ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

মায়উ নদীর দুঃখ

রেজাউল করিম খোকন

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৫:১৫ পূর্বাহ্ন

ধীরগতিতে বয়ে চলা সংকীর্ণ নদী মায়উ। বর্ষাকালে মায়উ নদী প্রসারিত হয় কিছুটা, তখন নদীর স্রোত বেগবান হয়। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা পল্লী মংনুর মানুষগুলোর স্বভাব চরিত্র মায়উ নদীর মতো। তারা এমনিতে খুব সহজ সরল, ভদ্র নম্র। তবে হঠাৎ হঠাৎ তাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষেপে উঠলে অন্যরকম হয়ে যায়। তখন আর চেনা যায় না তাদের।
মংনু গ্রামে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে অনেক দিন ধরে। তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির কমতি নেই। গ্রামের চায়ের দোকানে মুসলমানরা তাদের বৌদ্ধ প্রতিবেশীদের সঙ্গে এক বেঞ্চে বসে চা খেতে খেতে গল্প গুজবে মেতে উঠতো। তেমন কোনো বিরোধ নেই তাদের মধ্যে।
মংনু গ্রামের দৃশ্যপট হঠাৎ করেই বদলে যায়।
এক সকালে মায়উ নদীর পাড়ে শান্তিবাজারে অশান্তির ঝড় ওঠে।
বাজারে স্বাভাবিক কেনাবেচা চলছিল। হঠাৎ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বর্মী সৈন্যরা বাজারে অতর্কিতে হামলা চালায়। অস্ত্র তাক করে গ্রামবাসীর ওপর গুলি ছুড়তে থাকে। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ছুটতে থাকে বাজারের সব মানুষজন।
নাসির আলি বাজার করতে এসেছিল অন্যান্য দিনের মতো। কিন্তু বাজারে পা রাখা মাত্রই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়, যার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। বাজারের সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে যে যার মতো। নাসিরও ছুটতে থাকে। দৌড়ে পালাতে গিয়ে কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে আশেপাশে, কেউ কেউ আহত হয়ে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে পাশের সবুজ ধান ক্ষেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আতঙ্কিত মানুষের আর্তনাদ, চিৎকারে সেখানকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে ক্রমশ।
নাসির বাজারে আসার আগে রাস্তায় লোকজনের কাছে শুনেছে আগের দিন রাতে স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পে কারা যেন হামলা চালিয়েছে। বেশ কয়েকজন পুলিশ হতাহত হওয়ায় তার প্রতিশোধ নিতে বর্মী সৈন্যরা সকাল বেলাতেই হামলা শুরু করেছে পৈশাচিকভাবে। এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি আগে কখনও সৃষ্টি হয়নি এখানে।
নাসির অনেক দূর দৌড়ে আসার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গ্রামের একটা গাছের নিচে বসে হাঁপাতে থাকে। যেদিক থেকে ছুটে এসেছে সেদিকে তাকাতেই আগুনের লেলিহান শিখা, ধোঁয়া দেখা যায়। সঙ্গে শোনা যায় গুলিবর্ষণের শব্দ। নারী-পুরুষ- শিশুর আর্তচিৎকারও শোনা যায়।
এই মুহূর্তে কোনদিকে যাবে সে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না নাসির আলি।
সে একটা গ্যারেজে মেকানিকের কাজ করে। মাঝে মধ্যে গাড়ি চালিয়ে মংডু, বুচিডং যায়। মালামাল পরিবহনের ছোটখাটো কিছু গাড়ি চলাচল করে এখানে। ড্রাইভার কাম মেকানিক হিসেবে তার বেশ চাহিদা রয়েছে। দক্ষ হাতে পাহাড়ি পথে গাড়ি চালায় সে।
মংনু গ্রামেই নাসিরের বাড়ি।
এখনই বাড়ি যাওয়া দরকার। কিন্তু কোন পথে গ্রামে যাবে ভেবে কূল পায় না সে। বাড়িতে বুড়ো বাবা, ভাইবোন, বউ, ছেলেমেয়েরা আছে। তাদের কথা ভাবতেই অনেক আশঙ্কায় দুলে ওঠে মন। কয়েক জন গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে এখানে। তারা দেখে এসেছে বর্মী সৈন্য এবং পুলিশ গ্রামে ঢুকে একজন একজন করে গ্রামবাসীকে জবাই করছে। তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে যে যেভাবে পারছে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। রক্তে রঞ্জিত হয়েছে গ্রামের রাস্তাঘাট, সবুজ মাঠ, ধান ক্ষেত। পুরো জনপদই এখন রক্তাক্ত।
