ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

লক্ষ্মীছড়ার লক্ষ্মীছাড়া

সেলিম আউয়াল

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:০৭ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: সুমন রহমান

আমরা যাচ্ছি, যাচ্ছি, আর যাচ্ছি। রাস্তাটা যেন শেষ হচ্ছে না। গাড়িতে বসে চোখ যতদূর যায় চারপাশে সবুজের ছড়াছড়ি। ডানে বামে সামনের ছোট ছোট টিলাগুলো সবুজ চা গাছে মোড়ানো। সবুজ সাগর যেন ঢেউ খেলছে। এমন সবুজ আমার কখনো দেখা হয়নি। শ্রীমঙ্গল শহর ছেড়ে এইভাবে প্রায় পঞ্চাশ মাইল পথ পাড়ি দিই চা বাগানের ভেতর দিয়ে। এইটুকুন পথ পেরিয়ে যেতে নানা নামের কয়েকটি চা বাগানের সাইনবোর্ডের দেখা মেলে।
পিচঢালা রাস্তা হলেও গাড়ি ঘোড়ার তেমন চলাচল নেই। চা বাগানের রাস্তা তো, এমনিই সংরক্ষিত। সব ধরনের গাড়ি চলতে দেয়া হয় না এবং তখন বিকেলটা গড়াচ্ছে। হঠাৎ একটা দুটো জিপ আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। কোনটি ঝক্কর মার্কা, আবার কোনটি বেশ পিনপিনা। ঝক্কর মার্কাগুলো আবার লোকজনে ঠাসা।
ছোট্ট একটি টিলার উপরে লক্ষ্মীছড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলো। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে জিপটা টিলার উপরে ওঠে। আলো ঝলমলে চমৎকার বাংলো। আমার ভগ্নিপতি আনোয়ার বাগানটার ম্যানেজার, ও আমাদের জন্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। জিপটা বাংলোর ঠিক সামনে থামতেই হুড় হুড় করে ক’জন চা শ্রমিক জিপের কাছে ছুটে আসে। ওরাও আমাদের অপেক্ষায়। আমরা কিছু বুঝার আগেই সব ব্যাগপ্যাটরা ওরা গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়।
আমরা লোকজন প্রচুর। বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে চৌদ্দজন। ডিসেম্বর মাস বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে, এজন্যে বেড়াতে আসা। রাত যখন আটটা তখন আমরা লক্ষ্মীছড়া চা বাগান পৌঁছি। প্রায় প্রতিটি চা বাগানের নামের সাথে ছড়া শব্দটি লাগানো থাকে। মালনীছড়া, কেওয়াছড়া, লোভাছড়া। সিলেটে পাহাড়ি খালকে ছড়া বলে। প্রত্যেকটি বাগানই একটি ছড়াকে কেন্দ্র করে উঠেছে। লক্ষ্মীছড়া বাগানেও লক্ষ্মীছড়া নামে একটি ছড়া আছে। বিশাল বারান্দায় কার্পেট বিছানো, তার উপর কয়েকটি সোফা। ছাদের উপর একটি ঝাড়বাতি। এটা ম্যানেজার বাংলোর একটা ড্রইং রুমও। বারান্দার তিনটে দিকই খোলা। চারপাশে নানান ফুলের টব। টবের পর থাকা মাটিতে লাগানো ছোট ছোট ফুলের গাছ। তারপর বড়ো বড়ো নানান জাতের গাছ। ঠাণ্ডাও বেশ ঝেঁকে এসেছে। আর বাগানের ঠাণ্ডা তো যেন এন্টার্কটিকার ঠাণ্ডা। হাতমুখ ধুয়ে একটু ফ্রেস হতেই আমাদের কর্মসূচি শুরু। আজ আবার বড়দিন। লক্ষ্মীছড়া চা বাগানে প্রচুর খ্রিষ্টান আছে। তারা মূলত পৌত্তলিক ছিলো, খ্রিস্টান মিশনারিরা তাদেরকে খ্রিস্টান করেছে। বাগানটায় ছোট্ট একটি গির্জাও আছে। সন্ধ্যার পর গির্জায় অনুষ্ঠান। বাগানের পঞ্চায়েতের প্রধান খ্রিস্টান। আমরা আসছি শুনে আমাদেরকে তাদের অনুষ্ঠানে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
হালকা নাস্তা সেরেই আমরা আমাদের সাথে নিয়ে আসা মাইক্রোবাসে চাপি। সাথে আনোয়ারের জিপও। বাগান পথে খানিকটা ঘুরেই গির্জা। টিন দিয়ে বানানো গির্জাঘর। গির্জার চূড়ায় কাগজ দিয়ে বানানো একটি বড়ো তারকা। ভেতরে লাইট জ্বলছে। ছোট ছোট লাল নীল বাতি জ্বালানো হয়েছে চারপাশে। গির্জার পাশের মাঠে প্যান্ডেল বেঁধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাইক আনা হয়েছে। তাও আবার সাউন্ড সিস্টেম। শুদ্ধ বাংলায় অনুষ্ঠান উপস্থাপনের চেষ্টা করছে একটি তরুণী। তবে তাদের বাগানী ভাষার একসেন্ট চলে আসছে।
