ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিচিত্রিতা

সংবাদপত্রের অপরিহার্য অধ্যায়

মোবারক হোসেন

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:৪৭ পূর্বাহ্ন

একটি ছবি হাজার শব্দের পরিব্যাপ্তি। হাজার শব্দের প্রতিবেদনে যা ব্যক্ত করা যায় না, একটি মানসম্পন্ন ছবির মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি ব্যক্ত করা যায়। আরেকটু বিশ্লেষণ করলে এভাবে বলা যায়, হাজার শব্দের প্রতিবেদন যতটা না পাঠককে আর্কষণ করতে পারে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি একটি ছবি পাঠকের ভাবনায় ঢেউ ভাঙে। গণমাধ্যমজগতে এমনই এক চিন্তা-সত্তা বহু আগে থেকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রখর অনুভূতির প্রবীণ গণমাধ্যমবিদরা এ প্রয়োজনীয় সত্তাটি সংবাদপত্রে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে গেছেন।
যে ছবি প্রথম দর্শনে নিরীক্ষণী দৃষ্টি কাড়ে, মানুষকে আবেগী করে, বিশ্লেষণী চেতনায় তাড়না জায়গায়, কিংবা ক্ষণিকের দৃষ্টিপাতে পাঠককে উদাস করে দেয়- নিবন্ধে সেই মানের ছবির কথাই বলা হচ্ছে। চিত্র-সাংবাদিকতা এরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাত্রা শুরু করেছে।
এখন সংবাদপত্রে অনেক বিভাগের মধ্যে ‘ফটো সেকশন’ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে সব দৈনিকে চিত্র-সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত বিভাগ হিসেবে নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা সুদৃঢ় করেছে। কিন্তু এর যথাযর্থ ব্যবহার কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে- সেটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। জমজমাট ফটো সেকশন আছে কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এর যথাযথ কার্যকারিতার অবনমন হয়েছে- এমনটা ভাবলে চিন্তার আঁকাবাঁকা রেখাগুলো উঁকি-ঝুঁকি মেরে সামনে এগিয়ে আসে। দৃষ্টির ধূসর সীমানায় অসঙ্গতির জিজ্ঞাসা চিহ্নগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে নড়েচড়ে ওঠে।
সংবাদপত্রে ছবি তোলার কাজটির কৌতূহলী অভিযাত্রাকে যারা শখের বসে স্বীয় সত্তায় ধারণ করেছেন, পরে তারাই অনেকে এটা পেশা হিসেবে নিয়েছেন- এ বাস্তবতা অনস্বীকার্য। লম্বা লেন্সের বড় একটা ক্যামেরা তাক করে, ফ্লাসলাইটের চোখ ধাঁধানো আলো ছড়িয়ে, মুহূর্তেই সমবেত জনতাকে হকচকিয়ে- ছবি তোলা সহজ মনে হলেও আসলে এ কাজটা তত সহজ নয়, সহজ কোনো পেশাও নয়; এলাম আর অঙ্গভঙ্গি করে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে দ্রুত চলে গেলাম- এটাই চিত্র-সাংবাদিকতার শেষ কথা নয়। ছবি ধারণ করতে চিত্র-সাংবাদিকের থাকা চাই তাৎক্ষণিক বিষয়-বিবেচনার গভীর অনুভূতি, যে অনুভবে সাড়া দিয়ে ছবিটি ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়বে- পাঠকের ভালো লাগার অংশ হিসেবে।
এই ছবি তোলা পেশার দৃষ্টিভঙ্গিগত উপলব্ধি বুদ্ধির বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবি-লেখকরা যেমন স্বল্পশব্দের কথার ভাঁজে জীবনজগতের ছবি সাজিয়ে তুলেন, গল্প-কবিতার পরতে পরতে, তেমনই দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধ-ক্ষমতা থাকা দরকার একজন চিত্র-সাংবাদিকের। যেন ধারণ করা ছবি প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে আপন স্থান করে নেয় সংবাদপত্রের পাতায়। যে ছবি প্রথম দৃষ্টিপাতে পাঠককে টেনে নিয়ে আসবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। পাঠক বারবার পরখ করবে ছবির মায়াময়ী বিষয়বস্তু।
প্রকাশিত ছবি চমকিত করলে পাঠক অনুরূপ আরো ছবির প্রত্যাশায় ওই সংবাদপত্রের আগামীর সংখ্যাগুলোয় বারবার ঢুঁ মারতে সচেষ্ট হবে প্রত্যাশিত ছবির দুর্বার আকর্ষণে। এভাবে ভালো ছবির ভূমিকা সংবাদপত্রে অনন্য হয়ে যায়।  কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক সংবাদপত্রে এ বিষয়টি উপেক্ষিত হতে শুরু করেছে। হতে পারে, সংবাদপত্রে দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বিষয়টিতে নজর দেয়ারই সময় পাচ্ছেন না। কিংবা বহু-ব্যস্ততায় হারিয়ে যাচ্ছে এর গুরুত্ব।
