাম কেনা হয়তো ঠিক হয় নাই। ভদ্রলোক বললেন চিন্তার কোন কারণ নেই- অনেকেই কিনে। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম যদি প্রকৃত মালিক দেখে আমি তার সাইকেল চালাচ্ছি তাহলে তো সর্বনাশ হবে। তিনি বললেন চোর কোনসময়ই এক বরোতে বিক্রয় করে না। যেহেতু নিউইয়র্ক শহর পাঁচটি বরোতে বিভক্ত সেহেতু চোররা এক বরোর জিনিস চুরি করে অন্য বরোতে বিক্রি করে সে কারণে এতো দূরে এসে কেউ খোঁজ করে না সাধারণত। যাই হোক ভদ্রলোকের কথায় একটু আশ্বস্ত হয়ে কিছুদিন সাইকেলটা চালালাম। কিন্তু আমি চালিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারছিলাম না। পরে আমার এক বডভাই তিনি সাইকেলটা দেখে আমাকে বললেন এরকম সস্তায় পেলে আমার জন্য একটা পান কিনা দেইখেন তো। আমি তখন বললাম আমারটাই নিয়ে নেন। আমি ভালো দেখে একটা কিনবো
। তিনি বললেন আমার এটা হলেই চলবে। আমি দু’একদিন পর আমার বাসার কাছেই একটা সাইকেলের দোকানে গিয়ে দেখলাম একটা মোটামুটি ভালো সাইকেল তিনশত ডলারের নিচে নাই, উপরে দুহাজার ডলার দামের সাইকেল আছে। চিন্তা করলাম এতো দাম দিয়েতো কেনা যাবে না। কারণ আমি সাইকেলের জন্যে তো সমস্যায় নাই। তাছাড়া তিনশ’ ডলারেরটাও তেমন পছন্দ হয় না। আমার যেগুলো পছন্দ হয় সেগুলো পাঁচশত ডলারের উপর। পরে আমার পরিচিত এক ইয়েলো ক্যাব চালক ভাই বললো ভাই ব্রুকলিনে আমি একটা দোকান চিনি তারা ব্যবহারকৃত সাইকেল বিক্রি করে। আমি দেখেছি বেশ ভালো ভালো সাইকেল বিক্রি করে। উনি সঠিক ঠিকানা বলতে পারলেন না শুধু আইডিয়াটা বললেন। আমি তার কথামতো খুঁজে বের করে সেই দোকানে গিয়ে হাজির হলাম এবং দেখলাম এটা মূলত বাইসাইকেল মেরামতের দোকান। পাশাপাশি পুরনো বা চুরির সাইকেল কিনে হয়তো লাভে বিক্রি করে। আমি চিন্তা করলাম দোকানদার যেখান থেকে সাইকেল সংগ্রহ করুক তাতে আমার যায় আসে কি। আমিতো রিসিট ছাড়া কিনবো না। যাই হোক সেখান থেকে ভালো দেখে একটা সাইকেল কিনে নিলাম দুশ’ ডলারে যা দোকানে ছয়শ’ ডলার। স্লিম চাকার সুন্দর সাইকেল। সাইকেলটা কিনে আমার এক ভাই এর গাড়ির পিছনে ঢুকালাম। তাকে সাথে নিয়েই গিয়েছিলাম, তা নাহলে হয়তো চালিয়েই নিয়ে আসতাম। সামার সিজন হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই চালাতাম। দিনে সাইকেলটা পিতলের তালা লাগিয়ে বাসার সামনেই একটা পিলারের সাথে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতাম। যাতে চোর না নিতে পারে। রাতে ঘরের ভিতরে নিয়ে রাখতাম। কারণ আগেই জেনে ছিলাম নিউইয়র্ক শহরে ভালো সাইকেল প্রায়ই চুরি হয়। সেজন্যে সবাই ভালো লক ব্যবহার করে থাকেন। এভাবেই চললো বেশ কয়েকদিন। হঠাৎ একদিন কাজ থেকে এসে দেখি বাসার সামনে সাইকেলটা নেই। দিনে দুপুরে সাইকেলটা নিয়ে গেল ঘুণাক্ষরে কেউ টের পেল না এবং দেখল না তা ভাবা যায়? আমার বাসাটা যে এলাকায় মোটামুটি ব্যস্ত