বাগানের বড়ো বাবুর সাথে কথা বললাম-এই বাগানে খাসিয়া চা শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এজন্যে খাসিয়া ভাষায় লেখা ছাপানো বাইবেলও তারা ব্যবহার করে। আমরা কিছু সময় বড়দিনের অনুষ্ঠানে বসে আবার ফিরে আসি বাংলোয়। বাংলোর বারান্দায় গানের আসর। জবুথুবু হয়ে চা খেতে খেতে গান শুনছিলাম। আরো কী সব ভাজিভুজি। শীতের রাতে ঝাল ভাজিভুজি খেতে দারুণ লাগে। ঝালের চোটে শীত কেটে যায়। গান গাচ্ছে বাংলোর বাবুর্চির ছেলে সিদ্দিক। বাগানে একটি আশ্রম আছে, সেই আশ্রমের ন্যাড়া মাথার বৈরাগী তার পাশে বসে একতারা বাজাচ্ছিলো। বৈরাগী বাগানেরই শ্রমিক। সিদ্দিক ছেলেটার একটি পা খাটো, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কণ্ঠটা চমৎকার। সে শুধু উকিল মুনসি আর শাহ আবদুল করিমের গান গায়। পরিচিত গান। তবে সবগুলো গানেই সে নিজের কিছু শব্দ, মাঝেমধ্যে উকিল মুনসি আর করিমের নামের সাথে নিজের নামটাও জুড়ে দেয়। তারা কার্পেটে বসে গান করছে। আমরাও তাদেরকে ঘিরে গোল হয়ে বসেছি। চোখ যতো দূরে যাচ্ছে কোথাও কোন মানুষজন নেই। আমাদের থেকে সোজা টিলার অনেক নিচে বাগানের ফ্যাক্টরিতে কয়েকটি লাইট জ্বলছে। বাংলো থেকে দেখা যায়। তার মানে দিনে বাইনোকুলার লাগিয়ে বাংলোয় বসে বসেই ফ্যাক্টরির সবকিছু ফকফকা দেখা যাবে। ফ্যাক্টরিতে এক ঘণ্টা সময়ের পর একজন ঘণ্টা বাজিয়ে সময় জানাচ্ছিলো। এরমধ্যে আমাদের কয়েকটা বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের মায়েরা তাদেরকে বিছানায় শুইয়ে আড্ডায় বসে আছে।
যখন রাত বারোটার ঘণ্টা বাজে আমরা বারান্দা ছেড়ে বাংলোর হল রুমে চলে আসি। এখানে সোফা টোফা ছিলো। সব সরিয়ে কার্পেটের উপর তোষক বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এই রুমটায় আরেকটি সুবিধে এখানে ফায়ার প্লেস আছে। রুমের ঠিক মাঝামাঝি ওয়ালের সাইডে ছোট্ট একটি রুমের মতো ফায়ার প্লেসের কয়লায় আগুন ধরানো হয়েছে। সারা রুমজুড়ে চমৎকার একটি উম। আমরা পুরুষ যারা সবাই হলরুমে আর মহিলাদের থাকার ব্যবস্থা বেডরুমে।
ভোর হতেই চারপাশে মোরগের বাক, আমরা যেন গ্রামে ঘুমিয়ে ছিলাম। গ্রামেও মনে হয় এ ধরনের হয় না। একটি চাদর জড়িয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। রাতে খেয়াল করিনি এখন চারপাশটা ভালো করে দেখি। ম্যানেজার বাংলোটা সবচেয়ে উঁচু টিলাতে। টিলার উপরের সমতল ভূমির অর্ধেক জুড়ে বাংলো। বাকি অর্ধেক ফুল বাগান। ফুলবাগানের শেষ মাথায় গাড়ির গ্যারেজ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বাংলোর সামনের দিকের সমতল ভূমিতে চায়ের ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরির পাশে গাছগাছালি ঘেরা দু’তিনটে বাড়ি। এরমধ্যে একটি একজন এসিসট্যান্ট ম্যানেজারের বাংলো। আর বাকিগুলো বাগানের অফিস স্টাফ আর মাঠ পর্যায়ের সুপারভাইজরদের কোয়ার্টার। হিন্দু মুসলমান এদের সবাইকে বাবু বলা হয়। আর অনেক দূও পর্যন্ত কোন বাড়ি ঘর নেই। চারপাশেই টিলা আর টিলার বুকে কোমর সমান উচু চায়ের গাছ। একটি নির্দিষ্ট সময় পার হবার পর গাছের আগা ছাটাই করা হয়। এজন্যে গাছগুলো উঁচুতে উঠতে পারে না। ডাল কাাঁর পর যে কুঁড়ি বের হয় সেগুলোই তুলে নিয়ে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুকনো চা পাতা হয়। প্রতিটি টিলায়ই চা গাছের চেয়ে উঁচু উঁচু বড়ো বড়ো কিছু গাছ। এগুলোকে ছায়া গাছ বলে। চা গাছগুলো আবার বেশি রোদ সহ্য করতে পারে না। এইসব বড়ো গাছের ছায়া চা গাছের উপর পড়ে গাছগুলোকে শীতল রাখে। আমি বারান্দায় দাঁড়াতেই এক বেয়ারা ছুটে আসে। কাধে গামছা পাতা। আমার থেকে চার পাঁচ হাত দূরে একটু বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে। ওর নাম সুদন। ওর ডিউটি বাংলোতে। আমিও ওদের কাউকেই খুঁজছিলাম।
-কী ব্যাপার আশেপাশে তো কোন বাড়িঘর দেখছি না। কিন্তু এতো মোরগের ডাক শুনলাম, কোত্থেকে আসছে?
সুদন একটু বিনীত হাসে- সাহেব এইগুলা সব বন মোরগের বাক শুনছেন।
-কই এখন তো একটাও দেখছি না।
-সাহেব ভোরের দিকে আবার সবগুলো জঙ্গলে চলে যায়। সেই গভীর জঙ্গলে।
