বাংলারজমিন

কামারচাকের কৃষকের হাসি কেড়ে নিয়েছে বন্যা

মাসুদ আহমদ, মৌলভীবাজার থেকে

২২ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৭:৫৯ পূর্বাহ্ন

বোরো ধান ঘরে তোলার পর কামারচাক ইউনয়নের কৃষকের মুখে এখন হাসি নেই। বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে গোলার ধান, গোয়ালের গরু, বিধ্বস্ত হয়েছে ঘর-বাড়ি। অবস্থা সম্পন্ন কৃষক পরিবারের সদস্যরা এখন ত্রাণের জন্য ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে ত্রাণ পাওয়ার আশায়। ঘর-বাড়ি মেরামতের জন্য সরকারি সাহয্যের আশায় আছেন। এ ইউনিয়নের ৪২ গ্রামের ২৯ হাজার মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত। সাড়ে ৩ হাজার বাড়িঘর ধসে পড়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৌলভীবাজারে মনু নদীর বাঁধ ভাঙা বন্যার পানি রাজনগরের কামারচাক ইউনিয়নের সব গ্রাম থেকে এখনো নামেনি। মনু এবং ধলাই নদীর ঠিক মাঝে অবস্থিত এই ইউনিয়নের ৪২টি গ্রামের প্রায় সবকটিই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রামগুলোর বাড়ি-ঘরে এখনো পানি। মানুষ আত্মীয় স্বজন ও আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। গ্রামীণ সড়কে সড়কে হাঁটুপানি, কোমর পানি। কেউ আশ্রয় কেন্দ্র বা আত্মীয় বাড়ি থেকে এসে পানি সাঁতরিয়ে বা কলার ভেলায় চড়ে বসতভিটের অবস্থা দেখে যাচ্ছে। বুধবার (২০শে জুন) সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে ইউনিয়ন পরিষদের লাগোয়া মশাজান গ্রাম এখনো ফাঁকা, পশ্চিম দিকের যে দু-একটি বাড়ির ভিটে ভেসে উঠেছে তা বসবাস উপযোগী হয়নি। ঘরের ভেতর কাদামাটি, পলিমাটির আস্তরণ পড়েছে। কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত। এক সপ্তাহের বন্যায় ঘরের বাঁশ-বেতের বেড়া (আড়া), মাটির দেয়াল সব বিনষ্ট হয়ে গেছে। পশ্চিম মশাজান গ্রামে ঢুকেই দেখা যায়, স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্র শিহাব উদ্দিন বিধ্বস্ত প্রায় নিজ বাড়ির ঘরের ভেতর থেকে কোদাল দিয়ে টেনে কাদা-মাটি বের করছে। ভেতরে তার মা ঘরে বসবাস উপযোগী করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন। তা পিতা আলাল মিয়া কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে বাড়ির বাইরে গেছেন। শিশু শিহাব জানায়, ঈদের দিন সকালে বন্যার পানি ঘরে প্রবেশ করলে বাড়ি ঘর ফেলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে উঠেন পাশের ইউনিয়নে আত্মীয়বাড়িতে। ঈদ করা হয়নি। নতুন জামা-কাপড় কেনা হয়নি ঈদের আগে বন্যা আতঙ্কে। সকালে (বুধবার) থেকে বাড়ির পানি নামছে খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন ঘরের বেড়া প্রায় সবই ভেঙে পড়েছে। ভেতর কাদা-মাটিতে ভরা। তাই মায়ের সঙ্গে নিজেই কোদাল নিয়ে নেমে পড়েছে ঘর বসবাস উপযোগী করতে। জানায় বাড়ি ছাড়ার আগেই তার বইপত্র যত্নেই রেখে গিয়েছিল তাই নষ্ট হয়নি। এখন ঘর বসবাস উপযোগী হলেই মনোযোগ দিতে চায় পড়ায়। একই গ্রামের মানিক মিয়া ও মনির মিয়ার বাড়ির একই অবস্থা। বাড়ির উঠোনে কোমর পানি। ঘরের নানা স্থানে বন্যার তাণ্ডবের চিহ্ন। বিদ্যুতের মিটারের নিচের অংশে বন্যায় আসা পলি মাটির দাগ পড়েছে। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক জয়নাল আবেদিন শিবু একই গ্রামের বাসিন্দা। বাড়িতে পানি। তাই পরিবার অন্যত্র। জানান এই ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়ে গেছে। কোনোটা মাটিতে পড়ে গেছে। বসবাস উপযোগী করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু এসব পরিবার খুবই গরিব। শিবু আরো বলেন, এখন বন্যাদুর্গত এলাকায় বাতাসে দুর্গন্ধ। সিলেট মদন মোহন কলেজের সমাজ কর্ম বিভাগের শিক্ষক মশাজান গ্রামের আবুল কাশেম বলেন ঈদের ছুটিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়ি আসেন। কিন্তু ঈদের দিন ভোরবেলা ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ে। উপায়ন্তর না দেখে বুক পানি ভেঙে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে পাঠান। ঈদের নামাজ পড়া হয়নি। তিনি আরো বলেন, এই সময় এলাকার মানুষের অবস্থা যারা দেখেছে তারাই শুধু বুঝতে পেরেছে মানুষ কী ভয়ানক অবস্থার মধ্যে গেছে এবং বাড়ি ছেড়েছে। কামারচাক ইউনিয়ন কার্যালয়ে ত্রাণ বিতরণ হচ্ছিল বুধবার। হাজার হাজার নারী-পুরুষ। ইসলামপুর গ্রামের কৃষক মফিজ মিয়া (৬০) স্ত্রী ফয়জুন্নেছা (৫০) ও কন্যা হাসনা (২২)কে নিয়ে ইউনিয়ন কার্যালয়ের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিষণ্ন মুখে। জানালেন নিজের ১২ কিয়ার (৩০ শতকে ১ কিয়ার) বোরো খেতের ধান তুলে ছিলেন। কিন্তু বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দুটি গরু, সব ধান, চাল। এখন সাহায্য ছাড়া উপায় নাই। কথা হয় দ. কড়াইয়া গ্রামের ছাদ আলী (৪৫), আবদার নির্মল দাশ (৪০), জয়নাল মিয়া (৪২), হাটিকড়াইয়ার খতিফুন বেগম (৩৫), পঞ্চাননপুর গ্রামের কদর মিয়া (৪০) সহ অনেকের সঙ্গে। জানান এই মৌসুমে বোরো ফসল ভালো হয়েছিল। কোনো দুর্যোগ ছাড়াই সবাই ফসল উঠাতে পারেন ঘরে। খেতের প্রচুর ধান থাকায় এবার সবার মাঝে হাসি-খুশি ছিল।

