ঈদ আনন্দ ২০১৮

স্মৃতিকথা

রণাঙ্গনের সম্মুখ যোদ্ধা ডলার

মিজানুর রহমান

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:১৬ পূর্বাহ্ন

মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের এক অকুতোভয় সৈনিক আলী আকবর খান ডলার। পাক বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার, সম্মুখ সমরে লড়েছেন বিপুল বিক্রমে। চোখের সামনেই সহযোদ্ধাদের অনেকে শহীদ হয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন ভাগ্যের সহায়তায়। দ্বিতীয় জীবন পাওয়া ডলার অবশ্য তার জীবনের প্রতি অন্যায় করেননি। তিনি অপব্যয় করেননি একটু সময়ও।
মানুষের মাঝেই কাটিয়েছেন, আছেন আজও। মানুষকে ঘিরেই তার সমস্ত কিছু। জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেই যোদ্ধা এখন নানা রোগ-শোকে আক্রান্ত। ক’দিন আগে হারিয়েছেন ছোট ভাই, সহযোদ্ধা আলী আজম খোকাকে। পিঠাপিঠি দুই সহোদরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল খুব কম জনেরই। ডলার-খোকা সেই  সৌভাগ্যবানদের অন্যতম। ছোটভাইয়ের বিদায়ে বড় বেশি কাতর হয়ে পড়েছেন কিডনি জটিলতায় ভোগা বড় ভাই ডলার। মোহাম্মদপুর আদাবরস্থ বায়তুল আমান হাউজিংয়ের ১১ নম্বর সড়কের ‘অধ্যক্ষ কুঠির’ই এখন তার ঠিকানা। অবচেতন মনে সহযোদ্ধা ছোট ভাই খোকাকে খুঁজে ফিরেন তিনি।
রাজনীতি আর পদ-পদবির মোহ ত্যাগ করে স্বাধীনতার পর থেকে আত্মনিয়োগ করেন ‘মানুষ গড়া’র কাজে। মুক্তিযুদ্ধের গৌববোজ্জ্বল ইতিহাসের গর্বিত অংশীদার আলী আকবর খান ডলারের নামের আগে যুক্ত হয়েছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আরো দুটি বিশেষণ। ‘অধ্যক্ষ’ ও ‘প্রফেসর’ পরিচয়েও দ্যুতি ছড়িয়েছেন তিনি। ক্লান্ত শরীরে সেদিনও এক আলাপে বলছিলেন- ‘এক জীবনে যা পেয়েছি, তাতে আমি আপ্লুত। বন্দুক হাতে দেশকে শত্রুমুক্ত করার লড়াইয়ের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের আশপাশে অন্তত ৩টি স্থানে পাক সেনাদের পরাজিত করেছে আমাদের বাহিনী। যুদ্ধ-ত্যাগ, জীবনহানির আশঙ্কার পর মুক্তির যে আনন্দ সেটি আমি উপভোগ করেছি। যে চেতনা-আদর্শ এবং স্বপ্ন নিয়ে জীবন বাজি রেখেছিলাম, আজ হয়তো জাতি হিসেবে আমরা এর অনেক কিছু এখনো অর্জন করতে পারিনি। এটি হতাশার জন্ম দেয়। আবার ভাবি- আমার দেশের তরুণ প্রজন্ম একদিন তা অর্জন করবে, আমরা হয়তো দেখবো না। প্রফেসর ডলার সদ্য সাবেক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কার্যকরী সদস্য। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। পেশাগত জীবনে এক সময়ের আসাম প্রোভিন্সের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ সিলেটের মুরারি চাঁদ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তার হাত ধরে ওই কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং অবকাঠামোতে ব্যাপক সংস্কার হয়েছিল। সরকারের তরফে পুরস্কৃতও হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে তাকে দেশের ২৮ হাজার স্কুল-কলেজ, মাদরাসা  দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। প্রফেসর ডলার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অবসর নেন। অবশ্য অবসরকালীন ছুটিভোগরত অবস্থাতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দু’বছর তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়ে। কিন্তু তিনি আর রুটিন দায়িত্বে ফিরেননি।
জীবনভর শিক্ষকতায় কাটানো মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর খান ডলার গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম কলেজে শিক্ষকতা করা কালেই সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। জাসদের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি মশাল প্রতীকে টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচন করেন। ডলার রাজনীতির মানুষ। ছাত্র নেতা থেকে জননেতা। মানুষের জন্য কিছু করাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। সেটিই করেছেন-করছেন।
