শেষের পাতা

বাড়ছে অসংক্রামক রোগীর সংখ্যা

সচেতন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

২৩ জুন ২০১৮, শনিবার, ৯:২৮ পূর্বাহ্ন

দুই বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন জসিম উদ্দিন। ৫৭ বছর বয়সেই তাকে কাবু করে ফেলেছে এ রোগ। দুটি কিডনিই তার অকেজো। কিডনি হাসপাতালের গেটে কথা হয় তার ছেলে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু বাবা যে রোগে ভুগছেন তা ব্যয়বহুল। তাদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ সিঙ্গাইর উপজেলার মেদুলিয়ায়। কেবল জসিম উদ্দিন নন, বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন দেশে দিন দিন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অসংক্রামক রোগে বেশি  লোক মারা যাচ্ছে। ক্যানসার, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, কিডনি রোগ ইত্যাদিতে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আর আগে মানুষ বেশি মারা যেত ছোঁয়াছে রোগ কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদিতে। তারা বলেন, জীবনযাত্রার ধরন তথা লাইফস্টাইল পরিবর্তনের কারণে রোগের ধরনে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। ফলে এখন ৬০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হচ্ছে আগের মতো সংক্রামক ব্যাধিতে নয় বরং অসংক্রামক রোগে বা এনসিডিতে। তাই অসংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসকরা বলেছেন, অতিমাত্রায় তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যানসারে। আবার অনিরাপদ খাদ্যগ্রহণকেও চিকিৎসকরা ক্যানসারের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন। কৃষিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের খাদ্যদ্রব্যকে করে তুলছে অনিরাপদ। এর ওপর রয়েছে ফলমূল ও মাছে ফরমালিনের ব্যবহার। বায়ুদূষণকেও ক্যানসার বিস্তারের আরো একটি কারণ বলে মনে করেন তারা। বাতাসে সীসার পরিমাণ বৃদ্ধি ক্যাসারের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার) এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে বাংলাদেশসহ বিশ্বে সামপ্রতিক সময়ে চারটি মেগা-ট্রেন্ডস ক্রিয়াশীল যার প্রভাবে এসডিজি পর্বে স্বাস্থ্যের পরিমাণগত ও কৌশলগত গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ প্রসূত জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় আজকের বিশ্বে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। রোগের ধরনের পরিবর্তন তথা এপিডিমিয়োলজিকাল ট্রানজিশন। চতুর্থ মেগা-ট্রেন্ড হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা খরচজনিত পারিবারিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক ঝুঁকি। যা আউট অব পকেট খরচ হিসেবে বিশ্লেষক মহলে পরিচিত পেয়েছে। এক হিসাবে বাংলাদেশের এধরনের অর্থনৈতিক বোঝার কারণে প্রায় ৪০ লাখ লোক নতুন করে দারিদ্র্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রসূত সমস্যা নিরসনে জলবায়ু বিশেষজ্ঞদেরও স্বাস্থ্য আলোচনায় সামিল হতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা সমাধানে বড় ও ছোট দুই সমাধানের পথেই আগাতে হবে। অসংক্রামক ব্যাধি কি এমনই বেড়ে গেছে। জীবন-প্রণালির ধরনের বিষয়ও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি, স্বাস্থ্য-সচেতনতা, খাদ্যাভাসের মধ্যে শৃঙ্খলা- এসব বিষয়ে জনমত গড়ে তোলা জরুরি  বলে গবেষণায় তুলে ধরা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক পরিসংখানে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোগী আসার সংখ্যা বাড়ছে। হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে গত এক বছরে বেড়েছে ১৬ শতাংশ আর বহির্বিভাগে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে তা ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। এতে দেখা যায়, ২০০৯ সালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৪১ হাজার ৫৫৪ জন রোগী, এই বছরের বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নিয়েছিলেন এক লাখ ৬০ হাজার ৮ জন। একইভাবে ২০১০ সালে ভর্তি ৪২ হাজার ৭৭৯ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৬১ হাজার ৯৫৮ জন। ২০১১ সালে ভর্তি ৪৩ হাজার ২৭৫ জন এবং বহির্বিভাগ সেবা গ্রহণকারী সংখ্যা এক লাখ ৬৩ হাজার ৮১৩ জন রোগী, ২০১২ সালে ভর্তি ছিল ৪৪ হাজার ৫৫৯ জন এবং বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়, ২০১৩ সালে ভর্তি হয় ৪৩ হাজার ৩৪১ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নিয়েছে এল লাখ ৭৪ হাজার ৩৬৬ জন, ২০১৪ সালে ভর্তি হয় ৪৯ হাজার ২৪৩ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৫৩৩ জন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে গত এক বছরে ভর্তির ক্ষেত্রে কিডনি রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ শতাংশ আর বহির্বিভাগে সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ার হার ছিল ১৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। হাসপাতালটির পরিসংখ্যান মতে, ২০১৪ সালে ভর্তি ৫ হাজার ৫৫৩ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৬৩ হাজার ৭৫৬ জন। তার আগের বছরে এই সংখ্যা ছিল ভর্তিতে ৪ হাজার ৭৪১ জন এবং বহির্বিভাগে ৫৪ হাজার ৭৩৭ জন। ২০১২ সালে ছিল ভর্তি ৪ হাজার ৪৩৯ জন এবং বহির্বিভাগে ৫০ হাজার ৪১৭ জন। ২০১১ সালে ভর্তি ৪ হাজার ২২৪ এবং বহির্বিভাগে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ১১২ জন। ২০১০ সালে ভর্তি হয় ৪ হাজার ৮৪ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নিয়েছে ৫৩ হাজার ৭০৮ জন। ২০০৯ সালে ভর্তি হয় ৪ হাজার ৩০৯ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৫৩ হাজার ১৯৮ জন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতালের পরিসংখ্যানেও গত এক বছরের তুলনায় রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যানসার রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ ও বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নেয়ার হার ২৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৪ সালে ভর্তি হয় ৪ হাজার ৫৭ ও বহির্বিভাগ  দিয়ে সেবা নেয় দুই লাখ এক হাজার ১৯৫ জন, ২০১৩ সালে ভর্তি ৩ হাজার ৪৫ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে চিকিৎসা গ্রহণকারীর সংখ্যা এক লাখ ৬৩ হাজার ২৯ জন, ২০১২ সালে ভর্তি ৩ হাজার ২০ জন এবং বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নিয়েছে ৫৯ হাজার ২২১ জন। বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যসেবায় দেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করার ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথা বলেছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status