এক্সক্লুসিভ

শিক্ষার্থী ভর্তিতে সতর্কতা

ইউজিসি’র ‘ম্যানেজ’ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে প্রশ্ন!

স্টাফ রিপোর্টার

২৭ মে ২০১৮, রবিবার, ৯:২৩ পূর্বাহ্ন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সতর্ক করে গত ২৩শে মে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে। প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষার পর এ বিজ্ঞপ্তি দিলেও এবার রাঘববোয়ালদের বাদ দিয়ে চুনোপুঁটিদের অভিযুক্ত করায় বির্তকের মুখে পড়েছে মঞ্জুরি কমিশন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরাও প্রশ্ন তুলেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়ার কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে শোকজ এবং ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসের কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি’র সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠকে। কিন্তু সম্প্রতি দেয়া ইউজিসি’র গণবিজ্ঞপ্তিতে এ ১২টি মধ্যে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হলে তাদের ভবিষ্যৎ কি তার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। এটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি’র মধ্যে।
সূত্র জানিয়েছে, এ গণবিজ্ঞপ্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর সে তালিকা চলে যায় অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। এরপর ইউজিসি’র চেয়ারম্যানের টেবিলের এক সপ্তাহ আটকে থাকার পর অনেক প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। অভিযুক্ত না হওয়ার পরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নতুন করে ঢুকানো হয়। যাদের বিরুদ্ধে আউটার ক্যাম্পাস চালানোর কোনো অভিযোগ নেই। অথচ রাজধানীতে প্রকাশ্যে আউটার ক্যাম্পাস চালিয়ে সনদ বাণিজ্য করার অভিযোগ থাকলেও এদের নাম তালিকায় আসেনি। এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ছিল অভিযুক্ত সবার বিরুদ্ধে গণহারে সর্তক করে গণবিজ্ঞপ্তি দেয়ার। কিন্তু ইউজিসি তা না করে নামসর্বস্ব কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে সতর্ক করলে রাঘববোয়ালদের ছাড় দিয়েছে। এটাকে ম্যানেজ বিজ্ঞপ্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অনেকেই। বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে ইউজিসি’র চেয়ারম্যানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট শাখার উপ-পরিচালক জেসমিন পারভীন বলেন, এ ব্যাপারে কথা বলার এখতিয়ার কেবল চেয়ারম্যান স্যারের।
গত ২৩শে মে ইউজিসি’র গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সতর্কতা জারি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মালিকানা দ্বন্দ্ব, অনুমোদন না নিয়ে ক্যাম্পাস চালানো এবং সরকার বন্ধ করার পর কোর্টের আদেশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা, ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার নামে ক্যাম্পাসে ভর্তিও ব্যাপারে সতর্কতা দেয়া হয়। তবে অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস নিয়ে ঘাপলা পাকিয়েছে ইউজিসি। সেখানে বলা হয়, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চট্টগ্রামের ক্যাম্পাসের বাইরে ধানমন্ডির ৬৩ সেন্ট্রাল রোডে বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদিত ক্যাম্পাস আছে বলে জানানো হয়। কিন্তু গত ১৫ই মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত ক্যাম্পাস বন্ধ করা হয়েছে ইউজিসিকে জানানো পরও তাদের নামে সর্তকতা জারি করেছে। দি পিপল্‌স ইউনিভার্সিটি রাজধানীর আসাদ এভিনিউর বাইরে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টির অননুমোদিত একটি ক্যাম্পাস ২০১৫ সালে বন্ধ করার পরও এখন এ ক্যাম্পাসের নামে সর্তকতা জারি করে আসছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার অনুমোদিত ক্যাম্পাস বনানীর ১৪ নং রোডের ৭৬-৭৭ নং বাড়ি। পাশেই ১৭ নং রোডের ৭২ নং বাড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির বিভাগ ও ল্যাব চালুর অনুমতি রয়েছে ২০১৬ সাল থেকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে এ অনুমতি চিঠি আলাদাভাবে দেয়ার পরও একটি বিভাগের ভবনকে অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস বলে বিজ্ঞপ্তিতে চালিয়ে দিয়েছে ইউজিসি। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার অ্যাসিসন্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার জুয়েল ইসলাম বলেন, অনুমোদিত ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জায়গা সংকুলান না হওয়া ওই বাড়ি ভাড়া করা হয়। সেখানে কোন ধরনের ভর্তি তো দূরের কথা শিক্ষক ও আমাদের কোনো স্টাফ অবস্থান করেন না। এটাকে আউটার ক্যাম্পাস কীভাবে বললো ইউজিসি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে এ বাড়ি ভাড়ার বিষয়টি অবগত করে ২০১৬ সালে অনুমতি নেয়া হয়েছে। তারপরও প্রতিবছর কোনো কারণ ছাড়াই এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, রাজধানীর শুক্রবাদ এলাকায় মার্কেট দখল করে এবং ডজনখানেক ভাড়াবাড়িতে কার্যক্রম চালাচ্ছে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি। তারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার দাবি করলেও বেশির ভাগ কার্যক্রম ভাড়াবাড়িতেই চলছে। শুধু তাই নয়, স্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রোগ্রাম চালানোর কথা বলে অনুমতি নিয়ে তা ভাড়াবাড়িতে ভর্তি নেয়া হচ্ছে। আর উত্তরাতে রয়েছে আরেকটি ক্যাম্পাস। যেখানে ছাত্র ভর্তি করানো হয়। শুধু এটিই নয়, আরও বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় একই ধরনের কাজ করে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে গেলেই ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে রাস্তায় নামিয়ে নিজেদের বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভয়ও দেখানো হয়। রাজধানীর বসুন্ধরা শপিংমল সংলগ্ন সিটি ক্যাম্পাস চালাচ্ছে সিটি ইউনিভার্সিটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ক্যাম্পাস সাভারে হলেও এখানে ভর্তি থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম চলে। এ ক্যাম্পাসের অনুমোদন না থাকায় সরজমিন পরিদর্শনে আসেন সাবেক একজন শিক্ষাসচিব। ভর্তি থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম পরিচালনায় হওয়ায় এটা বন্ধ করার জন্য বলা হয় ইউজিসিকে। তিন বছরের বেশি সময় পরও তা বন্ধ হয়নি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার। রাজধানীর বনানীতে মূল ক্যাম্পাস হলেও ফার্মগেট ও নিউমার্কেট এলাকায় আরেকটি ক্যাম্পাস চালাচ্ছে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়। দুই জায়গায় চলে ভর্তি কার্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এটির মালিক হলেও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিষদের একজন রয়েছেন এর পিছনে। ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ধানমন্ডির ৩ নম্বর রোডের ১৫/২ নম্বর বাড়িতে পরিচালনার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু তারা রাজধানীর আরও ডজনখানেক ঠিকানায় ক্যাম্পাস খুলে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব ক্যাম্পাসের কোনোটিই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদিত নয়। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) একইভাবে ৫টির বেশি অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে রাজধানীতে। ৩ বছর আগে অনুমোদন পাওয়া সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির মহাখালীর একটি ঠিকানায় ক্যাম্পাস অনুমোদন দেয়া হলেও কাওরান বাজারের ৭১ নং বাড়িতে অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। যারা পাশেই মাছের আড়ৎ। স্বাভাবিকভাবে এ রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। সেখানে দিব্যি শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক একজন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান একজন মন্ত্রী জড়িত। শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি রাজধানীর উত্তরায় অনুমোদন ছাড়াই একাধিক ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। একই ধরনের অনিয়ম করছে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি। আরও বেশ কয়েকটি ভালো ও মধ্যম মানের দাবিদার বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ক্যাম্পাস রয়েছে যা ইউজিসি’র অনুমোদন নেই। কিন্তু ইউজিসি’র নজরে নেই এসব ক্যাম্পাস। সমপ্রতি ইউজিসি প্রকাশিত বৈধ ও অবৈধ ক্যাম্পাস সংক্রান্ত গণবিজ্ঞপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের সংগঠনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, আইন সবার জন্য সমান হওয়ার উচিত। এ বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে একাধিকবার আমরা বলেছি। কিন্তু বরাবরই তারা দ্বিমুখী আচরণ করেন।
এ ব্যাপাারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, যারা আইন মানবে তাদের ব্যাপারে আমরা কঠোর হবো। তার আগে তাদের কাছ থেকে ব্যাখা চাওয়া হবে যে, কেন তারা (কর্তৃপক্ষ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও আইনের বিধান কেন প্রতিপালন করেনি। কেউ অন্যায় না করলেও তাকে কেন সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার নজরে আসেনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status