বর্মী সৈন্যদের হামলা এবং নৃশংসতার কথা শোনার পর নাসির নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে নিজের বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করে। নিজের বাড়ির কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ায় একসময়।
বাড়ির ভেতরে বর্মী সৈন্যরা ঢুকছে। জোর গলায় কি যেন বলছে তারা। বাইরে থেকে শোনা যায়।
নাসিরের বাবা মুসা মিয়ার বয়স ৮০ পেরিয়েছে। লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। বর্মী সৈন্যরা বাড়ির লোকজনদের গালিগালাজ করায় মুসা মিয়া তাদের ওপর ক্ষেপে ওঠেন। তার ক্ষেপে ওঠা দেখে একজন বর্মী সৈন্য কাছে এসে তার গলা দু’হাতে চেপে ধরে। প্রচণ্ড আক্রোশে দু’হাতের চাপ বাড়াতে থাকে আরো, কিছুক্ষণের মধ্যে নিঃশ্বাস নিতে না পারা মুসা মিয়া ছটফট করতে থাকেন। এক সময় তার দেহটা স্থির হয়ে যায়। নিজের চোখের সামনে বাবার নির্মম মৃত্যুবরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে নাসির। বাবাকে উন্মত্ত বর্মী সৈন্যদের কবল থেকে রক্ষা করতে না পারা নাসির নিজের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করে। ছটফট করতে থাকে সে। অক্ষমতা, ব্যর্থতার গ্লানি তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না।
বৃদ্ধ বাবাকে বাঁচাতে হবে যেকোনো মূল্যে। সেদিকে ছুটে যেতে উদ্যত হতেই গ্রামবাসী প্রতিবেশীদের কয়েকজন নাসিরকে জোর করে ধরে রাখে। বাড়ির ভেতরে ঢোকা বর্মী সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক। তাদের সামনে যাওয়া মানে মৃত্যুকে হাত ধরে ডেকে আনা। বৃদ্ধ বাবাকে একদল নেকড়ের কবল থেকে রক্ষা করতে না পারার অক্ষমতা, ব্যর্থতা, দুর্বলতা তাকে কুরে কুরে খায়। জন্মদাতা বাবাকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখে নাসির। এর চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক ব্যাপার আর কি হতে পারে এই জীবনে।
এরপর নিজেকে স্থিরভাবে ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল তার।
একজন অশীতিপর বুড়ো মানুষকে অবলীলায় খুন করার পর বর্মী সৈন্যদের মধ্যে কোনোরকম অনুতাপ বোধ দেখা যায় না। তারা বাড়ির সবাইকে এক সঙ্গে জড়ো করে মেশিনগান তাক করে। কয়েকজন সৈন্য হাতে ধরা মেশিনগানের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে হুংকার ছেড়ে বর্মী ভাষায় বলতে থাকে ‘অ্যাই কুত্তার বাচ্চারা, তোরা বাঙালি, এই বাড়ি থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে যা। তা না হলে এই বুড়োর মতো অবস্থা করে দেবো, মেশিনগান যখন গর্জে উঠবে পালিয়েও বাঁচতি পারবি না। তারা মিয়ানমার ছেড়ে যেখানে খুশি চলে যা, এখানে থাকতে চাইলে মরতে হবে সবাইকে। আমরা তোদের কাউকে ছাড়বো না, বাঁচতে চাইলে মিয়ানমার ছাড়তে হবে তোদের। নইলে গরু-ছাগলের মতো জবাই করবো তোদের।
আঁরা কনডে যাইয়্যুম, আয়ারার যাইবার কোনো দ্যাশ নাই, এনডে আঁরার বাড়িঘর, জায়গা-জমি। এগুন ছাড়ি কোন দ্যাশত যাইয়ুম,’ নাসির কথাগুলো বলতে চাইছিল। কিন্তু পাশ থেকে একজন প্রতিবেশী ইশারা করে থামিয়ে দেয়।
বর্মী সৈন্যরা কারো কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। তাদের নির্দেশের আপত্তি করলে, কিংবা তাদের কাজের প্রতিবাদ জানালে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা। গত কয়েকদিনে মংডু শহরে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনযজ্ঞে নেমে তারা নৃশংসতার চরম প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে।
নাসির তার বউ-বাচ্চা, ভাইবোনদের নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। রাস্তায় গিয়ে দঁাঁড়ায়। একটু পরেই বাড়ির ভেতরে বর্মী সৈন্যরা এক ধরনের পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাড়িতে।