নামাজ সেরে বারান্দায় চা খেতে আসি। বাচ্চারা ঘুমিয়ে। আমরা বড়োরা চা খেতে বসেছি। সমুচা পিয়াজু সব গরম গরম। মনে হচ্ছে ধোঁয়া উড়ছে। বাসায় চিনি ছাড়া চাাঁ কাপেই রেডি করেই দেয়া হয়। শুধু চিনিটা মেশাতে হয়। সাধারণত ডাইনিং টেবিলে বসেই চা খাই। এখানে অবশ্য ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। শাদা উর্দি পরা বেয়ারা চাকা লাগানো একটি টি-টেবিল টেনে নিয়ে আসে। টি-পটে চায়ের লিকার, মিল্ক পটে গুলানো দুধ, সুগারপটে চিনি। আমি টি পট থেকে কাপে চা ঢালতেই চমৎকার সুগন্ধ আর রংয়ে মনটা ভরে যায়। দুধ চিনি ছাড়া শুধু একটু লিকার চাখি। শীতের সকালে দারুণ লাগে। একথা সে কথা বলার পর বন মোরগের কথা তুলি। সবাই হই চই করে ওঠেন-মোরগের ডাকে সবার ঘুম ভেঙ্গেছে। বন মোরগ শোনার পর সবার ইচ্ছে বন মোরগ দেখবেন। আনোয়ার বললো সমস্যা নেই বিকেল হলেই বনমোরগের দেখা মেলে, পাহাড়ের ডালে ডালে বন মোরগকে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। ঠিক আছে বিকেলে সবাইকে নিয়ে জিপে জঙ্গলের একটু ভেতরে যাবো। আমি বললাম বন মোরগ কি খাওয়া যাবে না? আনোয়ার থেমে কী যেন ভাবে-এ দিকের বাগানগুলোর মধ্যে সবচে বেশি বন মোরগ আমার বাগানে। কারণ আমি কাউকে বন্দুক দিয়ে মোরগ শিকার করতে দেই না। মাঝে মধ্যে খুব ভিআইপি গেস্ট হলে তাদেরকে শিকার করতে দেই। তবে বন্দুক দিয়ে নয়, তির ধনুক দিয়ে।
-আমার জন্যে একটু ব্যবস্থা করো না। আমি অবশ্য তির চালাতে পারি না।
-এটা সমস্যা না। আমার বেয়ারা রাখাল আছে। ভালো তির চালায়। মিস হয় না।
-রাখালকে ডাকো। চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ি।
আনোয়ার হাসে-এখন বেরিয়ে বন মোরগ পাবেন না। ভোরে আর সন্ধ্যার দিকে পাওয়া যায়। তবে শিকার করতে হলে প্রচুর হাঁটতে হবে। বন মোরগগুলো একটু গভীর জঙ্গলে থাকে। ওইসব এলাকায় গাড়ি যায় না। আর গাড়ির শব্দ পেলে ওরা আরো উচুতে উঠে যায়। আরো বেশি সতর্ক হয়ে বনের গভীরে লুকিয়ে পড়ে।
শেষমেশ সিদ্ধান্ত হয় দুপুরে একটু আগে ভাগে খেয়েই আমরা বন মোরগ শিকারে ছুটবো। আনোয়ার রাখালকে শিকারে যাবার কথা বলে রাখে। দুপুর এগারোটা সাড়ে ১১টা বাজতেই রাখাল এসে হাজির। কাধ পর্যন্ত ঝুলানো বাবরি চুলটা তেলে জবজবে। শরীরেও তেল মাখা। পরনে একটা পেন্ট আর গায়ে শার্টের সাথে পুরনো একটি কোট। হাতে একটি তির আর কিছু ধনুক। বললাম, আমরা তো দুটোর দিকে বেরবো।
আমরা বাগানে বেড়াতে আসায় আনোয়ার আজ ছুটি নিয়েছে। রাখালকে দেখে হাসে। আমাকে বলে-বুঝলেন না শিকারের কথা শুনেই ওর হাত নিসপিস করছে। বাগানে চা শ্রমিকদের মধ্যে নানা গোত্রের লোক আছে। ও হচ্ছে শরব গোত্রের মানুষ। শিকার হচ্ছে ওদের মূল পেশা। ওদের পূর্ব পুরুষরা সেই উড়িষা বিহার থেকে এসেছে। এদের কিছু চা বাগানে কাজ করে, আর বাকি সবার শিকার করেই দিন চালায়। শিকারের কথা শুনে ওর তর সইছে না, কতোক্ষণে শিকারে নামবে। আমাদের বাগানে আমি সহজে বন মোরগ শিকার করতে দেই না। যাক, রাখাল যখন এসেই পড়েছে, একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যান। তাহলে হাতে অনেক সময় পাবেন।
আমিও তাড়াহুড়ো করে একটু আগেভাগে খেয়ে নিই। শিকারি বলতে পায়ে গাম বুট, কাধে ঝুলানো চামড়ার বেল্টে গোল ডিবার মতো কার্তুজ আর কাধে ঝুলানো বন্দুক তেমনটি নয়। আমার পায়ে শুধু একটি ক্যাডস। নরমাল সার্ট পেন্ট, গায়ে একটি জ্যাকেট, মাথায় একটি ক্যাপ। বাড়তির মধ্যে একটি বাইনোকুলার। আসলে শিকারি হচ্ছে রাখাল, আর আমি হচ্ছি তার সহযাত্রী। রাখাল শিকারি জাতির লোক হলেও দু’হাজার সতের সালে এসেও ওরা সেই আদিম স্টাইলে তীর ধনুক দিয়ে শিকার করে। ওর ভাই বেরাদরেরা প্রতিদিনই বনে শিকার করতে যায়। হাতের সামনে যে প্রাণীই পায় শিকার করে। ওদের মধ্যে আরো কিছু লোক আছে ওরা কুচিয়া, কচ্ছপ, কাকড়া শিকার করে। পানিতে হাঁটলেই ওরা বুঝে ফেলে কোথায় কুচিয়া মাছ আছে। ওদের কাছে হাতলওলা লম্বা লম্বা ধারালো রড থাকে। সেই রড দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে কুচিয়া মাছ শিকার করে। রাখালের বাবাও শিকার করতো। ওর দাদাও ছিলো শিকারি। একবার শিকার করতে করতে রাখালের দাদা  চলে যায় গভীর জঙ্গলে। সেখানে পড়ে বাঘের খপ্পরে। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা একটি বাঘ তাকে আক্রমণ করে। ওর দাদাও কম না, শুরু করে বাঘের সাথে যুদ্ধ। ওর দাদার সাথে গ্রামের একজন লোক ছিলো। সে লোকালয়ে এসে বাঘে ধরার খবর দেয়। লাঠি বর্শা নিয়ে দশ বারোজনের একটি দল যখন সেখানে যায়, দেখে মাটিতে রাখালের দাদার ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে আছে আর তার পাশে মরে পড়ে আছে সেই বাঘটি।
হাঁটতে হাঁটতে রাখালের কাছ থেকে এইসব গল্প শুনতে শুনতে জিগ্যেস করি-তুমি কি এই ধরনের কোন সমস্যায় পড়েছো?