১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার উয়াশী গ্রামের মাতুতালয়ে জন্ম নেয়া ডলারের পৈতৃক নিবাস একই থানা কহেলা গ্রামে। পিতা নবী আওয়াল খান, মহর কোম্পানী নামে পরিচিত ছিলেন। মাতা বেগম সালেহা খানম। দুই ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। কহেলা প্রাইমারি স্কুলেই শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি ডলারের। পরে রাজাপুর প্রাইমারি স্কুলে। ব্যবসা পরিচালনার প্রয়োজনে বাবা নবী আওয়াল খান ঢাকায় থাকতেন। সেই সুবাদে বড় সন্তান ডলার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলে। সেখান থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে। এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রফেসর আলী আকবর খান একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার সহধর্মিনী আয়েশা খানম চৌধুরী। সিটি কলেজের অধ্যাপিকা (ভূগোল) হিসাবে সদ্য অবসরে গেছেন। ডলার-আয়েশা দম্পতির দুই সন্তান। বড় ছেলে  অ্যাডভোকেট  আশরাফ খান লেলিন। ছোট ছেলে আলী আকরাম খান পাবলো। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। পরিবারে তরফে অসুস্থ আলী আকবর খানের জন্য দেশবাসীর দোয়া চাওয়া হয়েছে।

যোদ্ধার জবানীতে
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব-পরবর্তী কিছু ঘটনা
১৯৬৭ সাল। আমি তখন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র। ওই বছরে স্কুল সংসদের জিএস নির্বাচিত হই। খ্যাতিমান একটি স্কুলের ক্যাপ্টেন হিসেবে ঢাকা মহানগরীর তৎকালীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দ্রুতই আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। কালচারাল সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলাম আগে থেকেই। ওই বছরে আমি ছাত্র ইউনিয়নের আঞ্চলিক সভাপতি নির্বাচিত হই। রাশেদ খান মেননের উপস্থিতে সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পাই। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সেরা কলেজ ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। শিক্ষার জন্য ওই কলেজের যেমন প্রশংসা ছিল, তেমনি আন্দোলন সংগ্রামের ভূমিকার জন্যও। বরাবরই ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর সহায়ক শক্তি ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজ। এমন এক সময়ে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশ উত্তাল। ’৬৮-র শেষ দিকে এবং ’৬৯-এর প্রথম দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। প্রতিনিয়ত হতে থাকা মিছিল-মিটিং শোভাযাত্রায় আমি আমার অবস্থান থেকে ছাত্রদের সংগঠিত করে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। ’৭০ সালে ইন্টারমেডিয়েট পাস করে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঠাঁই হয় ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনাতেই সান্নিধ্য পাই দেশ বরেণ্য ছাত্রনেতা- সিরাজুল আলম খান, আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, স্বপন কুমার চৌধুরী, চিস্তি হেলাল, আবদুল বাতেন চৌধুরী প্রমুখের। ’৭০ ছিল নির্বাচনের বছর। একজন সংগঠক হিসেবে সেই সময়ের কর্মসূচীগুলোতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করি।
