শেষের পাতা

সিপিডির বাজেট আলোচনা

ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২৫ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:০২ পূর্বাহ্ন

সিপিডি আয়োজিত প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, ব্যাংক সেক্টরে রিফর্মস (সংস্কার) এনে ভালোদের পুরস্কৃত করা হবে। আর খারাপরা যতই   প্রভাবশালী হোক তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে পাওনা আদায় করা হবে। ব্যাংক নিয়ে যে দুর্ভাবনা আছে, তা ঠিক করতে দুই মাসই যথেষ্ট।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত সিপিডি বাজেট ডায়লগ অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এ কথা বলেন। সিপিডি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সংলাপে বক্তব্য রাখেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাদ কবির। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সঞ্চালনা করেন সিপিডি’র বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
স্বাগত বক্তব্যে সিপিডি চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, ব্যাংক খাতে এখন স্বল্প মেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানতের ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার ফলে এসব স্বল্পমেয়াদি আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে; যা আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে আরো বিপজ্জনক করে তুলছে। রেহমান সোবহান বলেন, দীর্ঘমিয়াদি বিনিয়োগের জন্য বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছিল। আশি ও নব্বইয়ের দশকে এসব প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়েছিল। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি ও বড়, নতুন বিনিয়োগের উৎস হিসেবে পরিচিত শেয়ারবাজার কার্যকর নয়। তিনি মনে করেন, ঋণের প্রাপ্যতা ও বিনিয়োগের সুরক্ষার জন্য আর্থিক খাতের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। রেহমান সোবহান বলেন, বাংলাদেশে আজকে ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি, এটা এই সরকারের সৃষ্টি নয়। বরং এটা অনেক বছরের জিইয়ে রাখা একটা সমস্যা। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল থেকে এটার শুরু। এরপর থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এ সমস্যা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে।
মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েই ক্ষান্ত হলে হবে না। আমাদের গতিশীল কর্মকাণ্ড দিয়ে দেশকে আরো উন্নত করার তাগিদ থাকতে হবে। ভিয়েতনাম প্রায় আমাদের সমান সম্পদ নিয়ে কতটা উন্নতি করেছে, আমরা তা পারিনি। আমরা যেখানে এখনো মাত্র ৪০ বিলিয়ন রপ্তানি করি, সেখানে ভিয়েতনাম করে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা আমীর খসরুকে উদ্দেশ্য করে পরিকল্পনামন্ত্রী মোস্তফা কামাল বলেন, আপনাদের (বিএনপি সরকারের আমলে) সময় কত মাস ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাওয়া যায়নি। আমাদের সময় অনিয়ম হয়নি এমন কথা বলবো না। তবে আমরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের রিফর্মস আনবো। রিফর্মস এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো শক্তিশালী করবো। তিনি বলেন, আমরা কোনো ব্যবস্থা নেইনি এমন অভিযোগ সঠিক না। উইন উইন সিচুয়েশন আমরা ম্যাচ করবো। যারা ভালো তাদের যত প্রকারের উৎসাহ দেয়া যায় দেয়া হবে। আর খারাপ যারা আছে, তারা যত বড়ই হোক তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং তাদের কাছ থেকে পাওনা আদায় করা হবে। ব্যাংক খাতের করপোরেট কর কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, রপ্তানি ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। করপোরেট ট্যাক্স অনেক বেশি। এ ট্যাক্স নেট যদি আমরা না কমাই বিদেশিরা বিনিয়োগ করবে কেন?
