ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

বিপত্নীক মইন উদ্দিন

গাজী আসাদুজ্জামান

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৬:৪৯ পূর্বাহ্ন

ষাটোর্ধ্ব মইন উদ্দিন বিপত্নীক । তার স্ত্রী চার বছর আগে ব্রেস্ট ক্যানসারে মারা গেছেন। সেই থেকে তিনি একাকী জীবনযাপন করছেন। সরকারি চাকরি করতেন। টাকা-পয়সার অভাব নেই। ঢাকা শহরে তার দু’টি বাড়ি ও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। গ্রামেও প্রচুর জমিজমা রয়েছে। একজন কেয়ারটেকার রেখেছেন। সেই-ই সব দেখাশোনা করে। তার দু’টি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলে দু’টিকে বিয়ে দিয়েছেন। তারা চাকরি করেন। মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। এক কথায় তিনি এখন ভারমুক্ত।
মইন উদ্দিনের এখন কোনো কাজ নেই। সকালে নামাজ পড়ে একটু হাঁটাচলা করেন। নাস্তা খেয়ে একটু ঘুমান। এরপর দোতলা বাসে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। বিশেষ করে ভার্সিটি এলাকায় যেতে তার ভালো লাগে। সেখানে উঠতি বয়সের মেয়েদের দেখা তার একটা হবি। বাস থেকে নেমে ভার্সিটিতে তিনি কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করেন। কলা ভবনের সামনে, শহীদ মিনারের পাদদেশে, ভাস্কর্যের সামনে এলোমেলো জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতীর বসে থাকার দৃশ্য দেখেন। এছাড়া তার আর একটা বদ অভ্যাস কী দোতলা বাসে তিনি মেয়েদের সিটের কাছে বসেন। যাতে কাছ থেকে তাদের দেখা যায়। বয়স যখন কম ছিল তখন মেয়েদের রূপটা এতোটা গভীরভাবে দেখা হয়নি। কথায় আছে অল্প বয়সে নেড়িকুত্তাকেও ভালো লাগে। বয়স হলে বুঝতে পারা যায় কোন্ মেয়েটি বেশি সুন্দর। ব্রেস্ট, নিতম্ব, হাইট, মুখের আকৃতি, চুল সব মিলিয়ে একটি মেয়ে চয়েস করা এই বয়সে যতটা সহজ; তরুণ বয়সে সেটা আরো কঠিন। ভার্সিটির সুন্দরী মেয়েদের দেখলে মইন উদ্দিনের মাথা ঠিক থাকে না। মনে মনে ভাবেন সে যদি আবার ২০/২৫ বছরের তরুণ হতে পারতেন। তবে কতোই না ভালো হতো। একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ভাব জমাতে পারতেন। ওকে নিয়ে বিভিন্ন লোকেশনে ঘুরে বেড়াতেন। চাইনিজ খেতেন। কফি শপে আড্ডা দিতেন। হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াতেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মইন উদ্দিন। যা হওয়ার নয়, তাই ভাবছেন। আকাশ কুসুম কল্পনা। হঠাৎ মইন উদ্দিনের মোবাইলফোন বেজে উঠে। ফোন রিসিভ করেন মইন উদ্দিন।
হ্যালো
আসসালামু আলাইকুম
কে বলছেন?