৭১’র ২রা মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহাসিক বটতলা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনের সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ। ওই দিন ছিল হরতাল। কাকডাকা ভোরেই মিছিলে মিছিলে বটতলা ভরে যায়। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সেখানে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ একটি পতাকা নিয়ে আসেন। বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা পতাকাটি নেতাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কপালে রুমাল বাধা রব ভাই (আ স ম আবদুর রব) পতাকাটি উঁচু করে ধরে কয়েক বার ঘোরালেন। পরদিন পত্রিকায় সেই ছবি ছাপা হলো। তার পাশে ছিলেন- রেজাউল হক মুশতাক, শাহজাহান সিরাজ।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনসভা ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। যে জনসভায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল মুক্তিযদ্ধের চূড়ান্ত রাজনৈতিক নির্দেশনা। রাজনীতির অমর সেই ভাষণটি আজ পাঁচ  দশক পর পেয়েছে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। ওই জনসভায় মিছিল সহকারে যাওয়ার জন্য হলে হলে গিয়ে আমরা ছাত্রদের সংগঠিত করি। চারদিক থেকে মিছিল আসতে থাকে। দুপুর ২টার আগেই আমরা রেসকোর্সে উপস্থিত হই। ৩টার পরে মঞ্চে এলেন নেতা। নেতাকে দেখা মাত্র বিশাল জনসমুদ্র গর্জে ওঠে জয় বাংলা স্লোগানে। ওই জন সভায় একজনই বক্তা ছিলেন। মঞ্চে আসার মিনিট কয়েক পরেই তিনি ভাষণ দানের জন্য দাঁড়ান। তার সেই কাল জয়ী ভাষণ থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে সশস্ত্র যুদ্ধ অনিবার্য।
ওই সমাবেশের পর ছাত্রনেতারা গ্রামে গ্রামে-গঞ্জে ফিরতে শুরু করেন। আমিও তা-ই করি। উদ্দেশ্য পাকিস্তানিদের যে কোনো যড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে মানুষকে প্রস্তুত করা। প্রথমে আমি আমার মির্জাপুরের কহেলা গ্রামে ফিরি। সেখানে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়ায় অংশ নেই। দিনগুলো চলে যায় দ্রুতই। ২৫শে মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তানিরা নিরীহ বাঙ্গালীদের ওপর হামলা শুরু করে এবং ঢাকায় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালানোর সংবাদ পাই আমরা। এ খবরে এলাকার অনেকের মধ্যে মারাত্মক ভীতি ও হাতাশা দেখা দেয়। সেই সময়ে কেউ কেউ আমাদের টিপ্পনীও কাটে। বলতে থাকে এবার টের পাবে পাঞ্জাবিরা কি? আমরা অবশ্য তাদের কথায় মনোবল হারাইনি। বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিরোধের প্রস্তুতি জোরদার করতে থাকি। ৩রা এপ্রিল পাক সেনারা টাঙ্গাইল ঢোকার চেষ্টা করে। মির্জাপুরের গোড়াল সটিয়াছড়ায় ফজলুর রহমান খান ফারুকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেখানে সারাদিন যুদ্ধ চলে। প্রচুর পাকিস্তানি হতাহত হয়। তবে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধরা স্থান ছেড়ে দেয়। ফারুক ভাই আমাদের এলাকায় চলে আসেন।  প্রাথমিক অবস্থায় তার ঠিকানা হয় আমাদের বাড়ি। আমার পিতা নবী আওয়াল খান নিজে থেকে তাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেই দিন বাবা এলাকাবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ফারুক আমাদের এলাকার সন্তান। আমাদের প্রিয় নেতা। তাকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের।’ অবশ্য এলাকায় আমাদের বেশি দিন থাকা হয়নি। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে নাগরপুর থেকে টাঙ্গাইল থানার চর এলাকার ভেতর দিয়ে কালিহাতির পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে ভূয়াপুর এবং গোপালপুরের পশ্চিম এলাকা অর্থাৎ যমুনা নদীর তির ধরে জামালপুর চলে যাই। সেখান থেকে ময়মনসিংহ। ওখানে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমি রওনা করি হালুয়াঘাটের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই আমাদের বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে পাক সেনারা বোমা বর্ষণ করে। আমি যাত্রা পথ পল্টাতে বাধ্য হই। কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করে বিরতি করি বাজিতপুরে। সেখান থেকে এলাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। একবার চেষ্টা ছিল ভারতে যাওয়ার, কিন্তু তা-ও হলো না। টাঙ্গাইলে ফিরে সংবাদ পাই পাশের এলাকায় থাকা খন্দকার আবদুল বাতেনের। তিনি যোদ্ধাদের সংঘঠিত করছেন। তার নামেই গড়ে