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে লক্ষ্য করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, জাফরুল্লাহ ভাই, আপনি ভোটে দাঁড়ান, আমি ফান্ডিং করবো। আমাদের তো একটাই দোষ যে, ভোট ছাড়াই সরকার গঠন করেছি। এছাড়া বিএনপি অংশ না নেয়ায় ভোট ছাড়াই নির্বাচন হয়েছে।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, টাকা নেই বলে কোনো ব্যাংককেই কোনো চেক রিটার্ন হয়নি। ফারমার্স ব্যাংককে আমরা হাতে নিয়েছি। এটা লুটপাট এবং শেষ হয়ে গেল- এমন মন্তব্য করার সুযোগই এ মুহূর্তে নেই। শিক্ষিত বেকারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের লেবার যারা, কোথাও বেকার নেই। আমি মনে করি, যারা বেকার আছে তারা ইচ্ছা করেই বেকার। ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে এমএ মান্নান বলেন, ব্যাংকিং খাত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমের সমালোচনা হয়েছে। তারা কেন আরো বেশি স্বাধীন হচ্ছে না? এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের দেশে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে স্বাধীনতা দিলেও স্বাধীন থাকতে চায় না। আমি সরকারের বেতনে কাজ করেছি, নিম্ন পর্যায় ও মধ্য পর্যায়ে। তখন এর সত্যতা দেখেছি। কোনো কর্মকর্তাকে স্বাধীনতা দেয়া হলেও রাত শেষে সচিব সাহেবের অফিসের সামনে এসে হাঁটাহাঁটি করেন।
এর আগে বিএনপি নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ আলী চৌধুরী বলেন, ইদানীং দেশের পাঁচ শতাংশ লোকের আয় কতগুণ বেড়েছে তা আমরা জানি না। তবে যা বেড়েছে তা অবিশ্বাস্য। তারা সারা বিশ্বে বাড়িঘর কিনছে। তাদের টাকা রাখার জায়গা নেই। সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে এ পাঁচ শতাংশ মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় আনা গেলে এনবিআরের ট্যাক্স আদায় বহুগুণ বেড়ে যাবে। এসবিআরকে তাদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, যারা ব্যাংক লুট করছে, আপনারা তাদের ট্যাক্স কমিয়ে দিচ্ছেন। আবার যারা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিচ্ছেন না। ব্যাংকিং ডিভিশন বলে আপনারা যে জিনিসটা তৈরি করেছেন, এটাকে অবলপন করে দেন। দয়া করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজগুলো তাদের করতে দেন। একটি হোটেলে ব্যাংক মালিকদের সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যাওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে হোটেলে নিয়ে সিআরআর কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। চিন্তা করেন ইনস্টিটিউশন কোথায় গেছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর একটি প্রতিষ্ঠান, ওই প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত। সেই গভর্নরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হোটেলে। কারা হোটেলে? সব ব্যাংকের মালিকরা বসে আছে। তাদের বড় অংশই ব্যাংক লুটেরা। ব্যাংক লুটপাট করে এমন জায়গায় নেয়া হয়েছে আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারছে না। তিনি বলেন, ৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে কারা আছে দেশের মানুষ তা জানে। কারা ফারমার্স ব্যাংক লুট করেছে? কারা ব্যাংক-শেয়ারবাজার লুট করেছে? বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর তো ৮-১০ মিলিয়ন ডলার বাইরে যাচ্ছে। এ টাকা কারা নিয়ে যাচ্ছে? তাদের সম্পদ বিদেশে থাকলো, আইন মেনে আপনি এদের চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, ভোটের প্রয়োজনীয়তা না থাকায় এবারের বাজেটে ভোটারদের জন্য কিছু রাখা হয়নি। ওই ধনী ৫ শতাংশ মানুষ এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। তাদের জন্য বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, দেশের অর্থনীতি ডায়াবেটিকস রোগীর মতো তিলে তিলে নিঃশেষের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের জিডিপি গ্রোথের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়ছে না। এটার সমন্বয় না করতে পারলে ডায়াবেটিকস রোগীর মতো অর্থনীতি শক্তি হারিয়ে ফেলবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) নিহাদ কবির বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। কোথায় যেন আস্থার অভাব আছে। তিনি মনে করেন, ব্যাংকগুলোকে সরকার নতুন করে তহবিল দিচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর অদক্ষতাই প্রকাশ পায়।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো রওনক জাহান বলেন, অনেকে এবারের বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট বলেছেন। দরিদ্র মানুষের জন্য প্রতিবার বরাদ্দ থাকে। সামাজিক সুরক্ষায় বাজেট বাড়ছে। এটি সত্য হলেও এ দিয়ে ভোটার টানা যাবে না। সরকারের নয় বছরে সাধারণ মানুষের বৈষম্য বেড়েছে। ফলে এ বাজেটে ভোটার আকৃষ্ট করার কিছু নাই। চলমান বাজেট কাঠামো পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status