অপরপ্রান্ত থেকে আওয়াজ আসে। আমি তোমার সহকর্মী আফজাল বলছি। তোমার জন্য একটি সুসংবাদ আছে। এক্ষুণি চলে এসো। তোমার ভাবী তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। অতি সত্বর চলে এসো।
ফোন পেয়ে ওর অফিস সহকর্মীর বাসায় ছুটে যায় মইন উদ্দিন। দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে আসে ওর বন্ধু আফজাল। হাত ধরে সোফায় নিয়ে বসায়। এ সময় ঘরে ঢুকে আফজালের স্ত্রী। কুশল জিজ্ঞেস করে। কিছুক্ষণের মধ্যে নানা রকম মিষ্টি আর নানা রকম খাদ্যে টি-টেবিল ভরে যায়। মইন উদ্দিন জিজ্ঞেস করেÑ কি ব্যাপার এতো রাজকীয় আয়োজন। ব্যাপারটা কী। কোনো অনুষ্ঠান আছে নাকি। আফজালের স্ত্রী বলে আপনাকে ঘিরে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান আছে। সেটা না হয় পরেই বলবো। এখন খাওয়া শুরু করেন। আফজাল বসে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। মইন উদ্দিন আফজালের দিকে তাকালেন। বললেন তুমি হাসছো ক্যান। আমাকে খুলে বলো। আফজালের স্ত্রী বললেনÑ ভাইসাব আগে খাওয়া শুরু করেন। এরপর সব বলছি। খাওয়া শেষ হলে চা এনে দিলেন আফজালের স্ত্রী। চা খেতে খেতে মইন উদ্দিন আফজালকে বললেন এখন বলো কী জন্য ডেকেছো আমাকে? আফজাল বললো আমি বলবো না তোমার ভাবী বলবে। আফজালের স্ত্রী বললো না তুমিই বলো। আফজাল বললো দেখ মইন তোমার এখন বয়স হয়েছে। এ বয়সে একা একা থাকা বড় যন্ত্রণা। তাছাড়া, তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে কে তোমাকে সেবা শুশ্রƒষা করবে। তুমি যদি চলার শক্তি হারিয়ে ফেলো কে তোমাকে বাতরুমে নিয়ে যাবে। প্রস্রাব-পায়খানা কে পরিষ্কার করবে। বউ-ঝিরা তো এটা করতে পারবে না। তাই বলছিলাম তুমি একটা বিয়ে করো। তোমার চেয়ে বেশি বয়সীরাও তো বিয়ে করছে। তাছাড়া, তোমার টাকা পয়সার অভাব নাই। ঢাকায় দু’টি বাড়ি তোমার। ফ্ল্যাটও আছে। ছেলেরাও কামাই করছে। তোমার চিন্তা কী? আফজালের স্ত্রী বললো ভাইসাব আমরা একটি মেয়ে ঠিক করেছি। মেয়েটি সুন্দরী এবং ভদ্রঘরের। ব্যবহারও ভালো। আফজালের স্ত্রী মেয়েটিকে ডাকলেন। মেয়েটি এসে সোফায় বসলো। মইন উদ্দিন মেয়েটিকে দেখলেন। মেয়েটি সুন্দরীই। বয়স ৩৫/৩৬ হবে। পাতে নেয়া চলে। মইন উদ্দিন বললেন ভাবী বিয়ে-শাদীর ব্যাপার। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ না করে কিছু বলতে পারছি না। আমি আপনাকে পরে জানাবো। একথা বলে মইন উদ্দিন বাসার দিকে রওনা হলেন।
এশার নামাজ শেষে খাবার টেবিলে সবার সঙ্গে খেতে বসলেন মইন উদ্দিন। খাওয়া শেষে ছেলেদের বললেন তোমরা সবাই খাওয়া শেষে আমার রুমে এসো। জরুরি কথা আছে। ছেলের বউকে বললেনÑ বউমা আমাকে একটা পান দিওতো।
রুমে এসে পান চিবুতে চিবুতে একটা সিগারেট ধরালেন মইন উদ্দিন। খাটে হেলান দিয়ে সিগারেট পান করতে করতে ভাবতে থাকলেন কীভাবে কথাটা পারবেন। তার একটা রিহার্সেল মনে মনে করে নিলেন। মইন উদ্দিন বললেন দেখ বাবারা আমার এখন বয়স হয়েছে। যেকোনো সময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি। অথবা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায়ই শুয়ে থাকতে পারি। আমার একজন নার্সিংম্যানের দরকার। আমার তো টাকা-পয়সার অভাব নাই। দু’টি বাড়ি আছে। একটি ফ্ল্যাট আছে। গ্রামেও অজস্র সম্পদ। তাই আমি ভাবছি আরেকটি বিয়ে করবো। শেষ সময় একটু সেবা শুশ্রƒষা পেতে চাই। ছেলেরা বললো এটা কী বলছেন বাবা। আপনার কী মাথা ঠিক আছে? আপনি এখন বিয়ে করলে আমাদের মাথা কাটা যাবে। লোকে আমাদের ছিঃ ছিঃ করবে। সমাজে মুখ দেখানো যাবে না।
