দেশ বিদেশ

নির্যাতন ও মৃত্যুভয়ে ১১ তলা থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নামে শিশু শাওন

স্টাফ রিপোর্টার

২২ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৪ পূর্বাহ্ন

১২ বছর বয়সী জাহিদুল ইসলাম শাওন। অভাবের সংসারের কারণে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে একটি বাড়ির গৃহকর্মীর কাজ নেয়। কিন্তু, গৃহকর্তার শ্যালক ইকবালসহ ফ্ল্যাটের অন্যরাও নানা ছুতোই তাকে নির্যাতন করতো। রান্না ঘরের খুন্তি দিয়ে নানাস্থানে আঘাত করতো। রড দিয়ে পেটাতো। এই নির্যাতন সইতে না পেরে বাড়ি থেকে পালানোর পরিকল্পনা করে সে। বাড়ির মালিক ও দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য বুধবার সন্ধ্যার পর ১১তলা বাড়ির বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে নিচে নামছিল শাওন। বিষয়টি কয়েকজন পথচারী ও এলাকাবাসীর চোখে পড়ে। তারা চিৎকার ও চেঁচামেচি করতে থাকেন। এতে গৃহকর্তা নিচে নেমে শাওনকে আটক করে ভবনের গার্ড রুমে নিয়ে ফের নির্যাতন করেন। এলাকাবাসীর কেউ একজন জরুরি সেবা ৯৯৯ ফোন দিয়ে রমনা থানা পুলিশকে জানান। খবর পেয়ে পুলিশ এসে শাওনকে উদ্ধার করে। এ সময় বাড়ির মালিকের শ্যালক ইকবাল, তার স্ত্রী তামান্না খান ও  ইকবালের ভাগ্নে তানজিলুর রহমানকে আটক করে। তবে ফ্ল্যাটের মালিক ও তার স্ত্রী পলাতক আছে। তাদেরকে আটকের জন্য পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। ভয়ে তটস্থ শাওন রমনা থানায় সাংবাদিকদের জানান, গত ৭ মাস আগে রমনার ইস্কাটন গার্ডেনের ১২/এ, নম্বর বাড়ির ১১তলার ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটে গৃহকর্মীর কাজে যোগ দেয় সে। ওই বাসায় পাঁচজন থাকতো। সবাই আমাকে মারধর করতো। একবার তাদের একটি স্যুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়। তাদের ধারণা আমি চাবিটি চুরি করে টাকা নিয়েছি। এজন্য কখনও আমাকে রড দিয়ে কখনও বৈদ্যুতিক ক্যাবল দিয়ে পেটাতো। একবার বৈদ্যুতিক শটও আমাকে দিয়েছিল তারা। রড দিয়ে পিটিয়ে আমার পায়ের তালুও থেঁতলে দেয়া হয়।
শাওন আরো জানায়, তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার উত্তর সাহেবগঞ্জে। স্থানীয় একটি মাদরাসায় পড়তো। তার বাবার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন কালু। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় জাহাঙ্গীর ইকবালের নানাকে দেখাশুনা করতো। সেই সূত্রে শাওনকে ঢাকায় কাজ করতে পাঠায় শাওনের বাবা। সে আরো জানায়, আমাকে ঢাকায় পড়াশোনা করানোর কথা বলে আনা হয়। কিন্তু, পড়াশোনা তো দূরের কথা দিন-রাত ঘরের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা আমাকে দিয়ে করানো হয়নি। কাজের বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা দেয়া হতো না। সে আরো জানায়, একদিন দিলুরোডের কাঁচাবাজার থেকে বিভিন্ন তরকারি কিনে আনার পর আমাকে অনেক মারধর করা হয়। তামান্না আমাকে বলতো, গত সপ্তাহে কম দামে তরকারি এনেছিলি। এবার বেশি কেন? বল কত টাকা নিয়েছিস?
শাওন জানায়, এরপর একদিন তাদের একটি স্যুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়। স্যুটকেসে নাকি অনেক টাকা ছিল। ইকবালের ধারণা, আমি চাবি চুরি করেছি। তাই আমাকে চিকন রড দিয়ে মারধর করে। তার ভাগ্নে তানজিলুর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরি করছে। সেও এই কথা শুনে বাড়ি ফিরে আমাকে অনেক মারে। চাবি হারানোর পর একদিন বলে, ১০ হাজার টাকা পাচ্ছে না, আরেকদিন বলে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছে না। প্রতিদিনই আমাকে টাকার জন্য মারধর করতো। ইকবাল একদিন সবাইকে ডেকে আমাকে বৈদ্যুতিক শক দেয়। টাকা চুরির কথা স্বীকার না করলে আবার শক দেয়ার হুমকি দেয়। আমি ভয়ে বলি যে, আমিই টাকা চুরি করেছি। ওই ঘটনার কয়েকদিন পর ইকবাল নিজেই স্যুটকেসের চাবি খুঁজে পায়। এরপর আর কিছু বলেনি। সে আরো জানায়, মারধরের ওই ঘটনার পর আমি মাঝে মাঝে ফোনে বাবার সঙ্গে কিংবা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম। তখন আমি যাতে নির্যাতনের কথা না বলতে পারি সেজন্য সবসময় আমার সামনে বসে থাকতো তানজিলুর। একদিন ফোনে কথা বলার আগে ছুরি এনে আমার গলায় ধরে রাখে। আমি যদি ফোনে মারধরের বিষয় বাড়িতে জানাই তাহলে আমাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। আমি ভয়ে বাড়িতে কিছুই বলিনি। রোজার শেষের দিকে তারা আমার বিরুদ্ধে আড়াই লাখ টাকা চুরির অভিযোগ আনে। সে আরো জানায়, যদিও আমি চুরি করিনি। ২০শে জুনের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে আমাকে মারধর করবে আর বাবাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে তারা হুমকি দেয়। নির্যাতন ও মৃত্যু ভয়ে আমি বাথরুম থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নামি। পরে পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে। এত উঁচু ভবন থেকে নিচে নামার সময় ভয় লাগেনি প্রশ্ন করা হলে উত্তরে শাওন জানায়, ছোটকালে গাছে উঠতাম। একটু অভ্যাস ছিল, ভয়ও লেগেছে। কিন্তু, পাইপ বেয়ে না নামলে রাতে আমাকে অনেক অত্যাচার করা হতো। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিই। এ বিষয়ে রমনা থানার ওসি কাজী মাইনুল আলম মানবজমিনকে জানান, স্থানীয়দের কাছে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশ সেখানে গেলে বাড়ির মালিকের শ্যালক ইকবাল শাওনকে চোর বলে আখ্যায়িত করে। পরে তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে এলে তারা ঘটনাটি শিকার করে। তিনি আরো  জানান, শিশুটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে। এ ঘটনায় ফ্ল্যাটের মালিক ও তার স্ত্রীকে আটকের চেষ্টা চলছে। মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status