এলাকা। সব সময় মানুষ যাওয়া আসা করে। যেখানটায় আমি সাইকেলটা তালা দিয়ে রেখেছিলাম দেখলাম সেখানটায় তালাটা পড়ে আছে এবং কাটা। মনে হলো কোন বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে কেটেছে। যাইহোক সবাই বললো আফসোস করে লাভ নেই আরেকটা কিনে ফেলো। সাইকেল চুরি হলে আর পাওয়া যায় না। আমার এক ছোট ভাই বললো আপনি যেখান থেকে কিনেছেন খুঁজে দেখুন এরাও হয়তো অন্যের সাইকেল চুরি করে আপনার কাছে বিক্রি করেছে। হয়তো আপনার সাইকেলটা আবার ওখানে বিক্রি করেছে। আমি বললাম হয়তোবা। তবে আমারতো তারা রিসিট দিয়েছে। যাইহোক এটার সত্যতা খুঁজে পাইনি। আমি আবারও এদের কাছ থেকেই আরেকটি সাইকেল কিনে নিয়ে আসলাম আরো কম টাকায়। যা এখনো আছে। মূল কথায় আসা যাক। যেখান থেকে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া এবং বর্তমান সাইকেল কিনেছি। সেই পুরনো সাইকেলের দোকান মালিকের সাথে আমার একটা সখ্য গড়ে উঠে। আমি অন্যকোন কাজে ঐদিকটায় গেলে তাকে ‘হাই-হ্যালো’ বলে আসি। ধরুন তার নাম টমাস (ছদ্মনাম)। আমি যখন দ্বিতীয় সাইকেল কিনতে তার কাছে যাই তখন তার সাথে অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে গল্প করেছি। ভদ্রলোক বয়স্ক মানুষ। সত্তরের অধিক বয়স হবে। আমেরিকান ব্ল্যাক। পূর্বপুরুষ নাইজেরিয়ার। তাও শত বছরের অধিক আগে আসা। কথায় কথায় তার সঙ্গে নিউইয়র্কের সাইকেল চুরির ব্যবসার কথা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন নিউইয়র্কে প্রতিদিন শত শত সাইকেল চুরি হয় এগুলো জেনে কি করবা? কথাটা শুনে আমার কৌতূহল একটু বেড়ে গেল। সাধারণত সংবাদপত্রের মানুষেরা সব বিষয়েই বেশি জানার চেষ্টা করেন। অন্য পেশার লোকরা কোন ঘটনা এড়িয়ে গেলেও সংবাদপত্র কর্মী পারলে ঐখানে নাক গলাবে। পেশাগত কারণেই এদের মনের ভিতরে এরকম একটা কৌতূহলী দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে সবসময়। যেহেতু আমি নিজেও দীর্ঘদিন সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত ছিলাম সেহেতু আমিও এর ব্যতিক্রম নই। টমাস প্রথমে বলতে চাননি। বলা যায় ইনিয়ে বিনিয়ে তার ভেতর থেকে টেনে বের করেছি। এ এক ভয়াবহ সংবাদ। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনারা পুরনো সাইকেল কিভাবে পান। সরাসরি না বললেও পরোক্ষভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন আমি যাতে কারো সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার না করি। তিনি বললেন নিউইয়র্কে এক ইটালিয়ান আমেরিকান আছেন। মূলত আমেরিকান বলতে আমরা যাদের বুঝি এদের মূলশিকড় ইটালী তারপর রয়েছে বৃটিশ আইরিশ। কলম্বাস যেহেতু কোনো সময়ই আমেরিকায় আসেন নাই সেহেতু তার সঙ্গে আসা স্পেনিশরা আমেরিকার আশপাশের দেশগুলোতেই বসতি স্থাপন করে। যাইহোক সে ইতিহাস ভিন্ন। মূলকথায় ফেরা যাক্‌, টমাস