প্রথম পাতা

দোলাচলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

রোকনুজ্জামান পিয়াস

২৫ মে ২০১৮, শুক্রবার, ১০:১৩ পূর্বাহ্ন

মালয়েশিয়ার সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশটির শ্রমবাজার নিয়েও নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশটির দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, শ্রমবাজার সম্পর্কিত বিগত সরকারের চুক্তি নতুন করে পর্যালোচনা করা হবে। সেক্ষেত্রে বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরতা কমানোর কথাও বলেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী।  তাদের এই পর্যালোচনা বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়েও চলছে নানা বিশ্লেষণ। এদিকে দেশটির নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাও নড়েচড়ে বসেছেন। কর্মী প্রেরণে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা সিন্ডিকেট ভাঙতে উদ্যোগ নিয়েছে তারা।

এ ব্যাপারে কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশি হাইকমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছে ব্যবসায়ী কমিউনিটি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো দেশের সরকার পরিবর্তন হলে, পুরাতন চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে নতুন সরকার। মালয়েশিয়াও তাই করছে। তাদের এ পর্যালোচনার কারণে শ্রমবাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও মন্তব্য করেন ব্যবসায়ী নেতারা। আর সিন্ডিকেট ভাঙার দাবির বিষয়টিও পুরনো। বর্তমানের আলোচনাও সেটারই ধারাবাহিকতা। অপরদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সামনে উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে জয়েন্ট টেকনিক্যাল গ্রুপের একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় শ্রমবাজার সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা হবে।

সূত্রমতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় তিন বছরে ১৫ লাখ শ্রমিক নেয়ার ঘোষণা দেয়। এ লক্ষ্যে ওই বছরের ৮ই ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সইয়ের পর মালয়েশিয়া সরকারের কাছে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্টদের তালিকা পাঠায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

ওই সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মালয়েশিয়ায় যেতে প্রত্যেক কর্মীর খরচ পড়বে ৩৪ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। বিমান ভাড়া, রিক্রুটিং এজেন্টদের সার্ভিস চার্জ, মেডিকেল খরচ বাবদ ব্যয় হবে এই টাকা। আর বাকি টাকা দেবে চাকরিদাতারা। এরপর একই বছরের ২১শে সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে একটি নথি পাঠায়। যেখানে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (বিডাব্লিউএমএস) নামে নতুন একটি বিষয় সম্পর্কে বলা হয়। পাশাপাশি বিষয়টি সিনারফ্লাক্স এসডিএন বিএইচডি নামে একটি কোম্পানির হাতে  দেয়া হয়। পরে সিনারফ্লাক্সের বিরুদ্ধে মনোপলি ব্যবসার অভিযোগ করেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)। মালয়েশিয়ান এই প্রতিষ্ঠানটি ১০টি এজেন্সির মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। পরবর্তীতে তারা এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী নেয়া শুরু করে। বায়রা’র সদস্য এজেন্সিগুলো শুরু থেকেই এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে ধরনা দেয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।

এদিকে, সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর থেকে আবারো আলোচনায় এসেছে দেশটির শ্রমবাজার। সেদেশের সরকার বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে এ বিষয়ে ১৫ লাখ শ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত নতুন করে পর্যালোচনা করবে। বৃহস্পতিবার ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোর্ট পরিদর্শন শেষে দেশটির মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী এম কুলাসেগারান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে চাইছে তাদের সরকার। তাই সব কিছুই রিভিউ করা প্রয়োজন। আমরা বিদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে বেশি সচেতন। তাই তাদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে চাই।

অত্যাবশ্যক খাতেই শুধু আমরা বিদেশি শ্রমিকদের অনুমোদন দেবো। মন্ত্রী বলেন, আমরা মালয়েশিয়ার শ্রমিকদেরকে সবার আগে অগ্রাধিকার দেবো। আগে ভাববো মালয়েশিয়ার মানুষের কথা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাববো অন্যদের। তিনি এ সময় আরো বলেন, অন্য যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি আছে তাও পর্যালোচনা করা হবে। তবে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য আপাতত কোনো ভয় নেই বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা বৈধতার অধীনে মালয়েশিয়ায় কাজ করছেন তাদেরকে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া চলে যেতে বলা হবে না। তার ভাষায়, এক্ষেত্রে কিছু সময় লাগবে। মালয়েশিয়ায় যারা কাজ করছেন তাদেরকে অবিলম্বে বাক্স-প্যাটরা গুটিয়ে চলে যেতে বলা হবে না। তারা এখানে আসার জন্য দেশ ছেড়েছেন। তাই আমরা যতটুকু পারি ততটুকু করবো। মন্ত্রী বলেন, এক সময় যে চাকরিগুলো বিদেশিরা করতেন সেখানে শূন্য পদ সৃষ্টিতে কাজ করবে সরকার। এসব শূন্যপদ পূরণ করে তাদেরকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। যদি আপনি নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া যান তাহলে সেখানে কোনো বিদেশি শ্রমিক পাবেন না। আমাদেরও তাই করতে হবে।