রাখাল হাসে-না সাহেব। সেই জঙ্গল আছে নাকি। বাঘ ভাল্লুক এখন মানুষ দেখলে পালিয়ে বেড়ায়। এই বান্দরগুলা একটু দুষ্টামি করে।
ম্যানেজার বাংলো আর ফ্যাক্টরির আশেপাশে সবগুলো টিলাতেই চা গাছ লাগানো। রাস্তাগুলোও বেশ বড়ো। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট খাল। চার-ছ’ আঙ্গুল উচ্চতায় পানি যাচ্ছে। বড়ই স্বচ্ছ সে পানি। রাস্তার পাশের ছোট ছোট ঝোপে প্রজাপতির ওড়াওড়ি। আমি আর রাখাল হাঁটছি আর গল্প করছি। মাঝে মধ্যে হঠাৎ একজন দুজন চা শ্রমিকের সাথে দেখা হচ্ছিলো। বেশ অবাক হয়ে ওরা আমাকে দেখছিলো। তারপর রাখালের দিকে তাকাচ্ছিলো। রাখাল চোখের ইশারায় কী বুঝাচ্ছিলো। মনে হয় বুঝাচ্ছিলো-ভিআইপি গেস্ট। চুপচাপ চলে যাও। ওরাও মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিলো। রাখাল আমার আগে আগে হাঁটছে। রাখাল খুব জোর তালে হাঁটলেও মনে হচ্ছিলো কেমন হেলে দুলে হাঁটছে। আমার যদি মর্নিং ওয়াকের অভ্যাস না থাকতো তাহলে ওর সাথে হাঁটতে হিমশিম খেতে হতো। মাইল দুয়েক বোধ হয় হেঁটেছি। রাস্তাটা এখন আগের চেয়ে চিকন হয়ে এসেছে। কিছুদূর যাবার পর সেই পিচঢালা পথও নেই। মাটি বিছানো রাস্তা। এ দিকের সবগুলো টিলায় চা গাছ লাগানো নয়। কোন কোন টিলাতে চা গাছ লাগানো, আবার বেশির ভাগ টিলাতে ঘন জঙ্গল।
-কী রাখাল আর কতদূর হাঁটবো, কোন জায়গায় শিকার করবে?
রাখাল হাসে-সাহেব আর বেশি দূর না। এই তো চলে আসছি। এইভাবে দুয়েকটি মোড় নিয়েই একটি লোহার ঝুলন্ত সেতু। নিচ দিয়ে বয়ে চলছে একটি ছড়া। ছড়ার পানি খুব স্বচ্ছ। ব্রিজে দাঁড়িয়ে পানির নিচের বালিও দেখা যাচ্ছে। ছড়ায় পানি বেশি নেই। এই হাঁটুজল পরিমাণ হবে। ব্রিজটি রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত ব্রিজের মতো। ব্রিজটি পার হয়ে কিছু দূর যাবার পর ছোট একটি বাজার। বাজার বলতে গ্রাম্য বাজার না। আরো ছোট আকারের একটি বাজার। কোন স্থায়ী দোকান নেই। দু’তিনটে চারপাশ খোলা শেড। বাঁশের খুটি, চালে শন বিছানো। বাজার থেকে বের হবার পথে ময়লা ধরনের পাঞ্জাবি ধুতি পরা একটি লোক ছোট একটি দেবমূর্তি নিয়ে বসা। মূর্তির সামনে একটি কাপড় বিছানো। দুয়েকজন আট আনি, এক টাকার কয়েন ছুড়ে দিচ্ছিলো লোকটির দিকে। আজ ওদের পেমেন্ট ডে। ওদেরকে প্রতি সপ্তাহের বুধবারে বেতন আর রেশন দেয়া হয়। রেশন কিছু না, শুধু আটা আর চা পাতা। পেমেন্ট পেয়েই টুকটাক বাজার সদাই করে। মদের দোকানের বাকী টাকা শোধ করে মজা করে মদ খাবে। এখন বেতনের টাকাাঁ দেশের প্রচলিত মুদ্রা দিয়ে দেয়া হয়। আগে বড়ো বড়ো বাগানের নিজেদের এক ধরনের মুদ্রা ব্যবস্থা ছিলো। বাগানের মালিক পক্ষ শ্রমিকদেরকে বেতনের দিন দেশের প্রচলিত মুদ্রা না দিয়ে নিজেদের প্রচলিত টি কয়েন দিতো। সেই কয়েনগুলো তামা লোহা দিয়ে বানানো। কোনটি ছিলো গোল, কোনটি চারকোণে, কোনটি ডিমের মতো। এইসব মুদ্রা দিয়ে সেই বাগানের এরিয়ার দোকানে কেনাকাাঁ করা যেতো। সেইসব টি-কয়েন অবশ্য নিজেদের বাগানের বাইরে চলতো না। ভারতের নাগাপুর, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার এইসব জায়গা থেকে আসা চা শ্রমিকরা এইভাবে সেই বাগানটির মধ্যেই নিজেদের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
ছোট্ট হাঁটার একদিকে দু’তিন জন ছোট চাঙ্গায় করে মাছ নিয়ে এসেছে। একজন আটা বেচছে। দুজন এসেছে খই মুড়ি নিয়ে। একজন পুরনো কাপড় নিয়ে। মাছওলাদের কাছে তিনজন শরব দাঁড়িয়ে। একজন নিয়ে এসেছে বড়ো সাইজের তিনটে কচ্ছপ, একজনের ঝুড়িতে কয়েকটি কুচিয়া আর একজন দুটো সজারু নিয়ে এসেছে। সজারুগুলো জীবিত। সারা শরীর জুড়ে কাাঁ। পিঠের কাাঁর উপর ছোট্ট এক টুকরো কলাগাছ গেথে রেখেছে। সজারুগুলো নড়তে পারছে না। শরবগুলোর সাথে রাখাল টুকটাক কী কথা বলে। সবাই আমাকে সালাম করে। মাছওলার কাছে দুটো বিশাল শোল মাছ, নড়াচড়া করছে। এতো বড়ো শোল মাছ আমি দেখিনি। শোল মাছ আমার ভীষণ প্রিয়। বিশেষ করে শোল মাছ পুড়িয়ে কাচা লাই পাতা দিয়ে ভর্তা খেতে দারুণ লাগে। শহরে গ্যাসের চুলোয় মাছ পোড়া যায় না। রাখালকে দিয়ে দাম করাচ্ছিলাম। দাম যা চায়, সেটা অবাক হবার মতো। শহরে আটশ টাকা বললেও দরদাম করতাম না। কিন্তু এই লোকটা দামই হাকলো পাঁচশ টাকা। কী বলবো। বললাম চারশ টাকা। বলতেই বললো ঠিক আছে। মনে হলো লোকটা খুব খুশী। কারণ এই এলাকায় এতো টাকা দিয়ে মাছ কিনে খাবার লোক নেই। চা শ্রমিকরা দুধ চিনি ছাড়া একটু চা, এক আধখান রুটি আর চাল ভাজা আর মাঝে মধ্যে একটু ভাত হলেই খুশী। আর সবকিছুর পর ভাত পঁচিয়ে বানানো হাড়িয়া নামের একটু মদ সন্ধ্যেবেলা গলায় ঢালতে পারলেই জীবনটা ধন্য। এতো টাকা দিয়ে শোল মাছ কিনে কী হবে।