ওঠে ‘বাতেন বাহিনী’। তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে তার বাহিনীর (বাতেন বাহিনী) বেসামরিক প্রধানের দায়িত্ব দেন। বাতেন বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল- মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ। ঘিওর থানা দখল। সাটুরিয়া থানা দুবার আক্রমণ। চৌহালী অভিযান। নাগরপুর থানা শত্রু মুক্ত করা, ধল্লার ব্রিজ আক্রমণ, মানিকগঞ্জের জাবরা ব্রিজের কাছে হানাদারদের গানবোট আক্রমণ এবং খাস কাউলিয়ায় নিধন। আমাদের বাহিনীতে সাড়ে ৩ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা ছিলেন। একুশটি কোম্পানি ছিল। সুবেদার মেজর খন্দকার আবু তাহের ছিলেন বাতেন বাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার।     
 
যে স্মৃতি আজও ভাস্বর
বাতেন বাহিনীর ৩টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার তিল্লি গ্রাম, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার থানার লাউহাটি এবং নাগরপুর থানার শাহজানির চর। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত বা অসুস্থ যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ছিল  ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালও। সংবাদ আদান প্রদানের জন্য ছিল ‘অগ্নিশিখা’ বার্তা। কসুরার কাছাকাছি একটি গ্রামে কিছু অস্ত্র আছে এমন সংবাদ পাই। তখন আমাদের অস্ত্রশস্ত্র খুব ছিল না। সূত্রের ভিত্তিতে আমরা সেই অস্ত্র আমাদের আয়ত্তে নেই। পরে আরও কয়েকটি সফল অভিযানে আমাদের অস্ত্রবল বেড়ে যায়। শুরুতে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের কিছু এলাকায় থাকলেও পরিকল্পনা মতে বাতেন বাহিনী গাজীপুর ও ঢাকার দিকে ছড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত  নেয়। বিশেষ করে আমাদের টার্গেট ছিল আরিচা মহাসড়ক। ওই রাস্তাকে অকেজো করার পরিকল্পনা করি। আশেপাশে অন্য যোদ্ধাদের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ করি। আমরা ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে থাকলেও ২ নম্বর সেক্টরের সঙ্গে ছিল আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বিশেষ করে ঢাকা উত্তরের শহীদ মানিক বাহিনীর সঙ্গে। ওই বাহিনী আরিচা মহাসড়কে অনেকগুলো সফল অভিযান করে যাতে পাক বাহিনীর মনে মারত্মক ভীতির সৃষ্টি করে। আমরা আমাদের এলাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি করি যাতে পাক বাহিনী রাতে বের হতেই ভয় পেতো। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ২৫-৩০টি বোটে করে রাজাপুর নদীর ঘাটে আচমকা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান নেয়ার খবর আসে। এ-ও খবর আসে তারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত। আমাদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ক্ষেত্র, অনেকটা দুর্গে পরিণত হয়েছে। তাদের ভয় দেখানোর জন্যই পাক বাহিনীর এ অবস্থান ছিল। আমরা তাদের গতিবিধির ওপর সতর্ক পর্যবেক্ষণ রাখি এবং কোনোরকম সংঘাতে না জড়িয়ে সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কারণ, আমাদের ধারণা ছিল তাৎক্ষণিক যুদ্ধে জড়ালে হয়তো আমরা জয়ী হতে পারবো না। এ অবস্থা চলতে থাকে কয়েক দিন। টানটান উত্তেজনা। আমরা আক্রমণ পরিচালনা এবং যুদ্ধের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণে কোম্পানি কমান্ডারসহ নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে আলোচনা করি। ওই বৈঠকে বিভিন্ন মত আসে। অভিযানের কৌশল প্রশ্নে ভিন্নমতও হয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে সিরিজ আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। নভেম্বর মাসে আমাদের আক্রমণে ওই এলাকায় পাক বাহিনী প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারা মরণ কামড় দেয়ার পরিকল্পনা করে সাটুরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। কিন্তু সেটি আমরা ভেস্তে দিই। ২১শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সাটুরিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে নভেম্বর সন্ধ্যায় আমাদের বাাহনী সাটুরিয়ার দিকে অগ্রগর হতে থাকে। কুড়িকাহিনীয়ায় পাক বাহিনীর বাধার মুখে পড়ে। সেখানে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। রাত ৩টার দিকে আমরা সাটুরিয়ায় চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হই এবং প্রায় দুই ঘণ্টা অবিরাম যুদ্ধ হয়। