অনলাইন

বাংলাদেশের 'অপ্রত্যাশিত' সমৃদ্ধির নেপথ্যে: ভারতীয় অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিতে

২৫ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ন

অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অর্থনীতির ছাত্ররা 'বাংলাদেশ প্যারাডক্স' কথাটার সঙ্গে পরিচিত। বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদ এর আগে এই ধাঁধাঁর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
কিভাবে 'তলাবিহীন ঝুড়ির' তকমা ঝেড়ে বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছে, সেই 'ধাঁধাঁর' উত্তর তারা দেয়ার চেষ্টা করেছেন নানা তত্ত্বে।
'হোয়াই ইজ বাংলাদেশ বুমিং' নামে একটি লেখায় এবার অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বাংলাদেশের সমৃদ্ধির রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন।
কৌশিক বসু বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা অর্থনীতিবিদদের একজন । জন্ম কলকাতায়। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক।
'চমকপ্রদ এবং অপ্রত্যাশিত'
তাঁর ভাষায় বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে 'চমকপ্রদ এবং অপ্রত্যাশিত' সাফল্যের কাহিনীগুলোর একটি। 'হোয়াই ইজ বাংলাদেশ বুমিং'' নামে তাঁর লেখাটি গতকাল প্রকাশ করেছে 'প্রজেক্ট সিন্ডিকেট' নামের একটি ওয়েবসাইট।
সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একসময়ের দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এই দেশটি এখন শুধু পাকিস্তানকেই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।
কৌশিক বসুর মতে, মাত্র ১২ বছর আগে ২০০৬ সালেও বাংলাদেশের ভবিষ্যত এতটাই হতাশাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল যে, সে বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন পাকিস্তানেরটা ছাড়িয়ে গেল, তখন সেটিকে একটি 'অঘটন' বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু সেই বছরটাই ছিল আসলে বাংলাদেশের 'টার্নিং পয়েন্ট', বলছেন কৌশিক বসু।
"২০০৬ সাল হতে পরবর্তী প্রতিটি বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল পাকিস্তানের চেয়ে মোটামুটি আড়াই শতাংশ বেশি। আর এ বছরতো এটি ভারতের প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।"
তবে এটি ভারতের অর্থনীতির শ্লথগতির কারণেই ঘটবে বলে তিনি মনে করেন।
কীভাবে সম্ভব হলো?
বাংলাদেশ কীভাবে এই অসাধারণ কাজটি করলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন কৌশিক বসু। তিনি স্বীকার করছেন যে এর কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর কারও কাছে নেই, কারণ এ ধরণের ব্যাপক ঐতিহাসিক বিষয়ে সেটা থাকেও না। কিছু 'ক্লু' বা সূত্র খোঁজা যেতে পারে মাত্র।
কৌশিক বসুর মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পালাবদলের পেছনে বড় ভূমিকাটি পালন করেছে সামাজিক পরিবর্তন - বিশেষ করে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন।
এক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করছেন গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্রাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার কথা। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকারও নারী শিক্ষার প্রসার এবং সমাজে মেয়েদের ভূমিকা জোরালো করতে ব্যাপক ভূমিকা নিয়েছে।
কৌশিক বসু বলছেন, এর ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু পৌঁছে গেছে ৭২ বছর, যেখানে ভারতে তা ৬৮ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৬ বছর।বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পালাবদলে কৌশিক বসু দ্বিতীয় যে কারণটির কথা উল্লেখ করছেন, সেটি গার্মেন্টস শিল্প। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ যে ভারতের তুলনায় গার্মেন্টস শিল্পে অনেক বেশি ভালো করেছে, এর পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে একটি কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রম আইন।
তার মতে ভারত এবং পাকিস্তানের যে শ্রম আইন, তা নানাভাবে এই দুই দেশের কারখানা মালিকদের শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে। এর ফলে এসব দেশের কারখানাগুলো খুব বড় আকারে করা যায়নি, সেখানে বেশি সংখ্যায় শ্রমিকও নিয়োগ করা যায়নি।
কিন্তু বাংলাদেশে এরকম কোন আইনের অনুপস্থিতি বড় বড় গার্মেন্টস শিল্প স্থাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
কিন্তু বাংলাদেশ কি তার এই সাফল্য ধরে রাখতে পারবে?
কৌশিক বসু বলছেন, এখনো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল। কিন্তু কিছু ঝুঁকির কথা তিনি উল্লেখ করছেন, যা নিয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এখনই সচেতন হওয়া দরকার।
তাঁর মতে, যখন কোন দেশের অর্থনীতি ভালো করতে থাকে, তখন সেদেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বৈষম্য - এসবও বাড়তে থাকে। যদি এসবের রাশ টেনে ধরা না যায়, তা সমৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও কোন ব্যতিক্রম নয়।
তবে তাঁর মতে এর চেয়েও বড় ঝুঁকি হলো কট্টর ধর্মীয় এবং সামাজিক রক্ষণশীল শক্তি। এরা প্রগতিশীল সামাজিক খাতে বাংলাদেশের যে বিনিয়োগ, তার বিপক্ষে।
যদি বাংলাদেশ এই বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়, সেটি বাংলাদেশকে আবার অনেক পেছনে নিয়ে যাবে। কিভাবে ইতিহাসে এরকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে তার কিছু নজির তিনি টেনেছেন।
তিনি উল্লেখ করেছেন হাজার বছর আগে যে বিশাল আরব খেলাফত বিরাট এক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। কিভাবে দামেস্ক আর বাগদাদের মতো নগরী হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতি, গবেষণা আর নতুন আবিস্কারের এক বিশ্ব কেন্দ্র।
তবে কৌশিক বসু একেবারে সাম্প্রতিককালের নজিরও দিয়েছেন। তিনি বলছেন, পাকিস্তানের কাহিনীও একই। স্বাধীনতার পরের বছরগুলোতে পাকিস্তানের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে ভালো করছিল। ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল বেশি। সেসময় লাহোরের মত নগরী হয়ে উঠেছিল শিল্প-সাহিত্যের এক বহুমাত্রিক কেন্দ্র। কিন্তু তারপর এলো সামরিক শাসন। ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ। উত্থান ঘটলো ইসলামী জঙ্গীবাদের। ২০০৫ সাল নাগাদ ভারত সব দিক দিয়েই ছাড়িয়ে গেল পাকিস্তানকে।
ভারতও এখন এই বিপদের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন কৌশিক বসু। তিনি বলছেন, কয়েক বছর আগেও 'সেকুলার গণতন্ত্র' বলে পরিচিত ভারতের অর্থনীতি বাড়ছিল ৮ শতাংশ হারে। কিন্তু সেখানে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এবং নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য এখন উচ্চ শিক্ষা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান গবেষণা - সবকিছুকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
এসব উদাহারণ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে। বলছেন কৌশিক বসু।
যদি বাংলাদেশ এই ধর্মীয় মৌলবাদ রুখে দিতে পারে, তাঁর মতে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার এমন এক 'সাফল্য কাহিনী', যা দুই দশক আগেও ছিল অকল্পনীয়।

সূত্রঃ বিবিসি
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status