আমরা বন মোরগ শিকারে যাচ্ছি, মাছগুলো করবো কী। বিষয়টি রাখালকে বলতেই বললো, সমস্যা নেই। আমরা শিকার থেকে না আসাা পর্যন্ত মাছ নিয়ে ওরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। আমরা আবার হাঁটতে শুরু করি। রাখাল আশ্বাস দেয় আর বেশি না, খানিকটা হাঁটলেই ঘন জঙ্গল পাবো। সত্যি কিছুদূর হেঁটেই পেয়ে যাই ঘন জঙ্গল আর বড়ো বড়ো গাছগাছালি। হঠাৎ দেখি আমাদেও থেকে খানিক সামন দিয়ে একদল বাঁদর রাস্তা পার হচ্ছে। বড়ো সুশৃংখলভাবে। একজনের পেছনে আরেকজন। সবচে বড়ো সাইজের লাল রঙের একটা বানর সবার পেছনে। রাখাল হাত ইশারায় আমাকে থামতে বলে। আমরা দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বানরদের রাস্তা পাড়ি দেয়া দেখি। ওরা রাস্তা পাড়ি দিয়েই লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তার পাশের ছড়াটি পার হয়। আমরা হাঁটতে শুরু করি।  রাখাল বলে, বানরগুলো বড়ো বেয়াড়া। বিগড়ে গেলে খাবলে চোখটোখ তুলে ফেলবে। আমরা যখন বানরগুলোর কাছাকাছি চলে আসি, তখন বানরগুলো গাছে উঠে গেছে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে ছোটাছুটি করছে, ডাল ভাংছে। রাখালের সবকিছু চেনাজানা। আমার কাছে চারপাশটা জঙ্গলময় মনে হচ্ছিলো। কিন্তু রাখাল ক্যামন লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছিলো। আমি ওর পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে বুঝছিলাম এগুলোও এক ধরনের রাস্তা। গায়ের সাথে গাছের ডালপালা লাগছিলো, আমি হাঁটতে পারছিলাম না। রাখালকে ডাকতেই সে ঠোঁটে হাত দিয়ে আমাকে চুপ থাকতে ইশারা দেয়। আমরা চুপচাপ আরো কিছু সময় হাঁটি। এদিকে জঙ্গল আরো ঘন হয়ে উঠেছে। চারপাশে কী সব গাছগাছালি চিনতে পারছিলাম না। বনের একটি গন্ধ আছে, তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম। কয়েকপা হেটেই রাখাল হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। বাঘটাগ কিছু নাকি? রাখালের চোখ গাছের দিকে, আমার চোখে কিছু ধরা পড়ছিলো না, সাপ নাকি! রাখাল তার তির ধনুক তাক করে। ওর চোখকে ফলো করে গাছের ডালে চোখ রাখি। অবাক আনন্দে মনটা নেচে ওঠে। গাছের ডালে একটি বন মোরগ দাঁড়িয়ে। আমি কখনো বন মোরগ দেখিনি এই প্রথম দেখা। সাধারণ মোরগ আর বন মোরগের মধ্যে আমার কাছে পার্থক্য মনে হয়-বনমোরগগুলো একটু লম্বাটে টাইপের।
রাখাল ধনুকের ছিলায় তির বসিয়ে দুহাত দিয়ে টান টান করে, রাখালের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা। ওকে এখন যেন অন্য এক মানুষ মনে হচ্ছে। আমার চোখে পলক পড়ছিলো না। পলকহীন চোখ গাছের ডালে দাঁড়ানো মোরগটার দিকে তাকিয়ে। হালকা একটু নড়াচড়া করছে। তারপর ক্যামন শো করে একটু শব্দ হয়। রাখালের ছুড়ে দেয়া তিরটা লাগে মোরগের গায়ে। মোরগটা প্রাণপণে ডেকে উঠে কক্‌ কক্‌। তার ডাকে আশেপাশের আরো ক’টি মোরগ কক্‌ কক্‌ শব্দ তুলে প্রাণ হাতে ছুটে পালায়। তির খাওয়া মোরগটা গাছের নিচে পড়ে ছটফট করতে থাকে। দৌড়ে গিয়ে রাখাল মোরগটাকে ধরে। মোরগটা প্রাণপণে ছটফট করছে। রাখাল খুব কায়দা করে তিরটা মোরগের গা থেকে বের করে। মোরগটা তখনো ছটফট করছে। রাখাল ছোট্ট একটি ছুরি আমার হাতে দিয়ে বলে, সাহেব মুসলমানি জবাই দেন। ও মোরগটার পা আর ডানা ধরে আমি আল্লাহু আকবর বলে  গলা কাটি। মোরগটা অনেক সময় ছটফট করে ঠাণ্ডা হয়। মাটি থেকে তুলে নিই। বনমোরগ আর ঘরে পোষা মোরগের মধ্যে আরেকটা পার্থক্য চোখে পড়ে-বনমোরগের দু পায়ে প্রায় দু ইঞ্চি লম্বা দুটো শক্ত নখ। এই নখ দিয়ে সে আত্মরক্ষা করে। ঘরের মোরগের পায়ে এ ধরনের নখ থাকে না। রাখালের সাথে চার পাঁচ হাত লম্বা একটি লাঠি। ওর কাছে মাছ ধরার জালের মতো জাল দিয়ে বানানো ছোট্ট একটি ব্যাগ। জবাই করা মোরগটি সেই ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর ব্যাগটা লাঠির আগায় বেধে কাধে তুলে নেয়।
