দেশ বিদেশ

হুমকির মুখে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ

কাজী সোহাগ

২০ জুন ২০১৮, বুধবার, ৯:৩২ পূর্বাহ্ন

একটি প্রজ্ঞাপনের কয়েকটি শর্তে হুমকির মুখে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হতে চলেছে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের। এ চিত্র মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিকারক থেকে উৎপাদকে পরিণত হতে ইচ্ছুক উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর দেশের মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিকারকরা উৎপাদকে পরিণত হওয়ার ঘোষণা দেন। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর তারা ঘোষণা দিলেন, উৎপাদক হওয়ার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন এবং আমদানিকারক থাকতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। তারা বলছেন, মাঝখানে উৎপাদক হওয়ার স্বপ্নে যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে তা এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ স্থাপিত কারখানা চালুর আগেই বন্ধ করে দেয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের যে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছিল, তাও বন্ধ হয়ে যাবে। মোবাইল হ্যান্ডসেট শিল্পে  ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্নও মাঝ পথে থেমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গত বছরের প্রজ্ঞাপন সুবিধার কারণে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দ্রুততম সময়ে সংযোজন কারখানা স্থাপন করেছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত ব্র্যান্ড হচ্ছে- স্যামসাং, সিম্ফনি, আইটেল, ওয়ালটন ও উই। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে জারি করা হয় ভ্যাট সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন-১৬৮তে এমন কয়েকটি শর্ত দেয়া হয়েছে। যার ফলে বিদেশের কারখানায় তৈরি মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট, আমদানি শুল্কসহ মোট কর দিতে হবে ৩১ শতাংশ। আর দেশে সংযোজন কারখানা স্থাপনকারীদের শুধু যন্ত্রাংশ আমদানিতে কর দিতে হবে ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ আমদানির চেয়ে দেশের কারখানায় সংযোজন কর বেশি। সম্প্রতি প্রজ্ঞাপনটির কারণে মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরির সদ্য স্থাপিত কারখানা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন স্যামসাং, টেকনো, সিম্ফনি, ওকে মোবাইলসহ এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা জানান, এতে তথ্য প্রযুক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। দেশের মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজার আরো বেশি চোরাচালানিদের দখলে চলে যাবে। এদিকে প্রজ্ঞাপনের কয়েকটি শর্ত দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজন ও উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলে দাবি করেছে মোবাইল ফোন আমদানিকারক সংগঠন বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ)। অযৌক্তিক এসব শর্তে বিনিয়োগকারীরা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে, মোবাইল সংযোজন শিল্প টিকবে না এবং হাজার হাজার শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। এর ফলে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ স্বপ্ন চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে ট্রান্স বাংলাদেশ লিমিটেড (আইটেল) সিইও রেজওয়ানুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমার ফ্যাক্টরিতে অন্তত ১২শ’ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। এরইমধ্যে ১শ’ কোটি টাকার ওপর বিনিয়োগ করেছি। এখন যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে সব বন্ধ করে দিতে হবে। গত কয়েক দিনে আমরা মন্ত্রণালয় ও এনবিআরে দৌড়ঝাঁপ করেছি। যারা বিষয়টি শুনছে তারাই এটাকে অযৌক্তিক বলছেন। এখন অপেক্ষা করছি সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে। প্রজ্ঞাপন যদি পরিবর্তন করা না হয় তাহলে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। চাকরি থেকে বঞ্চিত হবেন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। মাত্র গত বছর প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বছরই তার বিপরীত প্রজ্ঞাপন জারি বিনিয়োগকারীদের বিস্ময় এবং হতাশার সৃষ্টি করেছে জানিয়ে বিএমপিআইএ সভাপতি রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, মোবাইল প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোই একটি পূর্ণাঙ্গ মোবাইল ফোন তৈরির জন্য অনেকগুলো সহযোগী শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্রাংশ সরবরাহ নিয়ে তা সংযোজনের মাধ্যমেই নিজস্ব ব্র্যান্ড-এর মোবাইল উৎপাদন করে। মোবাইল একটি প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্প, যেখানে বিশ্বের কোনো কোম্পানিই এককভাবে সবগুলো যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করে না, সেখানে বাংলাদেশে তা কীভাবে সম্ভব। একই প্রসঙ্গে তথ্য- প্রযুক্তি বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক রাশেদ মেহেদি জানিয়েছেন, ভোগ্যপণ্যের দুনিয়াতে এখন যত বড় ব্র্যান্ড আছে তারা কেউই কার্যত কোথাও সিকেডি বা পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন ও সংযোজন করে না। কারণ একটি পূর্ণাঙ্গ পণ্যের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পৃথক কারখানায় তৈরি হয়। অর্থাৎ একটি পণ্যের উৎপাদন ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে’ অনেকগুলো পৃথক পণ্য উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। যেমন- আই ফোন। এই হ্যান্ডসেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি কোয়ালোকম নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে মাইক্রো প্রসেসরসহ চিপসেট নেয়, স্যামসাংয়ের কাছ থেকে নেয় এলসিডি স্ত্রিন। আবার এর হাউজিং, কেসিং করে পৃথক একটি কোম্পানি। চার্জার বানায় অন্য একটি কোম্পানি। ক্যামেরা এবং অডিও সিস্টেমের সরবরাহ নেয়া হয় অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এভাবে পৃথক প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রাংশ নিয়ে অ্যাপলের কারখানায় সংযোজিত হয়ে তৈরি হয় আই ফোন। এমন ঘটনা শুধু স্মার্টফোন নির্মাতা কোম্পানির ক্ষেত্রে নয়; ডেল এইচপি আসুসের মতো ল্যাপটপ, ডেস্কটপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা টয়োটা, বিএমডব্লিউর মতো গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি বলেন, আমরা দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর উদাহরণও দিতে পারি। একটি গার্মেন্ট কারখানায় শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, সোয়েটার বানানো হয়। এখানে কাপড়, বোতাম, জিপার সবকিছু সরবরাহ করে পৃথক কোম্পানি। এখন যদি বলা হয়, নিজস্ব টেক্সটাইল, বোতাম এবং জিপার কারখানা না থাকলে সেটাকে গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদন কারখানা বলা হবে না, সেটি কি যৌক্তিক হবে? রাশেদ মেহেদি জানান, একইভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনও ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে’ পৃথক কারখানার যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। গার্মেন্ট কারখানার মতোই এখানে অনেকগুলো যন্ত্রাংশ নিপুণভাবে জুড়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হ্যান্ডসেট তৈরি হয়। অথচ এসআরও-১৬৮তে দেশে স্থাপিত মোবাইল হ্যান্ডসেট কারখানায় ‘হাউজিং প্ল্যান্ট’ থাকতে হবে! প্রজ্ঞাপন জারিতে অজ্ঞতা স্পষ্ট হয়ে যায় এই একটি শর্তেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status