ঈদ আনন্দ ২০১৮

স্বাস্থ্যকথা

এক মহা ঔষধের অপব্যবহারের গল্প

ডা. কাজী শামীম আহমেদ

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:১২ পূর্বাহ্ন

পেশাগত ব্যস্ততার মাঝে যখন একটুখানি অবসর পাই, চোখের সামনে গ্রামের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে। আনমনে চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়। গ্রামের মেঠোপথ। ফসলের মাঠে ছুটে চলা। নোয়াখালী দেশের দক্ষিণের জেলা। আমার আত্মার ঠিকানা।
জীবনের প্রথম সতেরো বছর কেটেছে আমার গ্রামে। সমবয়সী আমরা ছিলাম পাঁচ-ছয়জন। দুরন্তপনা খেলাধুলায় কেটেছে শৈশব আর কৈশোর। আমারই এক বড় ভাই, নাম তার সজল। সজল ভাইকে দেখলে মনে হবে এই বুঝি বাতাসে উড়ে যাবে। দুইশ’ ছয়খানা হাড় আর চামড়া দিয়েই ওনার শারীরিক গড়ন। ডিসেম্বর মাস গ্রামে বিয়ের ধুম নামতো। স্কুল ছুটির কারণে আমরা দলবেঁধে বিয়ে খেতে যেতাম। কিন্তু সজল ভাই এর টেবিলে কোনো ভাবেই বসতাম না। উনি একাই তিন চারজনের খাওয়া সাবাড় করে দিতেন। সজল ভাইকে দেখে আমার মনে হতো খাওয়াটা একটি শিল্প আর এই শিল্পের তিনি এক অসাধারণ শিল্পী। শনিবার ব্যস্ততম দিন। সকাল ৯টায় হাসপাতালে রাউন্ড শুরু করলাম। ১০টা অবধি মহিলা ওয়ার্ড-এ এলাম। সাত নাম্বার বেড-এ ভর্তি রেহনুমা। বরিশাল থেকে ভোরে এসেছে। তিনদিন যাবত প্রচণ্ড বমি সাথে কিছুদিন যাবত পা ও মুখ ফোলা। শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ডা. অহনা রেহনুমার বেডের দায়িত্বরত চিকিৎসক। অহনা থেকে রোগীর ইতিহাস শুনলাম। শারীরিক পরীক্ষা করলাম আর দু-চারটি প্রশ্ন করলাম। আচ্ছা রেহনুমা তুমি কি অনেকদিন যাবত শিমের বিচির মতো একটা ওষুধ নিয়মিত খাও? আমার প্রশ্ন শুনে রেহনুমা হতচকিয়ে গেল। রেহনুমা অপকটে স্বীকার করলো সাত-আট মাস আগে গ্রাম্য চিকিৎসক আবদুল হক-এর কাছে গিয়েছিল মোটা হওয়ার ওষুধ এর জন্য। আবদুল হক আগপাছ না ভেবে রেহনুমাকে মোটা হওয়ার ওষুধ দিয়ে দিলো। রেহনুমার ভাইকে বললাম আবদুল হককে ফোন দিতে। আমার পরিচয় দিয়ে আবদুল হককে ওষুধের নাম জিজ্ঞাস করলাম। উত্তরে বললো রেহনুমাকে ২০ মি.গ্রা. পেডনিসোলন খেতে দিয়েছে। পেডনিসোলন (স্টেরোয়েড) মেডিকেল চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী মহাঔষধ যাকে আমরা লাইফ সেভিং ঔষধ বলি। এটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করা অপরিহার্য। রেহনুমা গত সাতদিন যাবত হঠাৎ করে পেডনিসোলন খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ওর শারীরিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। মেডিকেলের ভাষায় এই রোগের নাম 'Iatrogenic cushing syndrome with Adreno cortical failure.' এই ধরনের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। আগেই বলেছি পেডনিসোলন এক মহা ঔষধ। গ্রাম্য চিকিৎসকরা কোনো কিছু না ভেবেই বাত, ব্যথা, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট, মোটা হওয়া এমনকি জ্বরের চিকিৎসায় এই ওষুধ প্রয়োগ করেন। যা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। পেডনিসোলন সেবনে রোগীর লক্ষণ সেরে যায় কিন্তু নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চিকিৎসা শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণে ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই ওষুধ ব্যবহার করেন বলেই অনেকাংশে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়িয়ে চলা যায়।
লেখার শুরুতে আপনাদের সজল ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। এখন উনি চল্লিশ ঊর্ধ্ব। শরীরে ভালোই মেদ জমেছে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু আগের মতোই কর্মঠ এবং প্রাণচঞ্চল। তারুণ্য কাটুক উচ্ছ্বলতায় খেলাধুলা আর হাস্যরসে। সবুজ শাক-সবজি, ফলমূল প্রোটিন আর পরিমিত শর্করা জাতীয় খাবার খেলেই স্বাস্থ্য হবে সুন্দর ও সুঠাম। সুস্থ তারুণ্যই এগিয়ে নিয়ে যাবে আমা
র সবুজ শ্যামল সোনার বাংলাকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। 

লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), সহকারী অধ্যাপক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status