আমরা আবার হাঁটি। এদিকে জঙ্গল আরো ঘন হচ্ছে। প্রথম দিকে যে পরিমান আলো গাছের পাতা-ডাল গলিয়ে বনে ঢুকছিলো, এখন তেমনটি নেই। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসছে। সেই সাথে পাখপাখালিরও হাকডাক বেড়েছে। এই ডালে ওই ডালে পাখি বসা। ডানা ঝাপটাচ্ছিলো কোনটি, আর কোনটি গাইছিলো গান। অবাক হচ্ছিলাম, ছোট সাইজের দুয়েকটি পাখি এতো জোরে চিৎকার করছিলো। ভাবাই যায় না, এতো ছোট্ট পাখি এতো জোরে ডাকতে পারে। নীড়ে ফেরা নানান জাতের পাখিরা হাকডাক দিয়ে বনকে মাতাল করে তুলেছে। রাখালের মধ্যে কেমন যেন এক ধরনের উন্মাদনা। ও এখন আর কথা বলছে না। ওর সব কথা এখন হাত আর চোখ ইশারায়। আমি রাখালের সাথে হাঁটি আর তার ইশারা নির্দেশগুলো পালন করতে থাকি। রাখাল গাছপালা ছুঁয়ে হাঁছে, কিন্তু কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। আমিও রাখালের মতো শব্দহীন হাঁটার চেষ্টা করছিলাম, যদিও তার মতো হচ্ছিলো না। তবুও আমি খুব চেষ্টা করছিলাম শব্দহীন হাঁটতে।  খানিক আগে মোরগটা তিরবিদ্ধ হবার পর জঙ্গলে এক ধরনের ছুটোছুটির মতো সাড়া হচ্ছিলো, এখন তেমনটি নেই। বন আবার সেই আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমি হাঁটছিলাম আর বড়ো বড়ো গাছের ডালপালা দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি একটি গাছের ডালে ছোট একটি মোরগ। আমি ফিস ফিস করে রাখালকে ডেকে মোরগ দেখাতেই রাখাল সেই আগের মতো ঠোঁটে হাতে রেখে আমাকে চুপ থাকতে ইশারা দেয়। তারপর হাতটা দুরের দিকে ইশারা করে। বেশ দূরে জঙ্গলের একটি খালি জায়গায় একটি মোরগের সাথে কয়েকটি বাচ্চা ঘাস খুটে খুটে খাচ্ছে। রাখাল সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে হাঁটছে আর গাছের ডালে ডালে চোখ রাখছে। আমিও রাখালের সাথে সাথে হাঁটছি। হঠাৎ রাখাল সেই আগের মতো থমকে দাড়ায়। আমি রাখালের চোখ অনুসরণ করে গাছের ডালে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। চোখে দেবার সুরমা কালারের মধ্যে ফুটফুটে শাদা বুটি তোলা একটি তিতর পাখি। রাখাল ধনুক তাক করে এবার আমি রাখালের মুখ ভালো করে দেখি। ওর চোখ মুখ, হাতের পাতার প্রতিটি রগের যেন টান টান অবস্থা। সেই আগের মতো শো করে একটি শব্দ হয়। তারপর তিরটা সোজা তিতরের গায়ে। তবে তিতরটা সেই মোরগের মতো এতো ছটফট করে না, তার আগেই মাটিতে পড়ে যায়। আগের মতোই ছুটে গিয়ে জবাই করি।
আমরা জঙ্গলের অনেক গভীরে। আমি একা হলে তো এতো ভেতরে আসতামই না। জঙ্গলটা এখন আরো ঘন। এখানে বাঘটাগ আছে নাকি, রাখালকে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছিলো। আমি শুধু ‘রাখাল’ শব্দটা  বলতেই, সে আগের মতো ঠোঁটে আঙ্গুল রাখছিলো। হঠাৎ মনে হলো আমার পায়ের উপর দিয়ে সির সির করে ঠান্ডা কি একটা প্রাণী যেন চলে গেলো। সাপটাপ নাকি। আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু রাখালের গোল গোল চোখগুলোর দিকে তাকাতে ক্যামন যেন ভয়ও করছিলো। এইভাবে রাখাল আরেকটি মোরগ শিকার করে। বাইরে এখন আধার না নামলেও বনের ভেতর বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। আগের মতো আর ডালপালা দেখা যাচ্ছে না। রাখাল একটি গাছের বড়ো ডালে বিশাল একটি মৌচাক দেখায়। তারপর বলে, সাহেব চলেন অন্ধকার হয়ে গেছে। মোরগ টোরগ দেখা যাবে না। আর আপনি হাঁটতেও পারবেন না।
তারপর সেই আগের মতো রাখালের পেছন পেছন হেঁটে আমরা জঙ্গল থেকে বের হই। তখন জঙ্গলের বাইরেও বেশ অন্ধকার। অন্ধকার নেমে এলেও অসুবিধে নেই। এখন আমরা মূল রাস্তায় চলে এসেছি, জঙ্গল ছেড়ে। হাঁটতে হাঁটতে সেই বাজারটার কাছে আসি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো একটি মশাল জ্বলছে। রাখাল বলে, সাহেব অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওই দেখেন ওরা মশাল জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের এখানে সন্ধ্যার আগেই বাজার শেষ হয়ে যায়।
আমরা বাজারে গিয়ে দেখি সেই মাছওয়ালা আর তার সাথে আরেকটি লোক আমাদের অপেক্ষা করছে। লোকজন আর নেই। শুধু একপাশে ছোট্ট একটি বাতি জ্বালিয়ে দুতিনটে লোক বসে আছে। ওদের দিকে চেয়েই অন্ধকারেই মনে হলো রাখালের চোখগুলো চিকচিক করে উঠেছে। আমাকে খুব বিনীতভাবে বললো, সাহেব বিশটা টাকা হবে। মনে মনে বলি-আরে বিশ টাকা বলছে কেন, একশ টাকা বললেও দিতে কোন দুঃখ নেই। আজ রাখাল যা এডভেঞ্চার করেছে। আমি তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ থেকে বিশ টাকার একটা নোট রাখালের হাতে তুলে দিয়ে বলি, আর লাগবে। রাখাল আমার চেয়ে আরো বেশি খুশী-না সাহেব এতো টাকা লাগবে না।
রাখাল মাছওলাকে একটা ধমক লাগায়-এই মাছটা ভালোভাবে বেঁধে দে। সাহেব আপনি দাঁড়ান। আমি আসতেছি।