নিজের চোখের সামনে অতি যত্নে তিল তিল করে গড়ে তোলা সুন্দর বাড়িটি বর্মী সৈন্যদের দেয়া আগুনে পুড়তে দেখে নাসিরের বউ রাহেলা আর্তনাদ করে ওঠে, ‘ও আল্লারে, আঁরার কি অইবো, আঁরা কনডে যাইয়্যুম, কনডে থাইক্ক্যুম, আল্লারে আঁরার উপর এ কোন গজব নাজিল অইয়্যে দে।’
ধমক দিয়ে বউকে থামাতে চায় নাসির, ‘চুপ কর্‌, রাহেলা। তুই নো বুঝর, এয়েনে চিল্লাইলে মিলিটারি আই সোজা গুলি করি দিবো, আঁরা আর বাঁচিন্নো ফাইজ্জুম। আল্লার দোহাই লাগের এক্কানা চুপ কর্‌। জান বাঁচাইতে চাইলে এনডত তুন যাওন ফরিবো।’ ‘আরা কোনো বাঁচিবার পথ খুঁজি ন’ ফাইর। জলদি জলদি এনডে তুন না গেলে ব্যাকগুনেরে মারি ফালাইবো দে। কোনো কথা ন’ কই এনডে তুন চল পেয়া ছা ব্যাকগুনেরে লই।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নাসির বউ- ছেলেমেয়েদের নিয়ে মায়উ নদীর পাড় ঘেঁষে চলা পথ ধরে হাঁটতে থাকে। কোন পথ ধরে এগোলে বাংলাদেশে যেতে পারবে জানে না তারা। যেতে যেতে তারা একই গ্রামের লাতু মিয়া এবং তার বড় ভাই লেদু মিয়াকে দেখতে পায়। তখনই আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি নামে।
লাতু মিয়া তার বড় ভাই লেদু মিয়াকে নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছে। বৃষ্টি হওয়ায় গ্রামের পথঘাট বেশ পিচ্ছিল এবং কর্দমাক্ত হয়ে আছে। পথ চলতে তাদের কষ্ট হচ্ছে অনেক। কিন্তু তাদের রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে হচ্ছে। কারণ স্থানীয় থানা থেকে খবর দেয়া হয়েছে জরুরিভিত্তিতে দেখা করার জন্য। খুব বেশি সময় দেয়া হয়নি তাদের। এক ঘণ্টার মধ্যে থানায় গিয়ে কথা বলতে হবে।
লাতু আর লেদু দু’ভাই মিলে ব্যবসা করে। তারা নদী পথে মালামাল পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের বেশ কয়েকটি নৌকা রয়েছে। এ ব্যবসায় মোটামুটি ভালো আয় হয় তাদের। মায়উ নদীতে নৌকাগুলো চলে।
সব কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু দু’দিন আগে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা এবং হতাহতের ঘটনার পর থেকে বর্মী সৈন্য, লুন্টিন পুলিশ এবং স্থানীয় রাখাইন মগ সন্ত্রাসীরা যেভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছে তাতে এখানে প্রাণ বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য তো দূরের কথা। শুধু রোহিঙ্গা মুসলমান নয় বাংলায় কথা বলা হিন্দুদেরও রেহাই দিচ্ছে না তারা। মাইক দিয়ে ঘোষণা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। পুড়ছে বাড়িঘর, দোকানপাট, ফসলের গোলা। কোথাও কোথাও ক্ষেতের পাকা ধানও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে বংশ পরম্পরায় এখানে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এখান থেকে যে কোনোমূল্যে তাদের উচ্ছেদ করে রোহিঙ্গামুক্ত এলাকা ঘোষণা করাটাই তাদের পরিকল্পনা। এই এলাকা দিয়ে তেলের পাইপ লাইন যাবে চীন দেশে। এরকম কথা শুনেছে লাতু মিয়া। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিদায় করে দিয়ে তাদের বাড়িঘর ভেঙে জায়গা-জমি দখল করে সেখানে সরকার শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে চায়।
স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে লাতু এবং লেদুর ওঠাবসা সবসময়। যে কারণে তারা সরকারি নানা খবরাখবর জানতে পারে। থানা থেকে জরুরি ডাক পাবার পর তাদের মনে কিছুটা চিন্তার উদ্রেক হলেও তারা তেমন ভয় পাচ্ছে না। তাদের ধারণা, অন্য সবার সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করছে পুলিশ এবং মিলিটারিরা তাদের সঙ্গে তেমন করবে না। কারণ স্থানীয় পুলিশদের সঙ্গে তাদের সখ্য অনেক দিন ধরে।
