শেষের পাতা

বিষণ্নতা, বদলে যাচ্ছে মানুষের চরিত্র

পিয়াস সরকার

২০ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৩২ পূর্বাহ্ন

বিষণ্নতায় ভুগছে মানুষ। হঠাৎ বদলে যাচ্ছে মানুষের চরিত্র। কখনো কোনো কারণে মনে আঘাত পেয়ে, কখনো নিজের মনমতো কাজ করতে না পেরে। আবার কেউ বেকারত্বের বোঝায় বিষণ্নতায় ভুগছেন। বিশেষজ্ঞরা বিষণ্নতাকে রোগ বললেও দেশের বেশিরভাগ বিষণ্নতায় ভোগা মানুষ ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন না। ফলে দিন দিন বিষণ্নতা রূপ নেয় মানসিক সমস্যায়, যা থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন আবিব আহসান। পরশু এসেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। তিনি বলেন, আমার এক কলেজ সহপাঠীর সঙ্গে দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্ক ছিল। হঠাৎ তার বিয়ে হওয়ার পর থেকে মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ি। পড়ালেখায় মন বসে না, সবার সঙ্গে মনের অজান্তে খারাপ ব্যবহার করছি। ঘুমের সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
আরেক রোগী স্বস্ত্রীক এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। বলেন, মানসিক সমস্যা নিয়ে এসেছি এটা মানুষ জানাজানি হলে খারাপ মন্তব্যের শিকার হতে পারি। তার স্ত্রী বলেন, সে বিয়ের আগ থেকেই ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। বিয়ের সময় বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ করেছিল। মাথায় ঋণের বোঝা আবার বিয়ের তিন মাসের মাথায় চাকরি হারান। এটা মেনে নিতে পারেনি। এমনকি পরিবারকে জানায় নি। দেখতাম হঠাৎ হাসি খুশি মানুষটা একরোখা ও বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। একমাস পরে বিষয়টা আমরা জানলাম, খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম। মন খারাপ হবার কারণে কক্সবাজার ঘুরতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু তার অবস্থার উন্নতি হয় না। কিছুদিন পর ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে আগের থেকেও অধিক বেতনে চাকরি হলেও মনের অবস্থার পরিবর্তন হয় না তার। তাই ডাক্তারের কাছে এলাম পরামর্শের জন্য।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকোথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মানসিক রোগ মানেই লজ্জার কোনো কারণ নয়। মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতোই অসুস্থতা। সব মানসিক রোগেরই বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সম্ভব। বর্তমানে অনেক উন্নত ও কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সুষ্ঠু ব্যবহারে রোগও পুরোপুরি সেরে যাচ্ছে। রোগীরা কর্মক্ষম থাকতে পারছে। কোনো কোনো রোগীকে দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয়, যেমনটি খেতে হয় অনেক শারীরিক রোগীদেরও, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ইত্যাদি রোগে প্রায় সারা জীবনই ওষুধ গ্রহণ করে যেতে হয়। আবার বেশিরভাগ মানসিক রোগীকেই দীর্ঘদিন ওষুধ খেতে হয় না। মানসিক চিকিৎসাসেবার মান এমনিভাবে নানা আঙ্গিক থেকে সফলতার দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মনোচিকিৎসার পদ্ধতিগুলোও অনেক উন্নততর হয়েছে। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারজানা রবিন বলেন, সমাজে অন্য রোগকে স্বাভাবিকভাবে দেখা হলেও মনের রোগ হলে ভাবা হয় পাগল। এই ‘পাগল’ শব্দটা না শুনতে চাওয়ার কারণেই ডাক্তার বিমুখী তারা। তবে, এখন ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা বাড়ছে। আরো সুখবর হচ্ছে খুব অল্প কারণেও আসছে আমাদের কাছে। তবে, সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম।
২০০৬ সালের এক জরিপে দেখা যায় ১৬.১ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। ২০০৯ সালের শিশু-কিশোরদের মাঝে করা এক জরিপে উঠে আসে ১৮.৪ শতাংশের কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১৬ সালের প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনে প্রকাশ করে ২০১৫ সালে বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৪২ হাজার ৭০৩ জন যা ২০১৪ সালের তুলনায় ৭ হাজার ৬৮৯ জন বেশি। ২০১৩ সালে যার সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৯৭৬ জন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন ১০ টাকায় টিকিট কেটে রোগীরা সুযোগ পাচ্ছেন ডাক্তার দেখাবার। হাসপাতাল কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী আসেন এখানে। তেমন কোনো চাপ নেই আবার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য রয়েছেন চার জন চিকিৎসক। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট-এর সহকারী অধ্যাপক আবদুল ওহাব বলেন, বেশিরভাগ রোগী আসেন সাধারণত বিষণ্নতা নিয়ে। আগের কোনো ঘটনার ফলে মানসিক আঘাতের কারণে মূলত বিষণ্নতার সূত্রপাত ঘটে। সাধারণত সমস্যা খুব সাধারণ হলেও অন্যের সঙ্গে শেয়ার না করতে পারা এবং অসহযোগিতামূলক আচরণের কারণে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আবার মানসিক চাপে অনেকে হয়ে পড়ছেন মাদকাসক্ত।
বিষণ্নতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা চলে আসতে পারে রোগীদের মাঝে। কর্মহীনতা এর সবথেকে ক্ষতির কারণ। একজন মানুষের মন খারাপ থাকার কারণে স্বাভাবিক কাজকর্ম যদি ব্যাহত হয় সেটিই আসলে বিষণ্নতা। মন খারাপ, খাবারে অরুচি এবং কর্মহীনতা যদি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকে তবে সেটিই বিষণ্নতা। কোনো একদিন আপনার মন খারাপ থাকলে তাকে বিষণ্নতা বলা যাবে না। কোনো কারণে দু’একদিন মন খারাপ থাকতেই পারে। বলেন, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল আহসান মাকসুদ। ঢাকাজুড়ে বিষণ্নতা বাড়ছে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে নিউ মুক্তি ক্লিনিক কল্যাণপুরের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শামসুন নাহার বলেন, ঢাকার অধিক জনসংখ্যা, কর্মহীনতা, অবকাশ যাপনের স্থান সংকট, মাদকাসক্ত, অনৈতিক সম্পর্ক, বন্ধুহীনতা, পূর্বের কোনো ঘটনা ভুলতে না পারা ইত্যাদির জন্য বাড়ছে বিষণ্নতা। তবে, বিষণ্নতা মুক্তির জন্য ডাক্তারের পরামর্শ, কাউন্সিলিংয়ে মুক্তি মিলতে পারে এই সমস্যার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status