আমাকে রেখে রাখাল সেই কুপির কাছে বসা লোকদের কাছে যায়। মাছওলা শক্ত একটি বেত মাছের এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে। এইভাবে দুটো মাছেরই কানকা দিয়ে বেত ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে মাছ বাঁধে। ওদেরকে টাকা দেবার পরও মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটি বাঁশের আগায় কেরোসিন জ্বলছে। তেল বোধ হয় বেশি নেই। শিখার তেজ কমে আসছে। তখন একজন মশালটা হাতে নিয়ে  আগুনের শিখাটা নিচের দিকে নামিয়ে আবার তুলে ধরে। শিখাটা আবার তেজী হয়ে ওঠে। এভাবে বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে রই। কিন্তু রাখালের পাত্তাই নেই। ওদেরকে বলি, রাখাল কই। ওরা খুব স্বাভাবিকভাবে বলে, পানি খেতে গেছে। প্রথম বুঝতে পারিনি। প্রায় আধ ঘণ্টা পর যখন রাখাল টলতে টলতে আসলো তখন বুঝলাম রাখাল কোন পানি খেতে গিয়েছিলো। আমার কাছ থেকে বিশ টাকা নিয়েই ঘরে বানানো ‘হাড়িয়া’ নামের মদ গিলেছে।
কাছে এসেই মাছওলাকে ধমক লাগায়, এই ঠিকমতো মাছ বেধেছিস তো। ইচ্ছে হয়েছিলো ধমক লাগাই, কিন্তু ওর এখন যা অবস্থা, উল্টো আমাকে বললো-মাছ আপনার হাতে থাকুক। আমার এক হাতে তির আর আরেক হাতে মোরগ। আমি মাছওলার কাছ থেকে মাছটা হাতে নিতেই ও মাছওলাকে ধমক লাগায়-এই পয়সা পাইছস তো যা এখন হাড়িয়া খা। তারপর সোজা বাড়ি যাবি।
আমরা হাঁটা শুরু করতেই মাছওলা মশাল নিয়ে হাড়িয়াওলার দিকে চলে যায়। তখন অন্ধকার বেশ জেকে বসেছে। আমি বললাম- রাখাল বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।
রাখাল আমাকে অভয় দেয়- সাহেব ভয় পাবেন না। আমি আছি না। চোর ডাকাইত কিছুই আমার সামনে আসবার সাহস নাই।
বেশ অন্ধকার হয়েছে। সাথে হালকা কুয়াশা। রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ে একটা দুটো জোনাক পোকার আলো জ্বলছিলো আর নিভছিলো। অন্ধকারে মনে হচ্ছে রাতটা বোধহয় অমাবশ্যা, বেশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাখাল আমার সামনে সামনে হাঁটছে আর বিড়বিড় করে কী বলছে। মাঝে মাঝে হেড়ে গলায় গান ধরছে। আমি শুধু রাখালকে ফলো করছিলাম আর পা চালাচ্ছিলাম আশেপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বনের অন্ধকারে জোনাক পোকার আলো ক্যামন ভূতুড়ে অবস্থা তৈরি করছিলো। এই অন্ধকারে একা থাকলে আমি ভয়ে মরেই যেতাম। রাখাল থাকায় কোন ডর ভয় করছিলো না। মাঝে মাঝে গানের মতো সুর করায় মজাই লাগছিলো। আমার সামনে সামনে একটি লোক হেড়ে গলায় গান গাইছে আর আমি তার পেছন পেছন মাছ হাতে হাঁটছি-শহরে যদি এ ধরনের দৃশ্য হতো, আমি লজ্জায় মরে যেতাম।
দেখতে দেখতে আমরা একসময় সেই ঝুলন্ত সেতুর কাছে চলে আসি। বুঝলাম রাখাল মাতাল হলেও তালে ঠিক আছে, অন্ধকারে রাস্তাটা ঠিক ঠিক চিনতে পারছে। ব্রিজে পা রাখতেই ক্যামন একটি পচা গন্ধ। প্রচণ্ড পচা গন্ধ। এমন পচা গন্ধ আগে কোনদিন পাইনি। মনে হয় পচা কোন পশুকে অন্য পশুরা টানা হেচড়া করছে। নাড়িভুঁড়ি যেন ছিড়ে আসছে। হঠাৎ মনে হলো প্রচন্ড গন্ধসহ একটি বাতাস আমার শরীরের সাথে ধাক্কা খেলো। আমি পড়েই যাচ্ছিলাম। তখুনি বাতাসে ভেসে এলো মাছ পোড়ার একটি গন্ধ। রাখালকে ডাক পাড়ি-এই রাখাল..। ও হাঁটছে তো হাঁটছে। দুবার ডাক দেবার পর ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে- সাহেব ডর মাত। হামি আছে না। বুঝলাম ওকে ডেকে লাভ নেই। পা চালিয়ে হাঁটি। ব্রিজ ছেড়ে কিছুদূর আসতেই দেখি গাড়ির হেডলাইটের আলো আমাদের দিকে আসছে। দ্রুত গাড়িটা আমাদের কাছে চলে আসে। দেরী হচ্ছে দেখে আনোয়ার জিপ নিয়ে আমাদেরকে খোঁজতে বেরিয়েছে।
আমি জিপে উঠার সময় আনোয়ারকে মাছ দুটো দেখাবার জন্য হেডলাইটের সামনে মাছ তুলে ধরতেই দুজনই অবাক। আমার হাতে ধরা বেতের মধ্যে মাছের দুটো কংকাল ঝুলে আছে।
আনোয়ার অবাক হয়ে একটা চিৎকার করে ওঠে-দাদা ভাই, আশ্চর্য! তারপর ঝটপট নিজেকে সামলে নেয়-কাঁটাগুলো ফেলে দেন।
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। কাঁটাগুলো ছুড়ে ফেলে গাড়িতে ওঠি। আমি অনেক সময় কোন কথা বলতে পারি না। অবাক লাগে, আমি নিজে মাছ কিনলাম। মাছ দুটো আমার হাতে। মাছগুলো নিয়ে আসার সময়ও নড়াচড়া করছিলো আর এখন শুধু কাঁটা।
গাড়িতে ওঠার অনেকক্ষণ পর আমি আনোয়ারকে জিগ্যেস করি, বুঝলাম না মাছগুলো আমি নিজে কিনলাম, মাছগুলো আমার হাতে ছিলো আর এখন দেখি কাঁটা।
আনোয়ার বিষয়টি হালকা করে- কিছু না। মনে হয় কোন পোকা খেয়ে ফেলেছে।