থানায় ঢোকামাত্র লাতু মিয়া হাড্ডিসার দীর্ঘাঙ্গী এক মিলিটারি সার্জেন্টকে দেখতে পায়। মিলিটারি সার্জেন্টের নাম বাজো মিং, সবাই তাকে ‘বাজো’ বলে ডাকে। লাতু মিয়াদের বাড়িতে কয়েকবার এসেছেও আগে। দাওয়াত খেয়েছে।
অন্য সময় হাসিমুখে কথা বললেও আজ বেশ গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসে আছে বাজো মিং। তার মুখে কোনো হাসি নেই। তার আগের রূপ, পাল্টে গেছে রাতারাতি। অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে বাজো মিং।
‘স্যার, কিল্লাই ডাইক্কোন আঁরারে, জরুরি কোনো কাজ আছে ফায়ান্নালার। কই ফেল্যুন, করি দিয়ুম,’
লেদু পরিবেশটাকে হালকা করতে বলে।
তারপরও সার্জেন্ট বাজোর মুখে ভাবান্তর ঘটে না। সে অনেকটা গম্ভীর মুখে নির্দেশের সুরে যা বলে তার মর্মার্থ হলো, ‘এখানকার সৈন্যরা তাদের একটি বড় নৌকা জরুরি কাজের জন্য নিয়ে যেতে চায়, তা আজই দিতে হবে বুঝিয়ে, সঙ্গে নৌকার মাঝি বা চালকও দিতে হবে।
লাতু ও লেদু, দুই ভাই তেমন প্রস্তাব শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এর আগে স্থানীয় পুলিশ এবং মিলিটারিদের অনেক ব্যক্তিগত কাজের জন্য নৌকা দিলেও এভাবে কঠিন নির্দেশের সুরে নৌকা চাওয়া হয়নি।
কি কাজের জন্য নৌকা দিতে হবে, এই মুহূর্তে জানতে চাওয়া মানে হাতে ধরে বিপদ ডেকে আনা। সার্জেন্ট বাজোকে আজ সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। হঠাৎ কি করে বসে বলা যায় না। ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে তাকে এখন।
তার চোখে-মুখে এক ধরনের নির্মমতা ফুটে উঠছে। নৌকা দিতে গড়িমসি করলে তাদের মেরে ফেলা হবে হয়তো, বুঝে নেয় দু’ভাই।
‘ঠিক আছে। নৌকা নদীর ঘাটত আছে, লই যাইবা দে আরি।’ লেদু বলে।
কিছু সময় পর কাছের নদীর ঘাটে নিজেদের একটি বড় নৌকা মিলিটারিদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। নৌকার সঙ্গে দু’জন মাঝিকেও দেয়া হয় ওটা চালানোর জন্য।
নৌকা নিতে আসা মিলিটারিদের মধ্যে চরম উত্তেজনা লক্ষ্য করে লাতু মিয়া। তার দিকে কটমট চোখে তাকায় কয়েকজন।
মাঝিসহ নৌকা নিয়ে চলে যায় মিলিটারির দল।
নদী পথে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি কাছের একটি গ্রামের পাশে ঘাটে গিয়ে ভিড়ে। পুরো গ্রামে লোকজন নেই। জনশূন্য অস্বাভাবিক পরিবেশ। বাতাসে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে।
যে দু’জন মাঝি নৌকার সঙ্গে গেছে তারা ঘাটে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি আগে কখনও দেখেনি তারা।
সৈন্যরা গ্রাম থেকে আনা একটির পর একটি লাশ এনে নৌকায় তুলতে শুরু করে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীর লাশে বোঝাই করা হয় নৌকা। এরপর মাঝিকে অস্ত্র উঁচিয়ে নির্দেশ দেয় একজন মেজর। সাগরে নিয়ে লাশগুলো ফেলে দিতে হবে। অন্যথা হলে গুলি করে মারা হবে। প্রাণের ভয়ে মাঝিরা কাঁপতে থাকে। এ ধরনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়নি তাদের আগে কখনও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা লাশ বোঝাই নৌকা নিয়ে মায়উ নদী বেয়ে সাগরের দিকে যেতে থাকে।
চরম নির্মমতা আর ভয়ঙ্কর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে মায়উ। ক্ষোভে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছে নদী। উত্তাল ঢেউ বইছে। থেমে থেমে বাতাস বইছে। ক্রমেই ঝড় ঘনীভূত হচ্ছে। এ অবস্থায় লাশ বোঝাই নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারে। ভীষণ ভাবে দুলছে নৌকা। কিন্তু এরপরও থেমে থাকার সুযোগ নেই। নদীর পাড়ে অস্ত্র হাতে সৈন্যরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের নির্দেশ নৌকা বোঝাই লাশগুলো সাগরে নিয়ে ফেলতে হবে যেকোনোভাবেই হোক। এর অন্যথা হলে তাদেরকেও লাশ হতে হবে। ঝড় তুফান অপেক্ষা করে লাশ বোঝাই নৌকাটি মায়উ নদী অতিক্রম করে সাগরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status