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার সাধারণ মানুষ বল্লম, ফালা, দা-বঁটি সড়কি, কুড়াল নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার নিধনে শামিল হয়। ওই জনযুদ্ধ দুপুর অবধি চলতে থাকে থেমে থেমে। পরে ঢাকা থেকে পাক বাহিনীর একটি পদাতিক দল বেলা ১২টার দিকে সাটুরিয়া পৌঁছায়। ফলে যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করেন। কৌশল হিসেবে ৫ মিনিট গুলি চালিয়ে বন্ধ রাখা যাতে হানাদাররা বেশি গুলি খরচ করে। একই সঙ্গে পাকিস্তানিদের পালানোর জন্য একটি রাস্তাও খোলা রাখা হয়। এভাবে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের দুটি কৌশলই কাজে দেয়। পাক বাহিনীর গুলি কমে আসে এবং তারা আমাদের ছেড়ে দেয়া দক্ষিণ দিকে সরে যেতে শুরু করে। ফেলে রেখে যায় বেশ কিছু অস্ত্র এবং মৃতদেহগুলো। সেদিনের যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে জিয়ারত হোসেন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। তার নামেই সাটুরিয়ার নামকরণ করা হয়েছিল জিয়ারত নগর। অবশ্য ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পর সেটি  বিলুপ্ত হয়ে ফের সাটুরিয়া ফিরে আসে।
সাটুরিয়া বিজয়ের পর আমরা নাগরপুর থানা দখলের প্রস্তুতি নিই। সেখানে পাক বাহিনী খুব শক্ত অবস্থানে ছিল। কাদের সিদ্দিকীর (বঙ্গবীর) নেতেৃত্বাধীন বাহিনীও নাগরপুর শত্রুমুক্ত করার চেষ্টায় ছিল। সর্বশক্তি নিয়োগ করে নাগরপুর অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। পরিকল্পনা মতে সেখানে সর্বাত্মক আক্রমণ হয়। পাকিস্তানিরা কপ্টার দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। ফলে সাময়িকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু কপ্টার চলে যাওয়ার পর সম্মুখ যুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাক বাহিনী পালাতে বাধ্য হয়। সেখানে তাদের অনেকে আহত এবং নিহত হয়।
১২ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল থেকে হানাদাররা পালিয়ে বিভিন্ন পথে ঢাকায় ফেরার চেষ্টায় ছিল। কনোড়া গ্রামে তাদের একটি দল আমাদের বাহিনীর মুখোমুখি হয়। দুপক্ষের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। রাতের আঁধারে তারা অস্ত্র এবং হতাহতদের ফেলে বিছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কনোড়া থেকে বিতাড়িত হয়ে নাগড়পাড়া হয়ে বালিয়া আমছিমুর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়ও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাধার মুখে পড়ে। সেখানেও কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ হয় এবং তাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। এ সময় তাদের অপর দল পাকুটিয়া হয়ে বালিয়াটির দিকে অগ্রসর হলে ভাটারা-জাজিরিয়ায় আমাদের বাহিনীর সদস্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। বিকাল থেকে শুরু করে সারা রাত যুদ্ধ চলে। ওই যুদ্ধে ভাঙ্গাবাড়ির নিজাম উদ্দিন শহীদ হন। পাক বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য পালিয়ে যায়। তবে কয়েকজন আটকা পড়ে, তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। যাদের কয়েকজন ঘটনাস্থলে মারা যান, বাকিদের পরে মুক্তিবাহিনীর হাই কমান্ডের কাছে জীবিত হস্তান্তর করা হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status