শেষের পাতা

গাজীপুর সিটি নির্বাচন

বিএনপিতে নানা চিন্তা

কাফি কামাল

২৩ মে ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৭ পূর্বাহ্ন

গাজীপুরে নতুন কৌশলে নির্বাচন করবে বিএনপি। মাঠে সক্রিয় থাকতে নতুন মামলা এড়ানোর পাশাপাশি পুরনো মামলায় জামিন নেবে বিএনপি নেতাকর্মীরা। কোনো ধরনের উস্কানি বা পাতানো ফাঁদে পা দেবে না তারা। নির্বাচনের দিন ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে কেন্দ্র পাহারা দেবে কর্মী-সমর্থকরা। ভোটারদের মধ্যে সাহস সঞ্চারে জোর দেয়া হবে প্রচারণায়। সর্বোপরি ভোটারদের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করা, কেন্দ্র পাহারা দেয়া ও নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে। খুলনায় দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সরকারের বাস্তবায়নকৃত কৌশল ও গাজীপুরে তাদের সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে পর্যালোচনার ভিত্তিতে পাল্টা কৌশলে ভোটের মাঠে থাকবে বিএনপি। এ নিয়ে গাজীপুর সিটির দলীয় মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের উপস্থিতিতে গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গাজীপুর জেলা ও মহানগর নেতাদের সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠকও করেছেন সিনিয়র নেতারা। সেখানে জেলা নেতাদের বেশকিছু নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

বৈঠকে অংশ নেয়া নেতারা জানান, খুলনা সিটি নির্বাচনের প্রেক্ষিতে গাজীপুরে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মনোভাব এবং সার্বিক পরিস্থিতির খবর নিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সভায় অংশ নেয়া নেতারা খুলনা সিটি নির্বাচনের প্রেক্ষিতে গাজীপুর সিটি নির্বাচন কীভাবে ফল রক্ষা করা যায় তার ব্যাপারে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছেন। পরে সিনিয়র নেতারা নির্বাচন নিয়ে জেলা নেতাদের কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। সূত্র জানায়, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে বিএনপি। এ জন্য প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা, নির্বাচনে বিদেশি কূটনীতিকদের পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণের অনানুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হবে। বৈঠকে অংশ নেয়া বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, খুলনা সিটি নির্বাচনকে শিক্ষা হিসেবে নিয়েছেন গাজীপুর জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। খুলনার কৌশলগুলো নিয়ে তারা পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছেন। ভোটারদের কাছে বিষয়গুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভোট রক্ষার পাল্টা কৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে স্থানীয় পর্যায়ে। তারা বলছেন, খুলনা সিটিতে যেভাবে বলপূর্বক ভোট ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে সেটা গাজীপুরে প্রতিরোধ করা হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে তিন সেট এজেন্ট প্রস্তুত রাখা হবে।
যারা কেন্দ্রে এজেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন তারা যেন শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে থাকতে পারে সে জন্য প্রতিটি কেন্দ্রের আশেপাশেই অবস্থান নেবে বিএনপির সমর্থকরা। কোনো কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়া হলে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানানো হবে। বলপ্রয়োগে ভোট লুটের চেষ্টা ঠেকাতে নেয়া হবে বিশেষ প্রস্তুতি। সার্বিক বিবেচনায় সামাজিকভাবেই ভোট অনিয়মের কৌশল মোকাবিলা করবে বিএনপি। নেতারা জানান, নেতাকর্মীদের মধ্যে যাদের মামলা জটিলতা রয়েছে নির্বাচনের আগেই উচ্চ আদালত থেকে তাদের জামিন নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিতের দিন যে অভিযোগে টঙ্গীতে বিএনপির ১০৩ জন নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ সেটার বাস্তবতা সম্পর্কে তথ্যগুলো আদালতের নজরে আনা ও নতুন করে মামলা এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়। গাজীপুরের নেতাদের বলা হয়, প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর সবাই যেভাবে একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছিলেন সে পরিস্থিতি ধরে রাখতে হবে। সবাইকে নির্বাচনী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচন দিন মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিয়েই প্রচারণাসহ সার্বিক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। সূত্র জানায়, গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েকটি ইফতার মাহফিল আয়োজনের আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে প্রচারণার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নেতা ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের নিয়ে ঢাকায় আলাদাভাবে এ ইফতারের আয়োজন করা হবে।
এ ব্যাপারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, আমরা চেষ্টা করবো যাতে এখানে সরকার সুষ্ঠু ভোটের বাইরে অন্যকিছু করতে না পারে। যেকোনো অনিয়মের ব্যাপারে আমাদের আপ্রাণ প্রতিবাদ থাকবে। প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ করা হবে। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, গাজীপুর ও খুলনা এক জিনিস নয়। গাজীপুরে ভোটের মাঠে অনিয়ম ও কারচুপি করা অনেক কঠিন হবে। গাজীপুর সিটির মানুষ অনেক সচেতন। গতবারও সরকার সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, এবারও ব্যর্থ হবে। তিনি বলেন, এখন নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সরকারদলীয় প্রার্থী নিয়মিত প্রচারণা চালাচ্ছেন। আমরা সেগুলোর ব্যাপারে ইসিতে অভিযোগ দিচ্ছি। তবে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অন্যায় করলেও প্রচারণার মাঠে আমি কোনো অন্যায় করবো না।