প্রসঙ্গের স্বার্থে এখানে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা খুবই আবশ্যকীয়। আগের পত্রিকাগুলোয় অনেক চিত্র-সাংবাদিক ছিলেন, যাদের লেখাপড়ার গণ্ডি প্রাথমিক স্তরের- কেউ কেউ ছিলেন সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। শোনা যায়, তারা নাকি অক্ষরের ভাষায় ছবির ক্যাপশন লিখতে পারতেন না। তোলা ছবি দেখিয়ে মুখে বর্ণনা দিয়ে ফটো-এডিটরকে ছবির বিষয়বস্তু বোঝাতে হতো। তাদের এক সময় সংবাদপত্র জগতে ‘ফটোগ্রাফার’ হিসেবে ডাকা হতো। কিন্তু সেদিন আর নেই। এখন অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিরাই ফটো-সাংবাদিকতা করছেন। স্বল্প পরিসরে কোনো কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান পাঠচক্র শেষে একাডেমিক প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। এই পেশাটি এখন ফটো-জার্নালিজম হিসেবে স্বীকৃত।
বর্তমান সময়ে অনেক শিক্ষিত যুবক দক্ষ হাতে ক্যামেরা ধরেছেন। আর ক্যামেরার সূক্ষ লেন্সে তুলে আনছেন ভাবনা জাগানো গুরুত্বপূর্ণ ছবি। যাদের কল্যাণে সংবাদপত্রের পাতায় আমরা দেখি ভাব-সাগরে অবগাহন করার মতো হৃদয়স্পর্শী ছবি। শুধু তাই-ই নয়, ছন্দের বাজি খেলায় শব্দ সাজিয়ে কবিতা লেখা কিংবা জীবনধর্মী ফিচারে শব্দের বিণুনিতে রঙের হোলি খেলা অনেক ফিচারলেখকও ভালো ছবি ধারণ করতে পারেন। তারা কলমের পাশাপাশি ক্যামেরাও  হাতে তুলে নিয়েছেন। অর্থাৎ যিনি ছবি তুলেছেন, তিনিই ফিচার লিখেছেন- এমন মেধাবী চিত্র-সাংবাদিক পাওয়া বিরল হলেও দুষ্প্রাপ্য নয়।
মানসম্পন্ন ছবি তোলা শুধু নেশাই নয়, বলা যেতে পারে পেশাও। যেমন কবিতা লেখা কবির নেশা, তেমনই ভালো ছবি তোলাও ফটো-সাংবাদিকের নেশা। আর যারা পেশা ও নেশাকে একসঙ্গে সমন্বিত করেছেন, জীবিকার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন; তাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ সমৃদ্ধ দৃষ্টি আরো মান উন্নীত করতে পারে ফটো-সাংবাদিকতার।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, কোনো মহলকে খুশি করতে কিছু ছবি ছাপা হয় পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে; যেটা সংবাদপত্রের প্রথম ও দ্বিতীয় পাতায় হরহামেশা ছাপা হয়; হতে পারে সেটা ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক কিংবা মালিকানার গুরুত্বে- যেটাকে পাঠক ভ্রূ কুঁচকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে অবলোকন করে। এতে একটি মহল খুশি হলেও পাঠকের বৃহত্তর অংশ মন্দের বুলি আউড়িয়ে বিদ্রূপাত্মক তির্যক দৃষ্টি মেলে ব্যঙ্গ করে। এ থেকে পত্রিকার পক্ষপাতিমূলক অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়ে যায়।
ব্যবসায়ী মহলের কিছু ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। ব্যবসা-বাণিজ্য পাতায় এ ছবি ছাপানো দূষণীয় নয় বরং আবশ্যকীয়। তবে এ ছবি যদি স্বার্থসংশিষ্ট হয়ে পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশে দৃশ্যমান জায়গায় অবস্থান গড়ে নেয়, তাহলে তো পাঠক ভ্রূ কুঁচকাবেই।
অনেক সংবাদপত্র মালিককে নিজস্ব পত্রিকায় ছবি কাভারেজ দিতে দেখা যায়। আবার মানের প্রশ্নে আপসহীন এবং পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতার সম্মানজনক সম্পর্কে আবদ্ধ এমন অনেক পত্রিকা কখনই এমনটা করে না। কারণ, অনেক পাঠকই বিজ্ঞ, যারা প্রচারসংখ্যা প্রভাবিত করেন, সংবাদপত্রে উচ্চমার্গীয় পাঠকের বহরকে দীর্ঘ করেন।
সংবাদপত্রে ছবি ছাপার বিষয়ে ছবি-সম্পাদকের প্রভাব ও পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করার প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা থাকা দরকার। সতর্কতা অবলম্বনের যাত্রায় অবশ্যই লক্ষণীয় যে, একদিকে গুরুত্বপূর্ণ ছবি যেন বাদ না পড়ে, অন্যদিকে অগুরুত্বপূর্ণ ছবি যেন না ছাপা হয়।
আবার, বোধের সংকটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছবি ছাপাই হয় না, পক্ষান্তরে অনেক কম গুরুত্বের ছবি ছাপা হয়ে যায়।  এ বিষয়গুলোও সংবাদপত্রের মান কঠিনভাবে ক্ষুণ্ন করে। আর পাঠকের বিরক্তির সূচকের ঊর্ধ্বগতিতে শেষমেষ এর দায় গিয়ে ঠেকে পত্রিকার প্রচারসংখ্যার ওপর।