জিপটা সোজা বাংলোয় উঠে যায়। বাংলোর পাশে বাগানে বারবি কিউ পার্টি হচ্ছে। পাহাড়ি পরিবেশ আনার জন্যে বাংলোর সবগুলো লাইট নিভিয়ে কয়েকটি মশাল জ্বালানো হয়েছে। অমাবশ্যার অন্ধকারে মশালের আলো মুখে পড়ে সবার মুখ ক্যামন চকচক করছে। একপাশে ইসহাক মিয়া বাবুর্চি কয়লার উপর শিকে গাথা মাংসের গায়ে চামচ দিয়ে তেল মশলা ঢালছে। আর আস্তে আস্তে শিকগুলো উল্টে পাল্টে দিচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে কয়লার গায়ে হালকা বাতাস দিচ্ছে। দুতিন বছর হলো ইসহাক মিয়া বাগান থেকে রিটায়ার্ড করেছে। তার  বাপও বাগানে কাজ করতো। তবে তাদের মূল বাড়ি বরিশাল। চা বাগানগুলোতে এখন দেশের বিভিন্ন জেলার লোকজনও কাজ করে। এজন্যে সাওতাল বস্তি, উড়িয়া বস্তির পাশাপাশি নোয়াখালি, কুমিল্লার লোকদের নিজের আলাদা আলাদা বস্তি গড়ে উঠেছে। সেই সব বস্তির নাম নোয়াখালী লাইন, বরিশালি লাইন- এই ধরনের। বাগানের চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করলেও আনোয়ার নিজে আলাদা বেতন দিয়ে ইসহাক মিয়াকে রেখে দিয়েছে। খুব ভালো রান্না করে আর বিশ্বাসী মানুষ। বাগানে থাকলেও ইসহাক মিয়ার মুখটা কিছুটা ফরসা ধরনের। মুখে হালকা দাড়ি। কয়লার আগুন মুখের উপর পড়ে ক্যামন একটি লাল আভা তৈরী করেছে। আমাদের জিপ দেখে সবাই ছুটে আসে। বাবুর্চি দ্রুত শিকগুলো উল্টে দিয়ে চুলো ছেড়ে আমার কাছে ছুটে আসে-মামা কয়টা মোরগ মারলেন। ইসহাক মিয়া আমাকে ‘সাহেব’ বলে না, মামা ডাকে। আমি রাখালের কাছ থেকে মোরগগুলো নিয়ে তার হাতে তুলে দিতে দিতে বলি-ওই বাজার থেকে দুটো শোল মাছ কিনেছিলাম। বাজার থেকে কিছুদূর আসার পর দেখি মাছ নাই খালি কাঁটা।
ইসহাক মিয়া বাবুর্চির কাছে যেন প্রশ্নের জবাব রেডি ছিলো। একটু হাসে-ও ওই লোহার পুল দিয়া আইছেন। বুঝছি লছমি ভূত খাইয়া ফেলছে। আইজকা তো আবার অমাবশ্য।
তারপর সেই বাবুর্চি আর আনোয়ারের কাছ যা শুনলাম-ব্রিটিশ আমলে লোহার ব্রিজটি বানানো হয়েছিলো। ব্রিজ বানাতে আসা এক ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার কার্টারের সাথে লছমি নামের এক চা শ্রমিকের প্রেম হয়। তাদের বিয়েও হয়েছিলো। লছমির একটি মেয়েও হয়েছিলো। এক সময় ব্রিজের কাজ শেষ হয়ে গেলে হঠাৎ একদিন কার্র্টার চলে যায়। আর কোনদিন ফিরে আসেনি। লছমি প্রতিদিন বাচ্চা কোলে ব্রিজে এসে কার্টারের জন্যে অপেক্ষা করতো। তখন ১৯২০ সাল। সিলেটের সকল চা বাগান থেকে হাজার হাজার শ্রমিক নিজেদের দেশে ফিরে যাবার জন্যে, ‘মুলুক চল’ নামের একটি আন্দোলন করে। তারা চা বাগান থেকে বেরিয়ে পড়ে। চা বাগানের মালিকরা দেশে ফিরতে আগ্রহী এসব শ্রমিককে আটকাতে নানান ফন্দি করে। বিভিন্ন স্থানে তাদেরকে বাধা দেয়। সিলেট থেকে চাঁদপুর ট্রেনে যেতে হয়। কিন্তু তাদেরকে ট্রেনে উঠতে দেয় না। কিন্তু শ্রমিকরাও থেমে থাকে না। তারাও রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে সিলেট থেকে চাঁদপুর যায়। চাঁদপুরে তারা গোয়ালন্দগামী স্টিমারে উঠতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদেরকে  উঠতে দেয়া হয়নি। পুলিশ গুলি চালিয়ে অনেক শ্রমিককে হত্যা করে। তারপর শ্রমিকরা চাঁদপুর রেলওয়ে ইয়ার্ডে জমা হয়। ব্রিটিশের গুর্খা সৈন্যরা আবার গুলি চালিয়ে আরো অনেক শ্রমিককে হত্যা করে। ‘মুলুক চল’ আন্দোলন করতে করতে শত শ্রমিক যখন বাগান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো, সেইসব শ্রমিকদের সাথে লছমির মা বাবা চলে যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারা লছমিকে নিতে পারেনি। শেষমেশ তারা লছমিকে ফেলে চলে যায়। লছমি তার মেয়েকে নিয়ে বাগানে একা একা থাকে। চাঁদপুরে গুর্খা সেনাদের গুলি বর্ষণের পর  চা শ্রমিকরা আবার নিজেদের বাগানে ফিরে যায়। সেই কারণে লছমির মা বাবাও আরো অনেকের সাথে লক্ষীছড়া বাগানে ফিরে এসেছিলো। এসে দেখে লছমি তার মেয়ে নিয়েই আছে। প্রতিদিন চলে আসে ব্রিজের কাছে। তার পুরো দিন কাটে সেই লোহার ব্রিজে। একসময় লছমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কোলের মেয়ের প্রতি কোনো খেয়াল বা নজর নেই। তখন মেয়েটি লছমির মার কাছে বড়ো হতে থাকে। এইভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন সকালে দেখা যায় ব্রিজের রেলিংয়ে লছমির গলায় ফাঁস লাগানো লাশ ঝুলছে। তারপর প্রায়ই অমাবশ্যার রাতে কেউ কেউ লছমিকে দেখে ব্রিজের রেলিংয়ে হাঁটছে। যারা জানে অমাবশ্যার রাতে ভুলেও কেউ মাছ নিয়ে লোহার ব্রিজ পাড়ি দেয় না।
পরের দিন সকালে আনোয়ার সেই লছমির মেয়ের মেয়ে, মানে লছমির নাতিকে ডেকে আনে। নাতিও বুড়ো হতে চলেছে। নাতির সাথে ওর ছেলেও ছিলো। ছেলেকে দেখে কেউ বলবে না ও একজন চা শ্রমিক। চা শ্রমিক বলতে আমরা সাধারণ কালো কালো রংয়ের মানুষই বুঝি। কিন্তু লছমির নাতির ছেলের গায়ের রং ফর্সা, চোখগুলো পিঙ্গল। নাম রবার্ট এবং ধর্মে খ্রিস্টান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status