গাজীপুরের মানুষের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে। হাসান সরকার বলেন, গাজীপুরের মানুষ সাহস করে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজে দেবে। আর সেটাই হবে সরকারের যেকোনো অনিয়ম চেষ্টার কার্যকর প্রতিরোধ। পাশাপাশি আমাদের দলের ও জোটের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে আছি, থাকবো এবং যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করবো। এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন যখন গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল তখন আমরা নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থী দিয়েছিলাম। জাতীয় নির্বাচনের বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা সে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি- এ কথাও বলেছিলাম। কিন্তু সরকারদলীয় এক নেতার রিটের প্রেক্ষিতে গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিত করে দেয় উচ্চ আদালত। আমাদের দলীয় মেয়র প্রার্থীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পরে সে স্থগিতাদেশ বাতিল করে আপিল বিভাগ নির্বাচনটি পিছিয়ে দেয়। যথাসময়ে খুলনা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে কি হয়েছে সেটা দেশবাসী দেখেছে। খুলনা সিটি নির্বাচনের পর গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে আমরা এখনো দলীয়ভাবে বসে আলোচনা করিনি। যদি দলীয় ফোরামে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে আমরা নতুন করে কৌশল নির্ধারণ করে নির্বাচনের মাঠে থাকবো। উল্লেখ্য, এর আগে ১৬ই মে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য অসুস্থ নজরুল ইসলাম খানকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর বলেছিলেন, খুলনার নির্বাচনটা নিঃসন্দেহে আই ওপেনার। গাজীপুরের নির্বাচনে নতুন করে ভাববো, নতুন স্ট্র্যাটেজি নেবো অথবা সিদ্ধান্ত নেবো নতুন করে।

আলোচনা হবে আমাদের পার্টির সব লেভেলে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর কেন্দ্রীয় সম্পাদক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা গাজীপুর নির্বাচনে আছি এবং আশাকরি শেষ পর্যন্ত থাকবো। খুলনা সিটি নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির সরকারি কৌশলটা আমরা দেখেছি। সে কৌশল পর্যালোচনা করছি। খুলনায় দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সরকারের বাস্তবায়নকৃত কৌশল ও গাজীপুরে তাদের সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে পর্যালোচনার ভিত্তিতে পাল্টা কৌশলে ভোটের মাঠে থাকবে বিএনপি। ন্যূনতম ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের যে দাবিতে আমাদের বৃহত্তর আন্দোলন সেটার অংশ হিসেবেই আমরা এইসব স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। খুলনায় সরকারের অনিয়মের কারণে দেশের মানুষ তাদের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারছে। আমরা নির্বাচনে না গেলে জনগণ একটি বিভ্রান্তির মধ্যেই থাকতো। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন কেমন হবে, এর একটা বার্তা পেয়েছে দেশবাসী। সরকারের সামনে বর্তমান ইসি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না বলে বিএনপির যে অভিযোগ সেটা প্রমাণ হয়েছে। তাই নির্বাচনটি আপাতত হারের হলেও শিক্ষা রয়েছে বহুমুখী। খুলনায় সরকারদলীয় প্রার্থী জিতলেও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যতিক্রম কিছু হলে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেবে জনগণ।

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে গতকাল একটি পর্যালোচনা বৈঠক করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে বেলা ১১টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত সে বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মেয়র প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার, সিটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর প্রধান সমন্বয়ক ফজলুল হক মিলন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মাজহারুল আলম, ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, হুমায়ুন কবির, জেলা বিএনপি নেতা মীর হালিমুজ্জামান ননী, সুরুজ আহমেদ, সোহরাবউদ্দিন ও বশির আহমেদ প্রমুখ অংশ নেন। এছাড়া বৈঠকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির ৮টি জোনাল কমিটির আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ গাজীপুর, কাশিমপুর, কোনাবাড়ি, টঙ্গী, কাউলতিয়া, গাছা, বাসন ও পুবাইল বিএনপির সিনিয়র নেতারা পর্যালোচনা বৈঠকে অংশ নেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status