দেশ বিদেশ

সৌদিফেরত নারীরা ঠাঁই পাচ্ছেন না পরিবারেও

রোকনুজ্জামান পিয়াস

১৯ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

ভাগ্য বদলের আশায় সৌদি গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন অনেক নারী। অনেকে ফিরেছেন নির্যাতনের গভীর ক্ষত নিয়ে, আবার অনেকে ফিরেছেন রোগাক্রান্ত হয়ে। এসব কারণে এদের কেউ কেউ ফিরতে পারছেন না পরিবারের কাছে। ঠাঁই হচ্ছে না পিতা, স্বামী এমনকি সন্তানদের কাছেও। মান-সম্মানের দোহায় দিয়ে তাদের বের করে দেয়া হচ্ছে বাড়ি থেকে। কেউ কেউ রোগাক্রান্ত হলেও চিকিৎসা মিলছে না। আবার কারো কারো বাড়িতে আশ্রয় মিললেও পরিবারের সদস্যদের কাছে ভালো আচরণ পান না। সমাজে তারা অনেকটা অচ্ছুতের মতো হয়ে বসবাস করেন। এদের মধ্যে যাদের খোঁজ মিলছে তাদেরকে সহযোগিতা করছে দু-একটি বেসরকারি সংস্থা। তাদের সাময়িক আশ্রয়, কাউন্সিলিং, আর্থিক, কর্মসংস্থানসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। তবে সংস্থাগুলো বলছে, বিদেশ ফেরত এসব  অসহায় নারীদের বৃহৎ পরিসরে পুনর্বাসনের জন্য সরকারি সহযোগিতার বিকল্প নেই। তাদেরকেই সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত। কতজন নারী, কোন ধরনের ঘটনার শিকার হয়ে ফিরছেন তা তাদেরই ভালো জানার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তাদের কাছে সে পরিসংখ্যান নেই। গত রোববার আশকোনার ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে কথা হয় নীলফামারীর চল্লিশোর্ধ্ব এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, গত ৬ মাস আগে গিয়েছিলেন সৌদি আরব। দেশটির রিয়াদে একটি বাসাবাড়িতে তাকে কাজ দেয়া হয়। তিনি বলেন, ওই বাসার ম্যাডাম ভালো ছিলেন। তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। কাজ একটু বেশি করতে হতো। এই নারী বলেন, কাজ বেশি করতেও আমার আপত্তি ছিল না। কারণ আমি সেখানে গিয়েছিলাম কাজই করতে। কিন্তু সমস্যা ছিল মালিক তাকে খুব নির্যাতন করতো। প্রায়ই মদ খেয়ে এসে তাকে মারতো। বুট জুতা খুলে বেধড়ক মারতো। মাঝে মাঝে মনে হতো আর বাঁচবো না। এভাবে ওই বাসায় চার মাস কাটে। একদিন বাইরে থেকে মদ খেয়ে এসে আবারো মারধর করতে থাকে। তার হাত থেকে রেহাই পেতে তিনি পালিয়ে যান। রাস্তায় পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। এরপর ট্যাক্সি করে দূতাবাসে পাঠিয়ে দেয়। তিনি বলেন, সেখান থেকে তাকে সফর জেলে পাঠায়। সাত দিন পর তাকে দূতাবাসের সেইফ হোমে পাঠানো হয়। এর চার দিন পর তিনি গত ১৯শে মে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু দেশে এসেও তিনি ফিরতে পারেননি স্বামীর ভিটায়। স্বামীহারা এই নারী জানান, তার বড় দুই ছেলে বিয়ে করে সংসার করছেন। আর একটা কিশোরী মেয়ে এখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ওই মেয়ের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করেই তিনি বিদেশ গিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেরা শাসিয়েছে যেন বাড়ি না ফিরি। এই অবস্থায় ব্র্যাক-এর আল আমিন নয়ন আমাকে এয়ারপোর্টে আসার পর কিছু টাকা দেন। পরদিন মিরপুরের দিয়াবাড়ি এলাকায় আমি একটি গ্যারেজে রান্নার কাজ নিই। তিনি বলেন, এখানে আমাকে থাকা-খাওয়া দেয়। আর মাসে ৬ হাজার টাকা বেতন দেয়। তিনি বলেন, সৌদি আরব যাওয়ার সময় ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম দালালকে। সবমিলে এখনো এক লাখ টাকার মতো ঋণ আছে। মেয়েটারও পড়াশোনা চালাতে হচ্ছে। ভাগ্যাহত জুরাইনের আরেক নারী। তিনিও সৌদি আরব