এদিকে মালয়েশিয়ায় ডা. মাহাথির মোহাম্মদ নেতৃত্বাধীন জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর শ্রমবাজার সিন্ডিকেট বন্ধে বাংলাদেশ হাইকমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছেন বাংলাদেশ কমিউনিটি ব্যবসায়ী নেতারা। মালয়েশিয়া বিজনেস কমিউনিটির ব্যানারে গত মঙ্গলবার বিকেলে তারা ওই স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, সোর্স কান্ট্রি হিসেবে ৩৭ হাজার টাকায় জনশক্তি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকার ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট অসহায় শ্রমিকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক তিন লাখেরও বেশি টাকা আদায় করছে। এভাবে তারা হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে  নেয়ায় বর্তমানে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার অনেকটা হুমকির মুখে পড়েছে। বিজনেস কমিউনিটির ১৪ সদস্যের স্বাক্ষরযুক্ত ‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেট মুক্তকরণ’ ওই স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়েছে, আমিন গং ও ১০ সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ার বিগত সরকারের (নাজিব রাজাক) সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে এসপিপিএ কোম্পানির কথা বলে ভিসা প্রসেসিং খরচ বাবদ শ্রমিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা জোরপূর্বক আদায়ের প্রথা চালু করে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর ‘সিন্ডিকেটের’ মূল হোতাসহ অন্যরা গা-ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে তাদের চালু হওয়া অতিরিক্ত টাকা আদায় পদ্ধতি। এই স্মারকলিপির অনুলিপি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজকে (বায়রা) দেয়া হয়েছে।

এদিকে নতুন করে আলোচনায় আসা মালয়েশিয়ার এই শ্রমবাজার নিয়ে চিন্তিত নয় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সমঝোতা স্বাক্ষর পর্যালোচনা বিষয়ে বৃহস্পতিবার দেশটির মন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের ব্যাপারে বায়রার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, কোনো দেশে নতুন সরকার, পূর্বের সরকারের সময়ে করা চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতেই পারে। তার মানে এই নয় যে, তারা ওই চুক্তি থেকে সরে আসবে। তিনি বলেন, এর আগে বাংলাদেশ থেকে তারা কর্মী নিতো বিশেষ পদ্ধতিতে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ সোর্স কান্ট্রি। সেক্ষেত্রে কর্মী নেয়া বন্ধ করতে হলে অন্যান্য দেশ থেকেও কর্মী নেয়া বন্ধ করতে হবে তাদের। নোমান বলেন, দেশটির চাহিদার আলোকেই পূর্বের সরকার তিন বছরে ১৫ লাখ লোক নেয়ার কথা বলেছিলো। এ সরকার সেটাই বিবেচনা করবে।

তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে তাদের বিদেশি কর্মী লাগবে। সেক্ষেত্রে পর্যালোচনা করলেও কমিয়ে দেয়া বা বন্ধ করে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের চাহিদা অনুযায়ীই লোক যাবে। সিন্ডিকেটের ব্যাপারে বায়রার এই নেতা বলেন, শুরু থেকেই সিন্ডিকেটের ব্যাপারে আমরা কথা বলে আসছি। মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে আমরা একাধিকবার কথা বলেছি। এটা নতুন কোনো বিষয় না বলেও তিনি জানান। শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটির সভায় তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন। এদিকে হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এখনো নতুন মন্ত্রী দায়িত্বগ্রহণ করেননি। তিনি দায়িত্ব নিলেই সিন্ডিকেটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য উত্থাপন করা হবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার এনডিসি গণমাধ্যমকে বলেন, মালয়েশিয়ার নতুন সরকার কি ভাবছে আমরা জানি না। আমরা অপেক্ষা করছি উভয় দেশের সমন্বয়ে জয়েন্ট টেকনিক্যাল গ্রুপের সভার। এই সভায় আমরা আমাদের জনশক্তি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status