১৩ই জুন মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে কামার চাকের ভোলানগরের ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করলেও ঈদকে সামনে রেখে কেউ বাড়ি ছাড়তে চায়নি। গত ২০-২২ বছরের তাদের বন্যার যে অভিজ্ঞতা তা ছিল পানি একদিকে আসবে ২-১ দিনের মধ্যেই নেমে যাবে। কিন্তু এবারের বন্যা সব অভজ্ঞতা ছাড়িয়ে যাবে তা বুঝতে পারেননি। বন্যার পানি ছুঁয়েছে অনেকের ঘরের টুল্লি (ছাদ) পর্যন্ত। তাই খোয়াতে হয়েছে গোলার ধান, গোয়ালের গরু, ঘরের আসবাবপত্র।
কামারচাক ইউপি চেয়ারম্যান নাজমুল হক সেলিম জানান, ইউনিয়নের ২৯ হাজার মানুষের প্রায় সবাই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ৪২টি গ্রামের প্রায় ৩ হাজার ৫শ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও ধসে পড়েছে। ২ হাজার টিউবওয়েল অকেজ। ইতিমধ্যে ৮৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। নগদ টাকা দিয়ে প্যাকেট করে চিড়া ও গুড় দেয়া হচ্ছে। তবে চিড়ার স্থানীয়ভাবে সংকট রয়েছে। নাজমুল হক সেলিম জানান ধান (বোরো) ফসল তোলারপর কৃষকের মুখে যে হাসি ছিল সেই হাসি আর নেই। সব মনু নদীর বাঁধ ভাঙা বন্যায় ভেসে গেছে। ভেসে গেছে কৃষকের ধান, চাউল, গরু, ছাগল। তার দাবি দ্রুত মনু নদীর বন্য প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামতের।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status