মইন উদ্দিনের বড় ছেলের বউ এতোক্ষণ চুপচাপ ছিল। সে মুখ খুললো। বললোÑ দেখুন বাবা আপনি আমাদের গুরুজন। পিতার সমতুল্য। আপনার সেবায় আমাদের কমতি হবে না। আপনার জন্য আমাদের যা যা করণীয় তাই তাই করবো। তবু আপনি বিয়ে করবেন না। আপনি বিয়ে করলে আমার বাপের বাড়ির মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। সবাই বিদ্রƒপ করবে। উপহাস করবে। ছোট ছেলে এক রকম হুমকি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মইন উদ্দিন শোয়া থেকে উঠে বসলেন। সবাইকে বললেন ঠিক আছে তোমরা এখন আসো। আমি এখন ঘুমাবো। ছেলে এবং বউরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে লাইট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেন মইন উদ্দিন।
ভোরে নামাজ শেষে নিজেই চা করলেন মইন উদ্দিন। চা এবং টোস্ট বিস্কিট খেয়ে পোশাক পাল্টিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে বউমাকে ডাকলেন। বললেন আমি কিছু দিনের জন্য দেশের বাড়ি যাচ্ছি; তোমরা আমার জন্য চিন্তা করো না। বড় বৌমা মইন উদ্দিনকে কদমবুছি করলেন। মইন উদ্দিন বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর জুতা পরে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হলেন মইন উদ্দিন।
হঠাৎ খবরবার্তা ছাড়া মইন উদ্দিনকে দেখে অবাক হয়ে যায় বাড়ির কেয়ারটেকার সুন্দর আলী। তাড়াতাড়ি ব্যাগ এগিয়ে নেয়। জিজ্ঞেস করে ঢাকার সবার কথা।
সুন্দর আলীর বউ রাতে কয়েক পদের ব্যঞ্জন তৈরি করে। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মইন উদ্দিন। গ্রামে মইন উদ্দিনের দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। গল্পগুজব করে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটছিল মইন উদ্দিনের। বিকেল বেলা হাঁটতে হাঁটতে বাজারে যায় মইন উদ্দিন। বাজারে ঢুকে একটি ফার্মেসিতে বসে আলাপজুড়ে দেয় তার ছোট বেলার বন্ধু খায়েরের সঙ্গে। খায়ের জিজ্ঞেস করে তার ছেলেমেয়ের কথা। তারা কেমন আছেÑকী করছে। মইন উদ্দিন অকপটে সব বলে। সে খায়েরের পরিবারের কথা জানতে চায়। ঘণ্টাখানেক গল্পসল্প করে উঠতে যাবে এমন সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি একটু কমলে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় মইন উদ্দিন। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি আর ধমকা বাতাস। মইন উদ্দিন দ্রুত পা চালায়। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই প্রচ- শব্দে তার কাছাকাছি একটি বাজ পড়ে। মইন উদ্দিন হাতে ধরা ছাতাসহ পড়ে যায় মাটিতে। দূর থেকে বাড়ির কেয়ারটেকারের স্ত্রী তা দেখে ছুটে আসে। কেয়ারটেকারের স্ত্রী এবং আরো কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে মইন উদ্দিনকে বাড়ি নিয়ে আসে। শরীর ম্যাসাজ করে। ডাক্তার আসে। ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়ে যায়। হুঁশ ফিরে না মইন উদ্দিনের।