জানালেন ঐ ব্যবসায়ীর অনেক কর্মচারী রয়েছে যারা বাইসাইকেল মেকানিক। রয়েছে তার অনেকগুলো ভ্যান গাড়ি। গাড়িগুলোর প্রতিদিন নিউইয়র্ক শহরে চষে বেড়ায় এবং দেখে দেখে ভালো সাইকেল চুরি করে। যখন তারা চুরি করার সুযোগ পায় তখন ঊর্ধ্বে একমিনিট বা তারচেয়ে কম সময় লাগে একটা সাইকেলের তালা কেটে ভ্যান গাড়িতে তুলতে। ঐ ব্যবসায়ীর না কি অনেকগুলো ভ্যান গাড়ি রয়েছে। চুরিকৃত সাইকেলগুলো তার নিজস্ব কারখানায় জমা হয় এবং সেগুলো আবার নতুন হয়ে যায়। পরে বিভিন্ন স্টোরে বিক্রি হয় চড়া দামে। সাধারণত এই কর্পোরেট চোররা কম দামি সাইকেল চুরি করে না। স্টোরের মালিকদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক আছে। তারা নতুন সাইকেলের পাশাপাশি ঐ সাইকেলগুলো বিক্রি করে। যারা চুরি করে এরা তার চাকরি করে এবং সাপ্তাহিক বা মাসিক বেতন পায়। একবার যারা চাকরি পায় তারা ইচ্ছা করলেও চাকরি ছাড়তে পারে না। অর্থাৎ তাদের বস যতদিন না চান। বস এর কথার উল্টো চলার চেষ্টা করলে উনার কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল গর্জে উঠতে সময় লাগে না। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে উনি একেবারে মেরে ফেলেন না। আহত করেন পরে চিকিৎসা করান এবং আবার কাজে লাগান। তবে ঐ কাজগুলো মূল ব্যবসায়ী করেন না। তার অধীনস্ত ম্যানেজার সুপারভাইজার এরাই বেশির ভাগ কাজ করে। টমাস বললো উনার অনেক ব্যবসা আছে। নিউইয়র্ক শহরে অনেক বাড়িও রয়েছে। তার পরিচয় মূলত বাড়ি কেনা বেচার ব্যবসায়ী হিসেবে। টমাস বললো সম্ভবত চিকাগো এবং লসএঞ্জেলসেও উনার ব্যবসা আছে। টমাসের ধারণা ড্রাগ ব্যবসার সাথেও হয়তো তিনি জড়িত। অত্যন্ত প্রভাবশালী ঐ ব্যবসায়ীর রয়েছে উপর মহলে সুসম্পর্ক। অনেক সিনেটর রয়েছে তার বন্ধু। রয়েছে উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের সাথে সখ্যতা। ছোটখাটো পুলিশরা তাকে ভয় পায়। টমাসকে আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন সময় কি চোর রা হাতে নাতে ধরা পড়ে না ? সে বললো পড়ে। তখন প্রতিষ্ঠানের লোকজন টাকা-পয়সা খরচ করে নিয়ে আসে। তাছাড়া পুলিশের খাতায় সাইকেল চুরি বড় কোন অপরাধ নয়। পরের দিনই জামিন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোর্ট খরচ তার বেতন থেকে কাটা যায়। কারণ বস এর নির্দেশ আছে সাইকেল যদি চুরি নাও করতে পারো সমস্যা নাই তবে পুলিশের কাছে ধরা পড়া যাবে না। সম্ভবত কেঁচো খুরতে সাপ বেরিয়ে যায় কি না সেই ভয়ে সেই নির্দেশ। যদিও তার হাত অনেক লম্বা তারপরও ঝামেলা এডিয়ে চলার চেষ্টা আর কি। টমাসের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে আমি এই ধারনায় পৌঁছালাম যে সম্ভবত টমাস আরো ইয়াং বয়সে ঐ ব্যবসার কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছে। তা না হলে বাহির থেকে