সংবাদপত্রজগতে ‘রাইট ম্যান রাইট প্রেস’ বলে একটা কথা আছে। এর পেছনের মর্মার্থ হচ্ছে- সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ দিয়ে কার্যসম্পাদন করানো। কারণ সঠিক দায়িত্বে উপযুক্ত কর্মী যদি কর্ম-সম্পাদন না করে তাহলে পত্রিকার মান অনিবার্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য এবং সে পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা ও ব্যবসা-সফলতা পেতে বাধাগ্রস্ত হবে।
কর্মপর্বে অফিসের সব বিভাগের সব স্তরের সমন্বিত কাজের সুসম্পাদিত রূপ হচ্ছে পত্রিকা । সংবাদপত্র এমনই একটি শিল্প, যেটা গণমাধ্যমে জগতে সিনেমা, টেলিভিশন ও রেডিওর পরিচালনা ব্যবস্থা থেকে আরো সূক্ষ স্তরে অবস্থান করে। অনেক জাঁদরেল কর্মী নিয়োজিত থাকার পরও দেখা যায় পত্রিকা পাঠকপ্রিয় হয়নি, ব্যবসা-সফলও হয়নি। অথচ বিশ্লেষণে দেখা যায়, পত্রিকার সার্বিক সম্পাদনা-মান যথেষ্ট উন্নত। শুধু কৌশলগত কিছু কারণে পত্রিকার পরিচালনা ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের কালো ছায়া নেমে আসে। এর দায়বদ্ধতা পরিকল্পনা বিভাগের কাঁধে চাপে; যারা কি না যথাযথ দায়িত্ব পালনে সফল হয়নি। এমনও দেখা যায়, নতুন টেলিভিশনের চ্যানেল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলে যতটা সহজে মিডিয়া-ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায়, কিন্তু নতুন পত্রিকা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হলেই বহু অর্থ ব্যয়ে ততটা সহজে দাঁড়াতে পারে না। তার অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ হলো বাস্তবমুখী পরিকল্পনার ঘাটতি।
তাই বলা যায়, পরামর্শ পেলে একজন সাধারণ ফটো-সাংবাদিকও ভালো ছবি তুলে এনে দিতে পারেন। দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রয়োজনীয় পরামর্শের অংশীদারি পেলে বেশিরভাগ সাধারণ মাপের ফটো-কর্মীরাও হয়ে উঠতে পারেন সমৃদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির ফটো-জার্নালিস্ট।
পাঠকপ্রিয় পত্রিকায় ফটো-সাংবাদিকতা বিভাগ শৈল্পিক চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ বিভাগকে অবহেলা করে কোনো দৈনিক প্রশ্নহীনভাবে পরিপূর্ণতা পায় না। চিন্তা জাগানিয়া ভালো ছবির সন্নিবেশ একটি পত্রিকাকে স্বপ্নের পথ মাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর। এজন্য ভালো ফটো-জার্নালিস্টের পাশাপাশি থাকা চাই বিজ্ঞ ফটো-এডিটর। তা না হলে সু্‌ষ্ঠু সিদ্ধান্তের অভাবে একটি ভালো ছবি যেমন অপ্রকাশিত থেকে যেতে পারে? আবার তার বিপরীতে একটি স্বল্পমানের ছবিও ছাপা হয়ে যেতে পারে; যা পত্রিকার মানকে টেনে নিচে নামায়। এ কারণে ধারণকৃত ছবি নির্বাচন পর্বে ভাববার অনেক বিষয় সামনে এসে দাঁড়ায়। ভালো ছবির ধারাবাহিকতা পাঠকমহলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারে, ছড়াতে পারে অদৃশ্য আবেদন, শানিত করতে পারে পাঠকের দৃষ্টির সীমানা। এসব ভেবে তবেই ছবি নির্বাচন।
সংবাদপত্রকে সমৃদ্ধ ছবির অধিকারী করতে হলে একদিকে যেমন দরকার মানসম্পন্ন ছবি অন্যদিকে তেমন দরকার সম্পাদনায় সঠিক সিদ্ধান্ত। তাহলেই কেবল সংবাদপত্রের ফটো বিভাগ পেতে পারে সমৃদ্ধির সোপান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status