গিয়েছিলেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। কিন্তু সেখানেও তাকে একের পর এক হাত বদল হতে হয়েছে। আর মুখোমুখি হয়েছেন নিত্য-নতুন নির্যাতনের। তিনি বলেন, প্রথমে তাকে রিয়াদের একটি বাড়িতে কাজ দেয়া হয়। কিন্তু ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। এতে করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থাবস্থায় কাজ করতে না পারায় মারধর করা হয়। পরে তাকে একটি মক্তবে (তার ভাষায় নারী বেচাকেনার হাট) পাঠানো হয়। তিনি বলেন, সেখানে আরো ১০-১২ জন নারী ছিলেন। তাদের সারিবদ্ধ করে বসানো হয়। তাদের মুখোমুখি বসে ৪-৫ সৌদিয়ান। এদের মধ্যে একজন আমাকে পছন্দ করে ৪০ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে যায় জেদ্দাতে। সেখানে বাসাবাড়িতে কাজ দেয়। সেখানে একমাস ৭ দিন কাজ করার পর বেতন চাইলে মারধর করে। ওই গৃহকর্তা, তার মা-বোন সবাই মিলে তাকে মারধর করতো। তার গোপনাঙ্গে আঘাত করতো। এতে তার মূত্রনালি ফেটে যায়। এরপর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে পুলিশের কাছে যান। গৃহকর্তা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। মারধর করে। পরে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে কয়েক গৃহকর্তার কাছে তার হাত বদল হয়। এক সময় অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে দূতাবাসে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে দেশে ফেরেন তিনি। অসহায় এই নারী বলেন, তার স্বামী ট্রাক চালাতো। একটা দুর্ঘটনায় তার পা খোঁড়া হয়ে গেছে। তিনি এখন ভিক্ষা করেন। সংসারে দুই মেয়ে। তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বিদেশ গিয়েছিলেন। কথা বলতে বলতে এক সময় হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। বলেন, এখন আমার বাড়িতে জায়গা নেই। সৌদি থেকে ফিরে বাড়িতে গেলে ভাসুর এবং স্বামী মারধর করে তাকে বের করে দিয়েছে। এখন আশ্রয় নিয়েছেন বোনের বাড়িতে। তিনি বলেন, তার চিকিৎসা দরকার। জরায়ুতে ইনফেকশন হয়েছে।
একইভাবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে নভেম্বর মাসে সৌদি আরব গিয়েছিলেন বরিশালের আরেক নারী। এক হাজার রিয়াল বেতন দেয়ার কথা থাকলেও ফিরেছেন শূন্য হাতে। সেই সঙ্গে সহ্য করতে হয়েছে নানা রকম নির্যাতন। তিনি বলেন, আমি গিয়েছিলাম নভেম্বর মাসে। ঠিকমতো খাবার দিত না। মারধর করতো। বেতন চাইলেই মারধর করতে শুরু করতো। পিঠে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়েছে, অনেক নির্যাতন করেছে। তারপর আমি পালিয়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় নিই। এরপর আমাকে সফর জেলে পাঠায়। একটা  সৌদি টাকা দুই চোখে দেখি নাই। তিনি বলেন, স্বামী ও শিশু সন্তানকে রেখে গিয়েছিলেন পরিবারে শান্তির জন্য। এখন ফিরে আসার পর সেখানেও ঠাঁই হচ্ছে না। তিনি বলেন, সৌদি আরবে নির্যাতনের পর ফিরে আসা নারীর স্বামী কী করতে পারে, আপনি তো বোঝেন। এ ব্যাপারে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, এই সব নারীকর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স সরকার পায়। স্বাভাবিকভাবে তারা বিপদে পড়লে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, যারা বিদেশ যাচ্ছে তারা দারিদ্র্যের কারণেই যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে ফিরে এসে আরো দরিদ্র হচ্ছে। তিনি বলেন, তাদের প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ সকলেরই দায়িত্ব রয়েছে। বলেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status