ঐ মাফিয়া সম্পর্কে এতো জানে কিভাবে? যাইহোক সে কথাতো আর তাকে বলতে পারি নাই। যাক ঐদিন চলে আসলাম। এরপরও আরো দু/একবার তার সাথে দেখা হয়েছে। আজ সরকারী ছুটি কাজ নেই। তাছাডা শরীরটাও খারাপ। ঠান্ডা লেগেছে সাথে জ্বরও আছে। বাসা থেকে বের হয়নি। তাই ভাবলাম সবাইকে অবহিত করি এই ক্ষমতাধর ধনী রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত ক্ষত সম্পর্কে। টমাসের বারণটা শুনলাম না এই কারণে যে ভাবলাম আমি লিখবো আমার ভাষায় টমাস তা বুঝবে না। তাছাডা আমি জানি নিউইয়কের্র উল্ল্যেখযোগ্য ইংরেজী পত্রিকা ছাড়া আমেরিকানরা কমিউনিটি ভিত্তিক কোন পত্রিকাই পড়ে না। বিশেষ কারণ ছাড়া। দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলো ছবি দেখার জন্যও হাতে নেয় না। আর ফেইসবুকের বন্ধু ছাড়া বাংলাভাষায় লেখা কোন বিষয় কোন ভিন্নভাষী পড়ারতো প্রশ্নই উঠে না। অথচ কিমউনিটি ভিত্তিক বাংলা পত্রিকায় অমুক দল তমুক দল অমুক সমিতি তমুক সমিতির নেতা হিসেবে ছবি ছাপানোর প্রতিযোগিতা দেখলে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। আমার এক উর্ধতন পুলিশ বন্ধু আছে। সে মূলত সাউথ আমেরিকান। সে একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোমাদের লোকরা প্রায়ই নির্বাচন করে এটার কারণটা কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন নির্বাচনের কথা বলছো ? সে বললো আমি জানিনা কিসের নির্বাচন এবং সে হাসতেছে। আমিও তার সাথে হাসলাম কি আর করা। কিন্তু আমিতো বুঝেছি সে কোন নির্বাচনের কথা বুঝাতে চাচ্ছে। লজ্জার কথা তারপরও বলছি বাংলাদেশে মোট চারশত ছিয়াশিটা উপজেলা আছে। আল্লাহর রহমতে প্রত্যেক উপজেলার সমিতিই আমেরিকায় আছে। সাথে চৌষট্টি জেলা সমিতি ,বিভাগীয় সমিতিতো আছেই। আরো আছে মসজিদ কমিটি নানা জনকল্যাণ সমিতি। এসবের সব নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা হন। তাদের দ্বারা কি জনকল্যাণ হয় তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের চোখে যা দেখি তাদের মূলকাজ সম্ভবত: সামার সিজনে পিকনিকের আয়োজন করা। এর বাইরে তাদের আর কি কাজ আছে তাঁরাই ভালো জানেন। তারা প্রতি বৎসরই নির্বাচন করেন এবং নেতা নির্বাচন করেন। সেই নেতা আবার নিজেকে অনেক কিছু মনেও করেন। অনেক নেতাই বিসনেস কার্ড ব্যবহার করেন। সেই কার্ডে আবার সমিতির পদের নামটা উজ্জ্বল থাকে। যা নিতান্তই লজ্জাস্কর। সেই সব ফালতু নির্বাচনে নিরাপত্তার অজুহাতে পুলিশি সহযোগিতার জন্য দরখাস্ত করে বসেন। পুলিশ ডিপার্টমেন্টকেও বাধ্য হয়ে সাহায্য করতে হয়। সে যাইহোক এক প্রসংঙ্গে বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও চলে আসে। তারপরও আপনাদেরকে এই চিত্রটা সম্পর্কেও জানালাম সেটাই কম কিসের।
নিউইয়র্ক, মে, ২০১৮
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status