সকাল বেলা এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকে মইন উদ্দিনের বাড়ির কেয়ারটেকারের স্ত্রী নাজমা। মইন উদ্দিনকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। হাত থেকে দুধের গ্লাস পড়ে ভেঙে যায়। গ্লাস ভাঙার শব্দে জেগে উঠে মইন উদ্দিন। তাকিয়ে থাকে নাজমার দিকে। নাজমা ডাক দেয় তার স্বামীকে। কেয়ারটেকার সুন্দর আলী মইন উদ্দিনকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। মইন উদ্দিন সুন্দর আলীকে ডাক দেয়। কিন্তু সুন্দর আলী এবং তার স্ত্রী কেউ এগিয়ে আসে না। পরে মইন উদ্দিন ওদের উদ্দেশে বলে গ্লাস ভাঙার জন্য আমি তোদের কিছু বলবো না। ভয় নাই, কাছে আয়। একথার পরও ওরা কাছে আসে না। কিছুক্ষণ পর পর শুধু উঁকি মেরে দেখে। এবার মইন উদ্দিন শোয়া থেকে ওঠে বসে। এগিয়ে যায় ওদের দিকে।
মইন উদ্দিনকে আসতে দেখে ভয়ে ওরা দৌড় দেয়। তারপর ভূত ভূত বলে চিৎকার শুরু করে। ওদের চিৎকারে লোকজন ছুটে আসে। ওরাও মইন উদ্দিনকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ফোরকান আলী এগিয়ে আসেন। সে মইন উদ্দিনকে হাত দিয়ে স্পর্শ করেন। তারপর সকলকে বলেন ভয় নেই। এ ভূত নয়। আমাদের মইন উদ্দিন। সে পৌঢ় থেকে যুবক হয়ে গেছে। সবই আল্লাহর কৃপা। তোমরা অযথায়ই ভয় পাচ্ছো। এই দেখো আমি তার গলা জড়িয়ে ধরছি। কিছু বলছে না সে। আমাকে আক্রমণও করছে না। তোমরা অকারণে ভয় পাচ্ছো।
মইন আলী এতক্ষণ হতভম্বের মতো সবকিছু দেখছিল। এবার সে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আলমিরার আয়নায় নিজের অবয়ব দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। একী অবস্থা তারÑ চুল-দাড়ি সব কাঁচা হয়ে গেছে। চামড়ার ভাঁজ উবে গেছে। তাকে দেখতে মনে হচ্ছে ২৪/২৫ বছরের যুবক। এক রাতের মধ্যে ভোজবাজির মতো সব ওলটপালট হয়ে গেছে। এতক্ষণ পর বুঝতে পারে মইন উদ্দিন কেয়ারটেকার সুন্দর আলী আর তার বৌ-এর ভয়ের কারণ। মইন উদ্দিন ওদের কাছে ডেকে নেন। ওদের মাথায় হাত বোলান। ভয় নেই বলে আশ্বাস দেন। সুন্দর আলীর বউকে বলেন রান্নাবান্না করো। দুপুরে খেয়ে আমি ঢাকা চলে যাবো।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে কাপড়-চোপড় গোছগাছ করে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন মইন আলী। তার মধ্যে বিরাট একটা পরিবর্তন এসেছে। তাকে দেখতে মনে হচ্ছে যুবক। বিয়ে-শাদী হয়নি। বাসে পুরুষ সিট না পাওয়ায় একটি মেয়ের পাশে বসেন তিনি। বাস ছুটে চলে ঢাকার উদ্দেশে। বাস মহাখালী এলে নেমে পড়েন মইন উদ্দিন। একটি রিকশায় করে বাসায় আসেন। বাসায় পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়েন মইন উদ্দিন। কিছুক্ষণ পর তার বড় ছেলের বউ দরজা খুলে দেন। জিজ্ঞেস করেন কাকে চান? মইন উদ্দিন ছেলের বউকে বলেনÑ কেমন আছো বউ মা? তোমরা সবাই ভালো তো? এতক্ষণ মইনউদ্দিনের ছেলের বউ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ‘বউ মা’ শব্দ শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। বললেন আপনি কি গাঁজা খেয়ে এসেছেন। হেরোইন খান? আচ্ছা বলুন তো আমার বয়স কতো? মইন উদ্দিন বললেন তোমার বয়স আগামী ১লা জুলাই ২৪ বছর পূর্ণ হবে। ২৪ বছরের মেয়ের ২৫ বছরের ছেলের শ্বশুর হয় কীভাবে? আপনি পাগল না ছাগল বলুন তো? পাগলেরও একটা আত্মসম্মান বোধ থাকে আপনার তাও নেই। একথা বলে দরজা বন্ধ করে দিলেন মইন উদ্দিনের ছেলের বউ। কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় নক করলেন মইন উদ্দিন। এবার ছেলে এসে বললেন কাকে চান। মইন উদ্দিন বললেনÑ আমি তোর বাবা। আমাকে চিনতে পারলি না। মইন উদ্দিনের ছেলে বললেন আপনি আমার বাবা। ২৫ বছরের একটি ছেলে এসে ২৭ বছরের একটি ছেলেকে বলছে সে নাকি তার বাবাÑ এটা কেউ বিশ্বাস করবে। যত সব ফালতু। দেখুন আপনাকে শেষবার বলছি। ভালোয় ভালোয় চলে যান নতুবা পুলিশ ডাকবো। এ কথা বলেই দরাম করে দরজা বন্ধ করে দেয় মইন উদ্দিনের ছেলে। মইন উদ্দিন আবার দরজায় কড়া নাড়েন। কিন্তু দরজা খুলছে না কেউ।
কিছুক্ষণ পর সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি ঢোকে বাসায়। গাড়ি থেকে নেমে আসেন থানার ওসি। দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন মইন উদ্দিনের দুই ছেলে ও ছেলের বউরা। ওসির উদ্দেশে বলেনÑ এই যে স্যার, উনিই সেই ব্যক্তি।
ওসি সাব মইন উদ্দিনকে ভালো করে দেখলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন আপনার নাম? বাড়ি কোথায়? মইন উদ্দিন বললেন এটাই আমার বাসা। আমার নাম মইন উদ্দিন। এরা আমার দুই ছেলে ও ছেলের বউ। ওসি সাব প্রচ- একটা ধমক ছিলেন মইন উদ্দিনকে। বললেনÑ তোমার কী পেট খারাপ না মাথা খারাপ হয়েছে। এটা তোমার ছেলে আর ছেলের বউ। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় অবস্থা। ওসি সাব সেকেন্ড অফিসারকে হুকুম দিলেন ওকে গাড়িতে তুলে অনেক দূর নামিয়ে দিতে। এরপর মইন উদ্দিনের উদ্দেশে বললেন ফের যদি আবার এই বাসায় আসো তাহলে তোমার খবর আছে। লাল দালানে যেতে হবে। পুলিশের গাড়ি দীর্ঘক্ষণ চলার পর মাইল তিনেক দূরে নামিয়ে দিলো মইন উদ্দিনকে। মইন উদ্দিন চিন্তা করলেন এখন কোথায় যাওয়া যায়। শেষমেশ চিন্তা করলেন ইস্কাটনে তার মেয়ের বাসায় যাবেন। একটি সিএনজি বেবিট্যাক্সিতে করে রওয়ানা হলেন মইন উদ্দিন। একটি নামীদামি মিষ্টির দোকান থেকে ২ কেজি মিষ্টি কিনে মেয়ের বাসায় ঢুকলেন মইন উদ্দিন।
কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন তার মেয়ের জামাই। সালাম দিয়ে বললেন কাকে চান? মইন উদ্দিন বললেনÑ তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। আমি তোমার শ্বশুর। নূপুরের বাবা। মইন উদ্দিনের মেয়ের জামাই গলার স্বর কিছুটা বিকৃত করে বললেনÑ আপনি কী একটা ছাগল না পাগল। একটা যুবক নূপুরের বাবা হতে যাবে কেন? হতে পারে একটা প্রেমিক। যান এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান বাসা থেকে আর কখনো এই বাসায় পা দেবেন না। এক রাশ কষ্ট নিয়ে ফিরে যাবার সময় মইন উদ্দিন মিষ্টির প্যাকেটটি এগিয়ে ধরে জামাইকে বললো এটা নূপুরকে দিও। মইন উদ্দিনের মেয়ের জামাই ক্ষিপ্ত হয়ে মিষ্টির প্যাকেটটি ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। মেয়ের বাসা থেকে কিছুটা অপদস্থ হয়ে ফিরে আসছিলেন মইন উদ্দিন। রাস্তায় নামতেই শুরু হলো বৃষ্টি আর ঝড়। সেই সঙ্গে বজ্রপাত। নিজেকে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করলেন না তিনি। কী লাভ বেঁচে থেকে তার চেয়ে মরাই শ্রেয়। যদি সন্তানরা আমাকে না চিনে। এমনি ভাবনা ভাবতে ভাবতেই পথ চলছিলেন মইন উদ্দিন। হঠাৎ প্রচ- বাজ পড়ে তার সামনে। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। পথচারীরা তাকে তুলে নিয়ে ভর্তি করেন হাসপাতালে। এক রাত তার জ্ঞান ছিল না। ভোরে ডাক্তাররা তাকে দেখে হতবাক হয়ে যান। গতকাল যাকে তারা ট্রিটমেন্ট করেছেন এ যেন সে না। ২৫/২৬ বছরের যুবক এক রাতেই ষাটোর্ধ্ব বয়সে পরিণত হয়েছেন। জ্ঞান ফিরলে ডাক্তাররা তাকে জিজ্ঞেস করেন আপনার নাম কী? বাসা কোথায়? এরপর এক নার্স তার মোবাইলফোনটি তার হাতে এগিয়ে দেন। বলেনÑ আপনার স্বজনদের ফোন দেন। তারা এলে আপনি তাদের সঙ্গে যেতে পারবেন।
মইন উদ্দিন মোবাইলফোনটি হাতে নেন। এরপর বন্ধু আফজালকে কল দেন। বলেন, আমি ইউনাইটেড হাসপাতালে আছি। বেড নং ৪, ওয়ার্ড নং ২। অসুস্থ। এক্ষুণি চলে এসো। ফোন পেয়ে আফজাল সাহেব মইন উদ্দিনের ছেলেমেয়েদের খবর দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই হাসপাতালে ছুটে আসেন।
মইন উদ্দিনের বড় ছেলে মইন উদ্দিনের গলা জড়িয়ে ধরে। বলে বাবা আপনার কী হয়েছিলো? মইন উদ্দিন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে কীসের বাবা আমি তোমার? যে ছেলের বউ শ্বশুরকে বলে গাঁজাখোর-হেরোইনখোর সে বউ হয় ক্যামনে। মইন উদ্দিনের কথা শুনে ছেলে এগিয়ে আসে। বলে কী সব বলছো বাবা? তোমার ছেলের বউ তোমাকে এসব বলার সাহস পাবে! মইন উদ্দিন ক্ষেপে যান। রাগত স্বরে বলেন তুমি আর কথা বলতে এসো না বাপু। যে ছেলে নিজের বাসা থেকে পুলিশ ডেকে বাবাকে বের করে দিতে পারে সে কিসের ছেলে। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। এ সময় মেয়ে এবং মেয়ের জামাই এগিয়ে আসে। বলে ছেলে না থাক মেয়ে আর মেয়ের জামাইতো আছে। বলি হারি। কী সুন্দর কথা। মেয়ে আর মেয়ের জামাইতো আছে? আরে তোমার বাসায় যখন গেলাম। কম অপদস্থ করেছো আমাকে। আমার নেয়া মিষ্টি দরজায় রাখা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওনি। একথার পর সবাই সবার দিকে তাকাতে থাকে। আসল রহস্য জানার জন্য। ডাক্তাররাই খুলে বলে সব। আর আগেরটুকু বলে মইন উদ্দিন। মইন উদ্দিনের কথা শেষ হলে এগিয়ে আসে বন্ধু আফজাল আর তার স্ত্রী। আফজাল বলে তোমার অসুস্থতার খবর শুনে তোমার জন্য একজন নার্স নিয়ে এসেছি। যে কয়েকদিন তুমি অসুস্থ থাকো তোমার নার্সিং করবে সে। দেখো তোমার নার্স পছন্দ হয়েছে নাকি। মইন উদ্দিন মুচকি হেসে দেয়। বলে কাটা ঘায়ে আর নুনের ছিটা দিও না বন্ধু। এমনিতেই আমার বারোটা বেজে গেছে। আর না...। মইন উদ্দিনের কথা শুনে সবাই হেসে উঠে।

পাদটীকা: ১৯৮৬ সালে মিয়ামী বিচে এক অষ্টাদশী তরুণী গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে স্নান করছিল। স্নান শেষে কটেজে ফিরছিল সে। হঠাৎ তার কাছেই বজ্রপাত ঘটে। এতে সে আহত হয়। তাড়াতাড়ি নেয়া হয় তাকে হাসপাতালে। এক রাতের মধ্যেই পরিবর্তন ঘটে তার। পরিণত হন ৮০ বছরের বুড়িতে। চুল পেকে যায়। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। সেই পটভূমিকায় এ গল্পটি রচিত হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status